উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র ভয়াবহ by শফিউল আলম তরফদার

একাত্তর সালে মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করি। স্বাধীনতার আগে আমরা ধারনা পেয়েছিলাম এবং বিশ্বাস করেছি , পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশ তথা পূর্ব পাকিস্তানিরা ক্রমাগতভাবেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছর পরও কি আমরা সত্যিকারভাবে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি, সেটাই এখন অনেকের কাছে বিশাল আত্মজিজ্ঞাসা ।

কারণ, স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য শুধু মাত্র একটি পতাকা, একটি স্বতন্ত্র ভৌগলিক সার্বভৌম অঞ্চল অর্জন ছিল না । শিক্ষা-বিজ্ঞানে ঋদ্ধ একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসাবে বিশ্ব পরিসরে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর একটি প্রবল আকাঙ্ক্ষাও স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতির ঝাঁপিয়ে পড়ার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে।  

লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই সাফল্যকে আমরা কেন ধরে রাখতে পারিনি, সেটা মূল্যায়ন করা প্রত্যেক জনগণের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে । জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দু’য়েকটি সাফল্য বাদ দিলে  প্রায় ক্ষেত্রে আমরা দিন দিন পিছনের দিকেই হাঁটছি। এ ব্যর্থতার দায়ভার নিশ্চয়ই কাউকে না কাউকে নিতে হবে। গরীব ক্রমশ গরীবের দিকেই যাচ্ছে, আর ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। এখন আমরা যদি ব্যর্থতার এই কারণগুলি খুঁজে বের করতে না পারি তবে আমাদের অবশ্যই আগামী প্রজন্মের জিজ্ঞাসার  কাঠগড়ায়  দাঁড়াতে হবে।

এ কথা সবাই কমবেশি স্বীকার করবেন যে, একটি জাতির প্রকৃত উন্নয়নের মৌলিক সোপান হচ্ছে শিক্ষা। দূরবর্তী কোনো দেশ বা জাতির উদাহরণ দেবার প্রয়োজন নেই , আমাদের আশপাশের এমনকি এশিয়ায় দ্রুত উন্নতির শিখরে উঠা দেশসমূহের দিকে তাকালে এর জবাব মিলবে।

তাই একজন শিক্ষক হিসাবে প্রথমেই আমি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দিতে চাই। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বকে খাটো না করেই বলছি, শিক্ষাব্যবস্থার দিকে আলোকপাত করলে প্রথমেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। আমরা যখন বিদেশে কোনো সেমিনার বা ট্রেনিং কোর্সে অংশগ্রহণ করি, তখন লক্ষ্য করি আমাদের প্রতিবেশী ভারত থেকে আগত বিজ্ঞানীরা উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সাথে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এ পারফরমেন্স এবং অবস্থানে মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন একটা নির্ভুল সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে যা আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে বিবেচিত।

আমরা একবার কুদরত-ই-খুদা কমিশন গঠন করি, আবার শামসুল হক কমিশন গঠন করি, সরকার পরিবর্তন হলে মনিরুজ্জামান কমিটি গঠন করি, অথচ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বারবার পরিবর্তন বা এক্সপেরিমেন্ট করা যুগোপোযোগী কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদি আন্তর্জাতিক মানের হতে পারে তবে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা এখানে কেন প্রয়োগ করা যাবে না।

ভারতের শিক্ষকরা শুনে অবাকই হয় M.A/M.Sc পাশ করেই কিভাবে একজন ছাত্র শিক্ষক হয়ে  বিশ্ববিদ্যালয় এর M.Sc. ছাত্রকে পড়ান। তারা কোনোদিন দু’টি পোস্ট-ডক্টরেট  ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কল্পনাও করতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে মাত্র ৩.০ পয়েন্ট পেয়েই শুধুমাত্র রাজনৈতিক এবং তদবিরের কারণে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে ছাত্রত্ব পার হবার ২/১ মাসের মধ্যেই যোগদান করেন। ভারতে পিএইচডি ডিগ্রির বৃত্তি পাবার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নেয়া হয় এবং এমন বৃত্তি দেয়া হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারদের বেতন স্কেলের কাছাকাছি। এভাবেই ডক্টরেট এবং পোস্ট ডক্টরেটের মাধ্যমে যখন তিনি উচ্চশিক্ষার মুখ্য অধ্যায়গুলি সমাপ্ত করেন, তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখেন।

ভারতের রাজনীতিবিদদের নেতিবাচক চরিত্র সম্পর্কে অনেক কিছুই হয়তো বলা যাবে কিন্তু একথা অনেকেই স্বীকার করবেন যে , তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে নোংরা রাজনীতি কথা কখনো  চিন্তাও করেন না। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতারা যেভাবে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীবর্গের সাথে চলাফেরা করেন তা দেখে স্বাভাবিকভাবেই কিছু জুনিয়র ছাত্র অথবা তাদের অনুসারীরা লেখাপড়া থেকে রাজনীতির দিকেই মনোযোগী হয়ে যায়, কারণ অতি অল্প সময়ই টাকা এবং খ্যাতির শীর্ষে যেতে এর বিকল্প কিছুই নাই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের যত খুন-খারাবি, সংঘর্ষ হয় তার অধিকাংশের পেছনে থাকে টেন্ডারবাজি অথবা অর্থনৈতক লাভালাভ কাজ করে ।  আর এই টেন্ডারবাজি করতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের আশ্রয় নেয় । ফলে দেখা যায় সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের দলও পরিবর্তন হয়ে যায়। এবং সেই একই কায়দায় তারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বর্তমান শিল্প কারখানার সংঘর্ষে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছে। একইভাবে দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিশেষ পুলিশ বাহিনী বা ক্যাম্পাস পুলিশ গঠন করা যেতে পারে। যারা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ঠিক করার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে  এবং তারা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।

আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ কয়েক মাস ছাত্রহত্যার কারণে বন্ধ থাকার পর যেদিন ক্লাস শুরু হলো, আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম প্রথম দিনেই শতকরা ৯০% ছাত্র উপস্থিত। সামান্য গুটিকতেক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের জন্যই বার বার শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে অথচ সাধারণ ছাত্ররা এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম হতে অনেক দূরে অবস্থান করে। আমার মনে হয় পৃথিবীতে এমন কোন রাষ্ট্র পাওয়া যাবে না, যেখানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আমাদের একটু ভাবতে হবে এবং সময় খরচ করতে হবে কিভাবে এই গুটিকতেক দানবের হাত থেকে আমাদের এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করা যায়।

এখন আসা যাক শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অচলাবস্থা, ছাত্র সংঘর্ষ ইত্যাদির পেছনেও শিক্ষক রাজনীতি জড়িত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম জাপানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে গিয়েছিলেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলারের পরিচয় জানতে চাইলে উনি অনেক চেষ্টা করেও ভাইস চ্যান্সেলরের নাম বা পরিচয় জানাতে পারেন নাই। Italy-’র  ICTP গেস্ট হাউসে আমি ছিলাম। সেখানে ICTP এর Director সাথে একই লিফটে আমি নিচে নেমে অভ্যর্থনা কেন্দ্রে যখন রুমের চাবি হস্তান্তর করি, অভ্যর্থনকারী মাথা উঁচু করে Director কে দেখলেনই না, আমাকে এবং ICTP Director-কে একই ব্যবহার করে সে নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকল। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর মহোদয় যখন বের হন তখন প্রক্টরের হাতে থাকে ওয়াকিটকি, বেস্টন করে থাকেন অসংখ্য প্রফেসর এবং কর্মচারী। এই সম্মান পেতে আমরা কেউ সাদা, কেউ লাল, কেউ নীল বর্ণধারী হয়ে থাকি। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার জন্য তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র হত্যা করার উস্কানি দিতেও দ্বিধাবোধ করি না। তাই স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আমাদের বিবেকবান মানুষকে চিন্তা করতে হবে এবং এমন একটা ব্যবস্থা চালূ করতে হবে যাতে শিক্ষকরা নোংরা রাজনীতি করার কোনো সুযোগ না পান।
   
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক Status অনুযায়ী বিভাগের চেয়ারম্যান হতে লাল, নীল দল হতে হয় না। সিনিয়র শিক্ষকরা ক্রমশ তিন বছর পর পর চেয়ারম্যান পদ লাভ করেন। একইভাবে দুই বছর পর সিনিয়রিটি অনুযায়ী যদি ডিন সিন্ডিকেট সদস্য সিলেকশান করা যায়, সেক্ষেত্রে রাজনীতি অনেক কমে আসবে। আর মুখ্য পদটি যদি ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে না নেয়া হয় তাহলে শিক্ষক রাজনীতি অনেকটাই নির্বাসনে যাবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের ভিসি অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিযুক্ত করা  সরকারের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে হয়। যদিও বা সেখানে নতুন ভিসি নিযুক্তির অল্প ক’দিন পরেই সিনিটে ভিসি প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন করে শিক্ষক আন্দোলন শুরু হয়েছে।

ভারতের এক প্রাইভেট কলেজের প্রফেসর ড. সুজিত (যিনি আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন) আমাদের বিভাগ পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। কথার ফাঁকে উনাদের বেতনের স্কেল সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। অবাক হয়ে শুনলাম উনার মূল বেতন স্কেল ভারতীয় রুপিতে ৬৫ হাজার, সাথে DA ৬৫,০০০/- এবং ৪০% ঘরভাড়া। প্রফেসর বা শিক্ষকদের বেতন স্কেল এত উন্নতমানের করা হয়েছে কেন জিজ্ঞাসা করলে, উনার উত্তরে আমদের অবাকই হওয়ার কথা। ভারত সরকার যখন দেখতে পেল যে, দেশের মেধাবী ছাত্ররা দলে দলে I.T.  B.B.A, M.B.A ইত্যাদি অর্থ অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন এবং কম মেধাহীন ছাত্ররা বাধ্য হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করছেন, তখন সরকার মেধাবী ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে এমন একটা বেতন স্কেল প্রদান করল, যাতে মেধাবীরা লাইনচ্যুত না হন । ভারত সরকার আরো মনে করল শিক্ষকরা যদি মেধাবী শ্রেণীর না হয় তাহলে ছাত্ররা কখনই আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারবে না।

আমাদের দেশের সরকার বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী সব সময় বলে আসছেন শিক্ষকতার পেশাকে আকর্ষণীয় করার জন্য ভিন্ন বেতন স্কেল দেয়া হবে। সেটা দেয়ার আগেই সামরিক এবং বেসামরিক আমলারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য তিন তারকা, চার তারকা, বিশেষ সচিব ইত্যাদি পদ সৃষ্টি করে নিজেরা নিজেরাই ভিন্ন স্কেল চালু করে দেশের মহান সেবক (!) হিসাবে প্রমাণ করার সুযোগ গ্রহণ করেছে।

এগুলো মুলত আমাদের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান পরিস্থিতির খুবই ক্ষুদ্র একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। বিরাজমান অবস্থার প্রকৃত সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হলে এর ভয়াবহতায় পুরো জাতি সাংঘাতিকভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন হতাশাজনক পরিস্থিতি আখেরে সমগ্র জাতির জন্যই মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। এভাবে দিক-লক্ষ্যহীন, এলোমেলো আর নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি কোনো সচেতন, দেশপ্রেমিক নাগরিকেরই কাম্য নয়। বিষয়টি নিয়ে উচ্চশিক্ষার সাথে জড়িত সবার বিশেষ করে দেশের নীতি-নির্ধারকদের গভীরভাবে ভাববার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি, সংকীর্ণ গোষ্ঠিস্বার্থে নয়- আধুনিক, শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক, আত্মমর্যাদাশীল একটি জাতির পর্যায়ে নিজেদের নিয়ে যেতে চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই ।

শফিউল আলম তরফদার: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.