কথা সামান্যই-নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা- দুটি ভিন্ন বিষয় by ফজলুল আলম
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই কিছু না কিছু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলি- নানা দ্বন্দ্ব আমাদের মনে তোলপাড় করে। জীবনযাপনের সমস্যা নানা ধরনের হতে পারে, অনেকের জীবনে অর্থনৈতিক সমস্যা, অনেকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক সমস্যা, অনেকের পারিবারিক সমস্যা- এ রকম অনেক কিছু বড় হয়ে দাঁড়ায়।
অনেকে শুনে আশ্চর্য হবেন যে এসব বাস্তব সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা কতগুলো দার্শনিক তত্ত্বের মধ্যে প্রায়ই ঘুরপাক খায়।
অনেকে অর্থের অভাব চুরি করে বা লোক ঠকিয়ে মেটানোর চেষ্টা করে না, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমস্যা হলে দৈহিকভাবে কাউকে আক্রমণ করে সমাধান করতে যায় না, পরিবারে সবার সঙ্গে বনিবনা না হলে চিলি্লয়ে বা সম্পত্তির অন্যায় ভাগবাটোয়ারা করে শেষ করে না। এটাই নীতিশাস্ত্র বা নীতিজ্ঞান- এই শিক্ষা মানুষের মানবিকতা থেকে এসেছে। এটা তথাকথিত সভ্য সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রসূত নয়। মানুষ 'ভালো' ও 'মন্দে'র পার্থক্য কিভাবে নির্ণয় করে, সেটা বের করতে দার্শনিকরা চেষ্টা করেন। তাঁদের ব্যাখ্যা অনুসরণ করে আইন প্রণয়নকারীরা আইনও তৈরি করেন। নীতি হচ্ছে কর্তব্য নির্ধারণের উপায়; নীতিশাস্ত্রের দুটো অর্থ হতে পারে, একটা হচ্ছে নীতিনির্ধারণের বিদ্যা, অপরটি হচ্ছে ন্যায়-অন্যায় ও কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে বিচারবিষয়ক শাস্ত্র।
অথচ একই সমাজে অনেক মানুষ আছে, যারা অনেক অপকর্ম অবলীলায় করে যাচ্ছে ও তারা অধিকাংশই বহাল তবিয়তে আছে। অপকর্মে পারদর্শী ব্যক্তিরা অভাবের জন্য এসব করছে বলে মনে হয় না। তারা মানবতাবিরোধী ও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনবিরোধী কাজ করেই চলছে। এটা কেমন করে সম্ভব হচ্ছে? এই দুই দলের লোকজন কিন্তু সমাজে একই স্থানে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও আছে, তবুও সমাজ চলছে। অনেকে বলবেন, মানুষ জন্মগতভাবে বিবেকবান এবং একই সঙ্গে তারা স্বার্থপর ও লোভী। কারো কারো বিবেক তাকে অপকর্ম করতে বাধা দেয়, আবার কেউ কেউ শুধু নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়।
নীতির কথায় নৈতিকতার ছায়া এসে যায়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা সম্ভবত নীতিজ্ঞানের চেয়ে নৈতিকতা নিয়ে বেশি চিন্তিত। তার কারণ হচ্ছে নৈতিকতা সামাজিক বিষয়। পবিত্রতা-অপবিত্রতা (অপবিত্রতা শুধু নারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়), পাপ-পুণ্যের দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে ধর্ম এই সামাজিক বিষয়টি তৈরি করেছে। পরিবার, পাড়া, পাশ্বর্িকতা ও বৃহত্তর জগতে নর-নারীর কোন কোন ব্যবহার ও আচার-আচরণ গ্রহণযোগ্য তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ম নির্দেশ করে দিয়েছে। নীতিজ্ঞানপ্রসূত আইনকানুন রাষ্ট্র পরিচালনা করে; কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন সমাজ পরিচালনা করে। দুটো কিন্তু একই উদ্দেশ্য সাধন করে না এবং একে অপরের পরিপূরক কি না সেটাও প্রশ্নাতীত নয়।
একটা সময় ছিল, যখন ইউরোপে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন সবই ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত হতো। রাজরাজড়ারা ধর্মীয় যাজক ছাড়া চলতে পারতেন না। রেনেসাঁস এই অবস্থার পরিবর্তন আনে। আমাদের উপমহাদেশে যে রেনেসাঁসের কথা বলা হয়, সেটা কিন্তু ইউরোপের রেনেসাঁসের যৎসামান্য প্রভাব মাত্র, আসল রেনেসাঁস নয়। বঙ্গীয় রেনেসাঁ ছিল কলকাতা, বিশেষত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষাকেন্দ্রিক। সেটাকে বঙ্গের আধুনিকীকরণ বলে অভিহিত করা যায়, এর বেশি কিছু নয়। এখনো দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা সামাজিক আইনকানুন প্রণীত হয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় আইনের সমান্তরালে শরিয়া আইন প্রচলিত ও গৃহীত। সাধারণ মানুষের মনে, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে এই শরিয়া আইন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবশ্য পালনীয়। বাংলাদেশের অপর বৃহৎ ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায় অনুরূপ তাদের ধর্মীয় বিধিনিষেধ ভক্তিভরে পালন করে। সবাই পাপ-পুণ্য, পরকাল গ্রাহ্য করে। এমনকি ক্ষুদ্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর (বা আদিবাসী) মানুষও তাদের নিজস্ব ধর্মের বিধিনিষেধ মেনে চলে। এসবের মধ্যেই নৈতিকতার ভিত্তি বেঁচেবর্তে ফুলেফেঁপে সমাজ দখল করে রেখেছে। নীতিশাস্ত্র এসবে আসে না। আমরা জানি যে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনগুলো পাশ্চাত্য শাসকদের কাছ থেকে এসেছে। ফলে আমরা সুযোগ পেলেই সেগুলো অগ্রাহ্য করি। সেসবের ভালো-মন্দ, ন্যায়-নীতি থাকলেও আমাদের কাছে সেগুলো সর্বদা গ্রহণযোগ্য হয় না। শাস্তির ভয়ে আমরা রাষ্ট্রীয় আইন মানি। আবার অনেকে দুর্নীতির সুযোগ আছে বলে রাষ্ট্রীয় আইন মানে; আইন মেনে দুর্নীতির সুযোগ পাওয়ার কথাটি বৈপরীত্যব্যঞ্জক হয়ে গেল। এখানে এটা নিয়ে পূর্ণ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়, তবে ভুক্তভোগীরা জানেন যে সব আইনের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি হয়। এ সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পূর্ণ প্রতিবেদন আছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রটি কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সব সময় নিয়ন্ত্রিত নয়। তার ওপর ধর্ম নিয়ন্ত্রকরা অতিরিক্ত পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী বিধায় তাঁদের প্রণীত আইন, বিশেষত যৌতুকবিধি, ব্যভিচার আইন, পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির অসম বণ্টন, বিবাহবিচ্ছেদ হলে ছেলেমেয়েদের ওপর দাবি ইত্যাদি সবই নারীদের মানবিক অধিকারবিরোধী। আসলে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে আনাও ধর্মীয় বা সামাজিক নৈতিকতার কাজ, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতার সোচ্চার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এসব আইন খুব কম পুরুষকেই শাস্তি দিতে পেরেছে। সতীত্বের দায় শুধু নারীদের, পুরুষদের নয়। সব আইনে ঔচিত্যবোধ যুক্ত থাকলেও এর প্রয়োগ হয় পুরুষদের সুবিধার্থে।
ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুশাসনগুলো পাশ্চাত্যে বিলীয়মান হচ্ছে, সম্পূর্ণ চলে যায়নি। কিন্তু পাশ্চাত্যের নারীরা অনেক রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় আইনের বিধিনিষেধ মানছে না। সেখানে পুরুষরাও নারীদের সমান অধিকারের দাবি সমর্থন দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামাঞ্চলে ও ছোট শহরগুলোতে সামাজিক বা ধর্মীয় আইন ভাঙা সহজ কথা নয়। বাংলাদেশে ফতোয়া সম্পর্কে নতুন আইন হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে- ফতোয়া দিতে চাইলে দেওয়া যাবে; কিন্তু শাস্তি দেওয়ার অধিকার ফতোয়া প্রদানকারীর থাকবে না। বলা বাহুল্য, রাজধানী শহরেও ছোট ছোট পাড়া এলাকায় নৈতিকতার নামে অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। নারীদের বিরুদ্ধে এসবের প্রণেতা বখাটে বা মাস্তান হওয়ার অভিলাষী যুবকরা। তাদের উৎপাতে অনেক নারীর ক্যারিয়ার নষ্ট হয়েছে এবং অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে- এর সবই হয়েছে নৈতিকতার নামে। নীতিশাস্ত্রের আলোকে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে এই নারীরা কোনো 'পাপ' করেনি। তাদের জীবনযাপনের স্বাধীনতায় যারা হস্তক্ষেপ করে তারাই অনৈতিক কাজ করছে, অথচ তাদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
অনেকে অর্থের অভাব চুরি করে বা লোক ঠকিয়ে মেটানোর চেষ্টা করে না, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমস্যা হলে দৈহিকভাবে কাউকে আক্রমণ করে সমাধান করতে যায় না, পরিবারে সবার সঙ্গে বনিবনা না হলে চিলি্লয়ে বা সম্পত্তির অন্যায় ভাগবাটোয়ারা করে শেষ করে না। এটাই নীতিশাস্ত্র বা নীতিজ্ঞান- এই শিক্ষা মানুষের মানবিকতা থেকে এসেছে। এটা তথাকথিত সভ্য সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রসূত নয়। মানুষ 'ভালো' ও 'মন্দে'র পার্থক্য কিভাবে নির্ণয় করে, সেটা বের করতে দার্শনিকরা চেষ্টা করেন। তাঁদের ব্যাখ্যা অনুসরণ করে আইন প্রণয়নকারীরা আইনও তৈরি করেন। নীতি হচ্ছে কর্তব্য নির্ধারণের উপায়; নীতিশাস্ত্রের দুটো অর্থ হতে পারে, একটা হচ্ছে নীতিনির্ধারণের বিদ্যা, অপরটি হচ্ছে ন্যায়-অন্যায় ও কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে বিচারবিষয়ক শাস্ত্র।
অথচ একই সমাজে অনেক মানুষ আছে, যারা অনেক অপকর্ম অবলীলায় করে যাচ্ছে ও তারা অধিকাংশই বহাল তবিয়তে আছে। অপকর্মে পারদর্শী ব্যক্তিরা অভাবের জন্য এসব করছে বলে মনে হয় না। তারা মানবতাবিরোধী ও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনবিরোধী কাজ করেই চলছে। এটা কেমন করে সম্ভব হচ্ছে? এই দুই দলের লোকজন কিন্তু সমাজে একই স্থানে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও আছে, তবুও সমাজ চলছে। অনেকে বলবেন, মানুষ জন্মগতভাবে বিবেকবান এবং একই সঙ্গে তারা স্বার্থপর ও লোভী। কারো কারো বিবেক তাকে অপকর্ম করতে বাধা দেয়, আবার কেউ কেউ শুধু নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়।
নীতির কথায় নৈতিকতার ছায়া এসে যায়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা সম্ভবত নীতিজ্ঞানের চেয়ে নৈতিকতা নিয়ে বেশি চিন্তিত। তার কারণ হচ্ছে নৈতিকতা সামাজিক বিষয়। পবিত্রতা-অপবিত্রতা (অপবিত্রতা শুধু নারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়), পাপ-পুণ্যের দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে ধর্ম এই সামাজিক বিষয়টি তৈরি করেছে। পরিবার, পাড়া, পাশ্বর্িকতা ও বৃহত্তর জগতে নর-নারীর কোন কোন ব্যবহার ও আচার-আচরণ গ্রহণযোগ্য তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ম নির্দেশ করে দিয়েছে। নীতিজ্ঞানপ্রসূত আইনকানুন রাষ্ট্র পরিচালনা করে; কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন সমাজ পরিচালনা করে। দুটো কিন্তু একই উদ্দেশ্য সাধন করে না এবং একে অপরের পরিপূরক কি না সেটাও প্রশ্নাতীত নয়।
একটা সময় ছিল, যখন ইউরোপে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন সবই ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত হতো। রাজরাজড়ারা ধর্মীয় যাজক ছাড়া চলতে পারতেন না। রেনেসাঁস এই অবস্থার পরিবর্তন আনে। আমাদের উপমহাদেশে যে রেনেসাঁসের কথা বলা হয়, সেটা কিন্তু ইউরোপের রেনেসাঁসের যৎসামান্য প্রভাব মাত্র, আসল রেনেসাঁস নয়। বঙ্গীয় রেনেসাঁ ছিল কলকাতা, বিশেষত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষাকেন্দ্রিক। সেটাকে বঙ্গের আধুনিকীকরণ বলে অভিহিত করা যায়, এর বেশি কিছু নয়। এখনো দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা সামাজিক আইনকানুন প্রণীত হয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় আইনের সমান্তরালে শরিয়া আইন প্রচলিত ও গৃহীত। সাধারণ মানুষের মনে, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে এই শরিয়া আইন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবশ্য পালনীয়। বাংলাদেশের অপর বৃহৎ ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায় অনুরূপ তাদের ধর্মীয় বিধিনিষেধ ভক্তিভরে পালন করে। সবাই পাপ-পুণ্য, পরকাল গ্রাহ্য করে। এমনকি ক্ষুদ্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর (বা আদিবাসী) মানুষও তাদের নিজস্ব ধর্মের বিধিনিষেধ মেনে চলে। এসবের মধ্যেই নৈতিকতার ভিত্তি বেঁচেবর্তে ফুলেফেঁপে সমাজ দখল করে রেখেছে। নীতিশাস্ত্র এসবে আসে না। আমরা জানি যে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনগুলো পাশ্চাত্য শাসকদের কাছ থেকে এসেছে। ফলে আমরা সুযোগ পেলেই সেগুলো অগ্রাহ্য করি। সেসবের ভালো-মন্দ, ন্যায়-নীতি থাকলেও আমাদের কাছে সেগুলো সর্বদা গ্রহণযোগ্য হয় না। শাস্তির ভয়ে আমরা রাষ্ট্রীয় আইন মানি। আবার অনেকে দুর্নীতির সুযোগ আছে বলে রাষ্ট্রীয় আইন মানে; আইন মেনে দুর্নীতির সুযোগ পাওয়ার কথাটি বৈপরীত্যব্যঞ্জক হয়ে গেল। এখানে এটা নিয়ে পূর্ণ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়, তবে ভুক্তভোগীরা জানেন যে সব আইনের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি হয়। এ সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পূর্ণ প্রতিবেদন আছে। নৈতিকতার ক্ষেত্রটি কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সব সময় নিয়ন্ত্রিত নয়। তার ওপর ধর্ম নিয়ন্ত্রকরা অতিরিক্ত পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী বিধায় তাঁদের প্রণীত আইন, বিশেষত যৌতুকবিধি, ব্যভিচার আইন, পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির অসম বণ্টন, বিবাহবিচ্ছেদ হলে ছেলেমেয়েদের ওপর দাবি ইত্যাদি সবই নারীদের মানবিক অধিকারবিরোধী। আসলে পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে আনাও ধর্মীয় বা সামাজিক নৈতিকতার কাজ, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতার সোচ্চার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এসব আইন খুব কম পুরুষকেই শাস্তি দিতে পেরেছে। সতীত্বের দায় শুধু নারীদের, পুরুষদের নয়। সব আইনে ঔচিত্যবোধ যুক্ত থাকলেও এর প্রয়োগ হয় পুরুষদের সুবিধার্থে।
ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুশাসনগুলো পাশ্চাত্যে বিলীয়মান হচ্ছে, সম্পূর্ণ চলে যায়নি। কিন্তু পাশ্চাত্যের নারীরা অনেক রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় আইনের বিধিনিষেধ মানছে না। সেখানে পুরুষরাও নারীদের সমান অধিকারের দাবি সমর্থন দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামাঞ্চলে ও ছোট শহরগুলোতে সামাজিক বা ধর্মীয় আইন ভাঙা সহজ কথা নয়। বাংলাদেশে ফতোয়া সম্পর্কে নতুন আইন হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে- ফতোয়া দিতে চাইলে দেওয়া যাবে; কিন্তু শাস্তি দেওয়ার অধিকার ফতোয়া প্রদানকারীর থাকবে না। বলা বাহুল্য, রাজধানী শহরেও ছোট ছোট পাড়া এলাকায় নৈতিকতার নামে অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। নারীদের বিরুদ্ধে এসবের প্রণেতা বখাটে বা মাস্তান হওয়ার অভিলাষী যুবকরা। তাদের উৎপাতে অনেক নারীর ক্যারিয়ার নষ্ট হয়েছে এবং অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে- এর সবই হয়েছে নৈতিকতার নামে। নীতিশাস্ত্রের আলোকে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে এই নারীরা কোনো 'পাপ' করেনি। তাদের জীবনযাপনের স্বাধীনতায় যারা হস্তক্ষেপ করে তারাই অনৈতিক কাজ করছে, অথচ তাদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments