কুসংস্কার দূর করতে মিডিয়ার ভূমিকা by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
বাংলাদেশে একটি বেতারে রাত ১২টার দিকে ভূতের গল্প শোনানো হয়। কিশোর-কিশোরীরা বেশ আগ্রহভরে শুনে থাকে। শুধু এরা কেন, বৃদ্ধরাও আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। আমরা যেখানে বিজ্ঞানমনস্কতায় প্রচার চালাচ্ছি, সেখানে এ ধরনের প্রোগ্রাম কিভাবে সমর্থন করা যায়? আমি প্রায়ই বলে থাকি যে আমার গ্রামে কয়েকটি ভূত ছিল, বিদ্যুৎ
সরবরাহের পর তারা পালিয়ে গেছে। এ কথা বলার কারণ হলো, ছোটবেলায় শুনতাম যে অমুক তেঁতুলতলায় বা কড়ইতলায় ভূত বাস করে। সন্ধ্যার পর, বিশেষ করে অমাবস্যার রাতে ওই সব এলাকায় যাওয়া যাবে না। বিদ্যুতের আলো আসায় লোকজন ২৪ ঘণ্টা যাওয়া-আসা করছে। এখন আর এসব কথা কারো মুখে শোনা যায় না। সমাজকে সংস্কারমুক্ত করা কিংবা গুজব থেকে রক্ষা করাটা খুব কঠিন কাজ।
বেশ আগের কথা। আমার যে গ্রামে বাড়ি, সেখান থেকে ৮-১০ মাইল দূরে একটি অলৌকিক পুকুর আবিষ্কার হলো। কথাটা ঠিক তা নয়, পুকুর যেখানে ছিল, সেখানেই ছিল; কিন্তু গুজব রটে গেল যে এক বোবা ওই পুকুরের পানি পান করে কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করেছে। ব্যস, পড়ে গেল ওই পুকুর থেকে পানি নেওয়ার হিড়িক। আরো প্রচার হয়ে গেল এই পানি পানে অন্ধের অন্ধত্ব দূর হয়েছে, ল্যাংড়া স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে শিখেছে। আমি ছোটবেলায় ক্ষীণকায় ছিলাম, আমাকে নাদুসনুদুস করার জন্য দাদি একজনকে পাঠিয়েছিলেন ওখানকার পানি আনার জন্য। ইতিমধ্যে বোধ হয় জারিজুরি ফাঁস হয়েছে, আর পানি পাওয়া যায়নি। এ ধরনের গুজব রটলে বিষয়টির ভালোভাবে অনুসন্ধান করা দরকার। খোঁজ নিয়ে দেখতে হয় যে প্রকৃতপক্ষে কে এর দ্বারা উপকৃত হয়েছে। কেউ এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে না। ফলে একদল সুযোগসন্ধানী টুপাইস কামাই করে নেওয়া জাতি হিসেবে আমাদের একদিকে যেমন বৈশিষ্ট্য যে ঝড়-তুফান, সাইক্লোন দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর সে ধকল কাটিয়ে আবার পথ চলতে থাকি, তেমনি নানা রকম ছলনা-প্রতারণা, ভণ্ডামির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আবার যাত্রা করি। ইংরেজিতে যাকে বলে Resilience। প্রকৃতির সঙ্গে হাতাহাতি করা যায় না। কিন্তু মানব সৃষ্ট দুর্যোগও আমরা নীরবে মেনে নিই, সয়ে নিই। আমরা এর প্রতিবাদে কিছুই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিই না। একটা উদ্বেগের কারণ হচ্ছে যে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির যেভাবে বিকাশ হচ্ছে, ঠিক সমভাবে-নানাভাবে কুসংস্কার, অলৌকিকতা- এসব ধারণা আমাদের আচ্ছন্ন করে তুলছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ বোধ হয় সমাজতন্ত্র তথা সোভিয়েত ব্লকের পতন। এ ঘটনাকে পুঁজি করে ধর্মব্যবসায়ীরা নানাভাবে সমাজকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। পুঁজিবাদও পিছিয়ে নেই। শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে কি না, সেদিকে লক্ষ নেই। বিশাল ব্যয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়তে কোনো অর্থসংকট হয় না। অথচ সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার জন্য এত জাঁকজমকের প্রয়োজন হয় না, সেটা তাঁরা বেমালুম ভুলে যান। ভারতে এখন বহুসংখ্যক টেলিভিশন। বহু ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখানো হয়। প্রতিটি ধর্মেই মানুষের কল্যাণের জন্য নির্দেশনা রয়েছে। যদি এসব বলা হয় কিংবা আদর্শভাবে ধর্মের নিয়মনীতি মেনে চলেছে, এ ধরনের কিছু দেখানো হলেও সমাজের কল্যাণ হতো। তা করা হয় না। বরং কাহিনী এমনভাবে উপস্থাপিত করা হয়, যা দর্শককে অদৃশ্যবাদী করে তোলে এবং এতে দর্শক ইহজগৎবিমুখ হয়ে ওঠে। এটা নিশ্চয়ই কোনো সমাজের জন্য কাম্য হতে পারে না, যদি সে সমাজ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়। ভিনদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলা উচিত নয়। তবু মানুষ হিসেবে কিছু বলা যায়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু একটি বিশাল ইস্পাত কারখানার উদ্বোধন করার সময় বলেছিলেন যে এটাই হলো আধুনিক ভারতের মন্দির। এ কথার দ্বারা তিনি এই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন যে আধুনিক ভারত বিনির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু মনে হয় না, ভারত সে রকম গুরুত্ব দিতে পেরেছে। ফলে ভারতের সমাজ এখনো যথেষ্ট কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
ফিরে আসি মূল আলোচনায়। ভূতের গল্প উপস্থাপন করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে শ্রোতা বুঝবে এটি নিছক একটি গল্প। সত্যের লেশমাত্রও নেই। এ রকমভাবে উপস্থাপন করলে কোনো ক্ষতি ছিল না। যেমন- Spiderman-এর কাহিনী। বাচ্চাদের খুবই প্রিয়। আমার নাতি প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। সে Spiderman-এর পোশাক পরে কিঞ্চিৎ লম্ফঝম্প করে। একদিন নিজেই এসে বলছে যে কম্পিউটারের সাহায্যে ও এত লাফালাফি করতে পারে। বাচ্চাদের বিভিন্ন রূপকথা বা কল্পকাহিনী শোনানোর পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে এতে তাদের কল্পনাশক্তি বাড়ে। তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতে শিখবে।
আমিও দু-একদিন রেডিওতে প্রচারিত ভূতের গল্প শুনেছি। এখানে যেটা সবচেয়ে বিপজ্জনক তা হলো, উপস্থাপক এমনভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন যেন কাহিনীটি শতভাগ সত্য। কিছুটা ভয়ের বিষয় থাকে, যেমন- লাশের কথা কিংবা উল্টো করে হাঁটা অথবা উধাও হয়ে যাওয়া। এখানে আরো একটি কথা বলা প্রয়োজন, উপস্থাপকদের কেউ কেউ আবার এত বেশি স্টাইল করে কথা উচ্চারণ করে থাকেন যে 'র'-এর জায়গায় 'ড়' উচ্চারণ এসে যায়। যাঁরা এসব ভূতের গল্প চালানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি এবং ব্যাপক পল্লী বিদ্যুতের বিস্তৃতির ফলে ভূতের জায়গার বিলোপ ঘটেছে। যে কথাটি আমি এই নিবন্ধের শুরুতে বলেছি। শিশুদের অহেতুক ভয় দেখিয়ে তাদের মন দুর্বল করে দেওয়াটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। বরং আমাদের অতীত বীরত্বগাথা, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিভাবে আমাদের বীর সন্তানরা পশুশক্তির বিরুদ্ধে লড়েছিল, তা শোনানো যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেকের বই Witnes to Surrender-এ বর্ণিত একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এই মেজর সিদ্দিক পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সিদ্দিক সাহেব বর্ণনা করেছেন, ১২-১৩ বছরের এক কিশোর আমাদের মুক্তিবাহিনীকে পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুর ছেলেটির বাড়ি। সে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পাকিস্তানিরা বুঝেছিল যে ও ঠিক দায়িত্ব পালন করছে। তাই ছেলেটির বুকে স্টেনগান ধরে বলল যে মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে বল, নইলে মৃত্যু। ছেলেটি ঝুঁকে পড়ে এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে বলল, জয় বাংলা। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল কিশোরের বুক। ওর বুকের রক্তের বিনিময়ে অভ্যুদয় হলো বাংলাদেশের। এসব কাহিনী জানাতে হবে আমাদের কিশোরদের এবং নতুন প্রজন্মকে।
আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতেও বিলম্ব করে না। মোবাইল ফোনের ব্যবহার তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নিভৃত পল্লীর কৃষক ব্যবহার করছেন তাঁর পণ্যের বিপণনের জন্য। কোনো ব্যাপারেই তাঁদের অন্ধত্ব নেই। যে কারণে শত উস্কানির মুখেও বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা নানাভাবে প্ররোচিত করেছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে। কিন্তু বাংলার মানুষ সেই ফাঁদে পা দেয়নি।
শাসক সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের নৈতিক দায়িত্ব এটা দেখা যে টিভি-বেতারে যেসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে, সেগুলো যেন রাষ্ট্র তথা জাতির বৃহত্তর কল্যাণে আসে। এই ভূতের গল্প প্রচারের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞের মত নেওয়া যেতে পারে, যাতে প্রকৃত সিদ্ধান্তে আসা যায়।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
বেশ আগের কথা। আমার যে গ্রামে বাড়ি, সেখান থেকে ৮-১০ মাইল দূরে একটি অলৌকিক পুকুর আবিষ্কার হলো। কথাটা ঠিক তা নয়, পুকুর যেখানে ছিল, সেখানেই ছিল; কিন্তু গুজব রটে গেল যে এক বোবা ওই পুকুরের পানি পান করে কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করেছে। ব্যস, পড়ে গেল ওই পুকুর থেকে পানি নেওয়ার হিড়িক। আরো প্রচার হয়ে গেল এই পানি পানে অন্ধের অন্ধত্ব দূর হয়েছে, ল্যাংড়া স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে শিখেছে। আমি ছোটবেলায় ক্ষীণকায় ছিলাম, আমাকে নাদুসনুদুস করার জন্য দাদি একজনকে পাঠিয়েছিলেন ওখানকার পানি আনার জন্য। ইতিমধ্যে বোধ হয় জারিজুরি ফাঁস হয়েছে, আর পানি পাওয়া যায়নি। এ ধরনের গুজব রটলে বিষয়টির ভালোভাবে অনুসন্ধান করা দরকার। খোঁজ নিয়ে দেখতে হয় যে প্রকৃতপক্ষে কে এর দ্বারা উপকৃত হয়েছে। কেউ এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে না। ফলে একদল সুযোগসন্ধানী টুপাইস কামাই করে নেওয়া জাতি হিসেবে আমাদের একদিকে যেমন বৈশিষ্ট্য যে ঝড়-তুফান, সাইক্লোন দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর সে ধকল কাটিয়ে আবার পথ চলতে থাকি, তেমনি নানা রকম ছলনা-প্রতারণা, ভণ্ডামির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আবার যাত্রা করি। ইংরেজিতে যাকে বলে Resilience। প্রকৃতির সঙ্গে হাতাহাতি করা যায় না। কিন্তু মানব সৃষ্ট দুর্যোগও আমরা নীরবে মেনে নিই, সয়ে নিই। আমরা এর প্রতিবাদে কিছুই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিই না। একটা উদ্বেগের কারণ হচ্ছে যে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির যেভাবে বিকাশ হচ্ছে, ঠিক সমভাবে-নানাভাবে কুসংস্কার, অলৌকিকতা- এসব ধারণা আমাদের আচ্ছন্ন করে তুলছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ বোধ হয় সমাজতন্ত্র তথা সোভিয়েত ব্লকের পতন। এ ঘটনাকে পুঁজি করে ধর্মব্যবসায়ীরা নানাভাবে সমাজকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। পুঁজিবাদও পিছিয়ে নেই। শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে কি না, সেদিকে লক্ষ নেই। বিশাল ব্যয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়তে কোনো অর্থসংকট হয় না। অথচ সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার জন্য এত জাঁকজমকের প্রয়োজন হয় না, সেটা তাঁরা বেমালুম ভুলে যান। ভারতে এখন বহুসংখ্যক টেলিভিশন। বহু ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখানো হয়। প্রতিটি ধর্মেই মানুষের কল্যাণের জন্য নির্দেশনা রয়েছে। যদি এসব বলা হয় কিংবা আদর্শভাবে ধর্মের নিয়মনীতি মেনে চলেছে, এ ধরনের কিছু দেখানো হলেও সমাজের কল্যাণ হতো। তা করা হয় না। বরং কাহিনী এমনভাবে উপস্থাপিত করা হয়, যা দর্শককে অদৃশ্যবাদী করে তোলে এবং এতে দর্শক ইহজগৎবিমুখ হয়ে ওঠে। এটা নিশ্চয়ই কোনো সমাজের জন্য কাম্য হতে পারে না, যদি সে সমাজ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলতে চায়। ভিনদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলা উচিত নয়। তবু মানুষ হিসেবে কিছু বলা যায়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু একটি বিশাল ইস্পাত কারখানার উদ্বোধন করার সময় বলেছিলেন যে এটাই হলো আধুনিক ভারতের মন্দির। এ কথার দ্বারা তিনি এই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন যে আধুনিক ভারত বিনির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু মনে হয় না, ভারত সে রকম গুরুত্ব দিতে পেরেছে। ফলে ভারতের সমাজ এখনো যথেষ্ট কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
ফিরে আসি মূল আলোচনায়। ভূতের গল্প উপস্থাপন করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে শ্রোতা বুঝবে এটি নিছক একটি গল্প। সত্যের লেশমাত্রও নেই। এ রকমভাবে উপস্থাপন করলে কোনো ক্ষতি ছিল না। যেমন- Spiderman-এর কাহিনী। বাচ্চাদের খুবই প্রিয়। আমার নাতি প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। সে Spiderman-এর পোশাক পরে কিঞ্চিৎ লম্ফঝম্প করে। একদিন নিজেই এসে বলছে যে কম্পিউটারের সাহায্যে ও এত লাফালাফি করতে পারে। বাচ্চাদের বিভিন্ন রূপকথা বা কল্পকাহিনী শোনানোর পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে এতে তাদের কল্পনাশক্তি বাড়ে। তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতে শিখবে।
আমিও দু-একদিন রেডিওতে প্রচারিত ভূতের গল্প শুনেছি। এখানে যেটা সবচেয়ে বিপজ্জনক তা হলো, উপস্থাপক এমনভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন যেন কাহিনীটি শতভাগ সত্য। কিছুটা ভয়ের বিষয় থাকে, যেমন- লাশের কথা কিংবা উল্টো করে হাঁটা অথবা উধাও হয়ে যাওয়া। এখানে আরো একটি কথা বলা প্রয়োজন, উপস্থাপকদের কেউ কেউ আবার এত বেশি স্টাইল করে কথা উচ্চারণ করে থাকেন যে 'র'-এর জায়গায় 'ড়' উচ্চারণ এসে যায়। যাঁরা এসব ভূতের গল্প চালানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি এবং ব্যাপক পল্লী বিদ্যুতের বিস্তৃতির ফলে ভূতের জায়গার বিলোপ ঘটেছে। যে কথাটি আমি এই নিবন্ধের শুরুতে বলেছি। শিশুদের অহেতুক ভয় দেখিয়ে তাদের মন দুর্বল করে দেওয়াটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। বরং আমাদের অতীত বীরত্বগাথা, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিভাবে আমাদের বীর সন্তানরা পশুশক্তির বিরুদ্ধে লড়েছিল, তা শোনানো যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেকের বই Witnes to Surrender-এ বর্ণিত একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। এই মেজর সিদ্দিক পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হকের সঙ্গে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সিদ্দিক সাহেব বর্ণনা করেছেন, ১২-১৩ বছরের এক কিশোর আমাদের মুক্তিবাহিনীকে পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুর ছেলেটির বাড়ি। সে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পাকিস্তানিরা বুঝেছিল যে ও ঠিক দায়িত্ব পালন করছে। তাই ছেলেটির বুকে স্টেনগান ধরে বলল যে মুক্তিবাহিনী কোথায় আছে বল, নইলে মৃত্যু। ছেলেটি ঝুঁকে পড়ে এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে বলল, জয় বাংলা। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল কিশোরের বুক। ওর বুকের রক্তের বিনিময়ে অভ্যুদয় হলো বাংলাদেশের। এসব কাহিনী জানাতে হবে আমাদের কিশোরদের এবং নতুন প্রজন্মকে।
আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতেও বিলম্ব করে না। মোবাইল ফোনের ব্যবহার তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নিভৃত পল্লীর কৃষক ব্যবহার করছেন তাঁর পণ্যের বিপণনের জন্য। কোনো ব্যাপারেই তাঁদের অন্ধত্ব নেই। যে কারণে শত উস্কানির মুখেও বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা নানাভাবে প্ররোচিত করেছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে। কিন্তু বাংলার মানুষ সেই ফাঁদে পা দেয়নি।
শাসক সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের নৈতিক দায়িত্ব এটা দেখা যে টিভি-বেতারে যেসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে, সেগুলো যেন রাষ্ট্র তথা জাতির বৃহত্তর কল্যাণে আসে। এই ভূতের গল্প প্রচারের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞের মত নেওয়া যেতে পারে, যাতে প্রকৃত সিদ্ধান্তে আসা যায়।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
No comments