মেধাস্বত্ব-ভৌগোলিক নির্দেশনা আইন প্রণয়নের এখনই সময় by হামিদুল মিসবাহ
যখন বাংলাদেশের পরিচিতি কিংবা ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি সামনে আসে, তখন যৌক্তিকভাবেই সামনে চলে আসে দুটি নাম_ পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার অথবা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অখণ্ড ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন। বিশ্বের ভৌগোলিক নির্দেশনার মধ্যে আছে টেকিলা, শ্যামপেন, স্কচ হুইস্কি,
রকফোর চিজ, দার্জিলিংয়ের চা, কলাপুরী চপ্পল, কাশ্মীরি উল, হাভানা চুরুটসহ বিভিন্ন নাম, যেগুলো ভৌগোলিকভাবে এসব পণ্যের উৎপত্তিস্থানকে নির্দেশ করে। এসব নামের তুলনামূলক বিচারে খুব স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশের নিজের কী কী সম্পদ আছে যেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে? ঢাকাইয়া জামদানি, নকশিকাঁথা, রাজশাহীর ফজলি আম, চাঁদপুরের ইলিশসহ আরও বিভিন্ন বাংলাদেশি পণ্য আছে, যেগুলো যথার্থভাবেই বাংলাদেশকে নির্দেশ করতে পারে বিশ্বের মানচিত্রে।এখন তাহলে আমাদের বাধা কোথায়? সাধারণ দৃষ্টিতে এ কাজে আমাদের কোনো বাধা কিংবা সীমাবদ্ধতা নেই। আমাদের ঢাকাইয়া জামদানি, নকশিকাঁথা, রাজশাহীর ফজলি আমসহ বিভিন্ন পণ্য নিদ্বর্িধায় দলভুক্ত হতে পারে। কিন্তু কিছু আইনগত সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে বাধা হিসেবে কাজ করছে। ঢাকাইয়া জামদানি, নকশিকঁাঁথা, ফজলি আম ইত্যাদি বাংলাদেশি পণ্যগুলোর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে কোনো নিবন্ধন নেই। ভৌগোলিক নির্দেশনা সবসময়ই একটি পণ্য অথবা শিল্পের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট এলাকা, অঞ্চল কিংবা কোনো আঞ্চলিক জনগোষ্ঠীর সম্পর্ককে নির্দেশ করে। এ ক্ষেত্রে মূলত একটি স্থান অথবা জনপদে উৎপাদিত একটি পণ্যকে চিহ্নিত করা হয়, যার সঙ্গে জড়িত থাকে সেই পণ্য এবং জনপদের বিশেষ গুণগত বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস, সুনাম ও ঐতিহ্য।
ভৌগোলিক নির্দেশনা বরাবরই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়বস্তু হিসেবে বিশেষভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৮৮৩ সালের প্যারিস কনভেনশনে সর্বপ্রথম এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে মাদ্রিদ প্রটোকল এবং ১৯৭৯ সালে লিসবন চুক্তি সম্পাদিত হয়, যেখানে পণ্যদ্রব্যের মিথ্যা ও প্রতারণামূলক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে পণ্যগুলোর আসল উৎপাদকের পরিচিতি এবং মর্যাদা রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এরপর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডবিল্গউটিও) পরিচালনায় ১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত হয় বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার চুক্তি বা ট্রিপস। এই ট্রিপস চুক্তিতেই ভৌগোলিক নির্দেশনামূলক অধিকার রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় নূ্যনতম আইনি কাঠামোর মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজ নিজ আইনি কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মেনে চলতে বাধ্য।
ট্রিপস চুক্তিতে ভৌগোলিক নির্দেশনার একটিমাত্র সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, যা বিশ্বের সব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের জন্য অভিন্নভাবে প্রযোজ্য। তবে এই চুক্তিতে ভৌগোলিক নির্দেশনামূলক অধিকার রক্ষা এবং এর আইনগত স্বীকৃতির প্রক্রিয়াকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত, ২২ ধারা অনুযায়ী মৌলিক স্বীকৃতি/নিরাপত্তা যা সব ভৌগোলিক নির্দেশনার জন্য প্রযোজ্য এবং দ্বিতীয়ত, ২৩ ধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত নিরাপত্তা/স্বীকৃতি যা কেবল আঙুরের রস থেকে প্রস্তুতকৃত মদ বা ওয়াইন এবং চোলাইকৃত তরল পদার্থ বা স্পিরিটের জন্য প্রযোজ্য।
২০০১ সালে অনুষ্ঠিত দোহা ডিক্লারেশনের সময় ভারতসহ বেশ কিছু দেশ তাদের নিজস্ব পণ্যের বাজার এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য ট্রিপস চুক্তির ২৩ ধারার পরিধি ওয়াইন এবং স্পিরিট থেকে বাড়িয়ে অন্য সব পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তাব জানায়। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, চিলি এবং উরুগুয়ে প্রচণ্ড আপত্তি জানায়, যা এখনও পর্যন্ত একটি অমীমাংসিত বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে। ট্রিপস চুক্তির ২৩ ধারাটি মূলত ওয়াইন এবং স্পিরিটকে একধরনের বিশেষ নিরাপত্তা বলয় প্রদান করেছে। তাছাড়া ২৩ ধারায় যেসব বিশেষ নিরাপত্তার বিধান আছে সেগুলোর মাধ্যমে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাষ্ট্রই কেবল বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে, যা স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে অনভিপ্রেত বিভেদ সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় এই যে, ২২ এবং ২৩ ধারার বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়ার কারণে আইন ভঙ্গ না করেও ভৌগোলিক নির্দেশনাগুলোর অপব্যবহার ঘটা সম্ভব।
এসবের বিপরীতে ট্রিপস চুক্তির বিভিন্ন আইনগত বাধ্যবাধকতা অনেক রাষ্ট্রকে তাদের নিজ নিজ দেশে ভৌগোলিক নির্দেশনা আইন প্রণয়নে বিশেষভাবে উদ্যোগী করেছে। ২৩ ধারার অন্যায্য এবং বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার কারণে বেশ কিছু রাষ্ট্র যেমন ভারত, তাদের নিজস্ব ভৌগোলিক নির্দেশনা আইনে পণ্যের স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তার জন্য সুই-জেনেরিস পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছে। ভারত তাদের নিজস্ব আইনে ট্রিপস চুক্তির আদলে ওয়াইন কিংবা স্পিরিটের মতো নির্দিষ্ট কোনো পণ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে বরং ভারতে উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যের স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তার জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। নিজেদের পণ্যের স্বীকৃতি এবং মর্যাদা রক্ষার্থে ভারতের হঠাৎ এ ধরনের গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠার পেছনে আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যকার একটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ওই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট এবং ট্রেডমার্ক অফিস (ইউএসপিটিও) বাসমতী চালকে একটি নতুন জাতের খাদ্যশস্য হিসেবে বিবেচনা করে সেদেশের একটি কোম্পানিকে বাসমতী চালের পেটেন্ট মঞ্জুর করেছিল। বাসমতী চালের পেটেন্টপ্রাপ্ত সেদেশের কোম্পানিটি এক ধরনের সরু সুগন্ধি চাল উৎপাদন করে, যা দেখতে বাসমতীর মতো হলেও কোনোভাবেই বাসমতীর সমকক্ষ নয়। এমতাবস্থায়, ভারত ও পাকিস্তান রাইসটেকের নামে নিবন্ধিত বাসমতী চালের পেটেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং বাসমতীকে একটি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে দাবি করে। কিন্তু সে সময়ে ভৌগোলিক নির্দেশনা বিষয়ে ভারতের নিজের কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় তারা তাদের দাবি আদায় করতে পারেনি। যদি সঠিক সময়ে ভারত ভৌগোলিক নির্দেশনা বিষয়ক আইনটি তৈরি করত তাহলে হয়তো ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে বাসমতীর স্বীকৃতি তারা পেত পারত। পরে ভারত এবং তার রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা তাদের এই বিরাট ভুল থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে এবং ১৯৯৯ সালে তাদের নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশনা আইনটি পাস করে।
তাহলে এখন আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? যে বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এক সময় ভারতের গায়ে আঘাত করেছে, সে একই স্বার্থের জন্যই ভারত এখন আঘাত করছে আমাদের গায়ে। এটা এখন মোটামুটি অনেকেরই জানা যে, আমাদের বেশ কিছু পণ্য যেমন, ঢাকাই জামদানি, নকশিকঁাঁথা এবং ফজলি আমের স্বত্ব ভারতের হাতে চলে গেছে। ভারত এসব পণ্যকে সেদেশে নিবন্ধিত করেছে এবং এ দেশের শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য, সুনাম ও অনন্যতার ওপর নিজের দখল বিস্তার করছে। ট্রিপস চুক্তি কোনো দেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার নিজের ভৌগোলিক নির্দেশনামূলক অধিকার রক্ষার অনুমতি দেয় মূলত তখনই, যখন সেই দেশটি জাতীয় পর্যায়ে ভৌগোলিক নির্দেশনামূলক অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত খাদ্য এবং অখাদ্যপণ্য মিলিয়ে মোট ৭৩টি পণ্যের তালিকা তৈরি করেছে, যেগুলো ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। এদের মধ্যে আছে মাছ, ফলমূল, মিষ্টি, সবজি ও কৃষিপণ্যসহ মোট ৫২টি খাদ্যপণ্য। আর বাকি ২১টি অখাদ্য পণ্যের মধ্যে ঢাকাই জামদানি এবং নকশিকাঁথাসহ বিভিন্ন পণ্য অন্তর্ভুক্ত আছে। বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ণ আইনটি না থাকার কারণে, এসব পণ্যের কোনোটিকেই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করে সুরক্ষা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। প্রস্তাবিত ভৌগোলিক নির্দেশনা আইনটি গত ২০০৩ সাল থেকে খসড়া অবস্থায় পড়ে আছে। এ দেশের পণ্যগুলোকে আইনি সুরক্ষা দিতে হলে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে পণ্যগুলোকে নিবন্ধিত করতে হবে, যা একটি যথাযথ আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতিতে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দরিদ্রতা হ্রাসের জন্য ভৌগোলিক নির্দেশনামূলক এই আইনটির বাস্তবায়ন যেভাবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনিভাবেই আমাদের নিজেদের অনন্য সঞ্জীবনী শক্তি পুনরুদ্ধারে এই আইনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই সেই সঞ্জীবনী শক্তি যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের শিকড়, জড়িয়ে আছে আমাদের পূর্বপুরুষদের ঘাম আর অশ্রুভেজা এই দেশের মাটির প্রতিটি কণা, জড়িয়ে আছে আমাদের আসল পরিচয়। সবশেষে এটাই বলতে হয় যে, কোনো কিছু একেবারে না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভালো।
ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ :প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কপিরাইট অ্যান্ড আইপি ফোরাম
No comments