সংকট উত্তরণ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাসংক্রান্ত রায়েই নিহিত by তারেক শামসুর রেহমান
উচ্চ আদালতের যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছিল, ওই রায়েই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটি দিকনির্দেশনাও আছে। দীর্ঘ ১৬ মাস পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের বিচারপতিরা রায় লেখা শেষে তাতে স্বাক্ষর করেন এবং তা ওয়েবে প্রকাশ করা হয়।
এটি একটি যুগান্তকারী রায় এবং দ্রুত তা উচ্চ আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে আদালত একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ব্লগে এ রায় নিয়ে একটি ছোট্ট মন্তব্য আমার চোখে পড়েছে। কোনো 'সরকারি কর্মকর্তা' অবসরে যাওয়ার পর কোনো 'সিদ্ধান্তে' স্বাক্ষর করতে পারেন কি না! বিচারপতিরা সেই অর্থে 'সরকারি কর্মকর্তা' নন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত চাকরিতে থেকেই তাঁরা নেন ও পরে তাতে স্বাক্ষর করেন। এটা রেওয়াজ। অতীতেও এমনটি হয়েছে। কিন্তু যিনি অবসরে চলে গেছেন এক বছর আগে, তিনি স্বাক্ষর করতে পারেন কি না- এটা একটা আইনি প্রশ্ন। আমি আইনজ্ঞ নই। এর সঠিক ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। তবে ব্লগের লেখালেখিতে এ বিষয়টি আমার চোখে পড়েছে। একজন সচিব অবসরে যাওয়ার এক বছর পর এসে পুরনো কোনো সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করতে পারেন না। একজন অধ্যাপক অবসরে যাওয়ার এক বছর পর পুরনো কোনো সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করতে পারেন না। একজন উপাচার্যও পারেন না। তিনি বা আমরা যখন অবসরে যাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্ক ছিন্ন হয় ওই দিনই। বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে গিয়েছিলেন ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায়ের পর পরই। রায়টি দেওয়া হয়েছিল ২০১১ সালের ১০ মে। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় দিতে না পারলেও সংক্ষিপ্ত একটি রায় তাঁরা দিয়ে গিয়েছিলেন। বিচারপতি খায়রুল হক বাদে বাকি বিচারপতিরা এখনো আপিল বিভাগে আছেন।
আমরা আগে থেকেই জানতাম, রায়টি সর্বসম্মতিক্রমে হয়নি। ওই রায়ের তিনটি দিক আছে। এক. সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা বলছেন, 'সংবিধানের (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬ রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার খর্ব করেছে বিধায় ওই তর্কিত আইন অসাংবিধানিক ও অবৈধ। সুতরাং তা বাতিল হবে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি, বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ মোট চারজন বিচারপতি ছিলেন এই মতামতের পক্ষে। অর্থাৎ তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন।
দুই. আপিল বিভাগের বাকি দুজন বিচারপতি অভিমত দিয়েছেন, 'ত্রয়োদশ সংশোধনী সাংবিধানিক ও বৈধ'। গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এর প্রয়োজন আছে বলেও তাঁরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
তিন. একজন বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীকে 'সাংবিধানিক ও বৈধ বলে স্বীকার করলেও এটি রাখা বা না রাখার ভার ছেড়ে দিয়েছেন জাতীয় সংসদের হাতে। পুরো তিনটি মতামত নিয়েই একটি রায় এবং রায়টি হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে নয়; বরং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।
প্রকাশিত রায়ের অনেক দিক আছে, যা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। ১. যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল হয়েছে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আইনগতভাবে বিবেচনায় নেওয়া যাবে না; ২. তবে বাকি তিনজন বিচারপতি যেহেতু এই সংশোধনীকে 'বৈধ ও সংবিধানসম্মত' বলেছেন এবং যেহেতু তাঁদের মতামতও রায়ের একটি অংশ, সে ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত আমরা 'যেকোনো ফর্মে' বিবেচনায় নিতে পারি; ৩. যেহেতু পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' মাধ্যমে সম্পন্ন করা, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে এই সরকার পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে- এটা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি; ৪. যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নিযুক্তিকে নিরুৎসাহী করা হয়েছে, এটাকেও ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে; ৫. একজন বিচারপতি যেহেতু 'চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের' ভার সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে দশম জাতীয় সংসদ কিভাবে আয়োজন করা যায়, সে ব্যাপারে সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমার মতে, স্পিকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন এবং দুটি বড় দল বা জোটের পাঁচজন সদস্য নিয়ে এই সরকার গঠিত হতে পারে, যাঁরা শুধু নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তবে নিরপেক্ষতার স্বার্থে স্পিকারসহ কেউই নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না; ৬. ইসিকে শক্তিশালী করার কথাও বলা আছে রায়ে। বিষয়টি নতুন নয়। অনেকেই ইসিকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর ইসি সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করে। সেখানেও এ প্রসঙ্গটি উঠেছে। ইসিকে স্বাধীনভাবে পরিচালনার কথা বলা হলেও আইন সংশোধন ছাড়া ইসিকে স্বাধীন করা যাবে না। তত্ত্বগতভাবে ইসি স্বাধীন হলো। কিন্তু নির্বাচন চলার সময়ের আগে ও পরের মাসগুলো কয়েকটি মন্ত্রণালয় যদি ইসির নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্বাচনের এক মাস আগে ও নির্বাচনের এক মাস পর ইসির নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের (মাঠপর্যায়ে) বদলি করার ক্ষমতা পাবেন। এমনকি মাঠপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা যদি আইনবহির্ভূর্ত কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, তাঁকে শাস্তি দিতে পারবেন। শুধু দু-একটি ধারা পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করা যাবে না। সত্যিকার অর্থেই সংসদে আইন পাস করিয়ে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। আর্থিকভাবেও ইসি স্বাধীন হবে। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকবে। নতুবা অর্থের জন্যই সরকার ইসির কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাবে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথা রায়ে বলা আছে। এটা একটা ভালো দিক। যদি সংসদ সদস্যদের বহাল রেখে নির্বাচন হয় (যা সংশোধিত সংবিধানে আছে), তাহলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে প্রভাব খাটাবেন, তখন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের করার কিছুই থাকবে না। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর প্রথম বড় ধরনের সংশোধন করা হয় ২০০১ সালে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে আরপিওতে আরো সংস্কার আনা হয়। এ ক্ষেত্রে ইসিকে আরো সংস্কার আনতে হবে আরপিওতে। শুধু এ বিষয়টি নিয়ে ইসি যদি আবার মতবিনিময় করে, তাহলে ইসি ভালো করবে।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত রায়ের মধ্যেই সংকট সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া আছে। যেকোনো ফর্মে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, নতুবা দেশ এক গভীর সংঘাতে নিপতিত হবে। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের আগে বেশ কয়েকজন 'অ্যামিকাস কিউরি' (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করেছিলেন। 'অ্যামিকাস কিউরি'দের একজন বাদে সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তাঁরা দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতামতও আমরা ফেলে দিতে পারি না। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি- এটা উপলব্ধি করেই উচ্চ আদালত 'আরো দুটো সংসদ' তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সংসদ। আমি এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। সংসদ প্রকাশিত রায়ের আলোকে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিক। সেই সিদ্ধান্তে বিএনপি সম্পৃক্ত হোক। সংসদে আলোচনায় তাঁদের সুযোগ দেওয়া হোক। পরস্পরের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস যদি থাকে, আমার বিশ্বাস একটা পথ আমরা খুঁজে পাবই। ইসিকে স্বাধীন করতে হবে পর্যায়ক্রমে, যাতে ইসি সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে একাদশ কিংবা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। কিন্তু বিচারপতিদের একটা বড় অংশ যেখানে চেয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকুক- এটাই হোক আলোচনার ভিত্তি।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com
www.tsrahmanbd@yahoo.com
আমরা আগে থেকেই জানতাম, রায়টি সর্বসম্মতিক্রমে হয়নি। ওই রায়ের তিনটি দিক আছে। এক. সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা বলছেন, 'সংবিধানের (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬ রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার খর্ব করেছে বিধায় ওই তর্কিত আইন অসাংবিধানিক ও অবৈধ। সুতরাং তা বাতিল হবে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি, বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ মোট চারজন বিচারপতি ছিলেন এই মতামতের পক্ষে। অর্থাৎ তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছেন।
দুই. আপিল বিভাগের বাকি দুজন বিচারপতি অভিমত দিয়েছেন, 'ত্রয়োদশ সংশোধনী সাংবিধানিক ও বৈধ'। গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এর প্রয়োজন আছে বলেও তাঁরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
তিন. একজন বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীকে 'সাংবিধানিক ও বৈধ বলে স্বীকার করলেও এটি রাখা বা না রাখার ভার ছেড়ে দিয়েছেন জাতীয় সংসদের হাতে। পুরো তিনটি মতামত নিয়েই একটি রায় এবং রায়টি হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে নয়; বরং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।
প্রকাশিত রায়ের অনেক দিক আছে, যা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। ১. যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল হয়েছে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আইনগতভাবে বিবেচনায় নেওয়া যাবে না; ২. তবে বাকি তিনজন বিচারপতি যেহেতু এই সংশোধনীকে 'বৈধ ও সংবিধানসম্মত' বলেছেন এবং যেহেতু তাঁদের মতামতও রায়ের একটি অংশ, সে ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত আমরা 'যেকোনো ফর্মে' বিবেচনায় নিতে পারি; ৩. যেহেতু পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' মাধ্যমে সম্পন্ন করা, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে এই সরকার পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে- এটা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি; ৪. যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নিযুক্তিকে নিরুৎসাহী করা হয়েছে, এটাকেও ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে; ৫. একজন বিচারপতি যেহেতু 'চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের' ভার সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে দশম জাতীয় সংসদ কিভাবে আয়োজন করা যায়, সে ব্যাপারে সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমার মতে, স্পিকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন এবং দুটি বড় দল বা জোটের পাঁচজন সদস্য নিয়ে এই সরকার গঠিত হতে পারে, যাঁরা শুধু নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তবে নিরপেক্ষতার স্বার্থে স্পিকারসহ কেউই নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না; ৬. ইসিকে শক্তিশালী করার কথাও বলা আছে রায়ে। বিষয়টি নতুন নয়। অনেকেই ইসিকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর ইসি সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করে। সেখানেও এ প্রসঙ্গটি উঠেছে। ইসিকে স্বাধীনভাবে পরিচালনার কথা বলা হলেও আইন সংশোধন ছাড়া ইসিকে স্বাধীন করা যাবে না। তত্ত্বগতভাবে ইসি স্বাধীন হলো। কিন্তু নির্বাচন চলার সময়ের আগে ও পরের মাসগুলো কয়েকটি মন্ত্রণালয় যদি ইসির নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্বাচনের এক মাস আগে ও নির্বাচনের এক মাস পর ইসির নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের (মাঠপর্যায়ে) বদলি করার ক্ষমতা পাবেন। এমনকি মাঠপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা যদি আইনবহির্ভূর্ত কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, তাঁকে শাস্তি দিতে পারবেন। শুধু দু-একটি ধারা পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করা যাবে না। সত্যিকার অর্থেই সংসদে আইন পাস করিয়ে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। আর্থিকভাবেও ইসি স্বাধীন হবে। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকবে। নতুবা অর্থের জন্যই সরকার ইসির কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাবে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথা রায়ে বলা আছে। এটা একটা ভালো দিক। যদি সংসদ সদস্যদের বহাল রেখে নির্বাচন হয় (যা সংশোধিত সংবিধানে আছে), তাহলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে প্রভাব খাটাবেন, তখন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের করার কিছুই থাকবে না। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর প্রথম বড় ধরনের সংশোধন করা হয় ২০০১ সালে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে আরপিওতে আরো সংস্কার আনা হয়। এ ক্ষেত্রে ইসিকে আরো সংস্কার আনতে হবে আরপিওতে। শুধু এ বিষয়টি নিয়ে ইসি যদি আবার মতবিনিময় করে, তাহলে ইসি ভালো করবে।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত রায়ের মধ্যেই সংকট সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া আছে। যেকোনো ফর্মে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, নতুবা দেশ এক গভীর সংঘাতে নিপতিত হবে। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের আগে বেশ কয়েকজন 'অ্যামিকাস কিউরি' (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করেছিলেন। 'অ্যামিকাস কিউরি'দের একজন বাদে সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তাঁরা দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতামতও আমরা ফেলে দিতে পারি না। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি- এটা উপলব্ধি করেই উচ্চ আদালত 'আরো দুটো সংসদ' তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সংসদ। আমি এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। সংসদ প্রকাশিত রায়ের আলোকে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিক। সেই সিদ্ধান্তে বিএনপি সম্পৃক্ত হোক। সংসদে আলোচনায় তাঁদের সুযোগ দেওয়া হোক। পরস্পরের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস যদি থাকে, আমার বিশ্বাস একটা পথ আমরা খুঁজে পাবই। ইসিকে স্বাধীন করতে হবে পর্যায়ক্রমে, যাতে ইসি সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে একাদশ কিংবা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। কিন্তু বিচারপতিদের একটা বড় অংশ যেখানে চেয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকুক- এটাই হোক আলোচনার ভিত্তি।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
www.tsrahmanbd.blogspot.com
www.tsrahmanbd@yahoo.com
No comments