হুমায়ূনের তেতুল বনের ‘সাইকেল ডাক্তার’ by শাহ মোহাম্মদ ফাহিম
এক.
বাংলা সাহিত্যের চিকিৎসক চরিত্রেরা আমার আগ্রহের। তাদের মধ্য দিয়ে উত্তর উপনিবেশি চিকিৎসক, বস্তুত এলোপাথির ডাক্তার সমাজকে বুঝার চেষ্টা আগ্রহের মূল কারণ। সেই তাগিদ থেকেই এর আগে আমি ‘রাজনৈতিক’ ম্যাগাজিনে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের শশী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে মহেন্দ্র’র ডাক্তারি চরিত্রে আলো ফেলার চেষ্টা করেছিলাম।
বাংলা সাহিত্যের চিকিৎসক চরিত্রেরা আমার আগ্রহের। তাদের মধ্য দিয়ে উত্তর উপনিবেশি চিকিৎসক, বস্তুত এলোপাথির ডাক্তার সমাজকে বুঝার চেষ্টা আগ্রহের মূল কারণ। সেই তাগিদ থেকেই এর আগে আমি ‘রাজনৈতিক’ ম্যাগাজিনে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের শশী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে মহেন্দ্র’র ডাক্তারি চরিত্রে আলো ফেলার চেষ্টা করেছিলাম।
বৃহস্পতিবার রাতে আটলান্টিকের ওপারে জীবনাবসান হলো বাংলাভাষার অন্যতম জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের। চিকিৎসকরা ক্যান্সার আক্রান্ত এই লেখকের শরীরে দুদিন আগে আক্রমণ করা ভাইরাস চিহ্নিত করতে পারেননি। ফলে কার্যত চিকিৎসাহীন অবস্থায়ই জীবনাবসান হলো তার। এই শোকের মধ্যে ভাবছি কিছুদিন আগে হুমায়ূনের ‘তেতুল বনে জোছনা’ উপন্যাসের চরিত্র আনিস ডাক্তারের জীবনে নজর দিয়ে আমার তৈরি এই লেখাটা কিছুটা পরিবর্তন করে বার্তা’র পাঠকের জন্য দেয়া চলে।
হুমায়ূনের এই বইটি বেছে নেয়ার কারণ হচ্ছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ও ‘চোখের বালি’র প্রকাশকাল বৃটিশ উপনিবেশকালে। কিন্তু ‘তেতুল বনে জোছনা’ লেখা হয়েছে বাংলাদেশের জন্মেরও ত্রিশ বছর পরে। এই বইতে উপনিবেশ-উত্তর সময়ের একজন ডাক্তারের জীবনের কথকতা সহজ সরল গদ্যে তুলে ধরেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ইংরেজরা চলে গেলেও তাদের উপনিবেশ ব্যবস্থা যে এখনো বহাল আছে আনিসের চরিত্রে তার ভালোই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
উপন্যাসের একবারে প্রথমদিকে প্রচণ্ড ঝড়ের পর মতি যখন ‘প্রকৃতির খেলা’ নিয়ে ভাবছিল ঠিক তখনই ‘সাইকেল হাতে ধরে হেঁটে হেঁটে’ আনিস ডাক্তারের আবির্ভাব। তাকে দেখেই মতির বুক ধড়াস করে উঠল। কারণ সে ‘অতিরিক্ত ভালো মানুষটি’র দু’টা শার্ট ও একটা লুঙ্গি চুরি করেছে। শুধু মতি না, বিরাটনগরের সব মানুষের মতেই ‘আনিস অতি ভালো মানুষ, অতি সজ্জন’। ‘নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলে’ বলেই গ্রামের মানুষের কাছে আনিস ‘ডাক্তার হিসেবে এক নম্বরেরও উপরে’। আগের দুই ডাক্তারের ব্যবহার ভালো ছিল না। রোগীর সাথে ঠিকমত কথাও বলত না। সেই কারণেই হয়ত বিরাটনগরের মানুষের মতে সেই দুইজনের স্বভাব ছিল ‘খচ্চর ধরনের’।
উপনিবেশ আমল থেকেই এদেশের মেডিকেল ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণের ধরন, ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং কাজের পরিবেশ ডাক্তারদের মধ্যে দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের জন্ম দেয়। উপনিবেশকালের সামাজিক আভিজাত্যের এই বোধটি এখনো ডাক্তারদের মধ্যে প্রবল। এই বোধ থেকেই তারা নিম্নবিত্ত রোগীদের সাথে মিশতে পারে না। ভালো ব্যবহার করতে পারে না। তবে আনিস এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বিরাটনগরের সাধারণ মানুষের সাথে আনিসের ভালো রকমের সখ্য গড়ে ওঠে।
শহরের আধুনিকতায় কাটে আনিসের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের বড় একটা সময়। শহুরে জীবনের কৃত্রিমতায় সে জীবনের সৌন্দর্যগুলো উপভোগ করতে শিখে নাই। গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসে ‘বিরাটনগর কম্যুনিটি হেলথ কমপ্লেক্স’-এর ডাক্তারের সৃজনশীলতা প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠে। নবনীকে লেখা আনিসের চিঠিতে ‘স্বপ্নের অর্কিড’ থেকে ‘চাঁদের জোছনার মতো আলো’ ছড়ানোর বর্ণনা থেকেই তার প্রমাণ মিলে। নবনীর চিঠিতে আনিস আরো লিখে, ‘আমার চিঠি পড়ে তোমার কি হাসি পাচ্ছে? মনে হচ্ছে ডাক্তারের ভেতর কাব্য ভাব চলে এসেছে? রোগ শোক ছাড়াও ইদানীং আমি আরো অনেক কিছু নিয়ে ভাবি’।
প্রচলিত ডাক্তারি শিক্ষা যে আনিসের মতো ডাক্তারদের রোগ শোকের বাইরের জীবন ও কবিতা নিয়ে খুব একটা ভাবতে শেখায় না এ থেকেই তা বোঝা যায়। গ্রামের সাধারণ মানুষের সরলতা ও গ্রাম্য প্রকৃতির সংস্পর্শেই আনিস নতুন করে ভাবতে শিখে।
আমাদের দেশে বিয়ের বাজারে ডাক্তার ছেলের পসার বরাবরই ভালো। দেখা যায় ছেলের ডাক্তার পরিচয় দেখে বেশিরভাগ বাবাই তার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানে মেয়ের পরিবারের চাইতে ছেলের পরিবারের অবস্থান নিচে থাকলেও শুধুমাত্র ডাক্তার সাইনবোর্ডের কারণে মেয়ের পরিবার বিয়ে দিতে পিছপা হয় না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বড় হওয়া মেয়ে স্বামীর পরিবারে এসে সব কিছু আগের মতো না পেয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে ভোগে। জীবন যাত্রার নিম্নগতি সে মেনে নিতে পারে না। তার এই দ্বন্দ্ব সে তার ডাক্তার স্বামীর ওপর চাপিয়ে দেয়। এই অবস্থায় বউয়ের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ডাক্তারকে আরো বেশি পেশাদার ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে হয়। তা না হলে সংসারে শান্তি নষ্ট হয়।
নবনীর বাবাও ঠিক একই কারণে আনিসের সাথে মেয়ের বিয়ে মেনে নেন। কিন্তু ছোট বেলা থেকে নিজের ঘর ছাড়া নবনীর ঘুম হয় না। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় এসি লাগে। শীতের সময়ও এসি ছেড়ে রাখতে হয়। তাই আনিসের সাথে গ্রামে গিয়ে থাকা তো দূরের কথা শ্বশুর বাড়িতেই নবনী থাকে না। প্রত্যাশার সাথে না মিলার কারনে আনিসের অব্যক্ত ভালোবাসা নবনী বুঝতে পারে না। এক পর্যায়ে তালাকেরও সিদ্ধান্ত নেয় সে। অবশ্য উপন্যাসের শেষ দিকে এসে আনিসকে লেখা নবনীর চিঠিতে আমরা সেই সিদ্ধান্ত বদলের ইঙ্গিত পাই।
আধুনিককালে এ ডাক্তাররা নিজের পেশা ও সুনাম কামানো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। অর্থ-বিত্তের প্রতি লোভে অন্যান্য সাংসারিক কাজ এমনকি নিজের ব্যাপারেও তারা অনেকটা উদাসীন ও আত্মভোলা হয়ে পড়ে। টাকা কামানোর নেশা না থাকলেও বাকি ব্যপারগুলো আনিসের সাথে মিলে যায়। তার ‘ডাক্তারি সুনাম ছড়িয়ে পড়া’র কারণে ‘হাসপাতালে প্রচুর রোগী আসে’। এটা আনিসের আত্মপ্রীতির কারণ। এই সুনামের নেশায় গ্রামের মানুষের সেবা করতে গিয়ে সে নিজের প্রতি উদাসীন থাকে। আর তাই ‘শরীর কাঁপিয়ে জ্বর’ আসার পরও সে জ্বর না মেপে, ওষুধ না খেয়ে ‘হাত পা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে’ ছিল। ইলেকট্রিকের তারে সমস্যার কারণে ঘরে বাতি জ্বলে না। অথচ তার ঠিক করার জন্য ‘নেত্রকোনায় লোক পাঠানো’র কথাও তার মনে থাকে না।
তবে আনিস দাবী করে সুনামের লোভে নয়। বরং একাকীত্ব ও নি:সঙ্গতা থেকে বাঁচার জন্যই সে গ্রামের মানুষদের সাথে ব্যস্ত সময় কাটায়। তার ধারণা মানুষ নিঃসঙ্গতা দূর করতেই যার যার পেশা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আনিসও তার নিঃসঙ্গতা দূর করার চেষ্টায় ডাক্তার হয়। ‘চারপাশের মানুষদের নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত থেকে নিজের নিঃসঙ্গতা ভুলে থাকতে চায়’। আবার কর্মব্যস্ততার মাঝে সময় করে প্রায়ই সে ‘মগড়া খালের পাশে শশ্মানঘাটে’ যায়। সেখানে ‘শ্বেতপাথরের মেঝে’তে সুন্দর বসার ব্যবস্থা আছে। আনিস ‘লোক লাগিয়ে মেঝে পরিষ্কার করিয়েছে’। ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই চাপা’ স্বভাবের আনিস ‘মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে’। জোছনার সাহচর্যে একাকীত্ব দূর করার বৃথা চেষ্টা করে।
উত্তর উপনিবেশি ডাক্তারদের মধ্যে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা খুবই সাধারণ। যে যত বড় ডাক্তার তার নিজস্ব জগৎটাও তত ছোট। কাছের মানুষদের সাথে তাদের দূরত্ব দিনদিন বাড়তে থাকে। এমনকি মেডিকেল কলেজের সহপাঠী বা ডাক্তারি পেশার সহকর্মীদের সাথে সম্পর্কটাও সময়ের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে পড়ে। আনিসকেও আমরা তার ডাক্তার সহপাঠী বা সহকর্মী কারো সাথেই যোগাযোগ রাখতে দেখি না। একবার রোগী দেখতে গিয়ে এক সহকর্মীর সাথে আনিসের দেখা হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব একটা কথা-বার্তা হয় না। অন্তত পেশার খাতিরে তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকা উচিত তাও যে নাই এ থেকে তা সহজেই বোঝা যায়।
কয়েকদিন আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালকের সাথে দেখা করেছিলাম। তিনি পেরিফেরাল নার্ভ পালসিতে (এক ধরনের স্নায়ু বৈকল্য রোগ) আক্রান্ত। রোগের কারণে ঠিকমত হাঁটতে পারেন না। সারাদিন বাসায় বসে নিঃসঙ্গ সময় কাটান। একসময়ের দাপুটে এই সরকারি চিকিৎসক খুব আফসোস করে জানালেন অসুস্থ হওয়ার পর বিগত চার বছরে তার কোনো সহকর্মী তাকে দেখতে আসে নাই। তিনি রোগ সারাতে বাংলাদেশের স্বনামধন্য একজন নিউরোমেডিসিন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু একসময়ের সহকর্মী সেই ডাক্তারও খুব একটা সময় নিয়ে তার কথা শোনেন নাই বলে অভিযোগ করেন তিনি। তার দুই সন্তান। দুইজনই স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকেন। শেষ বয়সে এসে নিজের নিঃসঙ্গতার কথা বলতে গিয়ে তার চোখে পানি চলে এসেছিল।
দুই.
উপনিবেশ কালের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক সমস্যা হচ্ছে দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিগত। পুঁজির বিকাশের স্বার্থেই উপনিবেশ ব্যবস্থার জন্ম। এই ব্যবস্থার অধীন শিক্ষাক্রমে তাই মানবতাবোধের চাইতে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি ও সুনাম লাভের শিক্ষাই বেশি প্রাধান্য পায়। বৃটিশরা চলে গেলেও আমাদের দেশে তাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা বদলের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় নাই। তাই আমাদের ডাক্তারি শিক্ষাক্রমেও মানবতাবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানুষের প্রতি ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কোনো ধারণা দেয়া হয় না।
আনিসের মধ্যেও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা আমরা দেখি। হুমায়ূন আহমেদ তাকে মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে চিত্রায়িত করছেন, তবে তার চরিত্রের মূক অংশটি বেশ কয়েকবারই বের হয়ে আসে। বিরাটনগরের চেয়ারম্যান জহির খাঁ ‘দুষ্ট প্রকৃতির লোক’। এই লোক গ্রামে নানা ধরনের খারাপ কাজ করে বেড়ায়। যেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে তাকেই সে নানা কৌশলে সরিয়ে দেয়। কিন্তু বিরাটনগরের এই সব অন্যায় কাজ নিয়ে আনিসের ‘কখনো মাথাব্যথা ছিল না’। তার ধারণা ‘সে ডাক্তার মানুষ, সে রোগের নিদান দিবে। এর বেশি কিছু না’।
বিরাজমান চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় আধুনিক চিকিৎসাই স্বাস্থ্য রক্ষার একমাত্র সঠিক ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। সব চাইতে নির্ভরযোগ্য দাবি করতে গিয়েই আধুনিক ডাক্তারি শিক্ষা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব চাইতে নির্ভরযোগ্য অথচ তা শরীরের ওপর দখলদারি নিশ্চিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ভাবে পুরোপুরি ভালো থাকা। আমাদের প্রচলিত ডাক্তারি শিক্ষাক্রমে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষায় ডাক্তারের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। কিন্তু সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতায় ডাক্তারের ভূমিকা কি হবে তার নির্দেশনা কোথাও নাই। এমনকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার, গ্রামীণ স্বাস্থ্যের উন্নয়ন বা রোগ-বালাই ও চিকিৎসা বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলারও কোনো প্রয়াস নাই।
সে কারণেই আমাদের দেশে ভুরি ভুরি ডাক্তার থাকলেও স্বাস্থ্য আন্দোলন ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উচ্চতর গবেষণা কাজে তাদের খুব একটা আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না।
মানুষ হিসেবে ‘খাঁটি সোনা’ হলেও আনিস এই শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে পাস করা ডাক্তার। হয়তবা এই কারনেই বিরাটনগরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন বা গ্রামের মানুষদের স্বাস্থ্য সচেতন করার কোনো উদ্যোগ আনিসকে নিতে দেখা যায় না। ‘অল্প বয়স্ক গম্ভীর ধরনের এই ডাক্তার’ রোগী দেখতে ‘গভীর গ্রামে’ যেতেও আগ্রহী না। বরং ‘রোগীদের হাসপাতালে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত’ করার পক্ষপাতি সে। অথচ আধুনিক হাসপাতাল রোগীর শরীরের উপর পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তাকে ডাক্তারি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিণত করে।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আনিসের মানবতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। অবস্থা ভালো না এমন এক রোগীকে শহরে পাঠাতে না পেরে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আবার ইমাম সাহেব অসুস্থ শোনার পর ‘শরীরে জ্বর নিয়ে অনেকখানি হেঁটে’ তাকে দেখতে যায় আনিস।
মিঠাপুরের কিশোর কাদেরের এলার্জিক কারণে শ্বাসনালী ফুলে বন্ধ হয়ে যায়। তার চিকিৎসার জন্য আনিসের সহকর্মী সাইফুদ্দিন ডাক্তারের ডাক পড়ে। রোগ সারাতে না পেরে রোগীর ‘শেষ অবস্থা’ ঘোষণা করে সে ভিজিটের টাকা নিয়ে সরে পড়ে। রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কাছাকাছি কোন ডাক্তারের কাছে পাঠানো তো দূরের কথা আনিস এই রোগী দেখতে গেলে সে তাকেও নিরুৎসাহিত করে। এটা উত্তর উপনিবেশি ডাক্তারদের আরেকটা বড় সমস্যা। কোনো রোগীর রোগ সারাতে না পারলে তারা তাকে সচরাচর অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে পাঠায় না। যদিও পাঠায় তবে তার কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে। কারণ রোগী যদি অন্য ডাক্তারের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যায় তবে তার পসার কমে যেতে পারে। কিম্বা তাকে ছোট ডাক্তার মনে করতে পারে।
মতি ধারণা করেছিল আনিস ডাক্তার বেশি দিন বিরাটনগর থাকবেন না। শহরমুখি হবার প্রবণতার কারণেই বিরাটনগরে ডাক্তাররা বেশি দিন থাকেন না। সেই কারণেই হয়ত মতির এই ধারণা। পুরো উপন্যাসজুড়ে অবশ্য আনিসের গ্রামে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে শেষ দিকে এসে ‘ট্রপিকাল মেডিসিনে পিএইচডি করার স্কলারশিপ’ পেয়ে আনিসও সিদ্ধান্ত নেয় ‘বিরাটনগরে থাকার কাল শেষ হয়েছে’। ‘মানুষের ভালোবাসার বন্ধন’ কেটে ‘নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত’ থাকার সময় এসেছে। এভাবেই বিরাটনগরের সাইকেল ডাক্তারের ‘গ্রামে ডাক্তারি’র জীবন শেষ হয়।
শাহ মোহাম্মদ ফাহিম: স্বাস্থ্য ও মানবিক বিষয়াদির লেখক। নিয়মিত লেখেন
হুমায়ূনের এই বইটি বেছে নেয়ার কারণ হচ্ছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ও ‘চোখের বালি’র প্রকাশকাল বৃটিশ উপনিবেশকালে। কিন্তু ‘তেতুল বনে জোছনা’ লেখা হয়েছে বাংলাদেশের জন্মেরও ত্রিশ বছর পরে। এই বইতে উপনিবেশ-উত্তর সময়ের একজন ডাক্তারের জীবনের কথকতা সহজ সরল গদ্যে তুলে ধরেছেন হুমায়ূন আহমেদ। ইংরেজরা চলে গেলেও তাদের উপনিবেশ ব্যবস্থা যে এখনো বহাল আছে আনিসের চরিত্রে তার ভালোই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
উপন্যাসের একবারে প্রথমদিকে প্রচণ্ড ঝড়ের পর মতি যখন ‘প্রকৃতির খেলা’ নিয়ে ভাবছিল ঠিক তখনই ‘সাইকেল হাতে ধরে হেঁটে হেঁটে’ আনিস ডাক্তারের আবির্ভাব। তাকে দেখেই মতির বুক ধড়াস করে উঠল। কারণ সে ‘অতিরিক্ত ভালো মানুষটি’র দু’টা শার্ট ও একটা লুঙ্গি চুরি করেছে। শুধু মতি না, বিরাটনগরের সব মানুষের মতেই ‘আনিস অতি ভালো মানুষ, অতি সজ্জন’। ‘নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলে’ বলেই গ্রামের মানুষের কাছে আনিস ‘ডাক্তার হিসেবে এক নম্বরেরও উপরে’। আগের দুই ডাক্তারের ব্যবহার ভালো ছিল না। রোগীর সাথে ঠিকমত কথাও বলত না। সেই কারণেই হয়ত বিরাটনগরের মানুষের মতে সেই দুইজনের স্বভাব ছিল ‘খচ্চর ধরনের’।
উপনিবেশ আমল থেকেই এদেশের মেডিকেল ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণের ধরন, ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং কাজের পরিবেশ ডাক্তারদের মধ্যে দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের জন্ম দেয়। উপনিবেশকালের সামাজিক আভিজাত্যের এই বোধটি এখনো ডাক্তারদের মধ্যে প্রবল। এই বোধ থেকেই তারা নিম্নবিত্ত রোগীদের সাথে মিশতে পারে না। ভালো ব্যবহার করতে পারে না। তবে আনিস এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বিরাটনগরের সাধারণ মানুষের সাথে আনিসের ভালো রকমের সখ্য গড়ে ওঠে।
শহরের আধুনিকতায় কাটে আনিসের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের বড় একটা সময়। শহুরে জীবনের কৃত্রিমতায় সে জীবনের সৌন্দর্যগুলো উপভোগ করতে শিখে নাই। গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসে ‘বিরাটনগর কম্যুনিটি হেলথ কমপ্লেক্স’-এর ডাক্তারের সৃজনশীলতা প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠে। নবনীকে লেখা আনিসের চিঠিতে ‘স্বপ্নের অর্কিড’ থেকে ‘চাঁদের জোছনার মতো আলো’ ছড়ানোর বর্ণনা থেকেই তার প্রমাণ মিলে। নবনীর চিঠিতে আনিস আরো লিখে, ‘আমার চিঠি পড়ে তোমার কি হাসি পাচ্ছে? মনে হচ্ছে ডাক্তারের ভেতর কাব্য ভাব চলে এসেছে? রোগ শোক ছাড়াও ইদানীং আমি আরো অনেক কিছু নিয়ে ভাবি’।
প্রচলিত ডাক্তারি শিক্ষা যে আনিসের মতো ডাক্তারদের রোগ শোকের বাইরের জীবন ও কবিতা নিয়ে খুব একটা ভাবতে শেখায় না এ থেকেই তা বোঝা যায়। গ্রামের সাধারণ মানুষের সরলতা ও গ্রাম্য প্রকৃতির সংস্পর্শেই আনিস নতুন করে ভাবতে শিখে।
আমাদের দেশে বিয়ের বাজারে ডাক্তার ছেলের পসার বরাবরই ভালো। দেখা যায় ছেলের ডাক্তার পরিচয় দেখে বেশিরভাগ বাবাই তার মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানে মেয়ের পরিবারের চাইতে ছেলের পরিবারের অবস্থান নিচে থাকলেও শুধুমাত্র ডাক্তার সাইনবোর্ডের কারণে মেয়ের পরিবার বিয়ে দিতে পিছপা হয় না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বড় হওয়া মেয়ে স্বামীর পরিবারে এসে সব কিছু আগের মতো না পেয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে ভোগে। জীবন যাত্রার নিম্নগতি সে মেনে নিতে পারে না। তার এই দ্বন্দ্ব সে তার ডাক্তার স্বামীর ওপর চাপিয়ে দেয়। এই অবস্থায় বউয়ের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ডাক্তারকে আরো বেশি পেশাদার ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে হয়। তা না হলে সংসারে শান্তি নষ্ট হয়।
নবনীর বাবাও ঠিক একই কারণে আনিসের সাথে মেয়ের বিয়ে মেনে নেন। কিন্তু ছোট বেলা থেকে নিজের ঘর ছাড়া নবনীর ঘুম হয় না। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় এসি লাগে। শীতের সময়ও এসি ছেড়ে রাখতে হয়। তাই আনিসের সাথে গ্রামে গিয়ে থাকা তো দূরের কথা শ্বশুর বাড়িতেই নবনী থাকে না। প্রত্যাশার সাথে না মিলার কারনে আনিসের অব্যক্ত ভালোবাসা নবনী বুঝতে পারে না। এক পর্যায়ে তালাকেরও সিদ্ধান্ত নেয় সে। অবশ্য উপন্যাসের শেষ দিকে এসে আনিসকে লেখা নবনীর চিঠিতে আমরা সেই সিদ্ধান্ত বদলের ইঙ্গিত পাই।
আধুনিককালে এ ডাক্তাররা নিজের পেশা ও সুনাম কামানো নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। অর্থ-বিত্তের প্রতি লোভে অন্যান্য সাংসারিক কাজ এমনকি নিজের ব্যাপারেও তারা অনেকটা উদাসীন ও আত্মভোলা হয়ে পড়ে। টাকা কামানোর নেশা না থাকলেও বাকি ব্যপারগুলো আনিসের সাথে মিলে যায়। তার ‘ডাক্তারি সুনাম ছড়িয়ে পড়া’র কারণে ‘হাসপাতালে প্রচুর রোগী আসে’। এটা আনিসের আত্মপ্রীতির কারণ। এই সুনামের নেশায় গ্রামের মানুষের সেবা করতে গিয়ে সে নিজের প্রতি উদাসীন থাকে। আর তাই ‘শরীর কাঁপিয়ে জ্বর’ আসার পরও সে জ্বর না মেপে, ওষুধ না খেয়ে ‘হাত পা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে’ ছিল। ইলেকট্রিকের তারে সমস্যার কারণে ঘরে বাতি জ্বলে না। অথচ তার ঠিক করার জন্য ‘নেত্রকোনায় লোক পাঠানো’র কথাও তার মনে থাকে না।
তবে আনিস দাবী করে সুনামের লোভে নয়। বরং একাকীত্ব ও নি:সঙ্গতা থেকে বাঁচার জন্যই সে গ্রামের মানুষদের সাথে ব্যস্ত সময় কাটায়। তার ধারণা মানুষ নিঃসঙ্গতা দূর করতেই যার যার পেশা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আনিসও তার নিঃসঙ্গতা দূর করার চেষ্টায় ডাক্তার হয়। ‘চারপাশের মানুষদের নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত থেকে নিজের নিঃসঙ্গতা ভুলে থাকতে চায়’। আবার কর্মব্যস্ততার মাঝে সময় করে প্রায়ই সে ‘মগড়া খালের পাশে শশ্মানঘাটে’ যায়। সেখানে ‘শ্বেতপাথরের মেঝে’তে সুন্দর বসার ব্যবস্থা আছে। আনিস ‘লোক লাগিয়ে মেঝে পরিষ্কার করিয়েছে’। ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব দিকেই চাপা’ স্বভাবের আনিস ‘মাঝে মাঝে এখানে এসে বসে’। জোছনার সাহচর্যে একাকীত্ব দূর করার বৃথা চেষ্টা করে।
উত্তর উপনিবেশি ডাক্তারদের মধ্যে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা খুবই সাধারণ। যে যত বড় ডাক্তার তার নিজস্ব জগৎটাও তত ছোট। কাছের মানুষদের সাথে তাদের দূরত্ব দিনদিন বাড়তে থাকে। এমনকি মেডিকেল কলেজের সহপাঠী বা ডাক্তারি পেশার সহকর্মীদের সাথে সম্পর্কটাও সময়ের সাথে সাথে দুর্বল হয়ে পড়ে। আনিসকেও আমরা তার ডাক্তার সহপাঠী বা সহকর্মী কারো সাথেই যোগাযোগ রাখতে দেখি না। একবার রোগী দেখতে গিয়ে এক সহকর্মীর সাথে আনিসের দেখা হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব একটা কথা-বার্তা হয় না। অন্তত পেশার খাতিরে তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকা উচিত তাও যে নাই এ থেকে তা সহজেই বোঝা যায়।
কয়েকদিন আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালকের সাথে দেখা করেছিলাম। তিনি পেরিফেরাল নার্ভ পালসিতে (এক ধরনের স্নায়ু বৈকল্য রোগ) আক্রান্ত। রোগের কারণে ঠিকমত হাঁটতে পারেন না। সারাদিন বাসায় বসে নিঃসঙ্গ সময় কাটান। একসময়ের দাপুটে এই সরকারি চিকিৎসক খুব আফসোস করে জানালেন অসুস্থ হওয়ার পর বিগত চার বছরে তার কোনো সহকর্মী তাকে দেখতে আসে নাই। তিনি রোগ সারাতে বাংলাদেশের স্বনামধন্য একজন নিউরোমেডিসিন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু একসময়ের সহকর্মী সেই ডাক্তারও খুব একটা সময় নিয়ে তার কথা শোনেন নাই বলে অভিযোগ করেন তিনি। তার দুই সন্তান। দুইজনই স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকেন। শেষ বয়সে এসে নিজের নিঃসঙ্গতার কথা বলতে গিয়ে তার চোখে পানি চলে এসেছিল।
দুই.
উপনিবেশ কালের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক সমস্যা হচ্ছে দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিগত। পুঁজির বিকাশের স্বার্থেই উপনিবেশ ব্যবস্থার জন্ম। এই ব্যবস্থার অধীন শিক্ষাক্রমে তাই মানবতাবোধের চাইতে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি ও সুনাম লাভের শিক্ষাই বেশি প্রাধান্য পায়। বৃটিশরা চলে গেলেও আমাদের দেশে তাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা বদলের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় নাই। তাই আমাদের ডাক্তারি শিক্ষাক্রমেও মানবতাবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানুষের প্রতি ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কোনো ধারণা দেয়া হয় না।
আনিসের মধ্যেও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা আমরা দেখি। হুমায়ূন আহমেদ তাকে মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে চিত্রায়িত করছেন, তবে তার চরিত্রের মূক অংশটি বেশ কয়েকবারই বের হয়ে আসে। বিরাটনগরের চেয়ারম্যান জহির খাঁ ‘দুষ্ট প্রকৃতির লোক’। এই লোক গ্রামে নানা ধরনের খারাপ কাজ করে বেড়ায়। যেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে তাকেই সে নানা কৌশলে সরিয়ে দেয়। কিন্তু বিরাটনগরের এই সব অন্যায় কাজ নিয়ে আনিসের ‘কখনো মাথাব্যথা ছিল না’। তার ধারণা ‘সে ডাক্তার মানুষ, সে রোগের নিদান দিবে। এর বেশি কিছু না’।
বিরাজমান চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় আধুনিক চিকিৎসাই স্বাস্থ্য রক্ষার একমাত্র সঠিক ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। সব চাইতে নির্ভরযোগ্য দাবি করতে গিয়েই আধুনিক ডাক্তারি শিক্ষা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব চাইতে নির্ভরযোগ্য অথচ তা শরীরের ওপর দখলদারি নিশ্চিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ভাবে পুরোপুরি ভালো থাকা। আমাদের প্রচলিত ডাক্তারি শিক্ষাক্রমে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষায় ডাক্তারের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। কিন্তু সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতায় ডাক্তারের ভূমিকা কি হবে তার নির্দেশনা কোথাও নাই। এমনকি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার, গ্রামীণ স্বাস্থ্যের উন্নয়ন বা রোগ-বালাই ও চিকিৎসা বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলারও কোনো প্রয়াস নাই।
সে কারণেই আমাদের দেশে ভুরি ভুরি ডাক্তার থাকলেও স্বাস্থ্য আন্দোলন ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উচ্চতর গবেষণা কাজে তাদের খুব একটা আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না।
মানুষ হিসেবে ‘খাঁটি সোনা’ হলেও আনিস এই শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে পাস করা ডাক্তার। হয়তবা এই কারনেই বিরাটনগরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন বা গ্রামের মানুষদের স্বাস্থ্য সচেতন করার কোনো উদ্যোগ আনিসকে নিতে দেখা যায় না। ‘অল্প বয়স্ক গম্ভীর ধরনের এই ডাক্তার’ রোগী দেখতে ‘গভীর গ্রামে’ যেতেও আগ্রহী না। বরং ‘রোগীদের হাসপাতালে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত’ করার পক্ষপাতি সে। অথচ আধুনিক হাসপাতাল রোগীর শরীরের উপর পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তাকে ডাক্তারি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরিণত করে।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আনিসের মানবতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। অবস্থা ভালো না এমন এক রোগীকে শহরে পাঠাতে না পেরে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আবার ইমাম সাহেব অসুস্থ শোনার পর ‘শরীরে জ্বর নিয়ে অনেকখানি হেঁটে’ তাকে দেখতে যায় আনিস।
মিঠাপুরের কিশোর কাদেরের এলার্জিক কারণে শ্বাসনালী ফুলে বন্ধ হয়ে যায়। তার চিকিৎসার জন্য আনিসের সহকর্মী সাইফুদ্দিন ডাক্তারের ডাক পড়ে। রোগ সারাতে না পেরে রোগীর ‘শেষ অবস্থা’ ঘোষণা করে সে ভিজিটের টাকা নিয়ে সরে পড়ে। রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কাছাকাছি কোন ডাক্তারের কাছে পাঠানো তো দূরের কথা আনিস এই রোগী দেখতে গেলে সে তাকেও নিরুৎসাহিত করে। এটা উত্তর উপনিবেশি ডাক্তারদের আরেকটা বড় সমস্যা। কোনো রোগীর রোগ সারাতে না পারলে তারা তাকে সচরাচর অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে পাঠায় না। যদিও পাঠায় তবে তার কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে। কারণ রোগী যদি অন্য ডাক্তারের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যায় তবে তার পসার কমে যেতে পারে। কিম্বা তাকে ছোট ডাক্তার মনে করতে পারে।
মতি ধারণা করেছিল আনিস ডাক্তার বেশি দিন বিরাটনগর থাকবেন না। শহরমুখি হবার প্রবণতার কারণেই বিরাটনগরে ডাক্তাররা বেশি দিন থাকেন না। সেই কারণেই হয়ত মতির এই ধারণা। পুরো উপন্যাসজুড়ে অবশ্য আনিসের গ্রামে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে শেষ দিকে এসে ‘ট্রপিকাল মেডিসিনে পিএইচডি করার স্কলারশিপ’ পেয়ে আনিসও সিদ্ধান্ত নেয় ‘বিরাটনগরে থাকার কাল শেষ হয়েছে’। ‘মানুষের ভালোবাসার বন্ধন’ কেটে ‘নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত’ থাকার সময় এসেছে। এভাবেই বিরাটনগরের সাইকেল ডাক্তারের ‘গ্রামে ডাক্তারি’র জীবন শেষ হয়।
শাহ মোহাম্মদ ফাহিম: স্বাস্থ্য ও মানবিক বিষয়াদির লেখক। নিয়মিত লেখেন
No comments