আশহারফির বেঁচে থাকার যুদ্ধ by সুমন মজুমদার
বেঁচে থাকার আনন্দের সঙ্গে পৃথিবীর সকল আনন্দও যেন তুচ্ছ হয়ে যায় কখনো কখনো। এই বাঁচবার গল্পটা আশহারফি দেবীর। ভারতের বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করেন আশহারফি । যার বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১২ বছর বয়সে। অতঃপর ১৯ পেরাতে না পেরোতেই পান মাতৃত্ব।
কিন্তু ভাগ্য আর কতদিন সইবে। অসংখ্য ভারতীয় নারীর মতো মাত্র ২৩ বছর বয়সেই হলেন স্বামী পরিত্যাজ্য। এভাবেই চলছিল আশহারফির জীবন। কিন্তু এই জীবনেও শঙ্কা নেমে এলো যখন মাত্র ৪০ বছর বয়সে ঘোষণা করা হলো তিনি আসলে মৃত। কিন্তু জীবিত থেকেও মৃতের তকমা গায়ে লাগিয়ে কে ঘুরতে চায়? তাই বর্তমানে ৬৪ বছরে পা রাখা আশহারফি দেবীও তার স্বীকৃতি আদায়ে লড়ে গেছেন দীর্ঘ দুই যুগ। এই দুই যুগ তিনি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে জীবিত থাকলেও কাগজে কলমে সবার কাছে ছিলেন মৃত। অবশেষে দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই শেষে গত মে মাসে তিনি আদায় করে ছেড়েছেন তার জীবিত থাকার স্বীকৃতি। গত মে মাসে তার গ্রামের পঞ্চায়েত আদালত তাকে এই জীবিত থাকার স্বীকৃতি দেয়।
জানা যায়, ১৯৬০ সালে বিহারের রোহতাস জেলার বরুন গ্রামে রাম জনম সিং নামে এক স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে বিয়ে হয় আশহারফি’র। ভারতের বিভিন্ন গ্রামের মতই আশহারফি আর জনম সিং’র বিয়েও তখন রেজিস্টার করা হয়নি। তাই নিজের বিয়ের কোনো দলিল বা প্রমাণ কিছুই ছিল না আশহারফির কাছে। তবু আজ এই ৬৪ বছর বয়সে এসে আশহারফি অস্পস্টভাবে ঠিকই মনে করতে পারেন সেই দিনটির কথা। জনম সিংয়ের ঘরে যেদিন তিনি বউ সেঁজে এসেছিলেন সেদিন তার বয়স ছিল ১২ বছর। চাইলে আজও তিনি চাইলে মনে করতে পারেন বিয়ের দিনে তার সেই লাল শাড়ি, তার বাবার বাড়ির পাশে গাছের মাথায় বাঁধা মাইকে জোরে বেজে চলা সেই হিন্দি সিনেমার গানও।
কিন্তু এত সুখ যে তার কপালে বেশিদিন সহ্য হয়নি। বিয়ের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আশহারফি আবিষ্কার করলেন যে এতদিন তাকে মিথ্যে বলেছেন রাম জনম সিং। কারণ তিনি জনম সিংয়ের প্রথম নয়, দ্বিতীয় স্ত্রী। তার বিয়ের মাত্র কিছুদিন আগেই জনম সিংয়ের প্রথম স্ত্রী জালাকিয়া দেবী মারা গিয়েছিলেন।
স্বামীর এতবড় প্রতারণা সত্ত্বেও আট দশটা ভারতীয় নারীর মতো মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন আশহারফি। তার বয়স যখন ১৯ তখন আশহারফি’র কোল আলো করে এলো এক কন্যা। কিন্তু এরপর থেকেই মেয়ে জন্ম দেবার দোষেই হোক বা অন্য কারণেই হোক জনম সিং যেন তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে গঞ্জনা দেয়া শুরু করলেন। কন্যাটির বয়স যখন চার তখন একদিন পুরোপুরিভাবে জনম সিং আশহারফিকে ফেলে চলে যান। সেই থেকে আশহারফি ও তার মেয়ে থাকতেন তার বাবার বাড়ি।
এভাবে সময় যায়। একসময় আশহারফির মেয়ে মিমলা বড় হয়ে ওঠে। আশহারফি তাকেও বিয়ে দেন স্থানীয় এক সব্জি বিক্রেতা অনিল কুমার সিংয়ের সঙ্গে। স্বামী পরিত্যাজ্য আশহারফিকে মেয়ে বিয়ে দিতে সাহায্য করেন তার বাবা ও ভাই। মেয়ের বিয়ের শেষে আশহারফি ভেছিলেন যে তার জীবনের যুদ্ধের এই বুঝি শেষ হলো। কিন্তু উপরে বসে ঠিকই তখন মুচকি হাঁসছিলেন বিধাতা। কারণ তখন থেকে যে ভাগ্য বিরম্বিত নারীটির আরেক যুদ্ধের শুরু ।
এতদিন পর তার মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়লো যখন আশহারফি দেখলেন তার স্বামী জনম সিং বিহারের সাসারাম জেলা মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল থেকে তাকে মৃত দেখিয়ে সার্টিফিকেট তুলে সেখানে নতুন আরেকটি সংসার পেতেছেন। সাসারাম জেলা মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল থেকে আশহারফিকে মৃত দেখিয়ে তার ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ইস্যু করা হয় ১৯৮৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। অর্থাৎ মাত্র ৪০ বছর বয়সে আশহারফি দেখলেন তিনি তখন আসলে কাগজে কলমে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত।
কিন্তু আজীবন সংগ্রামী এই নারীটি হার মেনে নেননি। বেঁচে থেকেও মৃত অপবাদ কে মাখতে চায় গায়ে। তাই আশহারফি ঠিক করলেন তার জীবিত থাকার স্বীকৃতি আদায়ে লড়াইয়ে নামবেন তিনি। প্রথমে তিনি তার বেঁচে থাকা এবং কাগজে কলমে মৃত ঘোষণা করার বিষয়টি পুলিশ, স্থানীয় রাজনীতিবিদ এমনকি আদালতেও জানান।
এ প্রসঙ্গে আশহারফি বলেন, “আমি পুলিশ থেকে শুরু করে সবার দরজাতেই টোকা দিয়েছি। কিন্তু আমি যে আসলে বেঁচে আছি আনুষ্ঠানিকভাবে এই সত্য স্বীকৃতি দিতে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে আমি কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙ্গে পড়ি।”
কিন্তু বিপদে পড়লেও নিরীহ গরুও যেমন শিং পাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় তেমনি আশহারফিও ঘুরে দাঁড়ালেন। তিনি ঠিক করলেন তিনি হারবেন না। তাই নিজের যুদ্ধ জয়ে তার মেয়ে এবং মেয়ে জামাইকে সঙ্গী করে গেলেন গ্রামের হাঁটে। সেখানে সবার কাছে বলতে লাগলেন তার ঘটনা। এদিকে তার এই বলে বেড়ানোর ঘটনা শুনে স্বামী জনম সিং কিন্তু বসে থাকেননি। ঠিকই সেদিন জনম সিং এবং তার তৃতীয় স্ত্রী সুভাগো দেবী এসে শাসিয়ে গিয়েছিলেন আশহারফিকে। এমনকি ১০৯৩-৯৪ সালে মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসিয়ে তার স্বামী আশহারফিকে জেলও খাটিয়েছিলেন।
আশহারফি বলেন, “আমাকে আনুষ্ঠানিক মৃত দেখিয়ে সেসময় জনম সিং তার সব সম্পত্তি তৃতীয় স্তীর নামে করে নিয়েছিল।”
শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে আশহারফি গত বছর তার জীবিতত্বের স্বীকৃতি আদায়ে স্বামীর বিরুদ্ধে গ্রাম পঞ্চায়েত আদালতে পিটিশন দাখিল করেন। দীর্ঘ আট মাস আদালত আশহারফি’র সমস্ত তথ্য প্রমাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এবং স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য নেয়। অবশেষে চলতি বছরের মে মাসে আদালত আশহারফি দেবী, তার স্বামী জনম সিং, পরিবারের সদস্যদের, গ্রামের সবাইকে, স্থানীয় পুলিশ, সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠায়। এবং আশহারফি দেবী যে আসলে জীবিত জনসমক্ষে তার রায় দেয়।
দীর্ঘ দুই যুগ কাগজে কলমে মৃত হিসেবে কাটিয়ে নতুন জীবন ফিরে পাওয়া বর্তমানের ৬৪ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা আশহারফি বলেন, “এখন আমার অস্তিত্ব প্রমানে আমার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র রয়েছে। আমি মরে যাইনি।”
মায়ের খুশিতে আবেগাপ্লুত বিমলা দেবী বলেন, “এটি যেন আমার মায়ের পূনঃজন্ম হয়েছে।”
অবশ্য জনম সিং কিন্তু তার স্বভাব ধরেই রেখেছেন। আদালতের রায়ের পরেও সে আশহারফিকে স্বীকার করে নেননি। বরং বলেছেন, “আশহারফি মারা গেছে ১৯৮৮ সালে। আমি বুঝতে পারছি না কেন এই মহিলা নিজেকে আমার স্ত্রী বলে দাবি করছে।” সূত্র: বিবিসি
জানা যায়, ১৯৬০ সালে বিহারের রোহতাস জেলার বরুন গ্রামে রাম জনম সিং নামে এক স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে বিয়ে হয় আশহারফি’র। ভারতের বিভিন্ন গ্রামের মতই আশহারফি আর জনম সিং’র বিয়েও তখন রেজিস্টার করা হয়নি। তাই নিজের বিয়ের কোনো দলিল বা প্রমাণ কিছুই ছিল না আশহারফির কাছে। তবু আজ এই ৬৪ বছর বয়সে এসে আশহারফি অস্পস্টভাবে ঠিকই মনে করতে পারেন সেই দিনটির কথা। জনম সিংয়ের ঘরে যেদিন তিনি বউ সেঁজে এসেছিলেন সেদিন তার বয়স ছিল ১২ বছর। চাইলে আজও তিনি চাইলে মনে করতে পারেন বিয়ের দিনে তার সেই লাল শাড়ি, তার বাবার বাড়ির পাশে গাছের মাথায় বাঁধা মাইকে জোরে বেজে চলা সেই হিন্দি সিনেমার গানও।
কিন্তু এত সুখ যে তার কপালে বেশিদিন সহ্য হয়নি। বিয়ের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই আশহারফি আবিষ্কার করলেন যে এতদিন তাকে মিথ্যে বলেছেন রাম জনম সিং। কারণ তিনি জনম সিংয়ের প্রথম নয়, দ্বিতীয় স্ত্রী। তার বিয়ের মাত্র কিছুদিন আগেই জনম সিংয়ের প্রথম স্ত্রী জালাকিয়া দেবী মারা গিয়েছিলেন।
স্বামীর এতবড় প্রতারণা সত্ত্বেও আট দশটা ভারতীয় নারীর মতো মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন আশহারফি। তার বয়স যখন ১৯ তখন আশহারফি’র কোল আলো করে এলো এক কন্যা। কিন্তু এরপর থেকেই মেয়ে জন্ম দেবার দোষেই হোক বা অন্য কারণেই হোক জনম সিং যেন তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে গঞ্জনা দেয়া শুরু করলেন। কন্যাটির বয়স যখন চার তখন একদিন পুরোপুরিভাবে জনম সিং আশহারফিকে ফেলে চলে যান। সেই থেকে আশহারফি ও তার মেয়ে থাকতেন তার বাবার বাড়ি।
এভাবে সময় যায়। একসময় আশহারফির মেয়ে মিমলা বড় হয়ে ওঠে। আশহারফি তাকেও বিয়ে দেন স্থানীয় এক সব্জি বিক্রেতা অনিল কুমার সিংয়ের সঙ্গে। স্বামী পরিত্যাজ্য আশহারফিকে মেয়ে বিয়ে দিতে সাহায্য করেন তার বাবা ও ভাই। মেয়ের বিয়ের শেষে আশহারফি ভেছিলেন যে তার জীবনের যুদ্ধের এই বুঝি শেষ হলো। কিন্তু উপরে বসে ঠিকই তখন মুচকি হাঁসছিলেন বিধাতা। কারণ তখন থেকে যে ভাগ্য বিরম্বিত নারীটির আরেক যুদ্ধের শুরু ।
এতদিন পর তার মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়লো যখন আশহারফি দেখলেন তার স্বামী জনম সিং বিহারের সাসারাম জেলা মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল থেকে তাকে মৃত দেখিয়ে সার্টিফিকেট তুলে সেখানে নতুন আরেকটি সংসার পেতেছেন। সাসারাম জেলা মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল থেকে আশহারফিকে মৃত দেখিয়ে তার ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ইস্যু করা হয় ১৯৮৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। অর্থাৎ মাত্র ৪০ বছর বয়সে আশহারফি দেখলেন তিনি তখন আসলে কাগজে কলমে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত।
কিন্তু আজীবন সংগ্রামী এই নারীটি হার মেনে নেননি। বেঁচে থেকেও মৃত অপবাদ কে মাখতে চায় গায়ে। তাই আশহারফি ঠিক করলেন তার জীবিত থাকার স্বীকৃতি আদায়ে লড়াইয়ে নামবেন তিনি। প্রথমে তিনি তার বেঁচে থাকা এবং কাগজে কলমে মৃত ঘোষণা করার বিষয়টি পুলিশ, স্থানীয় রাজনীতিবিদ এমনকি আদালতেও জানান।
এ প্রসঙ্গে আশহারফি বলেন, “আমি পুলিশ থেকে শুরু করে সবার দরজাতেই টোকা দিয়েছি। কিন্তু আমি যে আসলে বেঁচে আছি আনুষ্ঠানিকভাবে এই সত্য স্বীকৃতি দিতে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে আমি কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙ্গে পড়ি।”
কিন্তু বিপদে পড়লেও নিরীহ গরুও যেমন শিং পাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় তেমনি আশহারফিও ঘুরে দাঁড়ালেন। তিনি ঠিক করলেন তিনি হারবেন না। তাই নিজের যুদ্ধ জয়ে তার মেয়ে এবং মেয়ে জামাইকে সঙ্গী করে গেলেন গ্রামের হাঁটে। সেখানে সবার কাছে বলতে লাগলেন তার ঘটনা। এদিকে তার এই বলে বেড়ানোর ঘটনা শুনে স্বামী জনম সিং কিন্তু বসে থাকেননি। ঠিকই সেদিন জনম সিং এবং তার তৃতীয় স্ত্রী সুভাগো দেবী এসে শাসিয়ে গিয়েছিলেন আশহারফিকে। এমনকি ১০৯৩-৯৪ সালে মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসিয়ে তার স্বামী আশহারফিকে জেলও খাটিয়েছিলেন।
আশহারফি বলেন, “আমাকে আনুষ্ঠানিক মৃত দেখিয়ে সেসময় জনম সিং তার সব সম্পত্তি তৃতীয় স্তীর নামে করে নিয়েছিল।”
শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে আশহারফি গত বছর তার জীবিতত্বের স্বীকৃতি আদায়ে স্বামীর বিরুদ্ধে গ্রাম পঞ্চায়েত আদালতে পিটিশন দাখিল করেন। দীর্ঘ আট মাস আদালত আশহারফি’র সমস্ত তথ্য প্রমাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এবং স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য নেয়। অবশেষে চলতি বছরের মে মাসে আদালত আশহারফি দেবী, তার স্বামী জনম সিং, পরিবারের সদস্যদের, গ্রামের সবাইকে, স্থানীয় পুলিশ, সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠায়। এবং আশহারফি দেবী যে আসলে জীবিত জনসমক্ষে তার রায় দেয়।
দীর্ঘ দুই যুগ কাগজে কলমে মৃত হিসেবে কাটিয়ে নতুন জীবন ফিরে পাওয়া বর্তমানের ৬৪ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা আশহারফি বলেন, “এখন আমার অস্তিত্ব প্রমানে আমার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র রয়েছে। আমি মরে যাইনি।”
মায়ের খুশিতে আবেগাপ্লুত বিমলা দেবী বলেন, “এটি যেন আমার মায়ের পূনঃজন্ম হয়েছে।”
অবশ্য জনম সিং কিন্তু তার স্বভাব ধরেই রেখেছেন। আদালতের রায়ের পরেও সে আশহারফিকে স্বীকার করে নেননি। বরং বলেছেন, “আশহারফি মারা গেছে ১৯৮৮ সালে। আমি বুঝতে পারছি না কেন এই মহিলা নিজেকে আমার স্ত্রী বলে দাবি করছে।” সূত্র: বিবিসি
No comments