দুদকের মামলা প্রত্যাহার-আইন সংশোধনে অতি উৎসাহী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! by আশরাফ উল আলম, পার্থ সারথি দাস ও হায়দার আলী
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহারের এখতিয়ার চেয়ে দুদক আইন সংশোধনের যে প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেছে, জানা গেছে, এ ব্যাপারে অতি উৎসাহী ভূমিকা রাখছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও দুদকের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং প্রতিষ্ঠানটির ক্ষমতা খর্ব করতে সরকারের তৎপরতায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
তাঁরা বলেছেন, মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে নিয়ে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করা হলে দুদক 'ঠুঁটো জগন্নাথ' হয়ে যাবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের স্থলে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আসার পর বিষয়টি নিয়ে তৎপরতা বেড়ে যায়। সর্বশেষ দুদকে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুদক আইন সংশোধনের সুপারিশসংবলিত একটি চিঠি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদক একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না। রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ থাকবেই। তাই বলে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াস শুভ নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা দুদককে আরো শক্তিশালী অবস্থায় দেখতে চাই। এই প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রাস করার চেষ্টা অতীতেও হয়েছে। বিভিন্ন বাধার কারণে ব্যুরো থাকা অবস্থায় এটি কাজ করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটি হাত গুটিয়ে বসেছিল। এ অবস্থায় ২০০৪ সালে আইন করা হয় এটিকে শক্তিশালী করার জন্য। যদি সরকার বা রাজনীতিবিদরা দুদকের ক্ষমতা খর্ব করতে চান, তাহলে দুদক রেখে কী হবে? এটি তো হবে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে সরকারের অনুমতি নিতে হতো। কিন্তু আইন হওয়ার পর থেকে এই বাধা দূর হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে এখন দুর্নীতি দমন কমিশনকে আর সরকারের দ্বারে যেতে হয় না। এটা দুদকের অর্জন। এখন অবশ্য শোনা যাচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে দুদকের এখন যে স্বাধীনতা রয়েছে, তা খর্ব করার তৎপরতা শুরু হয়েছে। ব্যুরো থাকা অবস্থায় যেসব সমস্যা ছিল, তা আবারও ভর করলে প্রতিষ্ঠানটির অর্জন করা সাফল্য ম্লান হয়ে যাবে।'
দুদকের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা পেলে দুদকের স্বাধীনতা অবশ্যই খর্ব হবে। দুদক মামলা করবে আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যাহার করে নেবে, এটা তো হতে পারে না। তিনি মনে করেন, এ ধরনের আইন সংশোধনের প্রস্তাব পাস হবে না।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, কি ধরনের চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুদককে দিয়েছে, তা না দেখে কিছু বলা ঠিক নয়। তবে দুদকের মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেলে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করা হবে। এতে যে উদ্দেশ্যে দুদক গঠন করা হয়েছে, তা ব্যাহত হবে।
অতি উৎসাহী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ইউনিয়ন কাউন্সিলর থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মামলা পর্যন্ত প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছিল। দুদকের মামলাগুলো আমরা প্রত্যাহার করতে পারতাম কিন্তু করছি না বলেই সরকারের ভেতরের কেউ কেউ ক্ষেপে গেছেন। যদিও ব্যুরো আমলের বেশির ভাগ মামলাই রাজনৈতিক সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ওই সময় দায়ের করা হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে যদি তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে আদালত থেকেই মামলা নিষ্পত্তি হওয়া ভালো। যেমন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মামলা আদালতেই নিষ্পত্তি হয়েছে। এটা উনার জন্য সম্মানজনক।' রাজনৈতিক হয়রানি বিবেচনায় দুদকের মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা চেয়ে আইন সংশোধনের সুপারিশ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'এভাবে যদি আইনের সংশোধন করা হয়, তাহলে দুদকের স্বাধীনতা খর্ব হবে। আমাদের তো করার কিছুই নেই, আমরা তো আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি সংস্থা। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তো আমাদের হাতে নেই।'
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এটা সরকারে সিদ্ধান্ত নয়, সরকারের ভেতরের একটি অংশ অতি উৎসাহী হয়ে এটা করতে চাচ্ছে। এটা বাস্তবায়ন হবে না বলেই তিনি মনে করেন। সরকারের ভেতরের অংশটি কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিগত সময়ে তিনি তো দুদকের বিলুপ্তিও চেয়েছেন। সেটা না পেরে এখন আইন করে ক্ষমতা কমাতে চাচ্ছেন দুদকের।
কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা যে বিষয়টি সব সময় বলেছি, যদি কেউ নির্দোষ হয়, তাহলে তা আইনি প্রক্রিয়ায় প্রমাণ হওয়া ভালো। এটা তাদের জন্যও ভালো, দুদকের জন্যও ভালো। আইনি প্রক্রিয়ায় যাতে মামলা নিষ্পত্তি হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমরা পরামর্শ দিয়ে আসছি। এখনো সেই একই পরামর্শ দিচ্ছি। আইনি প্রক্রিয়ায় কেউ যদি নির্দোষ হয়, তাহলে আদালতই তাকে ছেড়ে দেবে, মামলা প্রত্যাহার করার কী দরকার?'
দুদক বিভিন্ন দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত করে। দুর্নীতিতে প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করে দুদক। তাহলে দুদকের দায়ের করা মামলা কি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক হতে পারে- জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, 'তা হতে পারে। কারণ অধিকাংশ মামলাই ব্যুরোর সময়ের। সে সময় ব্যুরো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছিল না। সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ছিল। আর যদি রাজনৈতিক প্রভাবে হয়েও থাকে, আমরা চাই মামলা ভুল হোক, শুদ্ধ হোক তা নিষ্পত্তি করার জন্য আদালত রয়েছে। নিষ্পত্তির জন্য আদালতই ভালো।'
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় দুদকের করা মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা সরকারের নির্বাহী বিভাগ নিজ হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে ফৌজদারি আইনের সংশ্লিষ্ট একটি ধারা পুনঃসংশোধন করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর গত বুধবার প্রস্তাব দিয়ে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। এ বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এরই মধ্যে ৩০টি সভায় দুদকের দায়ের করা ৩৪৭টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। তবে এখন পর্যন্ত দুদক এতে কোনো সম্মতি দেয়নি। এই মামলাগুলোতে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ও নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন।
'দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট'-এর ১০ ধারার ৪ উপধারা অনুযায়ী, দুদকের করা মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা কেবল দুদকের হাতেই ন্যস্ত। ২০০৪ সালে আইনটি সংশোধন করে দুদককে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর আগে সরকারের নির্বাহী বিভাগের হাতেই এ ক্ষমতা ছিল। দুদক সূত্রে জানা যায়, মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত কমিটি যেসব মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ দুদকে পাঠিয়েছে, তার বেশির ভাগই বিলুপ্ত ব্যুরোর সময়ে দায়ের করা। এ ছাড়া কিছু মামলা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে হয়রানির উদ্দেশে করা মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ প্রণয়নে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতি হলেন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
টিআইবির উদ্বেগ : 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা দুদকের কাছ থেকে সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সরকারকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বানও জানায় টিআইবি।
এই সিদ্ধান্তকে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপন্থী ও আত্মঘাতী উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার কোনোভাবেই দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশকে প্রাধান্য দিয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমনে দৃঢ় ও কঠোর হতে পারছে না, এ সিদ্ধান্ত তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের স্থলে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আসার পর বিষয়টি নিয়ে তৎপরতা বেড়ে যায়। সর্বশেষ দুদকে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুদক আইন সংশোধনের সুপারিশসংবলিত একটি চিঠি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদক একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না। রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ থাকবেই। তাই বলে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াস শুভ নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা দুদককে আরো শক্তিশালী অবস্থায় দেখতে চাই। এই প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রাস করার চেষ্টা অতীতেও হয়েছে। বিভিন্ন বাধার কারণে ব্যুরো থাকা অবস্থায় এটি কাজ করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটি হাত গুটিয়ে বসেছিল। এ অবস্থায় ২০০৪ সালে আইন করা হয় এটিকে শক্তিশালী করার জন্য। যদি সরকার বা রাজনীতিবিদরা দুদকের ক্ষমতা খর্ব করতে চান, তাহলে দুদক রেখে কী হবে? এটি তো হবে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে আগের দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে সরকারের অনুমতি নিতে হতো। কিন্তু আইন হওয়ার পর থেকে এই বাধা দূর হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে এখন দুর্নীতি দমন কমিশনকে আর সরকারের দ্বারে যেতে হয় না। এটা দুদকের অর্জন। এখন অবশ্য শোনা যাচ্ছে, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে দুদকের এখন যে স্বাধীনতা রয়েছে, তা খর্ব করার তৎপরতা শুরু হয়েছে। ব্যুরো থাকা অবস্থায় যেসব সমস্যা ছিল, তা আবারও ভর করলে প্রতিষ্ঠানটির অর্জন করা সাফল্য ম্লান হয়ে যাবে।'
দুদকের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা পেলে দুদকের স্বাধীনতা অবশ্যই খর্ব হবে। দুদক মামলা করবে আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রত্যাহার করে নেবে, এটা তো হতে পারে না। তিনি মনে করেন, এ ধরনের আইন সংশোধনের প্রস্তাব পাস হবে না।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, কি ধরনের চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুদককে দিয়েছে, তা না দেখে কিছু বলা ঠিক নয়। তবে দুদকের মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পেলে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার করা হবে। এতে যে উদ্দেশ্যে দুদক গঠন করা হয়েছে, তা ব্যাহত হবে।
অতি উৎসাহী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ইউনিয়ন কাউন্সিলর থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মামলা পর্যন্ত প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছিল। দুদকের মামলাগুলো আমরা প্রত্যাহার করতে পারতাম কিন্তু করছি না বলেই সরকারের ভেতরের কেউ কেউ ক্ষেপে গেছেন। যদিও ব্যুরো আমলের বেশির ভাগ মামলাই রাজনৈতিক সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ওই সময় দায়ের করা হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে যদি তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে আদালত থেকেই মামলা নিষ্পত্তি হওয়া ভালো। যেমন- মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মামলা আদালতেই নিষ্পত্তি হয়েছে। এটা উনার জন্য সম্মানজনক।' রাজনৈতিক হয়রানি বিবেচনায় দুদকের মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা চেয়ে আইন সংশোধনের সুপারিশ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'এভাবে যদি আইনের সংশোধন করা হয়, তাহলে দুদকের স্বাধীনতা খর্ব হবে। আমাদের তো করার কিছুই নেই, আমরা তো আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি সংস্থা। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তো আমাদের হাতে নেই।'
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এটা সরকারে সিদ্ধান্ত নয়, সরকারের ভেতরের একটি অংশ অতি উৎসাহী হয়ে এটা করতে চাচ্ছে। এটা বাস্তবায়ন হবে না বলেই তিনি মনে করেন। সরকারের ভেতরের অংশটি কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিগত সময়ে তিনি তো দুদকের বিলুপ্তিও চেয়েছেন। সেটা না পেরে এখন আইন করে ক্ষমতা কমাতে চাচ্ছেন দুদকের।
কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা যে বিষয়টি সব সময় বলেছি, যদি কেউ নির্দোষ হয়, তাহলে তা আইনি প্রক্রিয়ায় প্রমাণ হওয়া ভালো। এটা তাদের জন্যও ভালো, দুদকের জন্যও ভালো। আইনি প্রক্রিয়ায় যাতে মামলা নিষ্পত্তি হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমরা পরামর্শ দিয়ে আসছি। এখনো সেই একই পরামর্শ দিচ্ছি। আইনি প্রক্রিয়ায় কেউ যদি নির্দোষ হয়, তাহলে আদালতই তাকে ছেড়ে দেবে, মামলা প্রত্যাহার করার কী দরকার?'
দুদক বিভিন্ন দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত করে। দুর্নীতিতে প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করে দুদক। তাহলে দুদকের দায়ের করা মামলা কি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক হতে পারে- জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, 'তা হতে পারে। কারণ অধিকাংশ মামলাই ব্যুরোর সময়ের। সে সময় ব্যুরো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছিল না। সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ছিল। আর যদি রাজনৈতিক প্রভাবে হয়েও থাকে, আমরা চাই মামলা ভুল হোক, শুদ্ধ হোক তা নিষ্পত্তি করার জন্য আদালত রয়েছে। নিষ্পত্তির জন্য আদালতই ভালো।'
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় দুদকের করা মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা সরকারের নির্বাহী বিভাগ নিজ হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে ফৌজদারি আইনের সংশ্লিষ্ট একটি ধারা পুনঃসংশোধন করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর গত বুধবার প্রস্তাব দিয়ে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। এ বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এরই মধ্যে ৩০টি সভায় দুদকের দায়ের করা ৩৪৭টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। তবে এখন পর্যন্ত দুদক এতে কোনো সম্মতি দেয়নি। এই মামলাগুলোতে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ও নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন।
'দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট'-এর ১০ ধারার ৪ উপধারা অনুযায়ী, দুদকের করা মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা কেবল দুদকের হাতেই ন্যস্ত। ২০০৪ সালে আইনটি সংশোধন করে দুদককে এ ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর আগে সরকারের নির্বাহী বিভাগের হাতেই এ ক্ষমতা ছিল। দুদক সূত্রে জানা যায়, মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত কমিটি যেসব মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ দুদকে পাঠিয়েছে, তার বেশির ভাগই বিলুপ্ত ব্যুরোর সময়ে দায়ের করা। এ ছাড়া কিছু মামলা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে হয়রানির উদ্দেশে করা মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ প্রণয়নে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতি হলেন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
টিআইবির উদ্বেগ : 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা দুদকের কাছ থেকে সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সরকারকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বানও জানায় টিআইবি।
এই সিদ্ধান্তকে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপন্থী ও আত্মঘাতী উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার কোনোভাবেই দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশকে প্রাধান্য দিয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি দমনে দৃঢ় ও কঠোর হতে পারছে না, এ সিদ্ধান্ত তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
No comments