জবানবন্দিতে শহীদ জব্বল হোসেনের মেয়ে- বাবাকে বাঁচাতে আলীমের পা ধরে কেঁদেছিলেন মা
বিএনপির নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী বিউটি খানম জবানবন্দিতে বলেছেন, একাত্তরে আলীমের নির্দেশে তাঁর বাবা জব্বল হোসেনকে হত্যা করা হয়। বাবাকে বাঁচাতে তাঁর মা আলীমের পা ধরে কান্নাকাটি করেছিলেন।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ গতকাল বৃহস্পতিবার জবানবন্দিতে এসব কথা বলার সময় সাক্ষীর কাঠগড়ায় বিউটি খানম বারবার কেঁদে উঠছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত তাঁর জবানবন্দি নেন। শারীরিক কারণে জামিনে থাকা আলীম এ সময় ট্রাইব্যুনালে হাজির ছিলেন।জবানবন্দিতে বিউটি খানম (৫৭) বলেন, তাঁর গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার বালীঘাটা বাজারে, শ্বশুরবাড়ি পাঁচবিবির ধুরইল গ্রামে। একাত্তরের ২০ এপ্রিল মঙ্গলবার ছিল পাঁচবিবির হাটবার, এর মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁর বিয়ে হয়। ওই দিন বিকেলে তাঁরা জানতে পারেন, জয়পুরহাট শান্তি কমিটির সভাপতি আবদুল আলীম, পাঁচবিবি শান্তি কমিটির সদস্য জায়বর আলীসহ (বর্তমানে মৃত) পাকিস্তানি সেনারা পাঁচবিবি হাটে আক্রমণ করেছে। সেই আক্রমণে অনেকে হতাহত হন। এ খবর পেয়ে তিনিসহ তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভয়ে বাড়ির পাশের বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নেন।
রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষী বলেন, একাত্তরে তাঁর বাবা জব্বল হোসেন ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সুবেদার মেজর হিসেবে চট্টগ্রামের ১৭ উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে তিনি মাথা, বাহু ও ঊরুতে জখম হন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আহত অবস্থায় তাঁকে ধুরইলের শ্বশুরবাড়িতে আনা হলে পারিবারিক চিকিৎসক আবুল কাশেম (বর্তমানে মৃত) গোপনে তাঁর চিকিৎসা করেন। এ সময় তাঁর আহত হওয়ার ঘটনা জানা যায়।
বিউটি খানম বলেন, শ্বশুরবাড়িতে বাবাকে রাখা নিরাপদ মনে না করায় তিনিসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে ফিসকা পাড়ার নাজিমউদ্দিনের বাড়িতে নিয়ে রাখেন। কিন্তু ওই পাড়ার রাজাকার আলামুদ্দিন তাঁর বাবার অবস্থান জানতে পেরে আলীমকে খবর দেন। ২০ নভেম্বর রোজার ঈদের দিন সকালে আলীমের নির্দেশে শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা মিলে নাজিমউদ্দিনের বাড়ি আক্রমণ করে তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে যায়।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বলেন, এ ঘটনার পর তাঁর মা কুলসুম বেগম, ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন ও স্বামী গোলাম রসুল প্রথমে পাঁচবিবি শান্তি কমিটির কার্যালয়ে এবং পরে জয়পুরহাট শান্তি কমিটির কার্যালয়ে যান। সেখানে আলীমের সঙ্গে দেখা করে তাঁরা জব্বল হোসেনকে ছেড়ে দিতে অনুনয়-বিনয় করেন। পর পর দুই দিন দেখা করার পর আলীম তাঁদের একটি চিঠি দিয়ে সেটি বগুড়া নিউমার্কেটের মালিক রফিক খান বিহারিকে দিতে বলেন। তাঁরা বগুড়ায় গিয়ে চিঠিটি রফিক খানকে দিলে তিনি গোয়েন্দা শাখা, কারাগার প্রভৃতিতে খোঁজার টালবাহানা করে বলেন, জব্বল হোসেনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। বগুড়া থেকে ফিরে তাঁরা আবার আলীমের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তাঁর মা আলীমের পা ধরে অনেক কান্নাকাটি করে বলেন, একবার যেন তাঁকে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়। তখন আলীম রেগে গিয়ে বলেন, ‘জব্বল হোসেন চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাঁকে ছাড়া যাবে না।’ পরে একদিন চিকিৎসক ফরিদ আহমেদ (বর্তমানে মৃত) তাঁদের জানান, আলীমের নির্দেশে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জব্বল হোসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
এর আগে ১৯ নভেম্বর এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন বিউটি খানমের স্বামী মো. গোলাম রসুল। তিনিও তাঁর জবানবন্দিতে শ্বশুরকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও পরে তাঁকে হত্যার ঘটনার বিবরণ দেন।
জবানবন্দি শেষে ট্রাইব্যুনালে হাজির আবদুল আলীমকে শনাক্ত করেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী খলিলুর রহমান জেরা শুরু করেন। ৫ ডিসেম্বর বিউটি খানমকে আবার জেরা করবে আসামিপক্ষ।
No comments