আগামী নির্বাচন সামনে রেখে শাসক শ্রেণীর সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে by বদরুদ্দীন উমর
কী ধরনের সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব নতুন ব্যাপার নয়। আশির দশকের শেষ দিকে, বিশেষত ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ পর্যায়ে এ প্রশ্ন গুরুতর আকার ধারণ করেছিল।
কারণ ১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশের তথাকথিত কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা শ্রেণী-সংগ্রাম শিকেয় তুলে বহু বিচিত্র কায়দায় নবউত্থিত লুণ্ঠনজীবী বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থের সঙ্গে তাল রেখে রাজনীতি করার কারণে শ্রেণী-সংগ্রামের পরিবর্তে অভিন্ন শাসক শ্রেণীর দুই ভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্বই সমগ্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, যেভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আশির দশক থেকে দ্বন্দ্ব-বিরোধ দানা বাঁধে ও বিকাশ লাভ করে তার সঙ্গে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং এখনও এই দ্বন্দ্ব যে অবস্থায় আছে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। এ হলো এক ধরনের প্রাক-পুঁজিবাদী ও প্রাক-গণতন্ত্র চরিত্র, যার কোনো প্রাসঙ্গিকতা প্রকৃত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও নেই। কারণ বুর্জোয়া গণতন্ত্রে শোষক-শাসক শ্রেণী শোষিত ও শাসিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে থাকলেও এই বিরুদ্ধতার প্রয়োজনেই তারা নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থ ও সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও আবার পরস্পরের সঙ্গে আলোচনায় বসে, নানা ধরনের সমঝোতা করে।
বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই রাজনৈতিক চরিত্র ও সংস্কৃতি নেই। কাজেই প্রাক-পুঁজিবাদী ও প্রাক-গণতন্ত্র চরিত্র নিয়েই এরা এমনভাবে এক দল অন্য দলের বিরোধিতা করে যার কোনো তুলনা বা দৃষ্টান্ত অন্যান্য বুর্জোয়া সমাজে পাওয়া যায় না। ১৯৭২ সাল থেকে লুণ্ঠনজীবী এক ধরনের পেটি বুর্জোয়াদের শাসনে বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত শাসিত হতে থাকার কারণেই শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরেই এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে এবং এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যাতে তাদের সঙ্কটের মীমাংসা তাদের নিজেদের দ্বারা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এই সঙ্কট যে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে তা-ই নয়, সমগ্র অর্থনীতির মধ্যেও যে সঙ্কট আছে তার মূলেই রয়েছে শাসক শ্রেণীর লুণ্ঠনজীবী ও প্রাক-পুঁজিবাদী চরিত্র। এটা যদি না হতো তাহলে বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক-মালিক যে সংঘর্ষ এখন দেখা যাচ্ছে এ সংঘর্ষ নিরসনে সরকার ও মালিক শ্রেণীর পরিবর্তে তৈরি পোশাকের বিদেশি বা সাম্রাজ্যবাদী খরিদ্দারদের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতো না! শুধু তা-ই নয়, এই হস্তক্ষেপের কারণেই এখন সরকার ও মালিক শ্রেণী শ্রমিকদের মজুরি, কাজের শর্ত ইত্যাদি প্রয়োজনীয়ভাবে পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়ার চিন্তাভাবনা করছে!!
রাজনীতি ক্ষেত্রেও নিজেদের সমস্যার মীমাংসা এরা নিজেরা করতে অক্ষম হওয়ায় এবং নিজেদের দ্বন্দ্বকে মীমাংসার অতীত পর্যায়ে এনে দাঁড় করানোর ফলে এখানে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অচলাবস্থা দূর করার জন্যও বিদেশিরা অর্থাত্ এদের সাম্রাজ্যবাদী মুরব্বিরা এখন যথেষ্ট তত্পর। অন্য দেশের জন্য যা অচিন্তনীয় বাংলাদেশে তাই হচ্ছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অন্যান্য কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতরা এখানকার রাজনীতিতে খোলাখুলি হস্তক্ষেপ করছে। নির্বাচন কী ধরনের সরকারের অধীনে হওয়া দরকার, এ বিষয়ে পর্যন্ত তারা নিজেদের বক্তব্য অবাধে প্রদান করছে। এ কাজ কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূতের পক্ষে যে করা যায় না, এটা বলে সরকার বা বিরোধী পক্ষ কেউই কোনো প্রতিবাদ করছে না! এরা ধরেই নিয়েছে যে, বিদেশিদের অর্থাত্ এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীদের এই আচরণ স্বাভাবিক!
আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে, না একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে-এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা এখন চলছে। এ বাকবিতণ্ডায় এখন দুই জোটের সুবিধাবাদী শরিকরা এবং বামপন্থী নামে এক ধরনের সুবিধাবাদীরাও যোগ দিয়ে রাজনীতির বাতাস গরম করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই তীব্র বাকবিতণ্ডা উপরোক্ত দলগুলো এবং তাদের মুখপত্র সংবাদমাধ্যমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ বিষয় নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো উত্সাহ নেই, তাদের কোনো ভূমিকাও নেই। কারণ যে স্বার্থের দায় পূরণ করার জন্য এই দ্বন্দ্ব নির্বাচনী রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে জনস্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। এর কোনো গণতান্ত্রিক চরিত্র নেই।
১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এক দুরতিক্রম্য দ্বন্দ্বের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব হয়েছিল। সে সরকারের মধ্যে তত্কালীন শাসক শ্রেণীর সঙ্কটের প্রতিফলনই ঘটেছিল। কোনো একটি দলের অধীনে বা তাদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের সম্ভাবনা না থাকার কারণেই একমাত্রিক পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হয়েছিল। সুপ্রিমকোর্টের অব্যবহিত পূর্বের প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে এই ব্যবস্থা সংবিধান সংশোধনের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের এমনই অবস্থা যে, জজ সাহেবদের এভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা হলেও এই ব্যবস্থাকে নিজেদের অধীন করার জন্য তারা নিজেদের অনুগত জজ সাহেবদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্য নানা চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এর ফলে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ১৯৯০ সালের সঙ্কট নতুনভাবে মাথাচাড়া দেয় এবং শেষ পর্যন্ত এই দুই দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমস্যা সমাধান করতে অক্ষম হওয়ায় ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের বেনামি সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। এভাবে আবার সামরিক সরকার গঠন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।
বর্তমান সরকার এই সঙ্কটের কোনো পরোয়া না করে গায়ের জোরে নিজেদের সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত ১৯৯৬ সালের সংশোধনী বাতিল করেছে। মজার ব্যাপার এই যে, সে সময়ে বিএনপি সরকার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনার মতো নিজেদের অধীনে যে নির্বাচন করেছিল তাতে অংশগ্রহণ না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করায় তত্কালীন বিএনপি সরকার বাধ্য হয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক সংশোধনী আইন সংসদে পাস করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে শাসক শ্রেণীর রাজনীতির এমনই ভেল্কিবাজি যে, বিএনপি এখন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবক্তা ও দাবিদার এবং আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করে এরই মধ্যে এ বিষয়ে আইন পাস করেছে এবং নিজেদের সরকারের অধীনে বা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এক তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কী ধরনের সরকারের অধীনে হবে এর সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে জনগণের মধ্যে এ নিয়ে কোনো উত্তেজনা বা আন্দোলন নেই। এ সমস্যা শতকরা একশ’ ভাগ শাসক শ্রেণীর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং এই সঙ্গে এ সমস্যা হলো তাদের সাম্রাজ্যবাদী মুরব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সমস্যা। এ কারণে এ বিষয় নিয়ে তারাই আকাশ-বাতাস তোলপাড় করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যা গুরুতরভাবে চিন্তা ও বিবেচনার যোগ্য তা হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারা তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সে চেষ্টা করলে তার অবস্থা ১৯৯৬ সালে বিএনপি কর্তৃক তাদের সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো অথবা তার থেকেও খারাপ হবে। অন্যদিকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে কথা বলছে তা কার্যকর করতে হলে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন ভিত্তিতে কীভাবে গঠিত হবে তার একটা বাস্তবায়নযোগ্য ফর্মুলা তাদের উপস্থিত করতে হবে। জজ সাহেবদের দিয়ে এ সরকার গঠন না করে কোন প্রক্রিয়ায় এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে এটা এক বড় সমস্যা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকা সত্ত্বেও এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত বিএনপি কিছুই বলছে না। এই সঙ্কট নিরসনের জন্য পদ্ধতি নির্ধারণ এক কঠিন সমস্যা। কিন্তু আবার বলা দরকার যে নির্বাচন সম্পর্কিত এসব সমস্যা ও সঙ্কট জনগণের নয়। এসব হলো সম্পূর্ণভাবে শাসক শ্রেণীর নিজস্ব সমস্যা এবং তাদের জোটের শরিক ও তাদের নেজুড় তথাকথিত বামপন্থীদের সঙ্গে নিয়েই এবং সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতার মাধ্যমে তাদেরই এই সমস্যা ও সঙ্কটের সমাধান করতে হবে।
বদরুদ্দীন উমর: লেখক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, যেভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আশির দশক থেকে দ্বন্দ্ব-বিরোধ দানা বাঁধে ও বিকাশ লাভ করে তার সঙ্গে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং এখনও এই দ্বন্দ্ব যে অবস্থায় আছে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। এ হলো এক ধরনের প্রাক-পুঁজিবাদী ও প্রাক-গণতন্ত্র চরিত্র, যার কোনো প্রাসঙ্গিকতা প্রকৃত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও নেই। কারণ বুর্জোয়া গণতন্ত্রে শোষক-শাসক শ্রেণী শোষিত ও শাসিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে থাকলেও এই বিরুদ্ধতার প্রয়োজনেই তারা নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থ ও সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও আবার পরস্পরের সঙ্গে আলোচনায় বসে, নানা ধরনের সমঝোতা করে।
বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই রাজনৈতিক চরিত্র ও সংস্কৃতি নেই। কাজেই প্রাক-পুঁজিবাদী ও প্রাক-গণতন্ত্র চরিত্র নিয়েই এরা এমনভাবে এক দল অন্য দলের বিরোধিতা করে যার কোনো তুলনা বা দৃষ্টান্ত অন্যান্য বুর্জোয়া সমাজে পাওয়া যায় না। ১৯৭২ সাল থেকে লুণ্ঠনজীবী এক ধরনের পেটি বুর্জোয়াদের শাসনে বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত শাসিত হতে থাকার কারণেই শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরেই এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে এবং এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যাতে তাদের সঙ্কটের মীমাংসা তাদের নিজেদের দ্বারা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এই সঙ্কট যে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে তা-ই নয়, সমগ্র অর্থনীতির মধ্যেও যে সঙ্কট আছে তার মূলেই রয়েছে শাসক শ্রেণীর লুণ্ঠনজীবী ও প্রাক-পুঁজিবাদী চরিত্র। এটা যদি না হতো তাহলে বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক-মালিক যে সংঘর্ষ এখন দেখা যাচ্ছে এ সংঘর্ষ নিরসনে সরকার ও মালিক শ্রেণীর পরিবর্তে তৈরি পোশাকের বিদেশি বা সাম্রাজ্যবাদী খরিদ্দারদের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতো না! শুধু তা-ই নয়, এই হস্তক্ষেপের কারণেই এখন সরকার ও মালিক শ্রেণী শ্রমিকদের মজুরি, কাজের শর্ত ইত্যাদি প্রয়োজনীয়ভাবে পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়ার চিন্তাভাবনা করছে!!
রাজনীতি ক্ষেত্রেও নিজেদের সমস্যার মীমাংসা এরা নিজেরা করতে অক্ষম হওয়ায় এবং নিজেদের দ্বন্দ্বকে মীমাংসার অতীত পর্যায়ে এনে দাঁড় করানোর ফলে এখানে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অচলাবস্থা দূর করার জন্যও বিদেশিরা অর্থাত্ এদের সাম্রাজ্যবাদী মুরব্বিরা এখন যথেষ্ট তত্পর। অন্য দেশের জন্য যা অচিন্তনীয় বাংলাদেশে তাই হচ্ছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অন্যান্য কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতরা এখানকার রাজনীতিতে খোলাখুলি হস্তক্ষেপ করছে। নির্বাচন কী ধরনের সরকারের অধীনে হওয়া দরকার, এ বিষয়ে পর্যন্ত তারা নিজেদের বক্তব্য অবাধে প্রদান করছে। এ কাজ কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূতের পক্ষে যে করা যায় না, এটা বলে সরকার বা বিরোধী পক্ষ কেউই কোনো প্রতিবাদ করছে না! এরা ধরেই নিয়েছে যে, বিদেশিদের অর্থাত্ এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীদের এই আচরণ স্বাভাবিক!
আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে, না একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে-এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা এখন চলছে। এ বাকবিতণ্ডায় এখন দুই জোটের সুবিধাবাদী শরিকরা এবং বামপন্থী নামে এক ধরনের সুবিধাবাদীরাও যোগ দিয়ে রাজনীতির বাতাস গরম করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই তীব্র বাকবিতণ্ডা উপরোক্ত দলগুলো এবং তাদের মুখপত্র সংবাদমাধ্যমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ বিষয় নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো উত্সাহ নেই, তাদের কোনো ভূমিকাও নেই। কারণ যে স্বার্থের দায় পূরণ করার জন্য এই দ্বন্দ্ব নির্বাচনী রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে জনস্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। এর কোনো গণতান্ত্রিক চরিত্র নেই।
১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এক দুরতিক্রম্য দ্বন্দ্বের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব হয়েছিল। সে সরকারের মধ্যে তত্কালীন শাসক শ্রেণীর সঙ্কটের প্রতিফলনই ঘটেছিল। কোনো একটি দলের অধীনে বা তাদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের সম্ভাবনা না থাকার কারণেই একমাত্রিক পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হয়েছিল। সুপ্রিমকোর্টের অব্যবহিত পূর্বের প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে এই ব্যবস্থা সংবিধান সংশোধনের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের এমনই অবস্থা যে, জজ সাহেবদের এভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা হলেও এই ব্যবস্থাকে নিজেদের অধীন করার জন্য তারা নিজেদের অনুগত জজ সাহেবদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্য নানা চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এর ফলে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ১৯৯০ সালের সঙ্কট নতুনভাবে মাথাচাড়া দেয় এবং শেষ পর্যন্ত এই দুই দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমস্যা সমাধান করতে অক্ষম হওয়ায় ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের বেনামি সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করে। এভাবে আবার সামরিক সরকার গঠন বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।
বর্তমান সরকার এই সঙ্কটের কোনো পরোয়া না করে গায়ের জোরে নিজেদের সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত ১৯৯৬ সালের সংশোধনী বাতিল করেছে। মজার ব্যাপার এই যে, সে সময়ে বিএনপি সরকার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনার মতো নিজেদের অধীনে যে নির্বাচন করেছিল তাতে অংশগ্রহণ না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করায় তত্কালীন বিএনপি সরকার বাধ্য হয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক সংশোধনী আইন সংসদে পাস করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে শাসক শ্রেণীর রাজনীতির এমনই ভেল্কিবাজি যে, বিএনপি এখন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবক্তা ও দাবিদার এবং আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করে এরই মধ্যে এ বিষয়ে আইন পাস করেছে এবং নিজেদের সরকারের অধীনে বা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এক তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কী ধরনের সরকারের অধীনে হবে এর সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে জনগণের মধ্যে এ নিয়ে কোনো উত্তেজনা বা আন্দোলন নেই। এ সমস্যা শতকরা একশ’ ভাগ শাসক শ্রেণীর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং এই সঙ্গে এ সমস্যা হলো তাদের সাম্রাজ্যবাদী মুরব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সমস্যা। এ কারণে এ বিষয় নিয়ে তারাই আকাশ-বাতাস তোলপাড় করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যা গুরুতরভাবে চিন্তা ও বিবেচনার যোগ্য তা হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারা তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সে চেষ্টা করলে তার অবস্থা ১৯৯৬ সালে বিএনপি কর্তৃক তাদের সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো অথবা তার থেকেও খারাপ হবে। অন্যদিকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে কথা বলছে তা কার্যকর করতে হলে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন ভিত্তিতে কীভাবে গঠিত হবে তার একটা বাস্তবায়নযোগ্য ফর্মুলা তাদের উপস্থিত করতে হবে। জজ সাহেবদের দিয়ে এ সরকার গঠন না করে কোন প্রক্রিয়ায় এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে এটা এক বড় সমস্যা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকা সত্ত্বেও এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত বিএনপি কিছুই বলছে না। এই সঙ্কট নিরসনের জন্য পদ্ধতি নির্ধারণ এক কঠিন সমস্যা। কিন্তু আবার বলা দরকার যে নির্বাচন সম্পর্কিত এসব সমস্যা ও সঙ্কট জনগণের নয়। এসব হলো সম্পূর্ণভাবে শাসক শ্রেণীর নিজস্ব সমস্যা এবং তাদের জোটের শরিক ও তাদের নেজুড় তথাকথিত বামপন্থীদের সঙ্গে নিয়েই এবং সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতার মাধ্যমে তাদেরই এই সমস্যা ও সঙ্কটের সমাধান করতে হবে।
বদরুদ্দীন উমর: লেখক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ।
No comments