পদ্মা সেতুর ফিরে আসা by ড. হারুন রশীদ

অনেক নাটকীয়তা এবং ঘটনাপ্রবাহের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের চুক্তি পুনর্বহালের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল বিশ্বব্যাংকের এই ঘোষণার জন্য। দুর্নীতির সম্ভাবনা এবং প্রকল্পে অস্বচ্ছতার অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর অন্যতম দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক গত ২৯ জুন তাদের ঋণ চুক্তি বাতিল করে।


এটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক বিরাট দুঃসংবাদ। বর্তমান মহাজোট সরকারও বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। কারণ আওয়ামী লীগের নেতত্বাধীন মহাজোট সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। সে জন্য ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। বিএনপি সরকারের সময় যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেই বিশ্বব্যাংককে আবার বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে সংযুক্ত করতে সক্ষম হয় বর্তমান সরকার। সঙ্গত কারণেই ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে এককভাবে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার (নয় হাজার ৬০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বব্যাংক। এ জন্য গত বছরের ২৮ এপ্রিল এই বিপুল পরিমাণ অর্থায়নের চুক্তি করে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার, জাইকা ৪০ কোটি ডলার, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা আইডিবি ১৪ কোটি ডলার বিনিয়োগের জন্যও চুক্তিবদ্ধ হয়।
এর মধ্যে প্রকল্পের কাজ অনেক দূর এগিয়ে যায়। ২৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলনের প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনসহ বেশকিছু অগ্রগতি সম্পন্ন হয়। এ সংক্রান্ত কাজে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা খরচও হয়ে গেছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করেই বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ চুক্তি বাতিল করে। এতে পদ্মা সেতুর ভবিষ্যত অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যদিও বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এতে দেশে এক অভূতপূর্ব জনজাগরণের সৃষ্টি হয়। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে এক অভিনব দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে। সকলেই ‘যার হাতে যা আছে’ তাই নিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। অন্যদিকে মালয়েশিয়াসহ অনেক দাতা গোষ্ঠীও এগিয়ে আসে। সরকার সকল পথই খোলা রাখে। এমনকি বিশ্বব্যাংক যেসব কারণ দেখিয়ে ঋণ চুক্তি বাতিল করে সেগুলোও প্রতিকারের চেষ্টা করে। বেশকিছু দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থায়ও নেয় সরকার। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুইঞা এবং অর্থউপদেষ্টা মসিউর রহমানকে ছুটিতে পাঠানো হয়। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ চুক্তি পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেয়। যা বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসেও এক বিরল ঘটনা। বিশ্বব্যাংক এ সংক্রান্ত যে বিবৃতিটি দেয় তা প্রণিধানযোগ্য। গত ২১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন থেকে দেয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়Ñ বিশ্বব্যাংক গত ২৯ জুন, ২০১২ তারিখে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের জন্য ১.২ বিলিয়ন ডলারের আইডিএ ঋণ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল। এর আগে বিশ্বব্যাংকের ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করেছিল এবং এই প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট থাকার উদ্দেশে বিশ্বব্যাংক, সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি সুস্পষ্ট ও সুর্নিদিষ্ট পদক্ষেপ চিহ্নিত করেছিল যা বাংলাদেশ সরকার পূরণ করতে পারেননি। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে :- (ক) যে সকল সরকারী কর্মকর্তা ও সরকারী ব্যক্তিবগের্র (আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারী দায়িত্ব থেকে তাদের ছুটি প্রদান; (খ) এই অভিযোগ তদন্তের জন্য বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ; (গ) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সকল তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি প্রদান যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে। এবং; (ঘ) বিকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থার বিষয়ে একমত হওয়া যাতে বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী দাতারা প্রকল্পের ক্রয় কর্মকা- আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায়।
ঋণ বাতিলের পর, বাংলাদেশ সরকার উপরোল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ সরকার দূর্নীতির যে প্রমাণ বিশ্বব্যাংক চিহ্নিত করেছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংক মনে করে যে, প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহভাজন সকল সরকারি ব্যক্তিবর্গকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি দায়িত্ব থেকে ছুটি দেয়া হয়েছে এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু তদন্ত চলছে।
এসব পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানানোর সময় বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংককে পদ্মা বহুমুখী সেতুতে অর্থায়নের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করে। সরকার নতুনভাবে বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ গ্রহণে সম্মত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : সেতুর নির্মাণ কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্পে নতুন ক্রয় ব্যবস্থায় অধিকতর ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের সুযোগ; সুষ্ঠু, অবাধ ও দ্রুত তদন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া; এবং তদন্ত পর্যালোচনা করে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রদানের জন্য একটি স্বাধীন এক্সটারনাল প্যানেল গঠন। সরকারের সম্মত ব্যবস্থাগুলোর সন্তোষজনক বাস্তবায়ন এবং বিশ্বব্যাংকের গভর্নিং বডির সহায়তায়, বিশ্বব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতুতে নতুন করে সম্পৃক্ত হতে রাজি হয়েছে।
বিবৃতিতে দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক কিছু শর্তও যুক্ত করে দিয়েছে। ঋণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই শর্তগুলো নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। বিশ্বব্যাংকের শর্ত নতুন কোনো বিষয় নয়। শর্তের মূল লক্ষ্য যদি হয় দুর্নীতিমুক্ত এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন তাহলে সেটি মেনে নিতে কোনো পক্ষেরই আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই।
পদ্মা সেতু প্রকল্প শুধু বিশাল এক কর্মযজ্ঞ নয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে তা এক বিরাট প্রভাব ফেলবে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের বৃহত্তম এই সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শুধু দক্ষিণাঞ্চলই নয় সারাদেশেই এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্লেষকদের মতে, সেতু নির্মাণ সম্ভব হলে জাতীয়ভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এই প্রবৃৃদ্ধির হার হবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এর ফলে এ অঞ্চলে দারিদ্র্যের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও যে একটি আমুল পরিবর্তন ঘটবে সেটি তো বলার অপেক্ষা রাখছে না। বিশেষ করে পদ্মা সেতুতে রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় রেল পরিবহনের জন্য তা এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। এখন পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নই হচ্ছে মূল কথা।
বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিলের পর সরকার নানাভাবে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে সেটা পুনর্বহাল করতে পেরেছে এটা সরকারের জন্য এক বিরাট সাফল্য। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পথ বড় বন্ধুর। বিশ্বব্যাংক যেসব শর্তারোপ করেছে সেগুলো মেনে চলাটাও অত্যন্ত জরুরী। এই শর্ত অনেক ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সেটা যেন পরিস্থিতিকে আবার অচলাবস্থার দিকে না নিয়ে যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পদ্মা সেতু নিয়ে যত কথা হয়েছে বাংলাদেশের আর কোনো প্রকল্প নিয়ে এত ঘটনা নাটকীয়তা হয়নি। কাজেই উভয় পক্ষই এ সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল। পদ্মা সেতুতে ঋণ চুক্তি বাতিল করায় বিশ্বব্যাংকও সমালোচনার মুখে পড়ে। বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়, বাংলাদেশ সুদসহ এই ঋণ আবার পরিশোধ করে দেয়। কাজেই শর্ত এমন হওয়া উচিত যা একটি দেশের স্বাধীন দেশের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই অমর্যাদাকর না হয়। বিশ্বব্যাংক যে শর্ত দিয়েছে তা প্রকল্পকে দুর্নীতিমুক্ত এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে এমটিই বলছেন বিশ্লেষকরা। তবে শর্তের ভারে প্রকল্পই যেন ঝুলে না যায় সে ব্যাপারে অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে উচিত হবে সেতুর কাজ যথাসম্ভব দ্রুত শুরু করা। কারণ দেরি হওয়া মানেই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়া।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ফিরে আসায় সরকারের একটি নৈতিক বিজয় অর্জন হলো। এখন সেতু নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে পারলেই এই বিজয় সত্যিকার অর্থে দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে।

harun_press@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.