ডিসি-এসপিদের সতর্ক থাকার নির্দেশ-আমাদের শিশুরা কী শিখবে by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
বিসিএস, শিক্ষক নিয়োগ, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু বিচলিত হতে হয় প্রাথমিক সমাপনীর মতো দেশের লাখ লাখ খুদে শিক্ষার্থীর জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ যখন কানে আসে।
অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে এই প্রশ্ন না করে উপায় থাকে না, এই শিক্ষাজীবন থেকে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য কী শিক্ষা নেবে তারা? এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিচ্ছে ২৬ লাখের বেশি শিক্ষার্থী। এত শিশুর কোমল মনের ওপর কি অমোচনীয় কালো দাগই না ফেলে যাবে এই ঘটনা!অভিযোগ গুরুতর। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রাথমিক সমাপনীর বাংলা বিষয়ের যে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্নপত্রটি নাকি আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। মিলিয়ে দেখা গেছে, কম-বেশি ৪০ থেকে ৪৭ নম্বরের মিল পাওয়া গেছে পরীক্ষা হলে বিতরণ করা প্রশ্নের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের। এই মিল যে কাকতালীয় নয়, তার সপক্ষে আপাতত বড় যুক্তি হচ্ছে, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গঠন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিশুরা নিশ্চয়ই কাউকে বলেনি যে, পরীক্ষার প্রশ্ন এনে দাও। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায়, তাদের মাথায়ই হয়তো নেই পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পেয়ে যাওয়ার মতো কোনো বিষয়। তাহলে কেন এই নোংরা কাজটা করা হলো? কেনইবা শিশুদের এত বড় ক্ষতি করা হলো!
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমীন এ বিষয়ে বলেন, 'ক্লাস ফাইভের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়েও যদি অভিযোগ ওঠে তাহলে কী করা?' তিনি এ ঘটনাকে দুঃখজনক হিসেবে বর্নণা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক কালের কণ্ঠকে বলেন, অতীতে বহুবার বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এসব বিষয়ে তখন তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের বিষয়ে একটি আইন থাকলেও এর বাস্তবায়ন নেই। তাই বারবার এ ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকলে শাস্তি ন্যূনতম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড। কিন্তু আইনটি জারি হওয়ার পর আজ পর্যন্ত এর কোনো কার্যকারিতা দেখা যায়নি। এই আইন প্রণয়নের পরও বিভিন্ন পরীক্ষায় কমপক্ষে ৬৩ বার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভিন্ন কেলেঙ্কারির পর পরীক্ষা স্থগিত করে কমপক্ষে ২৯ বার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব তদন্ত প্রতিবেদনে সংকট সমাধানের সুপারিশ করা হলেও কোনো সুপারিশই কার্যকর হয়নি।
জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিশুদের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা উদ্বেগজনক। মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এটা ভালো দিক। এই ঘটনার পুরোপুরি তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্তের মাধ্যমে পুরো চক্রের মূল উৎপাটন না করলে দেশের জন্য তা অশনিসংকেত হয়ে দেখা দেবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় দেশে প্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। আলোচিত সেই ঘটনায় তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসএসসি পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে ১৯৯১ সালে। এরপর ১৯৯৭ সালের এসএসসি পরীক্ষা, ১৯৯৮ সালের এসএসসি পরীক্ষা, ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ২০০৬ সালে ২৭তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। ওই বছর ফাঁস হয় এমবিবিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। ২০০৭ সালে আবার এমবিবিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়। একই বছর ফাঁস হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা। ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ২০০৮ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আবারও ফাঁস হয়। ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ডিপ্লোমা ইন টেক্সাটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তৃতীয় সেমিস্টারের ১০টি বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল করা হয়। ২০১০ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আগে রংপুরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।
তবে কোনো ঘটনার জন্যই আজ পর্যন্ত জড়িত কারো শাস্তি হয়েছে- এমন নজির নেই। গত ১৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটিকে গুজব বলে বক্তব্য দেন সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান প্রাথমিক সমাপনীর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগের বিষয়ে বলেন, 'জাতির কপালে দুর্ভোগ চূড়ান্ত হয়ে বসল। শিশুদের পরীক্ষা- এই পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস, ভাবা যায়!'
No comments