বাংলাদেশের বোকাদের জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি! by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
বাংলাদেশে অতি-অজস্র-অনেক চালাক-চতুর লোকের ভিড়ে কিছু কিছু বোকা মানুষের মুখ জেগে থাকে মনের আয়নায়, যাঁদের কথা ভোলা যায় না, যাঁদের কথা ভুলতে পারি না কখনো। মনে পড়ে বেশ, আমাদের চাটগাঁর সীতাকুণ্ডের মাছ ব্যবসায়ী কাদের ভাইয়ের কথা।
ফরমালিন মিশিয়ে মাছ বিক্রি করলে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়- এ কথা ভেবে যিনি কোনো দিন মাছে ফরমালিন মেশাননি, মাছের ব্যবসা হারিয়ে এখন পথে পথে ঘুরে বেড়ানো সে মানুষটির করুণ মুখ বেশ মনে পড়ে।
মনে পড়ে আইসক্রিম বিক্রেতা প্রদীপ কাকুর কথা। স্কুল থেকে সরকারি বৃত্তির ৬০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হারিয়ে যাওয়া আমার ৬০০ টাকা পেয়ে যিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। গতবার বাড়ি গিয়ে লোকটিকে ভিক্ষা করতে দেখে অশ্রুসিক্ত হয়ে সব সময় তাঁর সততার কথা ভাবি।
এ রকম আরো কয়েকজন সৎলোকের কথা বলতে পারি, যাঁরা আমার জানামতে তাঁদের সততার খেসারত দিচ্ছেন আজও। ভাবি, কোনো কোনো মানুষ আমাদের দেশে এত বোকা হয় কী করে? যে দেশে মিথ্যা বলা মহাপাপ, জন্ম হোক যথা-তথা কর্ম হোক ভালো, যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া সমান অপরাধ- ইত্যাদি আপ্তবাক্য শুধু বইপত্রেই বসবাস করে, জীবনযাপনে মানা হয় না; যে দেশ দুর্নীতিতে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী, যে দেশে রাজনীতিবিদ, পুলিশ, আমলার বেশির ভাগই দুর্নীতিপরায়ণ, সে দেশে এ অল্প কয়েকজন মানুষ এত সৎ অথবা অন্যভাবে বললে এত বোকা কেন?
সে প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি আজ বহুকাল পরে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ভেতর। কিন্তু কিভাবে? সে কথাই আপনাদের বলছি আজ। হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হওয়ার পর, সোনালী ব্যাংকের দোষী সব কর্মকর্তা-কর্মচারী আর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের প্রতি যখন ঘৃণা আর নিন্দা বর্ষিত হচ্ছে পত্রিকাগুলোতে, তখন বেশ অজ্ঞাতেই রয়ে গেছেন সোনালী ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তার নাম, যাঁরা হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনে জীবন আর জীবিকাকে বাজি রেখেছিলেন। এর ভেতর অন্যতম সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অডিট বিভাগের জিএম মাসরুরুল হুদা সিরাজী, যাঁর সাহসী পদক্ষেপের ফলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক লুটের ঘটনা, হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আরো ছিলেন অডিট বিভাগের ডিজিএম আবু জাফর ও এজিএম শওকত আলী। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত হলমার্কের আড়াই হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি জানার পরও যখন না জানার ভান ধরেছিলেন সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ সব কর্মকর্তা, তখন এই মাসরুরুল হুদা সিরাজীই প্রথম সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় অডিটের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পত্রিকাগুলো লিখেছে, জিএম সিরাজীর সঙ্গে মিলে ডিজিএম আবু জাফর এবং এজিএম শওকত আলী সোনালী ব্যাংকের এমডি মইনুল হকের কাছে অডিট করার অনুমতি দেওয়ার আবেদন করলে তিনি তাঁদের ধমক দিয়ে অডিট বন্ধ রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু এমডির ধমক খেয়েও দমে যাননি এ তিন কর্মকর্তা। বরং এমডি ছুটিতে গেলে সে সুযোগে তাঁরা ইস্যু করে দেন অডিট নোট।
আর এরপর। এরপর শুরু হয় দিনে-রাতে ধমক আর হুমকি। এর একদিকে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আর অন্যদিকে ব্যাংকের তিন নিরীহ কর্মকর্তা। দেওয়া হয় তাঁদের ঘুষের অফারও। কিন্তু কোনো কিছু দিয়েই যখন তাঁদের বশ মানানো যাচ্ছিল না, ঠিক তখন অডিট শুরুর আগের রাতে এই তিন কর্মকর্তাকেই বদলি করে দেওয়া হয় কুমিল্লায়। বদলি তাঁরা হয়েছেন ঠিকই; কিন্তু বদলির ঠিক আগে আগেই তাঁরা অডিট অর্ডার জারি করে দিয়ে এসেছিলেন। এবং শুধু এই তিনজন লোকের কারণেই অনেক হুমকি-ধমকি আর লোভ উপেক্ষা করে উদ্ঘাটিত হতে পেরেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক লুটের ঘটনা হলমার্ক কেলেঙ্কারি।
অথচ এই লুটপাটের কথা জেনেও এই তিন সৎ কর্মকর্তা যদি চুপচাপ থাকতেন অন্য সহকর্মীদের মতো, তাহলে এত দিনে তাঁদের আরো একধাপ পদোন্নতি হতো। তাঁদের পকেটেও থাকত এখন কয়েক কোটি টাকা, সে টাকায় ঢাকায় বিলাসবহুল বাড়ি কিনে বসবাসও করতে পারতেন। আর তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারতেন ঢাকার নামকরা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
অথচ একটা সৎকাজ করার অপরাধে তাঁরা এখন বদলি হয়েছেন সুদূর কুমিল্লায়। এখন হয়তো তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে ঝগড়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিদিন, স্বামীর বোকামির খেসারত তাঁদেরও দিতে হচ্ছে বলে। তাঁদের সন্তানরাও হয়তো বাবাদের ভুল বুঝছে- এ রকম বোকাসোকা একটা কাজ করার জন্য। তবুও আমার শ্রদ্ধা সোনালী ব্যাংকের এই বোকা তিন কর্মকর্তার জন্য! যাঁরা বাংলাদেশের অগণিত চালাক লোকের মতো পকেট ভারী না করে সৎ আর নির্মোহ থেকেছেন। আর কেউ এই তিনজন লোকের কথা ভাবুক আর না-ই ভাবুক; আমি কিন্তু সব সময় তাঁদের কথা ভাবি। ভাবি, আগামী ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে বেড়াতে গেলে সুদূর কুমিল্লায় গিয়ে খুঁজে বের করব এই বোকা লোকগুলোকে। আর তাঁদের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলব, আপনাদের মতো গুটিকয় সৎলোক এখনো এ দেশে আছে বলেই ভূমিকম্প এখনো ধ্বংস করে দেয়নি বাংলাদেশকে। প্রবল বন্যা এসে এখনো ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি বাংলাদেশকে। আপনাদের মতো কিছু সৎ আর বোকা (?) লোক আছে বলেই বসন্ত এলে বাংলাদেশে আজও ফুল ফোটে। পাখিরা গান গেয়ে যায় আজও। আপনাদের জানাই অন্তরের অন্তস্তল থেকে গভীর শ্রদ্ধা।
শুধু আপনাদের মতো কিছু লোক বাংলাদেশে এখনো আছে বলেই অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার মতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহরে বসবাস করেও বাংলাদেশে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে; ফিরে আসি বারবার।
লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
shahnewazbiplob@hotmail.com
মনে পড়ে আইসক্রিম বিক্রেতা প্রদীপ কাকুর কথা। স্কুল থেকে সরকারি বৃত্তির ৬০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হারিয়ে যাওয়া আমার ৬০০ টাকা পেয়ে যিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। গতবার বাড়ি গিয়ে লোকটিকে ভিক্ষা করতে দেখে অশ্রুসিক্ত হয়ে সব সময় তাঁর সততার কথা ভাবি।
এ রকম আরো কয়েকজন সৎলোকের কথা বলতে পারি, যাঁরা আমার জানামতে তাঁদের সততার খেসারত দিচ্ছেন আজও। ভাবি, কোনো কোনো মানুষ আমাদের দেশে এত বোকা হয় কী করে? যে দেশে মিথ্যা বলা মহাপাপ, জন্ম হোক যথা-তথা কর্ম হোক ভালো, যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া সমান অপরাধ- ইত্যাদি আপ্তবাক্য শুধু বইপত্রেই বসবাস করে, জীবনযাপনে মানা হয় না; যে দেশ দুর্নীতিতে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ স্থানের অধিকারী, যে দেশে রাজনীতিবিদ, পুলিশ, আমলার বেশির ভাগই দুর্নীতিপরায়ণ, সে দেশে এ অল্প কয়েকজন মানুষ এত সৎ অথবা অন্যভাবে বললে এত বোকা কেন?
সে প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি আজ বহুকাল পরে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ভেতর। কিন্তু কিভাবে? সে কথাই আপনাদের বলছি আজ। হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটিত হওয়ার পর, সোনালী ব্যাংকের দোষী সব কর্মকর্তা-কর্মচারী আর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের প্রতি যখন ঘৃণা আর নিন্দা বর্ষিত হচ্ছে পত্রিকাগুলোতে, তখন বেশ অজ্ঞাতেই রয়ে গেছেন সোনালী ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তার নাম, যাঁরা হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনে জীবন আর জীবিকাকে বাজি রেখেছিলেন। এর ভেতর অন্যতম সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অডিট বিভাগের জিএম মাসরুরুল হুদা সিরাজী, যাঁর সাহসী পদক্ষেপের ফলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক লুটের ঘটনা, হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আরো ছিলেন অডিট বিভাগের ডিজিএম আবু জাফর ও এজিএম শওকত আলী। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত হলমার্কের আড়াই হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি জানার পরও যখন না জানার ভান ধরেছিলেন সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ সব কর্মকর্তা, তখন এই মাসরুরুল হুদা সিরাজীই প্রথম সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখায় অডিটের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পত্রিকাগুলো লিখেছে, জিএম সিরাজীর সঙ্গে মিলে ডিজিএম আবু জাফর এবং এজিএম শওকত আলী সোনালী ব্যাংকের এমডি মইনুল হকের কাছে অডিট করার অনুমতি দেওয়ার আবেদন করলে তিনি তাঁদের ধমক দিয়ে অডিট বন্ধ রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু এমডির ধমক খেয়েও দমে যাননি এ তিন কর্মকর্তা। বরং এমডি ছুটিতে গেলে সে সুযোগে তাঁরা ইস্যু করে দেন অডিট নোট।
আর এরপর। এরপর শুরু হয় দিনে-রাতে ধমক আর হুমকি। এর একদিকে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আর অন্যদিকে ব্যাংকের তিন নিরীহ কর্মকর্তা। দেওয়া হয় তাঁদের ঘুষের অফারও। কিন্তু কোনো কিছু দিয়েই যখন তাঁদের বশ মানানো যাচ্ছিল না, ঠিক তখন অডিট শুরুর আগের রাতে এই তিন কর্মকর্তাকেই বদলি করে দেওয়া হয় কুমিল্লায়। বদলি তাঁরা হয়েছেন ঠিকই; কিন্তু বদলির ঠিক আগে আগেই তাঁরা অডিট অর্ডার জারি করে দিয়ে এসেছিলেন। এবং শুধু এই তিনজন লোকের কারণেই অনেক হুমকি-ধমকি আর লোভ উপেক্ষা করে উদ্ঘাটিত হতে পেরেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক লুটের ঘটনা হলমার্ক কেলেঙ্কারি।
অথচ এই লুটপাটের কথা জেনেও এই তিন সৎ কর্মকর্তা যদি চুপচাপ থাকতেন অন্য সহকর্মীদের মতো, তাহলে এত দিনে তাঁদের আরো একধাপ পদোন্নতি হতো। তাঁদের পকেটেও থাকত এখন কয়েক কোটি টাকা, সে টাকায় ঢাকায় বিলাসবহুল বাড়ি কিনে বসবাসও করতে পারতেন। আর তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারতেন ঢাকার নামকরা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
অথচ একটা সৎকাজ করার অপরাধে তাঁরা এখন বদলি হয়েছেন সুদূর কুমিল্লায়। এখন হয়তো তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে ঝগড়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিদিন, স্বামীর বোকামির খেসারত তাঁদেরও দিতে হচ্ছে বলে। তাঁদের সন্তানরাও হয়তো বাবাদের ভুল বুঝছে- এ রকম বোকাসোকা একটা কাজ করার জন্য। তবুও আমার শ্রদ্ধা সোনালী ব্যাংকের এই বোকা তিন কর্মকর্তার জন্য! যাঁরা বাংলাদেশের অগণিত চালাক লোকের মতো পকেট ভারী না করে সৎ আর নির্মোহ থেকেছেন। আর কেউ এই তিনজন লোকের কথা ভাবুক আর না-ই ভাবুক; আমি কিন্তু সব সময় তাঁদের কথা ভাবি। ভাবি, আগামী ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে বেড়াতে গেলে সুদূর কুমিল্লায় গিয়ে খুঁজে বের করব এই বোকা লোকগুলোকে। আর তাঁদের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলব, আপনাদের মতো গুটিকয় সৎলোক এখনো এ দেশে আছে বলেই ভূমিকম্প এখনো ধ্বংস করে দেয়নি বাংলাদেশকে। প্রবল বন্যা এসে এখনো ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি বাংলাদেশকে। আপনাদের মতো কিছু সৎ আর বোকা (?) লোক আছে বলেই বসন্ত এলে বাংলাদেশে আজও ফুল ফোটে। পাখিরা গান গেয়ে যায় আজও। আপনাদের জানাই অন্তরের অন্তস্তল থেকে গভীর শ্রদ্ধা।
শুধু আপনাদের মতো কিছু লোক বাংলাদেশে এখনো আছে বলেই অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার মতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহরে বসবাস করেও বাংলাদেশে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে; ফিরে আসি বারবার।
লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত।
shahnewazbiplob@hotmail.com
No comments