কালান্তরের কড়চা-সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব মৌলবাদীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

গত রবিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় ১২টি ইসলামী মৌলবাদী দলের আহ্বানে হরতাল পালিত হয়েছে। হরতালের উদ্দেশ্য- সম্প্রতি আমেরিকায় নির্মিত একটি চলচ্চিত্রে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)কে অবমাননার প্রতিবাদ জানানো।


হরতাল কতটা সফল হয়েছে জানি না। কিন্তু আমেরিকার মাটিতে একটি উস্কানিমূলক ও উদ্দেশ্যমূলক ছবি বানানোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশেও প্রতিবাদ হওয়া দরকার ছিল। এই হরতাল সেই দরকার পূরণ করেছে।
অবশ্য এই ছবি তৈরির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এটা সরকারি প্রতিবাদ। বাংলাদেশের জনগণের প্রতিবাদ রবিবারের হরতালের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। সম্ভবত কেবল মৌলবাদী দলগুলো এই হরতাল ডাকায় এই হরতালের সঙ্গে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণ প্রকাশ পায়নি; তথাপি এই ছবি তৈরির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের মনেও যে গভীর ঘৃণা ও ক্ষোভ রয়েছে, তা এই হরতালের মধ্য দিয়ে উস্কানিদাতা পশ্চিমা দেশগুলোকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমি উৎকণ্ঠিত ছিলাম, এই হরতালের মধ্যে জামায়াত, হিযবুত তাহ্রীরের মতো ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটে কি না এবং তারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হরতালের সময় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়ে অথবা বিদেশি দূতাবাসের কোনো কোনোটিতে হামলা চালিয়ে হরতালের আসল উদ্দেশ্যটিই পণ্ড করে দেয় কি না। হরতাল শেষে যখন জানলাম শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়েছে, দেশের কোথাও কোনো ধরনের শান্তিভঙ্গ হয়নি, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি।
আমি জঙ্গি, মৌলবাদ ও মৌলবাদী সন্ত্রাসের প্রচণ্ড বিরোধী। কিন্তু মৌলবাদী জঙ্গিদের দমনের নামে খ্রিস্টান-বিশ্ব 'ওয়ার অন টেরোরিজমের' যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, তার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে রাজনৈতিক ও সামরিক; তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ারের ঘটনার পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তো বলেই ফেলেছিলেন, তিনি যে যুদ্ধে নেমেছেন তা ক্রুসেড।
তার চেয়ে বুদ্ধিতে দড় সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার থলের বিড়াল বেরিয়ে যাবে- এই ভয়ে বুশকে বলেন, 'এটা যে ক্রুসেড তা যেন তিনি না বলেন। তাহলে মনে হবে গোটা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধে নেমেছি। সুতরাং বলতে হবে এটা টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।' এ কথা বলে তিনি ব্রিটেনের কয়েকটি মসজিদ পরিদর্শন করেন এবং বুশকে দিয়েও কয়েকটি মসজিদ পরিদর্শন করান। গোটা বিশ্বের মুসলমানদের চোখে ধুলো দেওয়ার এটা ছিল একটা ধূর্ত প্রয়াস।
কিছুদিনের মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়েছে, বিশ্বকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে; এটা একটা প্রচণ্ড ভাঁওতা। কমিউনিজম ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার জন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সহায়তায় তালেবান, মুজাহিদ বাহিনী ইত্যাদি নামে ইসলামিক টেরোরিস্ট গ্রুপগুলো (যার সঙ্গে পবিত্র ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই) তৈরি করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সেই ইসলামিক টেরোরিস্টরাই তাদের জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হয়ে ওঠে। এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার নামে পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে আমেরিকা, ওয়ার অন টেরোরিজমের ট্রেডমার্ক লাগিয়ে যে যুদ্ধ শুরু করে, তার বলি প্রথমেই দুটি সেক্যুলার মুসলিম রাষ্ট্র- সাদ্দামের ইরাক ও গাদ্দাফির লিবিয়া। এখন শুরু হয়েছে আরেকটি সেক্যুলার মুসলিম রাষ্ট্র সিরিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা। এই চেষ্টা সফল হলে পরবর্তী টার্গেট শিয়া-মুসলিম রাষ্ট্র ইরান। ইরানের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সৌদি আরব, কাতার বিশ্বের প্রভৃতি মুসলিম সুন্নি দেশকে দাঁড় করানো হয়েছে। অর্থাৎ মুসলিম বিশ্বের ঐক্যকে বিভক্ত করা হয়েছে।
আসলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা (বিশ্বধনতন্ত্র) কমিউনিজম ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিপর্যস্ত করার পর এখন তাদের পরবর্তী টার্গেট করেছে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বকে। তাদের ভয় কমিউনিজমের পর খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদের শক্তিশালী শত্রু হয়ে দাঁড়াবে ইসলাম ও নবজাগ্রত মুসলিম দেশগুলো। তাদের এই ভয়ের কথা প্রথম ব্যক্ত করেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মিসেস মার্গারেট থ্যাচার। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, এখন পশ্চিমা শক্তি, তাদের সমাজ-সভ্যতা ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব।
কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভবের আগেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদের প্রবল শত্রু ছিল তুরস্কের ইসলামী সাম্রাজ্য অটোমান অ্যাম্পায়ার (ওসমানিয়া সাম্রাজ্য)। প্রথম মহাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা এই সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো করে ইরাক, জর্দান, কুয়েত, সৌদি আরব ইত্যাদি অসংখ্য তাঁবেদার রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এসব রাষ্ট্রের কোনো কোনোটিতে জাতীয়তাবাদী বিপ্লব ঘটে এবং ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসানের সূচনা হয়। এই আধিপত্য ধরে রাখা এবং মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের তেল-স্বার্থ পাহারা দেওয়ার জন্য ব্রিটেনের ব্যালফুর সাহেবের ঘোষণা অনুযায়ী আরব ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে আমেরিকা।
কমিউনিজম ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের স্লোগান ছিল, কমিউনিস্ট-আগ্রাসন থেকে গণতন্ত্র ও 'স্বাধীন বিশ্বকে' রক্ষা করা। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও নবজাগরণকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে এই সাম্রাজ্যবাদ পলিটিক্যাল ইসলাম ও ইসলামিক টেরোরিজম নিজেরাই জন্ম দেয় এবং এখন সেই টেরোরিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে গোটা মুসলিম বিশ্বকে (সেক্যুলার ও ধর্মীয় রাষ্ট্র নির্বিশেষে) দুর্বল ও পদানত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।
সাম্রাজ্যবাদীদের এই যুদ্ধের লক্ষ্য স্পষ্ট। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে একমাত্র পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে রক্ষা করা এবং আরবভূমি ক্রমাগত গ্রাস করতে দেওয়া, আরব ভূমির তেল ও অন্যান্য সম্পদের ওপর পশ্চিমাদের একচেটিয়া আধিপত্য রক্ষা এবং প্রত্যেকটি দেশে তাঁবেদার শাসকদের ক্ষমতায় রাখা। মিসরে আরব স্প্রিংয়ের এত বড় অভ্যুত্থান এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা প্রেসিডেন্ট পদে বসার পরও আসল ক্ষমতা রয়ে গেছে মার্কিন ও তাঁবেদার সামরিক বাহিনীর হাতে।
লাদেন হত্যার পরও মিত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানে চলছে আমেরিকান বর্বর ড্রোন হামলা। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইরাক ও লিবিয়াকে ধ্বংস করার পর সিরিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো হামলা, ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে অব্যাহত ড্রোন হামলা, এক কথায় মুষ্টিমেয় তাঁবেদার মুসলিম রাষ্ট্র ছাড়া গোটা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধেই চলছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন।
এই আগ্রাসনকে যৌক্তিকতা দানের জন্য একটি সন্ত্রাসী ইসলামী প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো প্রয়োজন। আমেরিকা তাও দাঁড় করিয়েছে এবং এই প্রতিপক্ষ যে কত বড় সন্ত্রাসী, তা প্রমাণ করার জন্য কথা বলার স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা রক্ষা ইত্যাদি নামে অনবরত ইসলাম ধর্ম ও তার নবীর নামে উস্কানিমূলক মন্তব্য, কার্টুন, চলচ্চিত্র প্রচার করে সাধারণ মুসলমানদেরও খেপিয়ে তোলা হচ্ছে এবং মুসলমানরা যত খেপছে, ততই পশ্চিমাদের পক্ষে প্রচার করা সহজ হচ্ছে, ইসলাম ধর্ম টেরোরিজমের ধর্ম এবং মুসলমানরা টেরোরিস্ট।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে হেয় করার জন্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা বহু লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীকে ক্রয় করেছিল। তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ছিলেন আর্থার কোয়েসলার। কমিউনিজম সম্পর্কে কুৎসা প্রচারকারী তাঁর বই 'দ্য গড দ্যাট ফেইলড্' (পরাভূত দেবতা)-এর কথা এত শিগগিরই আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
ঠিক অনুরূপভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার এবং সাধারণ মুসলমানদেরও বিক্ষুব্ধ করে তোলার জন্য বোম্বাইয়া মুসলমান-লেখক সালমান রুশদিকে মাঠে নামানো হয়েছিল। রুশদির 'স্যাটানিক ভার্সেস' বইটির সাহিত্যমূল্য যা-ই হোক, বইটির প্রকাশ ছিল উদ্দেশ্যমূলক ও উস্কানিমূলক। এই উদ্দেশ্য সফল করা গেছে। বিশ্বময় মুসলমানদের ক্ষিপ্ত করা গেছে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করা গেছে। বিক্ষোভে মানুষজন নিহত হয়েছে। পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা-বিশেষজ্ঞরা বিশ্ববাসীর কাছে ইসলাম ধর্মকে টেরোরিজমের ধর্ম হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে।
বর্তমানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্লোগান তুলে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করে আমেরিকা তথা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদ যে সর্বাত্মক বর্বর যুদ্ধে নেমেছে, তা তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক একচ্ছত্র প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বর্তমান টার্গেট মূলত মুসলিম দেশগুলো হওয়ায় ইসলামকেই টেরোরিজমের ধর্ম ও মুসলমানদেরই টেরোরিস্ট হিসেবে সাজানো সহজ হয়েছে।
যদিও আক্রান্ত মুসলিম দেশের বেশ কটিই সেক্যুলার এবং যে লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হচ্ছে, তারা সবাই মৌলবাদী নয়, তাদের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য মুসলমান সেক্যুলারিস্ট। এই যুদ্ধ আসলে টেরোরিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, এটি একটি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, গণহত্যাকারী বর্বর যুদ্ধ। এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা সব ধর্মের শান্তিকামী মানুষেরই দায়িত্ব।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, আগে ছিল কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, এখন এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নাম দেওয়া হয়েছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আসলে যুদ্ধটা ধনবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব-আধিপত্য রক্ষার এবং যুদ্ধের বলিও হচ্ছে বিশ্বের মানুষ ও মানবতা। সাম্রাজ্যবাদীদের এই যুদ্ধ এখন একসঙ্গে বহু ফ্রন্টে চলছে। সামরিকভাবে চলছে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র দ্বারা দুর্বল দেশগুলোর নিরস্ত্র জনগণের ওপর। রাজনৈতিক ফ্রন্টে চলছে টার্গেট করা দেশগুলোতে প্রচণ্ডভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ দ্বারা। ইরানকে তো অর্থনৈতিক ও সামরিক দুইভাবেই অবরোধ করা হয়েছে। কালচারাল ফ্রন্টে চলছে ভাড়াটে লোকদের দ্বারা অনবরত উস্কানিমূলক বই প্রকাশ, চলচ্চিত্র নির্মাণ। এভাবে উস্কানি দিয়ে বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিতে প্ররোচিত করা এবং তাদের ধর্ম ও সম্প্রদায়কে টেরোরিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করার তৎপরতা চলছে।
সম্প্রতি আমেরিকায় মহানবী (সা.)-এর অবমাননামূলক ফিল্মটি প্রদর্শনের পর লিবিয়ায় উত্তেজিত মানুষের হাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁর তিনজন সহকর্মীসহ নিহত হয়েছেন। সারা মুসলিম বিশ্বেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগে এক দুর্বৃত্ত মার্কিনি পবিত্র কোরআন পোড়ানোর অভিযান শুরু করেছিল। তার ফলেও হাঙ্গামা কম হয়নি। দোষ চাপানো হয়েছে 'সন্ত্রাসী ইসলামের' বিরুদ্ধে। এই উস্কানি দান পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ চালিয়ে আসছে।
বর্তমান মার্কিন ফিল্মটি প্রদর্শিত হওয়ার পাশাপাশি ফ্রান্সের স্যাটায়ার-পত্রিকা 'চার্লি হেবডো' প্রকাশ করেছে ইসলামের নবীর অবমাননামূলক এক কার্টুন। এর আগে ফরাসি সরকার ঘোষণা করে, মুসলিম নারীরা সে দেশে হিজাব পরিধান করতে পারবে না। জার্মান সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, মুসলমান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত খত্না ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করার। এগুলো কি হান্টিংটন সাহেবের তত্ত্ব অনুযায়ী কালচারাল ক্লাসের (Cultural Clash) বহিঃপ্রকাশ, না সাম্রাজ্যবাদী দম্ভ ও অভিলাষ পূরণের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় ও কালচারাল সংঘাত সৃষ্টি করা এবং শুধু মুসলিম বিশ্বে নয়, সারা বিশ্বে নতুন নতুন যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করা ও গুরুতর মন্দায় আক্রান্ত ধনবাদকে রক্ষার জন্য মারণাস্ত্র নির্মাণ ও বিক্রির ব্যবসাকে উৎসাহিত করা?
বাংলাদেশে উস্কানিমূলক মার্কিন চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে গত রবিবার যে হরতাল হয়েছে, তাকে আমি বর্তমান বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটা অংশ বলে মনে করি। ১২টি ইসলামী দল এই হরতালের ডাক দিয়েছে। এই ডাকটি তো আসা উচিত ছিল দেশের সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক দলগুলোর কাছ থেকেই। কারণ এটা একটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে অতীতে সব সময় নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে বাংলাদেশের সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক দলগুলোই। সেই নেতৃত্ব তারা হাতছাড়া করতে চায় কেন এবং কেনইবা মৌলবাদীদের হাতে আন্দোলনের রাজপথ ছেড়ে দিতে চায়?
মৌলবাদীদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার লক্ষ্য খুবই সীমিত। সাম্রাজ্যবাদীদের আসল লক্ষ্য তারা বুঝতে পারে না এবং তাতে আঘাত হানতেও জানে না। বাংলাদেশের সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক শিবিরের জানা উচিত, পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলাম ও তার নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে যে প্রচারণা চলছে, তার উদ্দেশ্য ধর্মীয় নয়, উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং বিশ্বে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজিত রেখে বিশ্ব ধনবাদের শেষ আশ্রয় মারণাস্ত্র ব্যবসার বিস্তার ঘটানো। সাম্রাজ্যবাদীদের এই যুদ্ধ একটি ধর্ম ও তার অনুসারীদের আঘাত করার ছদ্মাবরণে মানব স্বাধীনতা ও মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের শান্তিকামী, গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা এবং তাতে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রধান দায়িত্ব সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক শিবিরেরই।
লন্ডন, ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার, ২০১২

No comments

Powered by Blogger.