'ওরে বিহঙ্গ, বন্ধ কোরো না পাখা' by আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
সংবাদপত্র কালের দর্পণ, সমকালের মানুষের জীবন-বাস্তবতার চিত্র। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একে বলা হয় দ্বিতীয় পার্লামেন্ট বা সংসদ। জাতির পরিচালনায় যারা নিয়োজিত থাকেন তাদের কার্যক্রমের সাফল্য ও ব্যর্থতা অনেক সময় তারা অনুধাবন করতে পারেন না।
সংবাদপত্র তাদের মধ্যে সেই বোধ জাগিয়ে তোলে। সেই হিসাবে সমাজে বিশেষত গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সংবাদপত্রের সংখ্যা যত বেশি থাকে ততই মঙ্গল।মুদ্রিত কিংবা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংবাদ কিংবা কোনো প্রতিবেদন আমরা পড়ে বা প্রত্যক্ষ করে চমৎকৃত হই। কিন্তু এ কাজ, সাংবাদিক এবং এই পেশার খোঁজখবর যারা রাখেন, তারা জানেন যে তা কেমন কষ্টকর, কত শ্রম ও চেষ্টার ফসল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেক সময় সাংবাদিককে বিপন্ন করে তোলে। আমাদের দেশে বহু সাংবাদিক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য বিভিন্ন সময় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
সাংবাদিকরা ঘটনার সৃষ্টি করেন না। চলমান ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে তারা সচেতন ও প্রতিবাদী করে তোলেন। এ সফলতা সব সাংবাদিকের ভাগ্যে জোটে, তা নয়। সফল সাংবাদিকমাত্রই জনপ্রিয় ও লোকনন্দিত। তারকাদের মতোই তিনি খ্যাতিমান, পরিচিত। নিজের কাজের মাধ্যমে তিনি জনপ্রিয়, পরিচিত ও প্রশংসিত।
আবেদ খানের জন্ম ১৯৪৫ সালে (১৬ এপ্রিল)। বাল্য এবং কৈশোরে যখন পেঁৗছেন বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর বিপন্ন পৃথিবীর স্বাদ তিনি পেয়েছেন। ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ব্যাপক হলেও এ উপমহাদেশে সেই প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া তত প্রবল নয়। কিন্তু ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে তা বেশ নাড়া দিয়েছিল। এ প্রভাব আবেদ খানের মনোগঠনে ছায়া ফেলা স্বাভাবিক।
আবেদ খানের পরিবার সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে জড়িয়ে আছে। তার মায়ের চাচা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন সাংবাদিক, দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা। সেই কালের মুসলিম সমাজের জাগরণে এ পত্রিকার ভূমিকা ও অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ খণ্ডিত হলে আকরম খাঁ সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। অতঃপর ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে দৈনিক আজাদ। কিন্তু আবেদ খানের সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ি হয় অন্য একটি দৈনিককে আশ্রয় করে, আর তা হলো 'দৈনিক জেহাদ'। তার বয়স তখন মাত্র সতেরো বছর। এক বছরের ব্যবধানেই তিনি কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করেন, যোগ দেন (১৯৬৩) দৈনিক সংবাদে। তার সঙ্গে পরিচিত ব্যক্তিমাত্রই একে ভিন্ন গুরুত্বে বিশ্লেষণ করবেন। তার একটি রাজনৈতিক দর্শন ও মূল্যবোধ আছে। সর্বাধিক মানুষের সর্বাত্মক মঙ্গল বা উন্নয়নে তিনি আস্থাশীল। আবেদ খান বামপন্থি রাজনৈতিক আদর্শকে আজীবন লালন করেছেন। অন্তরের তাগিদই আবেদ খানকে সম্পৃক্ত করেছিল দৈনিক সংবাদের সঙ্গে। পরবর্তীকালে অবশ্য তার চাকরি ক্ষেত্রের বদল হয়েছে বেশ কয়েকবার।
১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান_ সবই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতির একেকটি অধ্যায়। আবেদ খান বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন ও ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। আবেদ খান একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের নৃশংসতার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি শব্দসৈনিক হিসেবে আকাশ বাণী বেতার কেন্দ্রে তার 'জবাব দাও' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
আবেদ খানের মতো সফল ও সার্থক কলামিস্ট বা প্রতিবেদক, সম্পাদক আমাদের খুব বেশি নেই। বহু সংবাদপত্রকে তিনি জনপ্রিয় করেছেন, সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার বিভিন্ন কলাম মানুষের মন ছুঁয়ে যায়, প্রাণকে স্পর্শ করে।
আবেদ খান একই সঙ্গে এ দেশের অন্যতম বরেণ্য সংবাদকর্মী, সাংবাদিক, সম্পাদক, লোকপ্রিয় টিভি উপস্থাপক। আমাদের বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এ বছর তার সাংবাদিক জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো। আমি আবেদ খানের দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। আশা করি, তার কলম ভবিষ্যতেও কথা বলবে, বৈরী পরিবেশেও তিনি লিখবেন : 'ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।'
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments