আমরা বাঙালি নই, আমাদের নিজস্ব পরিচয় আছে by লিটুস চিরান
আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতির দাবি বাংলাদেশে বসবাসরত সান্তাল, উরাঁও, গারো, হাজং, চাকমা, মারমা, কোচ, মগ, ত্রিপুরা ইত্যাদি জনগোষ্ঠির দীর্ঘ দিনের। বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই আত্মপরিচয়ের সংগ্রামসহ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত এ জাতিগুলো আজ অবধি তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূমির অধিকার পায়নি।
বাংলাদেশের বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠির মতো এ সকল জনগোষ্ঠিও চেয়েছিল বাংলাদেশে নিজস্ব পরিচয়ে বাঁচতে! কিন্তু আদিবাসীদের সে স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল ১৯৭২ সালের সংবিধান গৃহীত হবার পর।
প্রয়াত আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালের জাতীয় সংসদে গণপরিষদের অধিবেশনে (যে অধিবেশন সংবিধান সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়) প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এ সকল জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণের জন্য। “তোমরা সবাই বাঙালি হয়ে যাও” জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সেই দাবির তীব্র বিরোধিতা করে তিনি মাননীয় স্পিকারের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে বলেছিলেন “মাননীয় স্পিকার আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দ পুরুষ-কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি। আমাদের বাঙালি জাতি বলে কখনো বলা হয়নি, আমার পূর্ব পুরুষরাও কখনও ও নামে পরিচিত হননি, আমার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। আমরা আমাদের বাংলাদেশী মনে করি এবং বিশ্বাস করি কিন্তু বাঙালি বলে নয়।”
কিন্ত তার সেই আত্মপরিচয়ের দাবি বাঙালি জাতির জ্যাত্যাভিমানে পিষ্ট হয়ে মহান সংসদে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, তিনি বাধ্য হয়েছিলেন মহান সংসদ থেকে ওয়াক আউট করতে। আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের স্বপ্নও ধুলিসাৎ হয়েছিল।
বর্তমান মহাজোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের কথা গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করেছিল এবং বলেছিল আদিবাসীদের জীবনে শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটাতে তারা কাজ করবে। মহাজোটের অনেক নেতা (যারা বর্তমানে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন) আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন, পাশে থাকার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দেবার কথা।
মহাজোট সরকারের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বে আদিবাসী জনগণ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। আদিবাসীরা আত্মপরিচয়ের অধিকার ফিরে পাবে, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দেবে সরকার। তাদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। তাদের প্রতি শত শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, উচ্ছেদের হবে অবসান, তারা নতুন করে সাজাবে তাদের জীবন, বাঁধবে নতুন জীবন, যেখানে থাকবে না কোনো শোষণ, বৈষম্য ও অবিচার। কিন্তু আদিবাসীদের সে আশা আজ ভেঙে গেছে।
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩ক অনুচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব পরিচয় বিলুপ্ত করে মহাজোট সরকার নতুন নামে “ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠি (পুর্বে উপজাতি)” নামে অভিহিত করলেন এবং ৬(২) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে অনেকটা জোর করেই আদিবাসীদের বাঙালি করা হলো যা আদিবাসীদের জন্য সত্যিই অবমাননাকর ও লজ্জাজনক।
আদিবাসীদের সাথে কোন আলাপ আলোচনা না করেই গৃহীত হলো “ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০” এবং সর্বশেষ এ বছর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে দেশের আদিবাসীদের বসবাসকৃত জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের আদিবাসী দিবসে উদযাপনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হলো। কোনো সভ্য সমাজে এটা সম্ভব কি না জানি না কিন্তু বাংলাদেশে তা সম্ভব হলো! আজ আদিবাসী সমাজ হতাশ! তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার আবারও হরণ করে নিল সরকার!
যদি এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকতো তবুও হয়তো আদিবাসীদের আশার কিছু থাকত! কিন্তু এর পর যা হলো তাতে আদিবাসীদের আর কিছু আশা করার থাকে কী? রাষ্ট্র তার প্রতিনিধির মাধ্যমে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে ঘোষণা করল যে, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, এ দেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠিদের আদিবাসী না বলার এবং তাদের নিয়ে নাক না গলানোর পরামর্শ দিলেন। জাতিসংঘের সে ফোরামে উপস্থিত সকলে, রাষ্ট্রের প্রতিনিধির সেই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সমগ্র আদিবাসী সমাজ সে প্রতিনিধির বক্তব্যকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। সেই ক্ষত শুকিয়ে যাবার আগেই মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে ঘোষণা করলেন বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। এবং বিশেষত জোর দিয়ে বললেন, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের আদিবাসী বলা যাবে না, কারণ তাতে নাকি দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত আসবে! তাহলে কি এদেশের আদিবাসী মানুষ যারা আজ নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে তারা বাংলাদেশের মানুষ নয়? বাংলাদেশ কি তাদের দেশ নয়? বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কি এদেশের আদিবাসী সমাজের কোনো অবদান নেই? তবে কেন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন আসবে?
আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখিনি, সে সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু আমার গ্রামের অনেক প্রবীণের মুখে শুনেছি অনেক গারো আদিবাসী যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিল, অনেকে প্রাণ দিয়েছে, অনেকে যুবতী হারিয়েছে তাদের সম্ভ্রম! পার্বত্য ও সমতলে এমন অনেককেই শুনেছি যারা যুদ্ধ করেছে, বেঁচে আছেন, অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন, অনেকে আবার যুদ্ধ পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় নাম লিখাননি, কারণ তারা সংগ্রাম করেছিলেন দেশের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে নয়। তাহলে আজ কেন সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন? তারা তো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন দেশ গঠনের দাবি জানায়নি। তবে কেন তাদের অঘোষিত এক সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হচ্ছে তাদের জীবন?
যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, যে ভাষা আন্দোলনের চেতনায় বাংলা আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠি বাঙালি কি তা ভুলে গেছেন? বাঙালি জনগোষ্ঠি কি ভুলে গেছেন যে, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ও লক্ষাধিক সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের মাঝে ছিল এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠিও। যে জাতির নিজস্ব ভাষার মর্যাদা রক্ষার গর্বিত ৫২’র ইতিহাস আছে, যে জাতি নিজস্ব আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মপরিচয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় শোষণ-বঞ্ছনা-নির্যাতন-নিপীড়নের ৭১’এর দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যে জাতি ৪০ বছর বয়সের অধিকাংশ সময় সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা আছে, সে জাতি কী করে তার দেশে অধিকার বঞ্চিত এ সকল জাতিসমূহকে তাদের আত্মপরিচয়ে অধিকার হতে বঞ্চিত করতে পারে? তা সত্যিই বোধগম্য নয়।
রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে আদিবাসী স্বীকৃতি ও অধিকার প্রশ্নে ইতিবাচক হবে আদিবাসীরা এমনটিই আশা করে। কোনো অচেনা শক্তির উসিলায় রাষ্ট্র তার কোনো জনগোষ্ঠির আত্মপরিচয় অধিকার কেড়ে নিতে পারে না।
আমরা আশা করি, রাষ্ট্র তার বিপরীতমুখী অবস্থান হতে সরে গিয়ে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবে। উদ্যোগী হবে কারণ আদিবাসীরাও বাংলাদেশের জনগোষ্ঠি, বাংলা তাদেরও দেশ। পৃথিবীতে কে আগে এসেছে, আর কে পরে সেই মানদণ্ডে নয়, আদিবাসী স্বীকৃতি নির্ধারিত হয় কোন অঞ্চলে বহুকাল ধরে বসবাস করে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠি হতে বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠিসমূহ, যাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে সেই মানদণ্ডে। আদিবাসীদের স্বীকৃতির মানদণ্ড সম্পর্কে দেশের আপামর জনগণকে সচেতন করে তুলতে জাতীয় গণমাধ্যমগুলো বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখার পাশাপাশি সরকারকে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা ও উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদান করবে। আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার ফিরে পাবে, তাদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে, তাদের প্রতি বৈষম্যের অবসান হবে, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন আদিবাসীরাও দেখতে সাহস পাবে তো!
আজ রাষ্ট্রই পারে তা নিশ্চিত করতে। তবে তা হবে শোষণ, বঞ্চণা ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে, আদিবাসীদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আদিবাসীদের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার সে আশা-আকাঙক্ষা পূরণে রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে, আদিবাসীরা আজও সে স্বপ্ন দেখে।
লিটুস চিরান: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: litusl.chiran@facebook.com
প্রয়াত আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালের জাতীয় সংসদে গণপরিষদের অধিবেশনে (যে অধিবেশন সংবিধান সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়) প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এ সকল জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণের জন্য। “তোমরা সবাই বাঙালি হয়ে যাও” জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সেই দাবির তীব্র বিরোধিতা করে তিনি মাননীয় স্পিকারের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে বলেছিলেন “মাননীয় স্পিকার আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দ পুরুষ-কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি। আমাদের বাঙালি জাতি বলে কখনো বলা হয়নি, আমার পূর্ব পুরুষরাও কখনও ও নামে পরিচিত হননি, আমার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। আমরা আমাদের বাংলাদেশী মনে করি এবং বিশ্বাস করি কিন্তু বাঙালি বলে নয়।”
কিন্ত তার সেই আত্মপরিচয়ের দাবি বাঙালি জাতির জ্যাত্যাভিমানে পিষ্ট হয়ে মহান সংসদে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, তিনি বাধ্য হয়েছিলেন মহান সংসদ থেকে ওয়াক আউট করতে। আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের স্বপ্নও ধুলিসাৎ হয়েছিল।
বর্তমান মহাজোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীদের কথা গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করেছিল এবং বলেছিল আদিবাসীদের জীবনে শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটাতে তারা কাজ করবে। মহাজোটের অনেক নেতা (যারা বর্তমানে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন) আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন, পাশে থাকার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দেবার কথা।
মহাজোট সরকারের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বে আদিবাসী জনগণ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। আদিবাসীরা আত্মপরিচয়ের অধিকার ফিরে পাবে, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দেবে সরকার। তাদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। তাদের প্রতি শত শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, উচ্ছেদের হবে অবসান, তারা নতুন করে সাজাবে তাদের জীবন, বাঁধবে নতুন জীবন, যেখানে থাকবে না কোনো শোষণ, বৈষম্য ও অবিচার। কিন্তু আদিবাসীদের সে আশা আজ ভেঙে গেছে।
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩ক অনুচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব পরিচয় বিলুপ্ত করে মহাজোট সরকার নতুন নামে “ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠি (পুর্বে উপজাতি)” নামে অভিহিত করলেন এবং ৬(২) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে অনেকটা জোর করেই আদিবাসীদের বাঙালি করা হলো যা আদিবাসীদের জন্য সত্যিই অবমাননাকর ও লজ্জাজনক।
আদিবাসীদের সাথে কোন আলাপ আলোচনা না করেই গৃহীত হলো “ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০” এবং সর্বশেষ এ বছর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে দেশের আদিবাসীদের বসবাসকৃত জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের আদিবাসী দিবসে উদযাপনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হলো। কোনো সভ্য সমাজে এটা সম্ভব কি না জানি না কিন্তু বাংলাদেশে তা সম্ভব হলো! আজ আদিবাসী সমাজ হতাশ! তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার আবারও হরণ করে নিল সরকার!
যদি এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকতো তবুও হয়তো আদিবাসীদের আশার কিছু থাকত! কিন্তু এর পর যা হলো তাতে আদিবাসীদের আর কিছু আশা করার থাকে কী? রাষ্ট্র তার প্রতিনিধির মাধ্যমে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে ঘোষণা করল যে, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, এ দেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠিদের আদিবাসী না বলার এবং তাদের নিয়ে নাক না গলানোর পরামর্শ দিলেন। জাতিসংঘের সে ফোরামে উপস্থিত সকলে, রাষ্ট্রের প্রতিনিধির সেই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সমগ্র আদিবাসী সমাজ সে প্রতিনিধির বক্তব্যকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল। সেই ক্ষত শুকিয়ে যাবার আগেই মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে ঘোষণা করলেন বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। এবং বিশেষত জোর দিয়ে বললেন, পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের আদিবাসী বলা যাবে না, কারণ তাতে নাকি দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত আসবে! তাহলে কি এদেশের আদিবাসী মানুষ যারা আজ নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে তারা বাংলাদেশের মানুষ নয়? বাংলাদেশ কি তাদের দেশ নয়? বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কি এদেশের আদিবাসী সমাজের কোনো অবদান নেই? তবে কেন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন আসবে?
আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখিনি, সে সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু আমার গ্রামের অনেক প্রবীণের মুখে শুনেছি অনেক গারো আদিবাসী যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ছিল, অনেকে প্রাণ দিয়েছে, অনেকে যুবতী হারিয়েছে তাদের সম্ভ্রম! পার্বত্য ও সমতলে এমন অনেককেই শুনেছি যারা যুদ্ধ করেছে, বেঁচে আছেন, অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন, অনেকে আবার যুদ্ধ পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় নাম লিখাননি, কারণ তারা সংগ্রাম করেছিলেন দেশের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে নয়। তাহলে আজ কেন সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন? তারা তো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন দেশ গঠনের দাবি জানায়নি। তবে কেন তাদের অঘোষিত এক সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হচ্ছে তাদের জীবন?
যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, যে ভাষা আন্দোলনের চেতনায় বাংলা আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠি বাঙালি কি তা ভুলে গেছেন? বাঙালি জনগোষ্ঠি কি ভুলে গেছেন যে, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে ও লক্ষাধিক সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের মাঝে ছিল এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠিও। যে জাতির নিজস্ব ভাষার মর্যাদা রক্ষার গর্বিত ৫২’র ইতিহাস আছে, যে জাতি নিজস্ব আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মপরিচয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় শোষণ-বঞ্ছনা-নির্যাতন-নিপীড়নের ৭১’এর দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যে জাতি ৪০ বছর বয়সের অধিকাংশ সময় সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা আছে, সে জাতি কী করে তার দেশে অধিকার বঞ্চিত এ সকল জাতিসমূহকে তাদের আত্মপরিচয়ে অধিকার হতে বঞ্চিত করতে পারে? তা সত্যিই বোধগম্য নয়।
রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে আদিবাসী স্বীকৃতি ও অধিকার প্রশ্নে ইতিবাচক হবে আদিবাসীরা এমনটিই আশা করে। কোনো অচেনা শক্তির উসিলায় রাষ্ট্র তার কোনো জনগোষ্ঠির আত্মপরিচয় অধিকার কেড়ে নিতে পারে না।
আমরা আশা করি, রাষ্ট্র তার বিপরীতমুখী অবস্থান হতে সরে গিয়ে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবে। উদ্যোগী হবে কারণ আদিবাসীরাও বাংলাদেশের জনগোষ্ঠি, বাংলা তাদেরও দেশ। পৃথিবীতে কে আগে এসেছে, আর কে পরে সেই মানদণ্ডে নয়, আদিবাসী স্বীকৃতি নির্ধারিত হয় কোন অঞ্চলে বহুকাল ধরে বসবাস করে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠি হতে বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠিসমূহ, যাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে সেই মানদণ্ডে। আদিবাসীদের স্বীকৃতির মানদণ্ড সম্পর্কে দেশের আপামর জনগণকে সচেতন করে তুলতে জাতীয় গণমাধ্যমগুলো বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখার পাশাপাশি সরকারকে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি রক্ষা ও উন্নয়নে সহযোগিতা প্রদান করবে। আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার ফিরে পাবে, তাদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে, তাদের প্রতি বৈষম্যের অবসান হবে, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন আদিবাসীরাও দেখতে সাহস পাবে তো!
আজ রাষ্ট্রই পারে তা নিশ্চিত করতে। তবে তা হবে শোষণ, বঞ্চণা ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে, আদিবাসীদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আদিবাসীদের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার সে আশা-আকাঙক্ষা পূরণে রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে, আদিবাসীরা আজও সে স্বপ্ন দেখে।
লিটুস চিরান: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: litusl.chiran@facebook.com
No comments