আমাদের জাতে ওঠা by ড. চঞ্চল খান
কিংবদন্তী লেখক চলে গেলন। খবর পেলাম কম্বোডিয়া থেকে। এখানকার একটা কাজে আমি এসেছি। অনেকের মতো আমিও হুমায়ূন আহমেদের একজন মুগ্ধ পাঠক। তার চলে যাবার খবর পেয়েই ইন্টারনেটে বসলাম। পড়লাম ঢাকার পত্রিকাগুলো। সব পত্রিকাতেই হুমায়ূন আহমেদ প্রধান সংবাদ।
প্রথম আলো আলাদা কভার পেজ বের করেছে। ইচ্ছে করল, কোলকাতার পত্রিকাগুলোও একটু দেখে নিই। পরপর দুদিন কোলকাতার কাগজে হুমায়ূন আহমেদের খবর খুঁজলাম। পেলাম না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার পড়লাম বাংলাদেশের পত্রিকায়। আমার প্রিয়ভাজন আবৃত্তিকার রবিশঙ্কর মৈত্রীকে ব্যাপারটা জানিয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠালাম। সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তর দিল, ‘বাংলাভাষার উপর কোলাকাতার আর দাদাগিরি নেই, তবু ভাবটা আছে। ওরা জানেন না তলায় আর মাটি নেই। হুমায়ূন আহমেদকে ওরা চিনতে চাননি, অন্তত এই ঘটনার জন্য ওদেরকে ধিক।’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথেই হুমায়ূন আহমেদের সখ্যতা ছিল, এবং অনেকবার তিনি নুহাশ পল্লীতেও বেড়াতে গিয়েছেন। তার এই ব্যক্তিগত আত্মীয়তা থেকে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে অনেক পছন্দ করতেন, ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করি অন্তর থেকেই সুনীল হুমায়ূন আহমেদকে উচ্চ আসনে বসিয়েছিলেন। কোলকাতার দেশ পত্রিকার শারদীয় তিনটি সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপা হয়েছিল। এ ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির বাসায় ১৯৯৭ সালে রবিশঙ্কর মৈত্রী এবং প্রকাশক আলমগীর রহমানের সঙ্গে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন। কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদারও হুমায়ূন আহমেদের লেখা দেশে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার মনে হয় পুরো বিষয়টি হুমায়ূন আহমেদকে সম্মানের জন্য করা হয়েছিল তা নয়, বরং বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক পাঠককে ধরার উদ্দেশ্যই মূলে ছিল।
আমি ব্যক্তিগত জীবনের কোলকাতার একজন ভক্ত। সেই সত্তরের দশক থেকে কোলকাতায় আমার আসা যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে। থাকতাম বরিশালীয় বাঙালের হোটেল শ্রীনিকেতনে, পূরবী সিনেমা হলের উল্টো দিকে। অনেকে আজও কোলকাতার ঘটিদের আতিথেয়তা নিয়ে মশকরা করেন। বিশ্বাস করি বলেই কোলকাতার সমালোচকদেরকে বোঝাই-ব্যাপারটা অন্যরকম। সাধ্যের বাইরে খরচ করা, বা লোকদেখানো ভালো জিনিস না। সৎ উপায়ের উপার্জন দিয়ে যদি আড়াই শো গ্রাম মাছ জোটে, তাতে আপত্তির কী আছে? তার উপর অনেক দিনের কমিউনিস্ট শাসন মানুষকে মিতব্যয়ী বানিয়েছে। এটা ভালো জিনিস। আমাদের শেখার আছে। আমাদের দেশের আতিথেয়তা আবার অন্যরকম। ধার কর্জ বা এদিক সেদিক থেকে টাকা এনে অতিথি আপ্যায়ন করি আমরা, মানে বাংলাদেশের বাঙালরা। এটাই শিখেছে সেই পূর্ব বাংলার এবং এই বাংলাদেশের মানুষ। যুগ যুগ ধরে করে আসছি আমরা। কোলকাতায়ও ঘটি আর বাঙালদের আপ্যায়ন দুরকম। দেশভাগের পর এদিক থেকে যারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন তারা আজও অতিথি আপ্যায়নে অকৃপণ।
বলছিলাম হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ কোলকাতার পত্রিকায় প্রকাশ না করার দুঃখের কথা। এ প্রসঙ্গে বলছি, আমাদের জাতে ওঠা নিয়ে আমার কিছু আক্ষেপ। প্রথমত: বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতের সংগঠন যারা চালান, প্রতি বছরই তাদের অনুষ্ঠানে কোলকাতা থেকে যন্ত্রশিল্পী আনতে হয়। আমি তাদের নাম উল্লেখ করছি না। প্রথিতযশা সব শিল্পীর পরিচালনায় দলগুলো যেন কোলকাতার শিল্পী ছাড়া অনুষ্ঠান করতে পারে না। অজুহাত আর কি? যাই বলুন না কেন, আমাদের দেশের যন্ত্রসংগীতশিল্পীদের সঙ্গে গাইতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না কেউ কেউ। আমি নিজে একজন শিল্পী হিসেবে বলছি, আমাদের দেশে যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের অভাব আছে সত্যি। ঘুরে ফিরে হাতেগোনা কজনই ভালো বাজান। তার যন্ত্র অর্থাৎ এস্রাজ, সেতার, সরোদ-এগুলো বাজাবার মতো একাধিক গুণীশিল্পী নেই। কী-বোর্ডে আর বাঁশিতে বেশ কজন দক্ষ শিল্পী আছেন, এককথায় বেশ ভালো বাজিয়ে তারা। তবলাতেও বেশ ভালো ভালো কজন আছেন। তাদেরকে দিয়ে আমরা তো অনুষ্ঠান করি।
যন্ত্রসংগীতশিল্পীদেরও উপার্জন কণ্ঠসংগীতশিল্পীদের সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা। অভাব শুধু শিল্পীর নয়। নোটেশন পড়ার আমাদের এখানে নেই বললেই চলে। তবুও বলি, আমাদের শিল্পীদের দিয়ে কাজটা করলে কি খুব মন্দ হয়?
আমাদের দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেল তার নিয়মের মধ্যেই রেখেছে, ভারতীয় কোনো শিল্পীর গান প্রচার করবে না। কিন্তু তারাই আবার নিয়ম ভেঙে কোলকাতার শিল্পীদের বাজানো বা ঢাকার মঞ্চে গাওয়া গান চ্যানেলেই প্রচার করেছে। আমি জানি, আমাদের যন্ত্রশিল্পীরা ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পান। আমার মনে হয়েছে, বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানটাকে জাতে নিতে হলে বোধহয় কোলকাতার গন্ধটা দরকার। তাই ওই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজকরা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে আমাদের দেশের যন্ত্রসংগীতশিল্পীদের রাখেন না।
জাতে ওঠার আরেক কথা বলতে চাই। আমরা গান রেকর্ড করি কোলকাতায়। ভালো মানের হয়। এবং এই ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কোলকাতার সংগীত পরিচালক এবং যন্ত্রসংগীতশিল্পীরা সত্যিই ভালো। কিন্তু তাই বলে আমরা কি সব সময় ওদেশ থেকেই গান রেকর্ড করে আনব? আমি যখন ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্র নির্মাণ করি, তখন অনেকেই বলেছিলেন আমি যেন কোলকাতা থেকে মিউজিক করিয়ে আনি। আমি বললাম, এই তথ্যচিত্রের সবটুকুই বাংলাদেশের, মিউজিক কেন বাইরে থেকে নেব? তথ্যচিত্র দেখার পর মিউজিক নিয়ে কিন্তু কেউ আপত্তি করেনি।
কোলকাতায় ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ’ দেখানোর পর আমার পাশে বসা একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বলেছিলেন, ‘কী চমৎকার মিউজিক? কে করেছেন?’
গর্বের সঙ্গেই বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশের দৌলতুর রহমান।’
আমাদের জাতে ওঠার তালিকা নেহায়েত ছোটো না। বছরের একটা দীর্ঘ সময়জুড়ে আমাদের অনেক নামকরা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কোলকাতায় থাকেন। ওখানেই যেন বাড়ি, ওখানেই অনুষ্ঠান, ওখানেই ভক্তকূল। তারা কিন্তু আমাদের দেশ থেকে কোনো যন্ত্রসংগীতশিল্পী কোলকাতায় নিয়ে যাবার কথা চিন্তাও করেন না। তারা হয়তো এখান থেকে কাউকে নিয়ে গেলে তাঁদের গানের মান খারাপ হবে বলেই মনে করেন। এখান থেকে যন্ত্রসংগীতশিল্পীদের নিয়ে যাওয়াটা ওখানকার কেউ মানবেনও না বলেই মনে হয়।
আমাদের ঢাকা ক্লাব আর অফিসার্স ক্লাব জাতেওঠার জন্য প্রায়ই কোলকাতার শিল্পীদের আনেন অনেক টাকা সম্মানীর বিনিময়ে। সরকারি অনুমতি তো নিশ্চয়ই ক্লাবগুলো নিতে বাধ্য থাকে? কোলকাতার কজন শিল্পী বছরে কম করে হলেও চার-পাঁচবার ঢাকায় আসেন। এর বাইরে চেনা-জানা, কম চেনা, ভালো মন্দ, নতুন পুরোনো সবরকম ভারতীয় শিল্পীর গানই শুনতে হয়। ভারত থেকে যে-সকল শিল্পী আসেন তাদের সঙ্গে নিদেনপক্ষে পাঁচজন যন্ত্রসংগীত শিল্পী আসেন, কারো কারো সঙ্গে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আসেন, পে¬নে করে কেউ কেউ সাউন্ড সিস্টেমও নিয়ে আসেন। ভালো হোটেলে থাকা-খাওয়া, কেনা-কাটায় তাদের জন্য আমাদের আয়োজকদের মোটা অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যায়। যতো খরচই হোক তবু আমরা জাতে উঠবই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও বিন্দুমাত্র মমতা আমাদের জন্য নেই। হুমায়ূন আহমেদের ছবিসহ মৃত্যু সংবাদটি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষার পত্রিকাগুলোয় দুইঞ্চি জায়গা পেল না। বাংলাদেশের বাঙালির প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের এই মনোভাব আজকের নয়। দেশভাগের অনেক আগে থেকেই ওখানকার মানুষগুলো এরকমই। কিন্তু কোলকাতা নিয়ে আমার আবেগ, ভালোভাসা কোনোটারই কমতি নেই। আমিও ওদেশে যাই মাঝে মাঝে। দুএকটা অনুষ্ঠানও করা হয়। এবার বাইশে শ্রাবণে আমার একটা অ্যালবাম বের হচ্ছে। সবই হয়ে গেছে, বেশ আগেই। সবশেষ যে আঘাতটা পেলাম কোলকাতার মানুষদের কাছ থেকে, এই আঘাতটা আগে পেলে আমি ওখান থেকে অ্যালবামটা বের করতাম না। আমার জাতে ওঠার দরকার নেই। কোলকাতার সঙ্গেই আমার মমত্ববোধ ওই সিটি ওফ জয়কে ঘিরেই, জাতে ওঠাকে কেন্দ্র করে না। আমার মতো আর সবারও একটু বোধোদয় হলে ভালো হবে। এখনই নিজেদেরকে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। আমরা সারা বিশ্বের সকল বাঙালিকে ভালোবাসি। ভালোবাসি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদেরকে। কিন্তু ভালোবাসা একদিক থেকে হলে প্রেম হয়। যারা কেবল মুখে মুখে বন্ধুত্বের ঘোষণা দেয় তারা আমাদের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। আমি জানি, আমার এই মতামত প্রকাশের পর কেউ কেউ হয়তো আমাকে তাদের ঘরের বাইরে দলের বাইরে রাখবেন, কিন্তু তাতে আমার ভয় নেই। আমি জানি, আমার মতো আরো অনেকেই নিজেদেরকে সম্মান করতে শিখেছেন, আমি তাদেরই দলে। কোনো জাতে ওঠার দৌড়ে আমি নেই।
ড. চঞ্চল খান: রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, উন্নয়ন গবেষক
ইমেইল: chanchalkhan0@gmail.com
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথেই হুমায়ূন আহমেদের সখ্যতা ছিল, এবং অনেকবার তিনি নুহাশ পল্লীতেও বেড়াতে গিয়েছেন। তার এই ব্যক্তিগত আত্মীয়তা থেকে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে অনেক পছন্দ করতেন, ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করি অন্তর থেকেই সুনীল হুমায়ূন আহমেদকে উচ্চ আসনে বসিয়েছিলেন। কোলকাতার দেশ পত্রিকার শারদীয় তিনটি সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপা হয়েছিল। এ ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির বাসায় ১৯৯৭ সালে রবিশঙ্কর মৈত্রী এবং প্রকাশক আলমগীর রহমানের সঙ্গে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন। কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদারও হুমায়ূন আহমেদের লেখা দেশে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার মনে হয় পুরো বিষয়টি হুমায়ূন আহমেদকে সম্মানের জন্য করা হয়েছিল তা নয়, বরং বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক পাঠককে ধরার উদ্দেশ্যই মূলে ছিল।
আমি ব্যক্তিগত জীবনের কোলকাতার একজন ভক্ত। সেই সত্তরের দশক থেকে কোলকাতায় আমার আসা যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে। থাকতাম বরিশালীয় বাঙালের হোটেল শ্রীনিকেতনে, পূরবী সিনেমা হলের উল্টো দিকে। অনেকে আজও কোলকাতার ঘটিদের আতিথেয়তা নিয়ে মশকরা করেন। বিশ্বাস করি বলেই কোলকাতার সমালোচকদেরকে বোঝাই-ব্যাপারটা অন্যরকম। সাধ্যের বাইরে খরচ করা, বা লোকদেখানো ভালো জিনিস না। সৎ উপায়ের উপার্জন দিয়ে যদি আড়াই শো গ্রাম মাছ জোটে, তাতে আপত্তির কী আছে? তার উপর অনেক দিনের কমিউনিস্ট শাসন মানুষকে মিতব্যয়ী বানিয়েছে। এটা ভালো জিনিস। আমাদের শেখার আছে। আমাদের দেশের আতিথেয়তা আবার অন্যরকম। ধার কর্জ বা এদিক সেদিক থেকে টাকা এনে অতিথি আপ্যায়ন করি আমরা, মানে বাংলাদেশের বাঙালরা। এটাই শিখেছে সেই পূর্ব বাংলার এবং এই বাংলাদেশের মানুষ। যুগ যুগ ধরে করে আসছি আমরা। কোলকাতায়ও ঘটি আর বাঙালদের আপ্যায়ন দুরকম। দেশভাগের পর এদিক থেকে যারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন তারা আজও অতিথি আপ্যায়নে অকৃপণ।
বলছিলাম হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুসংবাদ কোলকাতার পত্রিকায় প্রকাশ না করার দুঃখের কথা। এ প্রসঙ্গে বলছি, আমাদের জাতে ওঠা নিয়ে আমার কিছু আক্ষেপ। প্রথমত: বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতের সংগঠন যারা চালান, প্রতি বছরই তাদের অনুষ্ঠানে কোলকাতা থেকে যন্ত্রশিল্পী আনতে হয়। আমি তাদের নাম উল্লেখ করছি না। প্রথিতযশা সব শিল্পীর পরিচালনায় দলগুলো যেন কোলকাতার শিল্পী ছাড়া অনুষ্ঠান করতে পারে না। অজুহাত আর কি? যাই বলুন না কেন, আমাদের দেশের যন্ত্রসংগীতশিল্পীদের সঙ্গে গাইতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না কেউ কেউ। আমি নিজে একজন শিল্পী হিসেবে বলছি, আমাদের দেশে যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের অভাব আছে সত্যি। ঘুরে ফিরে হাতেগোনা কজনই ভালো বাজান। তার যন্ত্র অর্থাৎ এস্রাজ, সেতার, সরোদ-এগুলো বাজাবার মতো একাধিক গুণীশিল্পী নেই। কী-বোর্ডে আর বাঁশিতে বেশ কজন দক্ষ শিল্পী আছেন, এককথায় বেশ ভালো বাজিয়ে তারা। তবলাতেও বেশ ভালো ভালো কজন আছেন। তাদেরকে দিয়ে আমরা তো অনুষ্ঠান করি।
যন্ত্রসংগীতশিল্পীদেরও উপার্জন কণ্ঠসংগীতশিল্পীদের সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা। অভাব শুধু শিল্পীর নয়। নোটেশন পড়ার আমাদের এখানে নেই বললেই চলে। তবুও বলি, আমাদের শিল্পীদের দিয়ে কাজটা করলে কি খুব মন্দ হয়?
আমাদের দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেল তার নিয়মের মধ্যেই রেখেছে, ভারতীয় কোনো শিল্পীর গান প্রচার করবে না। কিন্তু তারাই আবার নিয়ম ভেঙে কোলকাতার শিল্পীদের বাজানো বা ঢাকার মঞ্চে গাওয়া গান চ্যানেলেই প্রচার করেছে। আমি জানি, আমাদের যন্ত্রশিল্পীরা ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্ট পান। আমার মনে হয়েছে, বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানটাকে জাতে নিতে হলে বোধহয় কোলকাতার গন্ধটা দরকার। তাই ওই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজকরা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে আমাদের দেশের যন্ত্রসংগীতশিল্পীদের রাখেন না।
জাতে ওঠার আরেক কথা বলতে চাই। আমরা গান রেকর্ড করি কোলকাতায়। ভালো মানের হয়। এবং এই ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কোলকাতার সংগীত পরিচালক এবং যন্ত্রসংগীতশিল্পীরা সত্যিই ভালো। কিন্তু তাই বলে আমরা কি সব সময় ওদেশ থেকেই গান রেকর্ড করে আনব? আমি যখন ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্র নির্মাণ করি, তখন অনেকেই বলেছিলেন আমি যেন কোলকাতা থেকে মিউজিক করিয়ে আনি। আমি বললাম, এই তথ্যচিত্রের সবটুকুই বাংলাদেশের, মিউজিক কেন বাইরে থেকে নেব? তথ্যচিত্র দেখার পর মিউজিক নিয়ে কিন্তু কেউ আপত্তি করেনি।
কোলকাতায় ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ’ দেখানোর পর আমার পাশে বসা একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বলেছিলেন, ‘কী চমৎকার মিউজিক? কে করেছেন?’
গর্বের সঙ্গেই বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশের দৌলতুর রহমান।’
আমাদের জাতে ওঠার তালিকা নেহায়েত ছোটো না। বছরের একটা দীর্ঘ সময়জুড়ে আমাদের অনেক নামকরা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কোলকাতায় থাকেন। ওখানেই যেন বাড়ি, ওখানেই অনুষ্ঠান, ওখানেই ভক্তকূল। তারা কিন্তু আমাদের দেশ থেকে কোনো যন্ত্রসংগীতশিল্পী কোলকাতায় নিয়ে যাবার কথা চিন্তাও করেন না। তারা হয়তো এখান থেকে কাউকে নিয়ে গেলে তাঁদের গানের মান খারাপ হবে বলেই মনে করেন। এখান থেকে যন্ত্রসংগীতশিল্পীদের নিয়ে যাওয়াটা ওখানকার কেউ মানবেনও না বলেই মনে হয়।
আমাদের ঢাকা ক্লাব আর অফিসার্স ক্লাব জাতেওঠার জন্য প্রায়ই কোলকাতার শিল্পীদের আনেন অনেক টাকা সম্মানীর বিনিময়ে। সরকারি অনুমতি তো নিশ্চয়ই ক্লাবগুলো নিতে বাধ্য থাকে? কোলকাতার কজন শিল্পী বছরে কম করে হলেও চার-পাঁচবার ঢাকায় আসেন। এর বাইরে চেনা-জানা, কম চেনা, ভালো মন্দ, নতুন পুরোনো সবরকম ভারতীয় শিল্পীর গানই শুনতে হয়। ভারত থেকে যে-সকল শিল্পী আসেন তাদের সঙ্গে নিদেনপক্ষে পাঁচজন যন্ত্রসংগীত শিল্পী আসেন, কারো কারো সঙ্গে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আসেন, পে¬নে করে কেউ কেউ সাউন্ড সিস্টেমও নিয়ে আসেন। ভালো হোটেলে থাকা-খাওয়া, কেনা-কাটায় তাদের জন্য আমাদের আয়োজকদের মোটা অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যায়। যতো খরচই হোক তবু আমরা জাতে উঠবই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও বিন্দুমাত্র মমতা আমাদের জন্য নেই। হুমায়ূন আহমেদের ছবিসহ মৃত্যু সংবাদটি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষার পত্রিকাগুলোয় দুইঞ্চি জায়গা পেল না। বাংলাদেশের বাঙালির প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের এই মনোভাব আজকের নয়। দেশভাগের অনেক আগে থেকেই ওখানকার মানুষগুলো এরকমই। কিন্তু কোলকাতা নিয়ে আমার আবেগ, ভালোভাসা কোনোটারই কমতি নেই। আমিও ওদেশে যাই মাঝে মাঝে। দুএকটা অনুষ্ঠানও করা হয়। এবার বাইশে শ্রাবণে আমার একটা অ্যালবাম বের হচ্ছে। সবই হয়ে গেছে, বেশ আগেই। সবশেষ যে আঘাতটা পেলাম কোলকাতার মানুষদের কাছ থেকে, এই আঘাতটা আগে পেলে আমি ওখান থেকে অ্যালবামটা বের করতাম না। আমার জাতে ওঠার দরকার নেই। কোলকাতার সঙ্গেই আমার মমত্ববোধ ওই সিটি ওফ জয়কে ঘিরেই, জাতে ওঠাকে কেন্দ্র করে না। আমার মতো আর সবারও একটু বোধোদয় হলে ভালো হবে। এখনই নিজেদেরকে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। আমরা সারা বিশ্বের সকল বাঙালিকে ভালোবাসি। ভালোবাসি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদেরকে। কিন্তু ভালোবাসা একদিক থেকে হলে প্রেম হয়। যারা কেবল মুখে মুখে বন্ধুত্বের ঘোষণা দেয় তারা আমাদের প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। আমি জানি, আমার এই মতামত প্রকাশের পর কেউ কেউ হয়তো আমাকে তাদের ঘরের বাইরে দলের বাইরে রাখবেন, কিন্তু তাতে আমার ভয় নেই। আমি জানি, আমার মতো আরো অনেকেই নিজেদেরকে সম্মান করতে শিখেছেন, আমি তাদেরই দলে। কোনো জাতে ওঠার দৌড়ে আমি নেই।
ড. চঞ্চল খান: রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, উন্নয়ন গবেষক
ইমেইল: chanchalkhan0@gmail.com
No comments