বাংলানিউজে রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া ব্লগেঃ শরীর দেখাও, সুপারস্টার হও by পুস্পিতা
লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা ২০১২ এর সেরা পাঁচে স্থান পাওয়া সাদিয়া আর্জুমান্দ বানু সোমার ভাগ্য বিড়ম্বনা নিয়ে বাংলানিউজে প্রকাশিত রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় পুস্পিতা নামে একজন ব্লগার সোনার বাংলাদেশ নামক ব্লগে তার দীর্ঘ মতামত তুলে ধরেছেন।
গত ৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ১ টা ৩৮ মিনিটে তিনি এই মতামতটি পোস্ট করেন।
‘সুপার স্টার প্রতিযোগিতা তার সৌন্দর্যের দাম দিতে গিয়ে মেধা ও ভবিষ্যৎ গড়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে....’ শীর্ষক পোস্টে তিনি লিখেছেন, মেধাবী সোমার ধ্বংস হয়ে যাওয়া শিক্ষাজীবন সেই কথাগুলোর সত্যতাই যেন আবার ফুটিয়ে তুলছে। সোমার চোখে-মুখে-মননে-শরীরে এমন স্বপ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছিল, শিক্ষাজীবন যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তা বুঝার সুযোগই তার হয়নি। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরই সোমা ও তার পরিবার বুঝতে পেরেছে- সুন্দর একটি স্বপ্ন ও জীবন ওই সুন্দরী প্রতিযোগিতা ধ্বংস করে দিয়েছে।
সোমার মতো শতশত নারী এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ওই সব অসভ্য ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রসারের যন্ত্র হতে গিয়ে। সোমার মতো এক মেধাবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখে কি এবার বাকীরা সতর্ক হবে? নাকি সেই আগের মতোই ধ্বংসের পথে ছুঁটে যাবে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার নামে!
এর আগে ব্লগে ওই ধরনের একটি সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে ‘মেধা-বুদ্ধিমত্তা-প্রতিভা নয়, শরীর ও চামড়া হয়ে উঠুক তোমার ভবিষ্যতের নির্মাতা...!’ শিরোনামে লিখেছিলাম, .... এভাবে নারীর মননে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে, সৌন্দর্যই আসল শক্তি। সে সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। কিভাবে? উগ্র মেকআপে, স্বল্প বসনে যতটুকু সম্ভব শরীর না ঢেকে নেমে পড়ো। তোমাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। জ্ঞানের শক্তির কথা নারীর আর মনে থাকবে না। নারীকে হতে হবে সাদা। White Beauty। টার্গেট একটাই, সাদা হবো। তুমি কিছুই পাবে না, যদি চামড়া তোমার সাদা না হয়। আর শুধু সাদা হলেই হবে না, সেই সাদা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যদি সবার সামনে উম্মূক্ত করে দেওয়া না হয়, তাহলে নারীর সবকিছুই বৃথা!
বিজ্ঞাপনের ধারাবাহিকতায় নারীকে বাস্তবে প্রদর্শন ও উম্মুক্ত করতে হবে। তা হতে হবে আরও বাস্তব, আরও ব্যাপক, আরও নিকটে। কিভাবে?
সুন্দরী প্রতিযোগিতা। হাজারো সুন্দরী উম্মূক্ত হবে। তাদের ভেতর থেকে বের করে আনা হবে শারীরিক সৌন্দর্যের সুপার স্টার। নারীর প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে মিলতে হবে পুরুষের স্ট্যান্ডার্ড আকাংখার সঙ্গে। সেই পরীক্ষায় পাশ করতে হলে দেখাতে হবে শরীর, যেভাবে বলা হবে সেভাবে হাঁটতে হবে, বাঁকতে হবে, দুলতে হবে। খোলামেলা হতে হবে বিশেষ পোষাকে। প্রকৃতি নারীত্বের যে অনন্য সৌন্দর্য তোমার শরীরে দিয়েছে তার সবকিছুই উন্মুক্ত করো। বুঝানো হবে শরীর দেখিয়েই তুমি বিখ্যাত ও বড় হতে পারো। মেধা-বুদ্ধিমত্বা-প্রতিভা নয়, শরীর ও চামড়া হয়ে উঠুক তোমার ভবিষ্যতের নির্মাতা।
এবার সুন্দরী ক্রিম মেখে সাদা হয়ে চাকরি পাওয়া বিজ্ঞাপনের সেই কালো মেয়ের পিতা-মাতার মতো সোমার পিতা-মাতার চোখে আনন্দের নয়, কষ্ট ও হতাশার জল দেখা যাচ্ছে। কারণ, বিজ্ঞাপনে সাদা চামড়া চাকরি মিলিয়ে দিলেও বাস্তবে তা হয় না, হতে পারে না। সাদা চামড়া ও শরীরিক সৌন্দর্য সবকিছুর মূল হতে পারে না। প্রয়োজন মেধা, বুদ্ধিমত্বা, প্রতিভা, জ্ঞান, শিক্ষা। মেকাপ করে সোমার শারীরিক সৌন্দর্য সবার সামনে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হলেও সত্যিকারের সফলতা লাভের বাবি সবকিছুই ধ্বংস করে দিয়েছে ওই প্রতিযোগিতা। শুধু কি শিক্ষাজীবন ধ্বংস হচ্ছে? বরং ইজ্জ্বত, আব্রু, শরীর অনেক কিছুই নাকি শেষ করে দিতে হয়।
এর আগে ‘বুঝেছ নারী, শরীর তোমাকে অনেক কিছু দিতে পারে! শরীর দেখাও, সুপার স্টার হও!’ শিরোনামে আরেকটি পোস্টে লিখেছি, কেবল রূপ থাকলেই সুপারস্টার হওয়া যায় না, রূপের পাশাপাশি গুণও থাকতে হয়। সুন্দরীদের রূপ আর গুণ পরখ করার জন্যেই নাকি হচ্ছে ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার কম্পিটিশন। মেয়েদের রূপের পরীক্ষা করা হবে! আচ্ছা রূপের পরীক্ষা মানে কি? শারীরিক সৌন্দর্যের পরীক্ষা?! নারীর মুখ, হাত, পা, শরীরের আঁক-বাঁক সব কিছুর সাইজ নেওয়া হবে?! প্রদর্শন করা হবে?! এরপর যাকে সবচেয়ে বেশি মনে ধরবে তাকেই সুপার স্টার ঘোষণা করা হবে? এভাবে সুপার রূপবতী খুঁজে বের করা হবে?
হ্যাঁ, তাই তো করা হয়। বুঝানো হবে- নারী, শরীর তোমাকে অনেক কিছু দিতে পারে। তাই শরীর দেখাও, কোমর দোলাও, আনন্দ দাও, উম্মূক্ত হও! প্রকৃতি নারীত্বের যা কিছু তোমার শরীরে দিয়েছে সব দাও, সব দেখাও! দেখিয়ে যত বেশি আনন্দ দিতে পারবে তত বেশি পয়েন্ট। পত্রিকায় তোমার ছবি যাবে, টিভিতে তোমার খোলামেলা শরীরে কোমর দোলানো দেখে হাজার হাজার পুরুষের মনে কামনা জেগে উঠবে। এসএমএস-এর জোয়ার বয়ে যাবে।
এভাবে লাক্স তোমাকে সুপার স্টার বানিয়ে দেবে! হাতে দেওয়া হবে কিছু টাকা! চোখে এঁকে দেওয়া হবে রঙিন দুনিয়ার আকর্ষণীয় স্বপ্ন! তোমাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে কিভাবে শারীরিক সৌন্দর্যকে উম্মূক্ত করতে হয়, পুরুষের কামনা জাগিয়ে তুলতে হয়। তারপর নাটকে, বিজ্ঞাপনে হয়ে যাও আকর্ষণীয় পণ্য! এ পণ্যের ক্রেতার অভাব হয় না। লাক্স তোমাকে শরীর বিক্রির পথ দেখিয়ে দিয়েছে, এখন শুধু সামনে এগিয়ে চলা...! ভাল তো! নারী এরপর তার শারীরিক সৌন্দর্যের খেলা শুরু করবে! কত জায়গায় যাবে, কত জনের সঙ্গে মিশবে, কত কিছু দিতে হবে! শুধু দূর থেকে দেখালে তো আর হবে না! সাফল্য পেতে চাইলে খুশি রাখতে হবে!
ওহ হ্যাঁ, সেখানে শুধু রূপের নয়, গুণেরও পরীক্ষা হবে। কি সেই গুণ? নারীর ভেতর যে রূপ, লাবণ্য, সৌন্দর্য আছে তা কত বেশি, ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করা যায়, সে যোগ্যতা দেখা হবে? যার শরীর দেখে পুরুষের দেহ-মনের ভেতর বাঁধ ভাঙা কামনা জেগে উঠবে সে বেশি গুণী? হ্যাঁ, তাই তো দেখা যাচ্ছে। আসলে কি সেখানে আর কোন গুণের পরীক্ষা হয়?
আগেও একবার বলেছিলাম, লজ্জা নামক অনুভূতিটি যখন লোপ পাবে তখন অবাধ যৌনতার গন্ধকে ভুল মনে হবে না। এ সব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য এটি। লজ্জানুভূতি ধ্বংস করে দিয়ে নারীকে পণ্য হিসেবে, পণ্যের সঙ্গে পণ্যের প্রসারে উপস্থাপন করা। পণ্য ও যৌনতার মিল বন্ধন নারীর ভেতর তৈরি করেছে অদ্ভূত মানসিকতা। ফলে নারী নিজেকে সেক্সী হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করছে।
নতুন প্রজন্মকে খুব স্লো পয়জনিং করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে তাদের মগজের ভেতরে থাকা শালীনতা, নৈতিকতাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের বানানো হচ্ছে সেক্স সিম্বল ও প্রোডাক্ট! তাই মেয়েরা নিজেদের মানুষ ভাবার চেয়ে সেক্স সিম্বল হিসেবে ভাবতেই বেশি পছন্দ করছে।
এটা খুব পরিকল্পিত ও ভয়ংকর অনৈতিকতার আগ্রাসন। নারী কি এই ষড়যন্ত্র বুঝার চেষ্ট করছে? কখনও কি তাদের বিবেককে প্রশ্ন করেছে? এ ধরনের অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। লজ্জাহীনতা ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে সাময়িক আনন্দে ডুবে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেখানে না আছে দায়িত্ববোধ, না আছে জবাবদিহিতা, না আছে পারস্পারিক বিশ্বাস, না আছে মৌলিক কোন ভালোলাগা।
মাঝে মাঝে চিন্তা করি, অপসংস্কৃতি কি একটি নষ্ট প্রজন্ম তৈরি করে দিচ্ছে এ জাতিকে? কে রক্ষা করবে এদের? কে এগিয়ে আসবে? অপসংস্কৃতির প্রবল স্রোতের বিপরীতে শক্ত কোন বাঁধ তো দেখা যাচ্ছে না।
‘মেধা-বুদ্ধিমত্ত্বা-প্রতিভা নয়, শরীর ও চামড়া হয়ে উঠুক তোমার ভবিষ্যতের নির্মাতা...!’ শীর্ষক পোস্টে পুষ্পিতা আরও লিখেছেন-
নারী এমনিতেই তার আপন সৌন্দর্যে অনন্যা। আর সে সৌন্দর্যকে যখন নগ্ন প্রকাশে বা দেহের বিশেষ আকৃতিগত প্রদর্শনকে পুঁজি করে প্রকাশ করা হয়, তখন অনেকে সুযোগ নিতে চায়। মানব প্রকৃতি সুযোগ পেলে নিষিদ্ধ বস্তুর দিকে যেতে চায়। অনেকে সুযোগের অভাবে ভদ্র। ওরা যখন সুযোগ পায় তখন তা ভয়ানক রূপ নেয়। দেহ প্রদর্শনীর মাধ্যমে নারী কি সেই সুযোগকে হাতের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে? নারীর সৌন্দর্য ও অনুভূতি যা নারীর সম্পদ বা ভোগাতীত ঐশ্বর্য। কিন্তু সেই সম্পদকে প্রদর্শনীর মাধ্যমে সবার সম্পত্তি বা ভোগ্যবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় সাবান একটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ উপাদান। এটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই প্রয়োজনীয়। কিন্তু অধিকাংশ সাবানের মডেল হিসেবে টার্গেট করা হয়েছে নারীকে। সাবান মাখতে-মাখতে নারী মাঠ-ঘাট-পাহাড়-সমুদ্র মাড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, পাহাড়ি ঝর্ণায়, খোলা আকাশের নীচে উম্মূক্ত চামড়ায় সাবান মাখছে! সাবানের ফেনায় নারী সাদা হচ্ছে, যেন সাবানের প্রধান কাজ নারীকে সাদা করা। এরপর সাবান মেখে সাদা হওয়া নারীকে দেখে রাজপুত্রের চোখের পলক আর পড়ে না! রাজপুত্র এবার কাছে না এসে পারে না!
চামড়া সাদা না হলে এয়ার হোস্টেস হওয়া যাবে না, কোন চাকরি পাওয়া যাবে না! তাই চামড়া সাদা করতেই হবে। এক্ষেত্রে সুন্দরী ক্রিমই ভরসা। আবার তোমার মুখ সাদা কিন্তু গলা, হাত, বুক, পায়ের চামড়া কালো হলে কি চলবে? তাই পুরো শরীরে মাখো সাদা হওয়ার বডি লোশন। এভাবে সাদা হয়ে স্বল্প বসনে পুরুষের সামনে দাঁড়াও, চাকরি আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। খুশিতে তোমার মা-বাবার চোখে জল চলে আসবে।
আসলে পণ্যের ভিড়ে, পণ্যের প্রচারে নারী তার অস্তিত্বকে, নারীত্বকে পণ্যের ন্যায় উপস্থাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বড় আঙ্গিকে দেখলে এক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক ভাষাটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। আর নারীর নিরবতা পুরুষতান্ত্রিক লোলুপ ষড়যন্ত্রকে আরও উৎসাহিত করছে। এভাবে বিজ্ঞাপন, সুন্দরী ও ফ্যাশন প্রতিযোগিতার অসভ্যতাকে শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।
লজ্জ্বা নামক অনুভূতিটি যখন লোপ পাবে, তখন অবাধ যৌনতার গন্ধকে ভূল মনে করবে না। প্রকাশ্য-গোপনে বা দু`চোখের সামনে মানুষ্যত্ববোধ লোপ পাবে। এভাবে নারী হয়ে উঠেছে লোভনীয় এক মাংসপিনণ্ড। পশ্চিমা বিশ্বে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ধ্বংস হয়েছে এ পথে। আমাদের এখানেও শুরু হয়েছে। খুব বেশি দিন হয়তো লাগবে না সম্পূর্ণ মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যেতে। লক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। নারীরা যদি তা বুঝার চেষ্টা করতো! নাকি বুঝেও বুঝে না?
‘সুপার স্টার প্রতিযোগিতা তার সৌন্দর্যের দাম দিতে গিয়ে মেধা ও ভবিষ্যৎ গড়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে....’ শীর্ষক পোস্টে তিনি লিখেছেন, মেধাবী সোমার ধ্বংস হয়ে যাওয়া শিক্ষাজীবন সেই কথাগুলোর সত্যতাই যেন আবার ফুটিয়ে তুলছে। সোমার চোখে-মুখে-মননে-শরীরে এমন স্বপ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছিল, শিক্ষাজীবন যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তা বুঝার সুযোগই তার হয়নি। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরই সোমা ও তার পরিবার বুঝতে পেরেছে- সুন্দর একটি স্বপ্ন ও জীবন ওই সুন্দরী প্রতিযোগিতা ধ্বংস করে দিয়েছে।
সোমার মতো শতশত নারী এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ওই সব অসভ্য ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রসারের যন্ত্র হতে গিয়ে। সোমার মতো এক মেধাবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখে কি এবার বাকীরা সতর্ক হবে? নাকি সেই আগের মতোই ধ্বংসের পথে ছুঁটে যাবে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার নামে!
এর আগে ব্লগে ওই ধরনের একটি সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে ‘মেধা-বুদ্ধিমত্তা-প্রতিভা নয়, শরীর ও চামড়া হয়ে উঠুক তোমার ভবিষ্যতের নির্মাতা...!’ শিরোনামে লিখেছিলাম, .... এভাবে নারীর মননে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে, সৌন্দর্যই আসল শক্তি। সে সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। কিভাবে? উগ্র মেকআপে, স্বল্প বসনে যতটুকু সম্ভব শরীর না ঢেকে নেমে পড়ো। তোমাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। জ্ঞানের শক্তির কথা নারীর আর মনে থাকবে না। নারীকে হতে হবে সাদা। White Beauty। টার্গেট একটাই, সাদা হবো। তুমি কিছুই পাবে না, যদি চামড়া তোমার সাদা না হয়। আর শুধু সাদা হলেই হবে না, সেই সাদা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যদি সবার সামনে উম্মূক্ত করে দেওয়া না হয়, তাহলে নারীর সবকিছুই বৃথা!
বিজ্ঞাপনের ধারাবাহিকতায় নারীকে বাস্তবে প্রদর্শন ও উম্মুক্ত করতে হবে। তা হতে হবে আরও বাস্তব, আরও ব্যাপক, আরও নিকটে। কিভাবে?
সুন্দরী প্রতিযোগিতা। হাজারো সুন্দরী উম্মূক্ত হবে। তাদের ভেতর থেকে বের করে আনা হবে শারীরিক সৌন্দর্যের সুপার স্টার। নারীর প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে মিলতে হবে পুরুষের স্ট্যান্ডার্ড আকাংখার সঙ্গে। সেই পরীক্ষায় পাশ করতে হলে দেখাতে হবে শরীর, যেভাবে বলা হবে সেভাবে হাঁটতে হবে, বাঁকতে হবে, দুলতে হবে। খোলামেলা হতে হবে বিশেষ পোষাকে। প্রকৃতি নারীত্বের যে অনন্য সৌন্দর্য তোমার শরীরে দিয়েছে তার সবকিছুই উন্মুক্ত করো। বুঝানো হবে শরীর দেখিয়েই তুমি বিখ্যাত ও বড় হতে পারো। মেধা-বুদ্ধিমত্বা-প্রতিভা নয়, শরীর ও চামড়া হয়ে উঠুক তোমার ভবিষ্যতের নির্মাতা।
এবার সুন্দরী ক্রিম মেখে সাদা হয়ে চাকরি পাওয়া বিজ্ঞাপনের সেই কালো মেয়ের পিতা-মাতার মতো সোমার পিতা-মাতার চোখে আনন্দের নয়, কষ্ট ও হতাশার জল দেখা যাচ্ছে। কারণ, বিজ্ঞাপনে সাদা চামড়া চাকরি মিলিয়ে দিলেও বাস্তবে তা হয় না, হতে পারে না। সাদা চামড়া ও শরীরিক সৌন্দর্য সবকিছুর মূল হতে পারে না। প্রয়োজন মেধা, বুদ্ধিমত্বা, প্রতিভা, জ্ঞান, শিক্ষা। মেকাপ করে সোমার শারীরিক সৌন্দর্য সবার সামনে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হলেও সত্যিকারের সফলতা লাভের বাবি সবকিছুই ধ্বংস করে দিয়েছে ওই প্রতিযোগিতা। শুধু কি শিক্ষাজীবন ধ্বংস হচ্ছে? বরং ইজ্জ্বত, আব্রু, শরীর অনেক কিছুই নাকি শেষ করে দিতে হয়।
এর আগে ‘বুঝেছ নারী, শরীর তোমাকে অনেক কিছু দিতে পারে! শরীর দেখাও, সুপার স্টার হও!’ শিরোনামে আরেকটি পোস্টে লিখেছি, কেবল রূপ থাকলেই সুপারস্টার হওয়া যায় না, রূপের পাশাপাশি গুণও থাকতে হয়। সুন্দরীদের রূপ আর গুণ পরখ করার জন্যেই নাকি হচ্ছে ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার কম্পিটিশন। মেয়েদের রূপের পরীক্ষা করা হবে! আচ্ছা রূপের পরীক্ষা মানে কি? শারীরিক সৌন্দর্যের পরীক্ষা?! নারীর মুখ, হাত, পা, শরীরের আঁক-বাঁক সব কিছুর সাইজ নেওয়া হবে?! প্রদর্শন করা হবে?! এরপর যাকে সবচেয়ে বেশি মনে ধরবে তাকেই সুপার স্টার ঘোষণা করা হবে? এভাবে সুপার রূপবতী খুঁজে বের করা হবে?
হ্যাঁ, তাই তো করা হয়। বুঝানো হবে- নারী, শরীর তোমাকে অনেক কিছু দিতে পারে। তাই শরীর দেখাও, কোমর দোলাও, আনন্দ দাও, উম্মূক্ত হও! প্রকৃতি নারীত্বের যা কিছু তোমার শরীরে দিয়েছে সব দাও, সব দেখাও! দেখিয়ে যত বেশি আনন্দ দিতে পারবে তত বেশি পয়েন্ট। পত্রিকায় তোমার ছবি যাবে, টিভিতে তোমার খোলামেলা শরীরে কোমর দোলানো দেখে হাজার হাজার পুরুষের মনে কামনা জেগে উঠবে। এসএমএস-এর জোয়ার বয়ে যাবে।
এভাবে লাক্স তোমাকে সুপার স্টার বানিয়ে দেবে! হাতে দেওয়া হবে কিছু টাকা! চোখে এঁকে দেওয়া হবে রঙিন দুনিয়ার আকর্ষণীয় স্বপ্ন! তোমাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে কিভাবে শারীরিক সৌন্দর্যকে উম্মূক্ত করতে হয়, পুরুষের কামনা জাগিয়ে তুলতে হয়। তারপর নাটকে, বিজ্ঞাপনে হয়ে যাও আকর্ষণীয় পণ্য! এ পণ্যের ক্রেতার অভাব হয় না। লাক্স তোমাকে শরীর বিক্রির পথ দেখিয়ে দিয়েছে, এখন শুধু সামনে এগিয়ে চলা...! ভাল তো! নারী এরপর তার শারীরিক সৌন্দর্যের খেলা শুরু করবে! কত জায়গায় যাবে, কত জনের সঙ্গে মিশবে, কত কিছু দিতে হবে! শুধু দূর থেকে দেখালে তো আর হবে না! সাফল্য পেতে চাইলে খুশি রাখতে হবে!
ওহ হ্যাঁ, সেখানে শুধু রূপের নয়, গুণেরও পরীক্ষা হবে। কি সেই গুণ? নারীর ভেতর যে রূপ, লাবণ্য, সৌন্দর্য আছে তা কত বেশি, ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করা যায়, সে যোগ্যতা দেখা হবে? যার শরীর দেখে পুরুষের দেহ-মনের ভেতর বাঁধ ভাঙা কামনা জেগে উঠবে সে বেশি গুণী? হ্যাঁ, তাই তো দেখা যাচ্ছে। আসলে কি সেখানে আর কোন গুণের পরীক্ষা হয়?
আগেও একবার বলেছিলাম, লজ্জা নামক অনুভূতিটি যখন লোপ পাবে তখন অবাধ যৌনতার গন্ধকে ভুল মনে হবে না। এ সব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য এটি। লজ্জানুভূতি ধ্বংস করে দিয়ে নারীকে পণ্য হিসেবে, পণ্যের সঙ্গে পণ্যের প্রসারে উপস্থাপন করা। পণ্য ও যৌনতার মিল বন্ধন নারীর ভেতর তৈরি করেছে অদ্ভূত মানসিকতা। ফলে নারী নিজেকে সেক্সী হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করছে।
নতুন প্রজন্মকে খুব স্লো পয়জনিং করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে তাদের মগজের ভেতরে থাকা শালীনতা, নৈতিকতাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের বানানো হচ্ছে সেক্স সিম্বল ও প্রোডাক্ট! তাই মেয়েরা নিজেদের মানুষ ভাবার চেয়ে সেক্স সিম্বল হিসেবে ভাবতেই বেশি পছন্দ করছে।
এটা খুব পরিকল্পিত ও ভয়ংকর অনৈতিকতার আগ্রাসন। নারী কি এই ষড়যন্ত্র বুঝার চেষ্ট করছে? কখনও কি তাদের বিবেককে প্রশ্ন করেছে? এ ধরনের অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। লজ্জাহীনতা ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে সাময়িক আনন্দে ডুবে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেখানে না আছে দায়িত্ববোধ, না আছে জবাবদিহিতা, না আছে পারস্পারিক বিশ্বাস, না আছে মৌলিক কোন ভালোলাগা।
মাঝে মাঝে চিন্তা করি, অপসংস্কৃতি কি একটি নষ্ট প্রজন্ম তৈরি করে দিচ্ছে এ জাতিকে? কে রক্ষা করবে এদের? কে এগিয়ে আসবে? অপসংস্কৃতির প্রবল স্রোতের বিপরীতে শক্ত কোন বাঁধ তো দেখা যাচ্ছে না।
‘মেধা-বুদ্ধিমত্ত্বা-প্রতিভা নয়, শরীর ও চামড়া হয়ে উঠুক তোমার ভবিষ্যতের নির্মাতা...!’ শীর্ষক পোস্টে পুষ্পিতা আরও লিখেছেন-
নারী এমনিতেই তার আপন সৌন্দর্যে অনন্যা। আর সে সৌন্দর্যকে যখন নগ্ন প্রকাশে বা দেহের বিশেষ আকৃতিগত প্রদর্শনকে পুঁজি করে প্রকাশ করা হয়, তখন অনেকে সুযোগ নিতে চায়। মানব প্রকৃতি সুযোগ পেলে নিষিদ্ধ বস্তুর দিকে যেতে চায়। অনেকে সুযোগের অভাবে ভদ্র। ওরা যখন সুযোগ পায় তখন তা ভয়ানক রূপ নেয়। দেহ প্রদর্শনীর মাধ্যমে নারী কি সেই সুযোগকে হাতের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে? নারীর সৌন্দর্য ও অনুভূতি যা নারীর সম্পদ বা ভোগাতীত ঐশ্বর্য। কিন্তু সেই সম্পদকে প্রদর্শনীর মাধ্যমে সবার সম্পত্তি বা ভোগ্যবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় সাবান একটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ উপাদান। এটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই প্রয়োজনীয়। কিন্তু অধিকাংশ সাবানের মডেল হিসেবে টার্গেট করা হয়েছে নারীকে। সাবান মাখতে-মাখতে নারী মাঠ-ঘাট-পাহাড়-সমুদ্র মাড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, পাহাড়ি ঝর্ণায়, খোলা আকাশের নীচে উম্মূক্ত চামড়ায় সাবান মাখছে! সাবানের ফেনায় নারী সাদা হচ্ছে, যেন সাবানের প্রধান কাজ নারীকে সাদা করা। এরপর সাবান মেখে সাদা হওয়া নারীকে দেখে রাজপুত্রের চোখের পলক আর পড়ে না! রাজপুত্র এবার কাছে না এসে পারে না!
চামড়া সাদা না হলে এয়ার হোস্টেস হওয়া যাবে না, কোন চাকরি পাওয়া যাবে না! তাই চামড়া সাদা করতেই হবে। এক্ষেত্রে সুন্দরী ক্রিমই ভরসা। আবার তোমার মুখ সাদা কিন্তু গলা, হাত, বুক, পায়ের চামড়া কালো হলে কি চলবে? তাই পুরো শরীরে মাখো সাদা হওয়ার বডি লোশন। এভাবে সাদা হয়ে স্বল্প বসনে পুরুষের সামনে দাঁড়াও, চাকরি আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। খুশিতে তোমার মা-বাবার চোখে জল চলে আসবে।
আসলে পণ্যের ভিড়ে, পণ্যের প্রচারে নারী তার অস্তিত্বকে, নারীত্বকে পণ্যের ন্যায় উপস্থাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বড় আঙ্গিকে দেখলে এক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক ভাষাটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। আর নারীর নিরবতা পুরুষতান্ত্রিক লোলুপ ষড়যন্ত্রকে আরও উৎসাহিত করছে। এভাবে বিজ্ঞাপন, সুন্দরী ও ফ্যাশন প্রতিযোগিতার অসভ্যতাকে শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে।
লজ্জ্বা নামক অনুভূতিটি যখন লোপ পাবে, তখন অবাধ যৌনতার গন্ধকে ভূল মনে করবে না। প্রকাশ্য-গোপনে বা দু`চোখের সামনে মানুষ্যত্ববোধ লোপ পাবে। এভাবে নারী হয়ে উঠেছে লোভনীয় এক মাংসপিনণ্ড। পশ্চিমা বিশ্বে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ধ্বংস হয়েছে এ পথে। আমাদের এখানেও শুরু হয়েছে। খুব বেশি দিন হয়তো লাগবে না সম্পূর্ণ মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যেতে। লক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। নারীরা যদি তা বুঝার চেষ্টা করতো! নাকি বুঝেও বুঝে না?
No comments