সাক্ষাৎকার-ব্যাংকিং খাত থেকে সিন্দবাদের ভূত নামাতে হবে by ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : অজয় দাশগুপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভের পর সালেহ উদ্দিন আহমেদ ১৯৭০ সালে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেন অর্থনীতি বিষয়ে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে তাকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাংলাদেশ একাডেমী অব রুর্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট, কুমিল্লার মহাপরিচালক, এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর মহাপরিচালক এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের শীর্ষ অর্থায়ন সংস্থা পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মে, ২০০৫ থেকে এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। দেশ-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে ষাটটিরও বেশি বই, প্রতিবেদন ও জার্নাল-নিবন্ধ
সমকাল :হলমার্ক গ্রুপকে সোনালী ব্যাংক বিপুল অঙ্কের ঋণ প্রদান করেছে, যার পর্যাপ্ত জামানত নেই। ভুয়া কাগজপত্রও জমা দেওয়া হয়েছে। ঋণের অঙ্ক যেমন অনেক বড়, তেমনি কেলেঙ্কারিও নজিরবিহীন...।
ড. সালেহ উদ্দিন : নজিরবিহীন, হ্যাঁ এটাই হচ্ছে উপযুক্ত শব্দ। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের একটি শাখার তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার অর্থ কেলেঙ্কারি ঘটেছে। হলমার্ক নামের একটি অখ্যাত টেক্সটাইল কোম্পানিই নিয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। হলমার্ক কোনো খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান নয়। ব্র্যান্ডনেমও কেউ বলবে না। কোনো করপোরেট হাউস হিসেবেও তারা দাবি করে না। তাদের প্রকৃত ব্যবসা সম্পর্কে শিল্প-বাণিজ্যের যারা খোঁজখবর রাখেন তাদের স্পষ্ট ধারণা সম্ভবত নেই। কিন্তু তাদের ব্যাংকের একটি শাখা থেকে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ কেন ও কী প্রক্রিয়ায় দেওয়া হলো, সে প্রশ্ন সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এ ঘটনা নজিরবিহীন।
সমকাল :এ ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারল?
ড. সালেহ উদ্দিন :নিযন্ত্রণের দায়িত্বে যারা, নজরদারি যাদের করার কথা, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ_ প্রতিটি পর্যায়েই এটা ঘটেছে। কেবল এক পক্ষের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। বড় অঙ্কের ঋণ হলে কেবল শাখা পর্যায়ে নয়, রিজিওনাল অফিস ও হেড অফিসে সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ডেও ওঠে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আর সব বোর্ডের মতো নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসে একবার বোর্ড বসে। ব্যাংকে প্রতি সপ্তাহের বোর্ডসভার রেওয়াজ রয়েছে। বোর্ডে ঋণ নিয়ে ঐকমত্য না হলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশেষ কমিটি গঠন করে মূল্যায়ন করতে পারেন। এসব ধাপ পার হয়েই এত বড় দুর্নীতি হতে পেরেছে। বাংলাদেশে আমরা খেলাপি ঋণের সমস্যার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু হলমার্ক গ্রুপের ঘটনা ভিন্ন প্রকৃতির। অভ্যন্তরীণ অডিটেও বিষয়টি ধরা পড়ার কথা। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিশ্চয়ই এ ঋণ প্রস্তাব সংশ্লিষ্টদের নজরে এনেছিলেন।
সমকাল :পরিচালনা পর্ষদের দায় কতটা?
ড. সালেহ উদ্দিন : রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠনের রেওয়াজ চালু রয়েছে। পর্ষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়। তাদের মাধ্যমে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ হয়, এমন অভিযোগ অনেকদিনের। বোর্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ ঋণের বিষয়টি বোর্ডের খুব ভালোভাবেই অবগত থাকার কথা।
সমকাল : বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা কী ছিল?
ড. সালেহ উদ্দিন :কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে তারা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। তারা বিভিন্ন ব্যাংকে অডিট করে নিয়মিত। শাখা পর্যায়েও যেতে হয়। যেসব শাখা থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ মঞ্জুর করা হয়, সেখানে তদারকি বেশি। অন্য শাখাতেও যাওয়া হয়। আর অভিযোগ পেলে যে কোনো শাখায় তারা যে কোনো সময়ে যেতে পারে। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) শাখায় ঋণ প্রদান নিয়ে সমস্যা হচ্ছে_ এ বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আনা যেত। এটা সম্ভব যে সোনালী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে বিষয়টি ধরা পড়েনি কিংবা ধরা পড়লেও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদ তাকে গুরুত্ব দেয়নি। এ কারণে বলব যে বাংলাদেশ ব্যাংকে নয়, বরং সোনালী ব্যাংকের নানা পর্যায়েই ব্যর্থতা প্রকট ছিল। সর্বোপরি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংকের ভেতর ও বাইরের কিছু লোকের যোগসাজশ। এ কারণেই হয়তো তদারকিতে ইচ্ছাকৃত ঘাটতি ছিল বা অনিচ্ছা ছিল। এক কথায় বলতে পারেন যে নীতিনির্ধারণী ব্যর্থতা, লোভ, জালিয়াতি ও দুর্নীতি-অনিয়মের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে। গোটা বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা ছিল প্রকট মাত্রায়। কিন্তু এত বড় কেলেঙ্কারি চাপা থাকে না। এ কারণেই আমাদের কাছে হঠাৎ বিস্ফোরণ মনে হয়েছে।
সমকাল : বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার কথা বলায় অর্থমন্ত্রী প্রথমে এর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ড. সালেহ উদ্দিন :কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী তাদের এ ক্ষমতা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এটা না জানার কথা নয়। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে এ অভিজ্ঞতায় সেটা দূর করার জন্য দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত হবে। কৃষি ও শিল্প খাতের বিশেষায়িত ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে।
সমকাল : সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কয়েকজনকে ইতিমধ্যে সাসপেন্ড করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছে। এটাই যথেষ্ট মনে করেন?
ড. সালেহ উদ্দিন : ঘটনার ব্যাপকতার তুলনায় এখন পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে কিছুই করা হয়নি। পরিচালনা পর্ষদ ভাঙতে দেরি করলে নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। এ ঘটনায় যারাই যেভাবে দায়ী, তারা ক্রিমিনাল অপরাধ সংঘটিত করেছে এবং সেভাবেই আইনের আওতায় তাদের আনতে হবে। তবে সরকার সিরিয়াস না হলে ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তবে এটা করতে হবে পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে এবং পক্ষাপাতমুক্ত হয়ে। তারা কাউকে ছাড় দিচ্ছে, এমন ধারণা সৃষ্টি যেন না হয়।
সমকাল :হলমার্কের কাছ থেকে ঋণ ফেরত পাওয়ার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?
ড. সালেহ উদ্দিন : জরুরি ভিত্তিতে দেখতে হবে যে জামানত ঠিক আছে কি-না। ইতিমধ্যে কিছু ঋণ পরিশোধ হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ১৫ দিনের মধ্যে মোট ঋণের অর্ধেক পরিশোধ করতে বলেছেন হলমার্ক গ্রুপের কর্তৃপক্ষকে। এ গ্রুপ মিথ্যা তথ্য দিয়েছে, সেটা স্পষ্ট। ভুয়া দলিলপত্র জমা দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। হয়তো অন্য কারও নামের জমি নিজের বলে দেখিয়েছে, সরকারি খাস জমি দখল করে সেটা হলমার্কের বলে দাবি করেছে। এর সঙ্গে জড়িত সবার শাস্তি হতে হবে। অন্যথায় মারাত্মক ভুল সংকেত যাবে যে বড় ধরনের দুর্নীতিতে যুক্ত থাকলে কিংবা তাকে প্রশ্রয় দিলেও কেবল লঘু দণ্ডতেই রেহাই মেলে। শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, অর্থনীতির অন্যান্য শাখাতেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
সমকাল :বিদ্যমান অডিট পদ্ধতিতে কী পরিবর্তন প্রয়োজন?
ড. সালেহ উদ্দিন : অবশ্যই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতিও নজর দিতে হবে। দেশে এখন অনেক ভালো অডিট কোম্পানি রয়েছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেবে বলে আশা করব। যেখানে সমস্যা দেখা যাবে, ব্যবস্থা গ্রহণে গড়িমসি করলে চলবে না। পক্ষপাতও চলবে না। শেয়ার মার্কেটে ঘটনা তদন্ত এবং তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে যে ধরনের শিথিলতা আমরা দেখছি, ব্যাংকিং সেক্টরে সেরকম করা হলে সামনে আরও বিপর্যয় অপেক্ষা করে থাকবে। সময়ক্ষেপণ ইচ্ছাকৃতভাবে করা হতে পারে, যাতে মানুষ এক সময় বিষয়টি ভুলে যাবে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন হলমার্কের বিষয়টি নিয়ে ভালো অনুসন্ধান করছে। এটা চলতে থাকুক। তবে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংককে তাদের কাজ করে যেতে হবে। হলমার্কের মতো আরও কোনো কোম্পানি নিয়ম লঙ্ঘন করে ঋণ নিয়েছে কি-না সেটা জানতে চাই। এ ক্ষেত্রে কাউকেই যেন ছাড় দেওয়া না হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা বাড়ানোও জরুরি। এ জন্য তদারকি টিম শক্তিশালী করতে হবে। দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব স্বীকৃত হলে তাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কিংবা বাইরের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাপ থাকা চলবে না।
সমকাল : হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে কি?
ড. সালেহ উদ্দিন : এত বড় ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেবে। তারা ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাবে। তারা অভিযোগের আঙুল তুলবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। বিদেশি ব্যাংকগুলো আমাদের আমদানি-রফতানিকারকদের আস্থায় নিতে দ্বিধা করবে। ফলে ব্যবসার ব্যয় বাড়বে। বিদেশিরা রিস্ক প্রিমিয়াম চাইবে। আর দেশে আমানতকারীরা ব্যাংকে অর্থ রাখতে ভয় পাবেন। সোনালী ব্যাংক দেশের সর্বত্র বিস্তৃত। সরকারের বিপুল অর্থ জমা রয়েছে এ ব্যাংকে। তারা ট্রেজারি কাজও করে। এ ব্যাংকে এত বড় সমস্যা দেখা দেওয়ায় তারা ভাবতে পারে_ তাহলে কোথায় নিরাপদে অর্থ রাখা যাবে। ব্যাংকের লেনদেন কমে যেতে পারে। আমানত কমে গেলে ঋণ প্রদানের ক্ষমতা কমবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে উৎপাদনমূলক খাতগুলোতে। উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে সমস্যা হবে। এর ধারাবাহিকতায় অন্যান্য ব্যাংকও সমস্যায় পড়তে পারে। আর্থিক খাতে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সঞ্চয়-বিনিয়োগ-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ আরও অনেক খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এটা হচ্ছে সংক্রামক ব্যাধির মতো। সরকারকে যা করার দ্রুত করতে হবে। অন্যথায় আর্থিক ও অন্যান্য খাতে বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে।
সমকাল : আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেসরকারি খাতের ব্যাংগুলো এগিয়ে গেছে ...
ড. সালেহ উদ্দিন :এখন সরকার পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের এক-তৃতীয়াংশের মতো গচ্ছিত রয়েছে। বাকি অর্থ দেশি-বিদেশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। ঋণ প্রদানের অনুপাত একই ধরনের। কিন্তু সবকিছুর পরও সরকারি ব্যাংকের প্রতি মানুষের এক ধরনের আস্থা রয়েছে। সোনালী ব্যাংকের শাখা রয়েছে জেলা-উপজেলা সর্বত্র। তাদের বিল অন্য ব্যাংক কেনে। এখন তাতে চিড় ধরতে পারে। অনেকে ভাবতে পারেন যে, প্রধান সরকারি ব্যাংকেই যদি এত খারাপ অবস্থা তাহলে অন্যদের অবস্থা হয়তো আরও খারাপ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণের বোঝা রয়েছে। তার সঙ্গে যদি জালিয়াতি-ভুল তথ্য দিয়ে এত বড় অঙ্কের অর্থ কোনো গোষ্ঠী হাতিয়ে নিতে পারে, তার চেয়ে উদ্বেগের আর কী-ইবা হতে পারে। এই সিন্দবাদের ভূত অবশ্যই তাড়াতে হবে। সরকারের উচিত হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর কর্তৃত্ব একেবারে কমিয়ে ফেলা। এ কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার বদল হবে, রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত থাকবে। কিন্তু ব্যাংক চলবে আইন মেনে। অন্যথায় এখন সোনালী ব্যাংকে যে কেলেঙ্কারি ঘটেছে, অন্য কোনো ব্যাংকে সেটা ঘটবে আরেক সরকারের আমলে।
সমকাল :এ ঘটনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও তো প্রশ্ন উঠেছে?
ড. সালেহ উদ্দিন :এ ধরনের সমস্যার পরও বলব যে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রয়োজন রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের মুনাফার তাড়না বেশি থাকে। সেভ দ্য ক্যাটালিজম ফ্রম ক্যাপিটালিস্ট_ এ সতর্কবার্তা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আমাদের আর্থ-সামাজিক এমন অনেক অপরিহার্য খাত রয়েছে যেখানে ব্যক্তি খাতের ব্যাংক পুঁজি খাটাতে ইচ্ছুক হবে না। এভাবে জনকল্যাণ খাতগুলো উপেক্ষিত হতে থাকবে। সব ব্যাংক যদি বেসরকারি খাতে চলে যায় তাহলে তারা বেপরোয়া হবে, কেবল মুনাফার পেছনে ছুটবে। বিশেষভাবে সমস্যায় পড়বে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং কৃষি খাত।
সমকাল : আমাদের ব্যাংকিং খাতে বেশ কিছু সংস্কার সাধিত হয়েছে। তারপরও এমন বিপর্যয় ঘটল কীভাবে?
ড. সালেহ উদ্দিন :সংস্কার যথেষ্ট হয়েছে। তবে আর্থিক খাতের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ-পরামর্শ কতটা মেনে চলা হচ্ছে, সেটাই মূল বিষয়। বাইরের হস্তক্ষেপ থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা এত বড় অঙ্কের ঋণ দিল, যা তাদের কর্তৃত্বের বাইরে। কিন্তু বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। ব্যবস্থাপনা পর্ষদ কীভাবে গঠিত হবে, অডিট কীভাবে হবে_ এসব নিয়ে প্রচুর সুপারিশ রয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবে তেমন কার্যকর হয়নি। বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালক সংখ্যা সর্বোচ্চ কত হবে, সেটা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তা লঙ্ঘন করে ২৩-২৪ জন পর্যন্ত করা হয়েছে। অর্থঋণ আদালত, অর্থ বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার, ফিনান্সিয়াল অ্যাক্ট ১৯৪৭_ এসব বিষয়ে আইন ও বিধিবিধান যুগোপযোগী করার বিষয়টি জরুরি এজেন্ডায় থাকা চাই। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় মামলা দীর্ঘায়িত হয়। এর সুযোগ নেয় আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা। এক রিটেই চার-পাঁচ বছর সময় পেয়ে যায়। সংস্কার মান হচ্ছে পেশাদারিত্ব, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্তদের পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে পক্ষপাতমুক্তভাবে কাজ করতে দিতে হবে। শেয়ারবাজারে বিপর্যয় ঘটেছিল এর অভাবে। সোনালী ব্যাংকেও সেটাই ঘটল। শেয়ারবাজারে বিপর্যয় এবং ডেসটিনি-যুবকের মতো প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম রোধ করা যায়নি। এখন যে ব্যাংকিং খাতের ওপর তুলনামূলক বেশি আস্থা রয়েছে, সেটাতেও বড় সমস্যা দেখা গেল। এ অবস্থায় সংস্কারের তাগিদ বাড়বে বৈকি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, বিদ্যমান আইনেও অনেক প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।
সমকাল : হলমার্ক ঋণ পরিশোধের সময় চাইছে। এটা কীভাবে হতে পারে?
ড. সালেহ উদ্দিন : যে ঋণের ক্ষেত্রে কোল্যাটারাল ঠিক আছে, সেটা এক ধরনের বিবেচনা পাবে। যেখানে তা ঠিক নেই সেটার জন্য অন্য বিবেচনা। ফৌজদারি মামলা দায়ের করে অর্থ আদায় কঠিন। অর্থঋণ আদালতেও সময় না হলে যাওয়া যাবে না। কারণ, প্রতিটি ঋণ পরিশোধের সময় থাকে। এতে সন্দেহ নেই যে, তারা যা সিকিউরিটি দিয়েছে তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে। এখন যদি ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে বলবে যে ঋণ পরিশোধ করব কীভাবে। ক্রিমিনাল মামলা দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবশ্যই করতে হবে এবং তাদের মামলা ভালোভাবে সাজানো দরকার। তারা এটা যাতে ভয়ভীতি ছাড়াই করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
সমকাল : সর্বশেষ প্রশ্ন। সোনালী ব্যাংকের করপোরেট শাখা রয়েছে। মৌলভীবাজার-চকবাজার-কারওয়ান বাজারের মতো বাণিজ্য বড় কেন্দ্রে শাখা রয়েছে। তার পরিবর্তে কেন রূপসী বাংলা শাখাকে বেছে নিয়েছিল হলমার্ক গ্রুপ?
ড. সালেহ উদ্দিন : ঠিকই বলেছেন যে ওইসব শাখায় বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়। যেখানে সব বড় বড় ব্যবসায়ীর ভিড় থাকে। নিয়ম লঙ্ঘন করে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়া হলে সেটা কর্তৃপক্ষ এবং এমনকি অন্য ব্যবসায়ীদেরও নজরে আসত সহজে। ব্যবসায়ীরাই অভিযোগ করত ও হৈচৈ বাধিয়ে দিত। এ কারণে হলমার্ক গ্রুপ এমন একটি শাখা বেছে নিয়েছে যেখানে নজরদারি কিছু কম থাকে।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. সালেহ উদ্দিন :সমকাল পাঠকদের শুভেচ্ছা।
No comments