চরাচর-নীলপদ্মের নার্সারি by আরাফাত শাহরিয়ার
গাছগাছালির প্রতি ছিল তাঁর অন্য রকম ভালোবাসা। এ টানে উদ্যানতত্ত্ববিদ না হয়েও জামালপুর মহকুমার ঈশ্বরচন্দ্র গুহ হাতে নেন বিজ্ঞানভিত্তিক নার্সারি গড়ে তোলার কাজ। ১৮৯৪ সালে জামালপুর শহরের স্টেশন রোডে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের পশ্চিম পাশে বোসপাড়ায় স্থাপন করেন চৈতন্য নার্সারি।
সম্ভবত এটিই ছিল বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের প্রথম নার্সারি।ঈশ্বরচন্দ্র গুহ ৪৫ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন চৈতন্য নার্সারি। নার্সারির পাশাপাশি তৈরি করেন একটি মনোরম বাগান। তিনি এর নাম দেন ফোর ট্যাংকস গার্ডেন। নার্সারি ও বাগানকে সমৃদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন মহাদেশের নানা জাতের ফল, ফুল, গুল্ম, লতাপাতা, দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ, অর্থকরী উদ্ভিদ, ঔষুধি গাছপালার অপূর্ব সমাবেশ ঘটান।
পরিকল্পিতভাবে নির্মিত নার্সারি ও বাগানের প্রবেশপথের দুই পাশে ছিল ফলোদ্যান, জলোদ্যান, আঁকাবাঁকা পথ, কৃত্রিম পাহাড়, ঝরনা, দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ, গ্রিনহাউস, লতাগুল্ম ও বাহারি ফুলের সমারোহ। এ নার্সারি এতই সমৃদ্ধ ছিল যে নানা ঋতুতে দেখা দিত নানা সাজে।
১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নতুন রাজধানী ঢাকাকে তিলোত্তমা ও দৃষ্টিনন্দন নগরীরূপে সাজাতে সরকার জামালপুরের চৈতন্য নার্সারি থেকে নানা রকম বৃক্ষ এনে রোপণ করে। বর্তমানে সদরঘাটের বাহাদুর শাহ পার্ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনের পামগাছগুলো লুপ্ত চৈতন্য নার্সারির সাক্ষ্য বহন করছে। ঢাকায় বিভিন্ন জাতের ফল, ফুলের চাহিদা বেড়ে গেলে ১৩২২ বঙ্গাব্দে (১৯১৬-১৭ খ্রি.) ঢাকার তাঁতিবাজারে চৈতন্য নার্সারির শাখা খোলা হয়।
নার্সারির ক্যাটালগে চার হাজার ৬৪৮টি ফুল ও বৃক্ষের নাম, ৩১১ ধরনের ফার্ন, ২২৮ ধরনের অর্কিড ও ৭০০ জাতের গোলাপ ছিল। উপমহাদেশে তখনো আমাজন-লিলির চাষ হয়নি। পরম যত্নে চাষ করা হয় আমাজন নদীর অববাহিকার আমাজন লিলিও। ঈশ্বরচন্দ্র এর নাম দেন নীলপদ্ম। মালয়েশিয়ার তিন ধরনের কীটভুক তরু, দুষ্প্রাপ্য অর্কিড, হল্যান্ডের জাফরান, ফার্ন ও পামসহ বিভিন্ন দেশের নানা জাতের উদ্ভিদ চাষ হতো এই নার্সারিতে।
চৈতন্য নার্সারির পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে।
চৈতন্য নার্সারি লুপ্ত ঐতিহ্যের এক অপার বিস্ময়। ১৮৯৪ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ২৬-২৭ বছর সাফল্যের সঙ্গে টিকে ছিল এ নার্সারি। শেষদিকে অর্থসংকটে পড়েন ঈশ্বরচন্দ্র গুহ। ফলে তাঁর পক্ষে এ নার্সারি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ১৯২৪ সালের এপ্রিলে ঈশ্বরচন্দ্র মারা গেলে এ নার্সারি দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
আরাফাত শাহরিয়ার
No comments