বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৭৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবুল কালাম আজাদ, বীর বিক্রম এলএমজির গুলিতে বিমান ভূপাতিত করেন ফেনী জেলার পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া সমন্বয়ে বিলোনিয়া। এর তিন দিকে ভারত সীমান্ত।
১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বর সকাল থেকে বিলোনিয়ায় কয়েক দিন একটানা যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল অংশ নেয়।বিলোনিয়া মুক্ত করার জন্য ৩ নভেম্বর রাতে আবুল কালাম আজাদসহ মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে বিভিন্ন দিক দিয়ে বিলোনিয়ায় অনুপ্রবেশ করেন। পাকিস্তানিরা তাঁদের অনুপ্রবেশ টের পায়নি। রাতের অন্ধকারে তাঁরা বেশির ভাগ অবস্থান নিয়েছিলেন বিলোনিয়া-ফেনী রেল ও সড়কপথের দুই পাশে। রেলপথের এক পাশ দিয়েই সমান্তরাল সড়ক। তখন সেটি ছিল কাঁচা রাস্তা।
বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তানিদের অবস্থান। আবুল কালাম আজাদসহ বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা সমান্তরাল রেল ও সড়কপথের দুই পাশে অবস্থান নেওয়ায় পরশুরাম ও চিথলিয়া ঘাঁটির পাকিস্তানি সেনারা অবরোধের মধ্যে আটকা পড়ে। ৪ নভেম্বর সকালে চিথলিয়ার দিক থেকে রেলট্রলিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দল এগিয়ে আসে।
আবুল কালাম আজাদের সহযোদ্ধাদের আক্রমণে রেলট্রলি ধ্বংস ও টহল দলের সব পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। শব্দ শুনে পাকিস্তানিরা গোলাগুলি শুরু করে। এরপর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা অনবরত শেলিং ও ফায়ারিং অব্যাহত রাখে। আবুল কালাম আজাদসহ মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন।
পরদিন আগের দিনের মতোই শেলিং ও ফায়ারিং চলে। বিকেলের দিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বিমান আকাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। ফলে বিমান আক্রমণ তাঁরা প্রতিরোধ করতে পারেননি। তবে বিমান হামলায় তাঁদের তেমন ক্ষতি হয়নি।
তৃতীয় দিনেও আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণ চলে। পরশুরামে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা চেষ্টা করে চিথলিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের বা পালানোর। কিন্তু তাদের পালানোর পথ ছিল রুদ্ধ। সেদিন বিকেলেও পাকিস্তানি বিমান মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে বোমাবর্ষণ করে। এদিন বিমানগুলো খুব নিচু দিয়ে উড়ে বোমাবর্ষণ করতে থাকে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়। জনপদেরও অনেক ক্ষতি হয়। চারদিকে দাউ দাউ আগুন জ্বলতে থাকে।
আবুল কালাম আজাদসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এতে বিচলিত হননি। তাঁদের কারও কাছে ছিল এলএমজি, কারও কাছে এসএমজি। আজাদের কাছে ছিল এলএমজি। তাঁরা শেষরক্ষা হিসেবে তাঁদের কাছে থাকা অস্ত্রগুলোই বিমান আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবহার করেন।
বিমানগুলো একবার তাঁদের এলাকায় গোলাগুলি করে যাওয়ার পর তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন আবার কখন সেগুলো ফিরে আসে। বেশিক্ষণ দেরি করতে হয়নি। বিমানগুলো খুব নিচ দিয়ে তাঁদের দিকে উড়ে আসে। অস্ত্রের গুলির আওতায় আসামাত্র গর্জে ওঠে আবুল কালাম আজাদের এলএমজি ও তাঁর সহযোদ্ধাদের অস্ত্র।
দুটি বিমান উড়ে যায়। একটি ফিরে যেতে পারেনি। ঘুরপাক খেয়ে ছিটকে পড়ে মাঠে। আবুল কালাম আজাদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা চেঁচিয়ে ওঠেন সাফল্যের উল্লাসে। এদিন ছিল আবুল কালাম আজাদ ও তাঁর সহযোদ্ধাদের জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। মুক্তিবাহিনীর জন্যও। কোনো যুদ্ধের ইতিহাসে হয়তো এলএমজি-এসএমজি দিয়ে গুলি করে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার কথা শোনা যায়নি।
আবুল কালাম আজাদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা তা-ই করতে সক্ষম হন। অনেকের ধারণা, আজাদের এলএমজির গুলির আঘাতেই বিমানটি ভূপাতিত হয়। এ ঘটনা বিলোনিয়া এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে গভীর রেখাপাত করে। তাঁরা বিপুল উদ্যমে যুদ্ধ করেন। পরদিন বিলোনিয়ার বেশির ভাগ এলাকা মুক্ত হয়।
আবুল কালাম আজাদ ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৫ বালুচ রেজিমেন্টে। রেজিমেন্টটির অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। ওই বছরই তাঁকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে সেখানে বদলি করা হয়। যোগ দেওয়ার পর ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক তাঁকেসহ ওই রেজিমেন্টে কর্মরত বেশির ভাগ বাঙালিকে ছুটি দেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজ এলাকায় প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে গিয়ে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দেন। পুনর্গঠিত হওয়ার পর রাজনগর সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর নবগঠিত ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত বিলোনিয়া যুদ্ধে বিমান ভূপাতিত করার জন্য আবুল কালাম আজাদকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৬৭।
আবুল কালাম আজাদ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সুবেদার পদে উন্নীত হন। ১৯৯৫ সালে অবসর নেন।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার সাতড়াপাড়া গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার উত্তরখানের রাজাবাড়িতে। তাঁর বাবার নাম আবদুল গনি, মা মাহমুদা খাতুন। স্ত্রী সালেহা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে, তিন ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info
No comments