স্বাস্থ্যসেবা-বিপন্ন মানবতা ও মেডিকেলে ভর্তি :কিছু সুপারিশ by জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী
চিকিৎসকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন না হওয়ার তিনটি মূল কারণ_ ছাত্রাবস্থায় মেডিকেল ছাত্রদের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে পরিচিত করা হয়নি; ইন্টার্নশিপের সময় অত্যন্ত সীমিত _ মাত্র এক বছর, যা শহরের বড় হাসপাতালে ব্যয়িত হয়। এক দল চিকিৎসক গ্রামে অবস্থান করে সেবা দেবেন।
অপরপক্ষে ধনী শ্রেণীর নবীন চিকিৎসকরা শহরের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে অনারারি ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি উচ্চশিক্ষা নিয়ে ওপরতলায় অবস্থান করে নেন। যারা গ্রামে সেবা দিয়েছেন, তারা পেছনে পড়বে, এটা কেমন কথা?
সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে রংপুর মেডিকেল কলেজে জেনারেল ওয়ার্ডের এক দরিদ্র প্রতিবন্ধী রোগীকে জঙ্গলে রেখে আসার কাহিনী দেখিয়েছে। এ কাজ ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে করিয়েছেন একজন চিকিৎসক। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিঁড়ির পাশে চরম অবহেলায় মলমূত্রের মধ্যে পড়ে থাকা ট্রেনে পা কাটা তরুণ ইমতিয়াজের খবর 'এমন অবহেলা!' শিরোনামে প্রথম আলোতে ১৫ নভেম্বর ২০১১ প্রকাশিত হয়েছে।
গত কয়েক মাসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আরও খবর_ ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সের অবহেলায় নবজাতকের মৃত্যু (সমকাল ১১ অক্টোবর, ২০১১), মানিকগঞ্জে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, ক্লিনিক ভাংচুর (প্রথম আলো ও সমকাল ১৩ নভেম্বর, ২০১১)। দাউদকান্দিতে ভুল চিকিৎসায় এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু (সমকাল ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২)। ওই সংবাদে বলা হয়, পরীক্ষার্থী পেটের ব্যথার চিকিৎসা নিতে গেলে ডা. মোজাম্মেল হক একটি ক্যাপসুল ও একটি ইনজেকশন দেন, কিছুক্ষণের মধ্যে রোগীর মৃত্যু হয়। অতীতেও একই রূপ চিকিৎসায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছিল। ওষুধটি কি এজিথ্রোমাইসিন ছিল? অতীতে এজিথ্রোমাইসিনে মৃত্যুর খবর প্রথম আলো ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বিষয়টি জানেন। তিনি তদন্তের নির্দেশ দিলেও কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি বা ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে সম্পর্কে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সিলেটের অদূরে এক প্রাইভেট ক্লিনিকে যথাযথ বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা না নিয়ে একদিনে ৫২ জনের চোখের দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য কেটারেক্ট অপারেশন করায় ২০ জন চোখের পুরো দৃষ্টি হারিয়েছে। দরিদ্র মানুষ বলে কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সংবাদ পত্রিকায় দেখিনি।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোগীদের প্রতি চরম অবহেলা দেখে মর্মাহত হয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, 'ডাক্তাররা অমানুষ, গরিবের রক্তচোষা' (প্রথম আলো ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১২)। ড. মিজানুর রহমানের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন প্রথম আলোতে (৬ মার্চ, ২০১২)।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ 'অফিস সময়ের পর চিকিৎসকের অন্যত্র রোগী দেখার ব্যাপারে তিনি ক্ষতিকর কিছু দেখেননি।' কারণ 'সরকারি চিকিৎসকদের জন্য প্রাইভেট প্র্যাকটিস অবৈধ নয়।' 'রোগীর সংখ্যা বেশি, বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অপ্রতুল। তাই প্রাইভেট প্র্যাকটিসে রোগীদের উপকার হয়।' 'চিকিৎসকরা পুরো জীবনটায় রোগীর সেবায় নিয়োজিত। এমনকি নিজের রোগের চিকিৎসাটাও অনেক চিকিৎসকের করার সময় থাকে না।' হায়রে টাকা! সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরো সময় প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলে আরও বেশি রোগী উপকার পাবেন এবং সরকারি চিকিৎসকের আয়ও বহুগুণ বাড়বে নয় কি? পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এটা তো এমন কিছু অন্যায় নয়!
তদুপরি 'চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস ফির ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই! ডাক্তাররা যথেচ্ছ ফি আদায়ের পাশাপাশি ক্লিনিক থেকে কমিশন খাচ্ছেন।'
হাইকোর্টের বিচারপতি ও জজকোর্টের বিচারকদের বিকেলে প্র্যাকটিস করার সুযোগ দিলে অনেক মক্কেলের উপকার হবে নয় কি? সামরিক কর্মকর্তাদের দুপুর ২টা থেকে প্রাইভেট বাহিনী পরিচালনা করার বৈধ্যতা নয় কেন?
চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, '৪০-৫০% চিকিৎসক সময়মতো হাসপাতালে আসেন না।' স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেছেন, 'গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে তাদের সকাল ৮টায় বিএসএসএমইউতে আসা সম্ভব নয়।'
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক রুহুল হক প্রশ্ন করেছেন, '৩২ টাকার ওষুধের দাম ৬৪ টাকা হয় কী করে? (ভোরের ডাক ১৫ মার্চ, ২০১২ )। রজনিবৃত্তি পর্যায়ের মহিলাদের গায়ে-হাতে ব্যথা-বেদনার জন্য বনানীর প্রেসক্রিপশন পয়েন্টের এক চিকিৎসক সুইস বহুজাতিক নোভারটিসের সঙ্গে ব্যবস্থা করে সরাসরি কোম্পানি থেকে সরবরাহ নিয়ে বাইফসফোনেট গ্রুপের এক্লাস্টা (অপষধংঃধ) ইনজেকশন দেন। একটি ইনজেকশনের মূল্য পঁচিশ হাজার টাকা। বেক্সিমকোর বাইফসফোনেট এলেনডন বা স্কয়ারের অসটেল ট্যাবলেট লিখলে রোগীর মাসে খরচ হতো মাত্র ৭০০ টাকা। জাতীয় ওষুধনীতি-৮২ যথাযথভাবে প্রয়োগ হলে ৩০ ট্যাবলেটের মূল্য মাত্র ৩০০ টাকা হতো।
সবার জন্য স্বাস্থ্য :কিছুদিন আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, যথাযথ স্থানে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। চিকিৎসকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন না হওয়ার তিনটি মূল কারণ_ ছাত্রাবস্থায় মেডিকেল ছাত্রদের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে পরিচিত করা হয়নি; ইন্টার্নশিপের সময় অত্যন্ত সীমিত _ মাত্র এক বছর, যা শহরের বড় হাসপাতালে ব্যয়িত হয়। এক দল চিকিৎসক গ্রামে অবস্থান করে সেবা দেবেন। অপরপক্ষে ধনী শ্রেণীর নবীন চিকিৎসকরা শহরের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে অনারারি ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি উচ্চশিক্ষা নিয়ে ওপরতলায় অবস্থান করে নেন। যারা গ্রামে সেবা দিয়েছেন, তারা পেছনে পড়বে, এটা কেমন কথা?
বর্তমান সরকার চরম শিক্ষক স্বল্পতার মধ্যেও গত তিন বছরে নতুন ২১টি বেসরকারি এবং ৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশে বর্তমানে ৫৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৪ হাজার ২৪৫ জন এবং সরকারি ২২ মেডিকেল কলেজে ২ হাজার ৮১১ জন ছাত্র ভর্তির সুযোগ পায়। ৯টি সরকারি ডেন্টাল কলেজে ৫৬৭ জন এবং ১৪টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে ৮৯০ জন ছাত্র বিডিএস অধ্যয়নের সুযোগ পায়।
২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ৬১ হাজার ১৬২ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে। ২০১১ সালে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ৩৯ হাজার ৭৬৯ জনের অনেকে এবারও মেডিকেলে ভর্তিপ্রার্থী। এ ছাড়া উভয় সালে কয়েক লাখ ছাত্র বিজ্ঞানে এইচএসসিতে জিপিএ ৩ থেকে ৪.৫ পেয়েছে।
২০২৫ সালের মধ্যে 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' বাস্তবায়িত করতে হলে মানবিক গুণসম্পন্ন এক লাখ পঞ্চাশ হাজার চিকিৎসক, চলি্লশ হাজার ডেন্টাল সার্জন, বিশ হাজার ফিজিওথেরাপিস্ট, সমসংখ্যক ফার্মাসিস্ট এবং নূ্যনতম পাঁচ লাখ নার্স, টেকনিশিয়ান ও প্যারামেডিক প্রয়োজন হবে।
মেডিকেলে ভর্তি নিয়ে বিক্ষোভ ও রিট :অতীতে মেডিকেলে ভর্তির যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জিপিএ ৭ ধার্য ছিল। এবারের সরকার জিপিএ ৮কে ভর্তির নিম্নতম যোগ্যতা হিসেবে ধার্য করে। মেডিকেল ও ডেন্টালে মাত্র ৮ হাজার ৫১৩ ছাত্রের ভর্তির সুযোগ আছে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা প্রায় ১ লাখ ছাত্রের। এই সুযোগে সৃষ্টি হয়েছে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত কোচিংবাণিজ্য। শীর্ষে আছে প্রাইমেট, রেটিনা, শুভেচ্ছা ও থ্রি ডক্টর'স একাডেমী। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, 'এরা মাফিয়া থেকেও শক্তিশালী।' এসব সংগঠনের বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সরাসরি শাখা ও ফ্রানচাইজ করা শাখার সংখ্যা প্রায় ১০০। কোচিং পড়া ছাত্রদের 'ম্যাজিক নোট' সরবরাহ করে। আওয়াজ তোলে 'প্রতিবারের মতো এবারও যারা আমাদের কাছে পড়বে, তারা সবাই মেডিকেলে চান্স পাবে।' প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ভুয়া প্রশ্নপত্র বেচাকেনার অভিযোগও এসব কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে আছে।
'প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি না থাকা, কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করা এবং মেধার সুষ্ঠু মূল্যায়নের নিমিত্তে' সরাসরি গ্রেড বিবেচনার ভিত্তিতে মেডিকেলে ভর্তির জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় (সমকাল ১৩ আগস্ট, ২০১২)। পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে বিধায় মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে এবং হাইকোর্টেও রিট দায়ের হয়।
'মেডিকেল ও অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ২৬ আগস্ট, ২০১২ প্রথম আলো ও সমকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন। তিনি লেখেন, 'আমি বিশ্বাস করি, ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে মেডিকেল (বা অন্য কোথায়ও) পড়ার সুযোগ করে দেওয়া চমৎকার ব্যাপার। তবে অস্বচ্ছভাবে হলে এটা কিন্তু খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে।'
অধ্যাপক জাফর ইকবাল আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যত্ন করে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করলে কোচিং সেন্টারে গিয়ে লাভ হয় না, গাইডবইও মুখস্থ করতে হয় না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বছরের ভর্তি পরীক্ষার ফলের ডাটাবেজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, 'এসএসসি এবং এইচএসসিতে খুব ভালো গ্রেড নেই কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় শতকরা ৫০ জন।'
মেডিকেলে ভর্তির জন্য এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো গ্রেড থাকা যথেষ্ট নয়, তাদের মানবিক গুণাবলি আছে কিনা এবং ভবিষ্যতে সে লক্ষ্যকে স্মরণ রাখবে কিনা, ভর্তি পরীক্ষায় তা নির্ণয়ের চেষ্টা করতে হবে। নতুবা মানবতাবিবর্জিত চিকিৎসকের সংখ্যাই ক্রমাগত বাড়বে।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের শ্বশুর কর্নেল এমএম হক ঢাকা মেডিকেল কলেজে কয়েক বছর প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় লিখিতের চেয়ে মৌখিক পরীক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। 'গ্রামের ছেলেমেয়েরা যাতে অধিক হারে ভর্তি হতে পারে সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতেন। শহরের ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের প্রশ্ন করা হতো বাড়ি কোথায়? কখনও গ্রামে গিয়েছ, কীভাবে গিয়েছ? কত মাইল হাঁটতে হয়েছে? দাতব্য ডিসপেনসারিতে কী কী ওষুধ আছে? ইত্যাদি।
ভর্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার হার অতীতের সঙ্গে বর্তমানের খুব বেশি তফাত নেই। কিন্তু ভর্তি সম্পর্কে এত প্রশ্ন ও অভিযোগ ওঠেনি। ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ৩০ আগস্ট কালের কণ্ঠে 'মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা' প্রসঙ্গে প্রবন্ধ লিখেছেন, 'কোচিং ব্যবস্থাটা বাস্তবিক একটা দুষ্ট বাণিজ্যিক ব্যবস্থা_ অতি দ্রুত এর বাড়বাড়ন্ত।' তবে তিনি মূলত সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে আগামী বছর থেকে প্রচলনের সুপারিশ করেছেন।
সত্তর দশকের শেষে কর্নেল এমএম হক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হন। মেডিকেল কারিকুলামে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন, ব্যবহারিক বিজ্ঞানে (ইবযধারড়ৎধষ ঝপরবহপব) অন্তর্ভুক্তি এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্যের পরিধি বৃদ্ধি তার মৌলিক অবদান। এমবিবিএস শিক্ষা ৫ বছরের পরিবর্তে তিনি সাড়ে চার বছর এবং ইন্টার্নশিপ এক বছরের পরিবর্তে ১৮ মাস করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি মানবদরদি দুর্নীতিমুক্ত দূরদর্শী চিকিৎসক ছিলেন। কখনও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেননি। অর্থলিপ্সা না থাকায় সেবাধর্মী মানবতাবোধসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরির স্বপ্ন দেখেছেন অতি সহজে।
কিছু সুপারিশ :১. মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ এবং সেন্টারের রিট আবেদনের দ্বিধাবিভক্ত রায় এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতার বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সমর্থনমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ৩১ আগস্ট টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে 'প্রস্তাবনা' উল্লেখ করে পরীক্ষা দিতে আগ্রহী ছাত্রদের সঙ্গে সমঝোতার দিকে এগোচ্ছেন।
সমঝোতা খারাপ কিছু নয়। তবে সমঝোতা যাতে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলকর হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অগ্রসর হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
অষষ রহফরধ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ গবফরপধষ ঝপরবহপবং ও পৃথিবীর সকল নামকরা মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বিভাগ কিংবা এচঅ-৬ প্রাপ্ত ছাত্ররা মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে।
বাংলাদেশে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের উচ্চ গ্রেড চাওয়ার কারণ কী? ধনী ও নগরবাসীর সন্তানদের বিশেষ সুবিধা দেওয়াই কি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য? আমি মনে করি, চিকিৎসক হওয়ার সুযোগের মানদণ্ড একমাত্র উচ্চতর গ্রেড দিয়ে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। তাদের মানবিক গুণাবলি, কম অর্থলিপ্সা, দরিদ্র রোগীর প্রতি সহমর্মিতা ও আন্তরিক সহৃদয় ব্যবহার, প্রয়োজনে কষ্ট করে গ্রামে দরিদ্র ব্যক্তিকে পরিদর্শন করার মানসিকতা থাকা বাঞ্ছনীয়।
উপরোক্ত বিষয় নিরূপণের জন্য মনস্তত্ত্ববিদ, কমিউনিটি স্বাস্থ্য শিক্ষক, সমাজতত্ত্ববিদদের সহায়তা নতুন করে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের জন্য একটি ছোট প্রসপেক্টাস তৈরি করা প্রয়োজন। এতে উল্লেখ থাকতে হবে যে, পাস করার পর নূ্যনতম তিন বছর ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থান করে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। তিন বছর পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা নিতে পারবে সরকারি অর্থানুকূল্যে।
স্বল্পমেয়াদি ৬ মাসের ডিপ্লোমা বহু উন্নত দেশে প্রচলিত। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে তিন বছর পর সেবাদানের পুরস্কার হিসেবে নবীন চিকিৎসক এনেসথেসিয়া, প্যাথলজি, চক্ষু, নবজাতক ও শিশু, ইএনটি, ব্যাকটেরিওলজি, এক্সরে-আল্ট্রাসনোগ্রাফি প্রভৃতি বিষয়ে ছয় মাস ট্রেনিং নিয়ে ডিপ্লোমা লাভ করে রেজিস্টার বা জুনিয়র কনসালটেন্ট হতে পারবে।
মেডিকেলে ভর্তির ফরমটা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ছাত্রের মনমানসিকতার আভাস বের করা যায়। প্রত্যেক ছাত্রকে প্রতিবছর ২-৬ সপ্তাহ ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থান করে দেশ জানবে এবং স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান শিখবে। ভর্তি ফরমে ছাত্রের পরিবারের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ততা, গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংবাদ জানে কিনা প্রভৃতি বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন থাকলে ভালো হবে।
কোচিং ফি, প্রাইভেট শিক্ষক ফির বিপরীতে মেডিকেল কলেজের মাসিক টিউশন ফি এক হাজার টাকা এবং হোস্টেলের সিট ভাড়া ৫০০ টাকা ধার্য কি অযৌক্তিক হবে? শহরের বস্তিতে গার্মেন্টের মহিলাকর্মী এক সিটের ভাড়া মাসে এক হাজার টাকা দেন।
২. স্বাস্থ্যসেবা টিমওয়ার্ক। ভর্তির ফরমে জিজ্ঞেস করতে হবে এমবিবিএস/বিডিএসে ভর্তির সুযোগ না পেলে অন্য কোনো বিষয় বেছে নেবে? তা নির্ধারণে সহায়তা করার জন্য উল্লেখ করতে হবে যে, নিম্নলিখিত যে কোনো বিষয় অধ্যয়ন করে মানুষের কল্যাণের অংশীদার হওয়া যায়।
ক. ফার্মেসি খ. ফিজিওথেরাপি গ. মাইক্রোবায়োলজি মলিকুলার বায়োলজি ঘ. বায়োকেমিস্ট্রি ঙ. মেডিকেল ফিজিক্স চ. বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ছ. হেলথ ইকোনমিক্স জ. ল্যাবরেটরি মেডিসিন ঝ. তুলনামূলক এনাটমি ও ফিজিওলজি ঞ. বিশ্লেষণাত্মক কেমিস্ট্রি (ত) ইউনানি ও আয়ুর্বেদী প্রভৃতি।
ইন্টার্নশিপ হতে হবে দুই বছরমেয়াদি_ এক বছর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও এক বছর ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে ।
৩. স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক যথার্থ বলেছেন, দীর্ঘ সময় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজি পড়ে ছাত্ররা গ্রেড অর্জন করেছে। তাই এক ঘণ্টায় এসব বিষয় পুনঃপরীক্ষার প্রয়োজন নেই। মাদ্রাসা ও কারিগরিসমেত দেশের ১০ শিক্ষা বোর্ডের মানের প্রশ্ন নিয়ে অহেতুক বিতর্ক এড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সারবত্তা আছে।
৪. বিজ্ঞান বিষয়ে নূ্যনতম এচঅ-৬ পাওয়া অধূমপায়ী ছাত্রদের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে অধিকসংখ্যক গ্রামের ছেলেমেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। দু'চার বছর পূর্বে ভালো গ্রেডে পাস করে থাকলে তাদেরও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া অনুচিত হবে না। অনেক দরিদ্র ভালো ছাত্র অভাবের কারণে কিছু অর্থ উপার্জন করে কয়েক বছর পরে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে চায়। বয়সের বিবেচনা সামরিক, বিজিবি ও পুলিশ বাহিনীতে কাজে আগ্রহীদের জন্য প্রয়োজন হতে পারে অন্য বিভাগে নয়, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়।
বর্তমান শিক্ষা বছরে ২২টি সরকারি মেডিকেল কলেজে অতিরিক্ত এক হাজার ৫০০ আসন এবং ৫৩ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে অতিরিক্ত এক হাজার ৫০০ আসন বাড়ানো অত্যন্ত যৌক্তিক হবে। ডেন্টাল কলেজগুলোতে অতিরিক্ত এক হাজার সিট বাড়ানো ন্যায্য হবে। ফলে মেডিকেল ও ডেন্টালে ছাত্রভর্তির আসন সংখ্যা ৮ হাজার ৫১৩ থেকে বেড়ে গিয়ে ১২ হাজার ৭৬৩ হবে।
৬. ভর্তি পরীক্ষা ২০০ নম্বরে :ক. ৫০ নম্বর থাকবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত গ্রেডের মান বিবেচনার জন্য; খ. ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে ভাষা ও অন্যান্য আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং ইংরেজি ভাষাজ্ঞান নিরীক্ষার জন্য।
এ বছর থেকে সম্ভাব্য নম্বর বিভাজন নিম্নরূপ হতে পারে_ ২৫ নম্বর বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ এবং ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদের জন্য, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে ৪০ নম্বর, ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বিষয়ে ২৫ নম্বর এবং সঠিকভাবে জাতীয় সঙ্গীত লেখার জন্য ১০ নম্বর। গ. ৫০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা হবে ছাত্রের মুক্তিযুদ্ধের উপলব্ধি এবং মানবিক গুণাবলি ও মানসিকতা নির্ণয়ের জন্য। প্রতি পরীক্ষা বোর্ডে মনস্তত্ত্ববিদ, মুক্তিযোদ্ধা, কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষক ও স্থানীয় পর্যায়ের মহিলা প্রতিনিধি থাকবেন। মৌখিক পরীক্ষায় ৫ নম্বর বরাদ্দ থাকবে সকল নিয়মিত আবেদনকারীর জন্য। সুন্দর হাতের লেখা ও ভর্তির আবেদনপত্রের উত্তরের জন্যও নম্বর বরাদ্দ থাকবে।
৭. ২০২৫ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে অধিকসংখ্যক ছাত্রকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভাগে ভর্তি করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ক. আগামী তিন বছরের মধ্যে সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ফিজিওথেরাপি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মেসি, মেডিকেল ফিজিক্স, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ল্যাবরেটরি মেডিসিন, তুলনামূলক এনাটমি ও ফিজিওলজি প্রভৃতি বিভাগ চালু করা অতীব প্রয়োজন।
খ. জাতীয় প্রয়োজন ও অত্যধিক ছাত্রদের মেডিকেল শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ নিবৃত্তির জন্য বিএসএমএমইউর স্নাতকোত্তর ছাত্র ও ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের বুঝিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ২০০ ছাত্রের এমবিবিএস এবং ৫০ ছাত্রের বিডিএসে ভর্তির ব্যবস্থা নিন। পূর্বে বিএসএমএমইউতে এমবিবিএস ও বিডিএস পড়ানো হতো। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুতে চারশ'র মতো বিভিন্ন বিষয়ের সহকারী, সহযোগী এবং পূর্ণ অধ্যাপক আছেন। ৬০০-এর অধিক অন্যান্য চিকিৎসক আছেন। বর্তমানে তাদের সপ্তাহে ১৬ ঘণ্টাও কাজ নেই (প্রথম আলো ৩০ জুন, ২০১২)।
গ. মেডিকেল শিক্ষকের চরম অভাবহেতু আগামী কয়েক বছর নতুন কোনো মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ খোলার অনুমতি দেওয়া অনুচিত হবে। তবে বর্তমান সকল প্রাইভেট মেডিকেল কলেজকে ২৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় হবে।
ঘ. প্রতি বছর নূ্যনতম ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এইচএসসি পাস ২৫ জন পারামেডিক এবং ২৫ ডিপ্লোমা পাস নার্সকে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ দেওয়া দেশের জন্য কল্যাণকর এবং দূরদর্শিতার পরিচায়ক হবে।
জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী : জনগণের স্বাস্থ্য আন্দোলনের প্রবক্তা ও ট্রাষ্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র
সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে রংপুর মেডিকেল কলেজে জেনারেল ওয়ার্ডের এক দরিদ্র প্রতিবন্ধী রোগীকে জঙ্গলে রেখে আসার কাহিনী দেখিয়েছে। এ কাজ ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে করিয়েছেন একজন চিকিৎসক। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিঁড়ির পাশে চরম অবহেলায় মলমূত্রের মধ্যে পড়ে থাকা ট্রেনে পা কাটা তরুণ ইমতিয়াজের খবর 'এমন অবহেলা!' শিরোনামে প্রথম আলোতে ১৫ নভেম্বর ২০১১ প্রকাশিত হয়েছে।
গত কয়েক মাসে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আরও খবর_ ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সের অবহেলায় নবজাতকের মৃত্যু (সমকাল ১১ অক্টোবর, ২০১১), মানিকগঞ্জে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, ক্লিনিক ভাংচুর (প্রথম আলো ও সমকাল ১৩ নভেম্বর, ২০১১)। দাউদকান্দিতে ভুল চিকিৎসায় এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু (সমকাল ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২)। ওই সংবাদে বলা হয়, পরীক্ষার্থী পেটের ব্যথার চিকিৎসা নিতে গেলে ডা. মোজাম্মেল হক একটি ক্যাপসুল ও একটি ইনজেকশন দেন, কিছুক্ষণের মধ্যে রোগীর মৃত্যু হয়। অতীতেও একই রূপ চিকিৎসায় সাতজনের মৃত্যু হয়েছিল। ওষুধটি কি এজিথ্রোমাইসিন ছিল? অতীতে এজিথ্রোমাইসিনে মৃত্যুর খবর প্রথম আলো ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বিষয়টি জানেন। তিনি তদন্তের নির্দেশ দিলেও কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি বা ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে সম্পর্কে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সিলেটের অদূরে এক প্রাইভেট ক্লিনিকে যথাযথ বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা না নিয়ে একদিনে ৫২ জনের চোখের দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য কেটারেক্ট অপারেশন করায় ২০ জন চোখের পুরো দৃষ্টি হারিয়েছে। দরিদ্র মানুষ বলে কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সংবাদ পত্রিকায় দেখিনি।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোগীদের প্রতি চরম অবহেলা দেখে মর্মাহত হয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, 'ডাক্তাররা অমানুষ, গরিবের রক্তচোষা' (প্রথম আলো ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১২)। ড. মিজানুর রহমানের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন প্রথম আলোতে (৬ মার্চ, ২০১২)।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ 'অফিস সময়ের পর চিকিৎসকের অন্যত্র রোগী দেখার ব্যাপারে তিনি ক্ষতিকর কিছু দেখেননি।' কারণ 'সরকারি চিকিৎসকদের জন্য প্রাইভেট প্র্যাকটিস অবৈধ নয়।' 'রোগীর সংখ্যা বেশি, বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অপ্রতুল। তাই প্রাইভেট প্র্যাকটিসে রোগীদের উপকার হয়।' 'চিকিৎসকরা পুরো জীবনটায় রোগীর সেবায় নিয়োজিত। এমনকি নিজের রোগের চিকিৎসাটাও অনেক চিকিৎসকের করার সময় থাকে না।' হায়রে টাকা! সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরো সময় প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলে আরও বেশি রোগী উপকার পাবেন এবং সরকারি চিকিৎসকের আয়ও বহুগুণ বাড়বে নয় কি? পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় এটা তো এমন কিছু অন্যায় নয়!
তদুপরি 'চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস ফির ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই! ডাক্তাররা যথেচ্ছ ফি আদায়ের পাশাপাশি ক্লিনিক থেকে কমিশন খাচ্ছেন।'
হাইকোর্টের বিচারপতি ও জজকোর্টের বিচারকদের বিকেলে প্র্যাকটিস করার সুযোগ দিলে অনেক মক্কেলের উপকার হবে নয় কি? সামরিক কর্মকর্তাদের দুপুর ২টা থেকে প্রাইভেট বাহিনী পরিচালনা করার বৈধ্যতা নয় কেন?
চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, '৪০-৫০% চিকিৎসক সময়মতো হাসপাতালে আসেন না।' স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেছেন, 'গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে তাদের সকাল ৮টায় বিএসএসএমইউতে আসা সম্ভব নয়।'
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক রুহুল হক প্রশ্ন করেছেন, '৩২ টাকার ওষুধের দাম ৬৪ টাকা হয় কী করে? (ভোরের ডাক ১৫ মার্চ, ২০১২ )। রজনিবৃত্তি পর্যায়ের মহিলাদের গায়ে-হাতে ব্যথা-বেদনার জন্য বনানীর প্রেসক্রিপশন পয়েন্টের এক চিকিৎসক সুইস বহুজাতিক নোভারটিসের সঙ্গে ব্যবস্থা করে সরাসরি কোম্পানি থেকে সরবরাহ নিয়ে বাইফসফোনেট গ্রুপের এক্লাস্টা (অপষধংঃধ) ইনজেকশন দেন। একটি ইনজেকশনের মূল্য পঁচিশ হাজার টাকা। বেক্সিমকোর বাইফসফোনেট এলেনডন বা স্কয়ারের অসটেল ট্যাবলেট লিখলে রোগীর মাসে খরচ হতো মাত্র ৭০০ টাকা। জাতীয় ওষুধনীতি-৮২ যথাযথভাবে প্রয়োগ হলে ৩০ ট্যাবলেটের মূল্য মাত্র ৩০০ টাকা হতো।
সবার জন্য স্বাস্থ্য :কিছুদিন আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, যথাযথ স্থানে নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। চিকিৎসকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন না হওয়ার তিনটি মূল কারণ_ ছাত্রাবস্থায় মেডিকেল ছাত্রদের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে পরিচিত করা হয়নি; ইন্টার্নশিপের সময় অত্যন্ত সীমিত _ মাত্র এক বছর, যা শহরের বড় হাসপাতালে ব্যয়িত হয়। এক দল চিকিৎসক গ্রামে অবস্থান করে সেবা দেবেন। অপরপক্ষে ধনী শ্রেণীর নবীন চিকিৎসকরা শহরের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে অনারারি ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি উচ্চশিক্ষা নিয়ে ওপরতলায় অবস্থান করে নেন। যারা গ্রামে সেবা দিয়েছেন, তারা পেছনে পড়বে, এটা কেমন কথা?
বর্তমান সরকার চরম শিক্ষক স্বল্পতার মধ্যেও গত তিন বছরে নতুন ২১টি বেসরকারি এবং ৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশে বর্তমানে ৫৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৪ হাজার ২৪৫ জন এবং সরকারি ২২ মেডিকেল কলেজে ২ হাজার ৮১১ জন ছাত্র ভর্তির সুযোগ পায়। ৯টি সরকারি ডেন্টাল কলেজে ৫৬৭ জন এবং ১৪টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে ৮৯০ জন ছাত্র বিডিএস অধ্যয়নের সুযোগ পায়।
২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ৬১ হাজার ১৬২ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে। ২০১১ সালে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ৩৯ হাজার ৭৬৯ জনের অনেকে এবারও মেডিকেলে ভর্তিপ্রার্থী। এ ছাড়া উভয় সালে কয়েক লাখ ছাত্র বিজ্ঞানে এইচএসসিতে জিপিএ ৩ থেকে ৪.৫ পেয়েছে।
২০২৫ সালের মধ্যে 'সবার জন্য স্বাস্থ্য' বাস্তবায়িত করতে হলে মানবিক গুণসম্পন্ন এক লাখ পঞ্চাশ হাজার চিকিৎসক, চলি্লশ হাজার ডেন্টাল সার্জন, বিশ হাজার ফিজিওথেরাপিস্ট, সমসংখ্যক ফার্মাসিস্ট এবং নূ্যনতম পাঁচ লাখ নার্স, টেকনিশিয়ান ও প্যারামেডিক প্রয়োজন হবে।
মেডিকেলে ভর্তি নিয়ে বিক্ষোভ ও রিট :অতীতে মেডিকেলে ভর্তির যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জিপিএ ৭ ধার্য ছিল। এবারের সরকার জিপিএ ৮কে ভর্তির নিম্নতম যোগ্যতা হিসেবে ধার্য করে। মেডিকেল ও ডেন্টালে মাত্র ৮ হাজার ৫১৩ ছাত্রের ভর্তির সুযোগ আছে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা প্রায় ১ লাখ ছাত্রের। এই সুযোগে সৃষ্টি হয়েছে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত কোচিংবাণিজ্য। শীর্ষে আছে প্রাইমেট, রেটিনা, শুভেচ্ছা ও থ্রি ডক্টর'স একাডেমী। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, 'এরা মাফিয়া থেকেও শক্তিশালী।' এসব সংগঠনের বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সরাসরি শাখা ও ফ্রানচাইজ করা শাখার সংখ্যা প্রায় ১০০। কোচিং পড়া ছাত্রদের 'ম্যাজিক নোট' সরবরাহ করে। আওয়াজ তোলে 'প্রতিবারের মতো এবারও যারা আমাদের কাছে পড়বে, তারা সবাই মেডিকেলে চান্স পাবে।' প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ভুয়া প্রশ্নপত্র বেচাকেনার অভিযোগও এসব কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে আছে।
'প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি না থাকা, কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করা এবং মেধার সুষ্ঠু মূল্যায়নের নিমিত্তে' সরাসরি গ্রেড বিবেচনার ভিত্তিতে মেডিকেলে ভর্তির জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় (সমকাল ১৩ আগস্ট, ২০১২)। পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে বিধায় মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করে এবং হাইকোর্টেও রিট দায়ের হয়।
'মেডিকেল ও অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ২৬ আগস্ট, ২০১২ প্রথম আলো ও সমকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন। তিনি লেখেন, 'আমি বিশ্বাস করি, ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে মেডিকেল (বা অন্য কোথায়ও) পড়ার সুযোগ করে দেওয়া চমৎকার ব্যাপার। তবে অস্বচ্ছভাবে হলে এটা কিন্তু খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে।'
অধ্যাপক জাফর ইকবাল আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যত্ন করে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করলে কোচিং সেন্টারে গিয়ে লাভ হয় না, গাইডবইও মুখস্থ করতে হয় না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বছরের ভর্তি পরীক্ষার ফলের ডাটাবেজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, 'এসএসসি এবং এইচএসসিতে খুব ভালো গ্রেড নেই কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় শতকরা ৫০ জন।'
মেডিকেলে ভর্তির জন্য এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো গ্রেড থাকা যথেষ্ট নয়, তাদের মানবিক গুণাবলি আছে কিনা এবং ভবিষ্যতে সে লক্ষ্যকে স্মরণ রাখবে কিনা, ভর্তি পরীক্ষায় তা নির্ণয়ের চেষ্টা করতে হবে। নতুবা মানবতাবিবর্জিত চিকিৎসকের সংখ্যাই ক্রমাগত বাড়বে।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের শ্বশুর কর্নেল এমএম হক ঢাকা মেডিকেল কলেজে কয়েক বছর প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় লিখিতের চেয়ে মৌখিক পরীক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। 'গ্রামের ছেলেমেয়েরা যাতে অধিক হারে ভর্তি হতে পারে সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতেন। শহরের ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের প্রশ্ন করা হতো বাড়ি কোথায়? কখনও গ্রামে গিয়েছ, কীভাবে গিয়েছ? কত মাইল হাঁটতে হয়েছে? দাতব্য ডিসপেনসারিতে কী কী ওষুধ আছে? ইত্যাদি।
ভর্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার হার অতীতের সঙ্গে বর্তমানের খুব বেশি তফাত নেই। কিন্তু ভর্তি সম্পর্কে এত প্রশ্ন ও অভিযোগ ওঠেনি। ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ৩০ আগস্ট কালের কণ্ঠে 'মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা' প্রসঙ্গে প্রবন্ধ লিখেছেন, 'কোচিং ব্যবস্থাটা বাস্তবিক একটা দুষ্ট বাণিজ্যিক ব্যবস্থা_ অতি দ্রুত এর বাড়বাড়ন্ত।' তবে তিনি মূলত সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে আগামী বছর থেকে প্রচলনের সুপারিশ করেছেন।
সত্তর দশকের শেষে কর্নেল এমএম হক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হন। মেডিকেল কারিকুলামে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন, ব্যবহারিক বিজ্ঞানে (ইবযধারড়ৎধষ ঝপরবহপব) অন্তর্ভুক্তি এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্যের পরিধি বৃদ্ধি তার মৌলিক অবদান। এমবিবিএস শিক্ষা ৫ বছরের পরিবর্তে তিনি সাড়ে চার বছর এবং ইন্টার্নশিপ এক বছরের পরিবর্তে ১৮ মাস করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি মানবদরদি দুর্নীতিমুক্ত দূরদর্শী চিকিৎসক ছিলেন। কখনও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেননি। অর্থলিপ্সা না থাকায় সেবাধর্মী মানবতাবোধসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরির স্বপ্ন দেখেছেন অতি সহজে।
কিছু সুপারিশ :১. মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ এবং সেন্টারের রিট আবেদনের দ্বিধাবিভক্ত রায় এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতার বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সমর্থনমূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ৩১ আগস্ট টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে 'প্রস্তাবনা' উল্লেখ করে পরীক্ষা দিতে আগ্রহী ছাত্রদের সঙ্গে সমঝোতার দিকে এগোচ্ছেন।
সমঝোতা খারাপ কিছু নয়। তবে সমঝোতা যাতে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলকর হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অগ্রসর হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
অষষ রহফরধ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ গবফরপধষ ঝপরবহপবং ও পৃথিবীর সকল নামকরা মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বিভাগ কিংবা এচঅ-৬ প্রাপ্ত ছাত্ররা মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে।
বাংলাদেশে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের উচ্চ গ্রেড চাওয়ার কারণ কী? ধনী ও নগরবাসীর সন্তানদের বিশেষ সুবিধা দেওয়াই কি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য? আমি মনে করি, চিকিৎসক হওয়ার সুযোগের মানদণ্ড একমাত্র উচ্চতর গ্রেড দিয়ে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। তাদের মানবিক গুণাবলি, কম অর্থলিপ্সা, দরিদ্র রোগীর প্রতি সহমর্মিতা ও আন্তরিক সহৃদয় ব্যবহার, প্রয়োজনে কষ্ট করে গ্রামে দরিদ্র ব্যক্তিকে পরিদর্শন করার মানসিকতা থাকা বাঞ্ছনীয়।
উপরোক্ত বিষয় নিরূপণের জন্য মনস্তত্ত্ববিদ, কমিউনিটি স্বাস্থ্য শিক্ষক, সমাজতত্ত্ববিদদের সহায়তা নতুন করে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের জন্য একটি ছোট প্রসপেক্টাস তৈরি করা প্রয়োজন। এতে উল্লেখ থাকতে হবে যে, পাস করার পর নূ্যনতম তিন বছর ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থান করে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। তিন বছর পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা নিতে পারবে সরকারি অর্থানুকূল্যে।
স্বল্পমেয়াদি ৬ মাসের ডিপ্লোমা বহু উন্নত দেশে প্রচলিত। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে তিন বছর পর সেবাদানের পুরস্কার হিসেবে নবীন চিকিৎসক এনেসথেসিয়া, প্যাথলজি, চক্ষু, নবজাতক ও শিশু, ইএনটি, ব্যাকটেরিওলজি, এক্সরে-আল্ট্রাসনোগ্রাফি প্রভৃতি বিষয়ে ছয় মাস ট্রেনিং নিয়ে ডিপ্লোমা লাভ করে রেজিস্টার বা জুনিয়র কনসালটেন্ট হতে পারবে।
মেডিকেলে ভর্তির ফরমটা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে ছাত্রের মনমানসিকতার আভাস বের করা যায়। প্রত্যেক ছাত্রকে প্রতিবছর ২-৬ সপ্তাহ ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থান করে দেশ জানবে এবং স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান শিখবে। ভর্তি ফরমে ছাত্রের পরিবারের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ততা, গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংবাদ জানে কিনা প্রভৃতি বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন থাকলে ভালো হবে।
কোচিং ফি, প্রাইভেট শিক্ষক ফির বিপরীতে মেডিকেল কলেজের মাসিক টিউশন ফি এক হাজার টাকা এবং হোস্টেলের সিট ভাড়া ৫০০ টাকা ধার্য কি অযৌক্তিক হবে? শহরের বস্তিতে গার্মেন্টের মহিলাকর্মী এক সিটের ভাড়া মাসে এক হাজার টাকা দেন।
২. স্বাস্থ্যসেবা টিমওয়ার্ক। ভর্তির ফরমে জিজ্ঞেস করতে হবে এমবিবিএস/বিডিএসে ভর্তির সুযোগ না পেলে অন্য কোনো বিষয় বেছে নেবে? তা নির্ধারণে সহায়তা করার জন্য উল্লেখ করতে হবে যে, নিম্নলিখিত যে কোনো বিষয় অধ্যয়ন করে মানুষের কল্যাণের অংশীদার হওয়া যায়।
ক. ফার্মেসি খ. ফিজিওথেরাপি গ. মাইক্রোবায়োলজি মলিকুলার বায়োলজি ঘ. বায়োকেমিস্ট্রি ঙ. মেডিকেল ফিজিক্স চ. বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ছ. হেলথ ইকোনমিক্স জ. ল্যাবরেটরি মেডিসিন ঝ. তুলনামূলক এনাটমি ও ফিজিওলজি ঞ. বিশ্লেষণাত্মক কেমিস্ট্রি (ত) ইউনানি ও আয়ুর্বেদী প্রভৃতি।
ইন্টার্নশিপ হতে হবে দুই বছরমেয়াদি_ এক বছর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও এক বছর ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে ।
৩. স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক যথার্থ বলেছেন, দীর্ঘ সময় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজি পড়ে ছাত্ররা গ্রেড অর্জন করেছে। তাই এক ঘণ্টায় এসব বিষয় পুনঃপরীক্ষার প্রয়োজন নেই। মাদ্রাসা ও কারিগরিসমেত দেশের ১০ শিক্ষা বোর্ডের মানের প্রশ্ন নিয়ে অহেতুক বিতর্ক এড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে সারবত্তা আছে।
৪. বিজ্ঞান বিষয়ে নূ্যনতম এচঅ-৬ পাওয়া অধূমপায়ী ছাত্রদের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে অধিকসংখ্যক গ্রামের ছেলেমেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। দু'চার বছর পূর্বে ভালো গ্রেডে পাস করে থাকলে তাদেরও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া অনুচিত হবে না। অনেক দরিদ্র ভালো ছাত্র অভাবের কারণে কিছু অর্থ উপার্জন করে কয়েক বছর পরে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হতে চায়। বয়সের বিবেচনা সামরিক, বিজিবি ও পুলিশ বাহিনীতে কাজে আগ্রহীদের জন্য প্রয়োজন হতে পারে অন্য বিভাগে নয়, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়।
বর্তমান শিক্ষা বছরে ২২টি সরকারি মেডিকেল কলেজে অতিরিক্ত এক হাজার ৫০০ আসন এবং ৫৩ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে অতিরিক্ত এক হাজার ৫০০ আসন বাড়ানো অত্যন্ত যৌক্তিক হবে। ডেন্টাল কলেজগুলোতে অতিরিক্ত এক হাজার সিট বাড়ানো ন্যায্য হবে। ফলে মেডিকেল ও ডেন্টালে ছাত্রভর্তির আসন সংখ্যা ৮ হাজার ৫১৩ থেকে বেড়ে গিয়ে ১২ হাজার ৭৬৩ হবে।
৬. ভর্তি পরীক্ষা ২০০ নম্বরে :ক. ৫০ নম্বর থাকবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত গ্রেডের মান বিবেচনার জন্য; খ. ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে ভাষা ও অন্যান্য আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং ইংরেজি ভাষাজ্ঞান নিরীক্ষার জন্য।
এ বছর থেকে সম্ভাব্য নম্বর বিভাজন নিম্নরূপ হতে পারে_ ২৫ নম্বর বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ এবং ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদের জন্য, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে ৪০ নম্বর, ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বিষয়ে ২৫ নম্বর এবং সঠিকভাবে জাতীয় সঙ্গীত লেখার জন্য ১০ নম্বর। গ. ৫০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা হবে ছাত্রের মুক্তিযুদ্ধের উপলব্ধি এবং মানবিক গুণাবলি ও মানসিকতা নির্ণয়ের জন্য। প্রতি পরীক্ষা বোর্ডে মনস্তত্ত্ববিদ, মুক্তিযোদ্ধা, কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষক ও স্থানীয় পর্যায়ের মহিলা প্রতিনিধি থাকবেন। মৌখিক পরীক্ষায় ৫ নম্বর বরাদ্দ থাকবে সকল নিয়মিত আবেদনকারীর জন্য। সুন্দর হাতের লেখা ও ভর্তির আবেদনপত্রের উত্তরের জন্যও নম্বর বরাদ্দ থাকবে।
৭. ২০২৫ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে অধিকসংখ্যক ছাত্রকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভাগে ভর্তি করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ক. আগামী তিন বছরের মধ্যে সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ফিজিওথেরাপি, মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মেসি, মেডিকেল ফিজিক্স, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ল্যাবরেটরি মেডিসিন, তুলনামূলক এনাটমি ও ফিজিওলজি প্রভৃতি বিভাগ চালু করা অতীব প্রয়োজন।
খ. জাতীয় প্রয়োজন ও অত্যধিক ছাত্রদের মেডিকেল শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ নিবৃত্তির জন্য বিএসএমএমইউর স্নাতকোত্তর ছাত্র ও ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের বুঝিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে ২০০ ছাত্রের এমবিবিএস এবং ৫০ ছাত্রের বিডিএসে ভর্তির ব্যবস্থা নিন। পূর্বে বিএসএমএমইউতে এমবিবিএস ও বিডিএস পড়ানো হতো। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুতে চারশ'র মতো বিভিন্ন বিষয়ের সহকারী, সহযোগী এবং পূর্ণ অধ্যাপক আছেন। ৬০০-এর অধিক অন্যান্য চিকিৎসক আছেন। বর্তমানে তাদের সপ্তাহে ১৬ ঘণ্টাও কাজ নেই (প্রথম আলো ৩০ জুন, ২০১২)।
গ. মেডিকেল শিক্ষকের চরম অভাবহেতু আগামী কয়েক বছর নতুন কোনো মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ খোলার অনুমতি দেওয়া অনুচিত হবে। তবে বর্তমান সকল প্রাইভেট মেডিকেল কলেজকে ২৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয় হবে।
ঘ. প্রতি বছর নূ্যনতম ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এইচএসসি পাস ২৫ জন পারামেডিক এবং ২৫ ডিপ্লোমা পাস নার্সকে এমবিবিএস পড়ার সুযোগ দেওয়া দেশের জন্য কল্যাণকর এবং দূরদর্শিতার পরিচায়ক হবে।
জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী : জনগণের স্বাস্থ্য আন্দোলনের প্রবক্তা ও ট্রাষ্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র
No comments