চালচিত্র-নির্বাচন, সংসদ জাতীয় ঐকমত্য by শুভ রহমান
নির্বাচন হবে তো? জনমনে সংশয় দিন দিন বাড়ছে। সরকার এবং বিরোধী, দুই পক্ষ এ প্রশ্নে দুই মেরুতে। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর করতে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি। আর কিছুকাল পরই আওয়ামী লীগের বিদায় ঘণ্টা বেজে যাবে। কী বিপুল সম্ভাবনার অধিকারী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল।
এখন দেশের মানুষ তো বটেই, আওয়ামী লীগ নিজেও তার অবস্থার পুনর্মূল্যায়ন করছে। কী দেখছে আওয়ামী লীগ, ক্ষমতায় ফেরা যাবে?
সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সংসদকে কার্যকর করতে পারেনি। দিনবদল ও সমাজবদলের হাতিয়ার হিসেবে সংসদকে আওয়ামী লীগ কাজে লাগাতে পারেনি। অথচ আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে, সংসদীয় গণতন্ত্রকে তারই তো এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ছিল।
আওয়ামী লীগ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতেও যেন ইতস্ততই করছে। হয়তো পরিস্থিতির উন্নতির আশায় সময়ক্ষেপণ করতে চাইছে। দেখতে চাইছে, পদ্মা সেতু করে ফেলার পথে লক্ষণীয় অগ্রগতি হাসিল করা যায় কি না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করে অন্তত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের আইনানুযায়ী শাস্তি কার্যকর করার মতো জায়গায় আসা যায় কি না। জিনিসপত্রের দাম এই এখনকার মতো কৃত্রিমভাবে নয়, স্থায়ীভাবেই সহনীয় ও নিয়ন্ত্রিত রাখার ব্যবস্থা করা যায় কি না। আইনশৃঙ্খলার একটা লক্ষণীয় উন্নতি সাধন করা যায় কি না। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডসহ সাংবাদিক হত্যার কিনারায় নিদারুণ ব্যর্থতার কালিমা কিছুটা হলেও মুছে ফেলা যায় কি না। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এই শেষ সময়ে এখন আবার শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একের পর এক ধুম গণ্ডগোল, যা কোনো দিন চিন্তাও করা যায়নি। উপাচার্য আর উপউপাচার্য নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ধুন্ধুমার আন্দোলন হচ্ছে, সহিংসতা, পুলিশের সঙ্গে মারপিটে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস বন্ধ পর্যন্ত করে দিতে হচ্ছে। ওদিকে সিলেটে কলেজ ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়ার মতো বেদনাদায়ক ও ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে গেছে। এসবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শাসক মহাজোটের এ আমলের উজ্জ্বলতম অর্জন শিক্ষাসংস্কার ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তন নিজেদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কালিমা লিপ্ত হয়েই ম্লান হয়ে গেল। এ দেশের এযাবৎকালের একজন শ্রেষ্ঠ দেশ পরিচালক হয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিদারুণ অসহায়ত্বই ব্যক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা ভেতর থেকে হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক উন্নয়নের, ব্যর্থতার দায় ঘাড়ে করে মহাজোট সরকার মন্ত্রণালয় ভাঙাগড়া করল, নতুন প্রতিশ্রুতিশীল যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব দিল অপেক্ষাকৃত তরুণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। মাথা খুঁড়ে মরছেন তিনি। সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য দৌড়াদৌড়ি করে সরেজমিনে গিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইছেন। এর পরও তাঁর সব উদ্যোগে যে শাসক মহাজোটের রাজনৈতিক ব্যর্থতা, সংসদকে কার্যকর করার ব্যর্থতাই শেষ পর্যন্ত পানি ঢেলে দেবে না, তা হলফ করে বলা যায় না। বিশ্লেষকরা বলছেন, তাঁর অবস্থা হয়েছে গ্রিক পুরাণের অভিশপ্ত সিসিফাসের মতো। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পাথরটাকে ঠেলে ওপরে তুলে ঠিক জায়গায় রাখছে, পরমুহূর্তেই তা আবার নিচে গড়িয়ে পড়ছে। আসলে পরিবর্তনটা যে সর্বত্র ভেতর থেকেই হতে হবে, এ বোধটুকু শাসক মহাজোটের
হলো না।
একটা সুস্থ সমাজদেহের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তাসহ শক্তিশালী সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। এ ব্যবস্থা কবে হবে?
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, ঈদের আগে তার মীমাংসা হচ্ছে না। ঈদের পরও যে মীমাংসা হবে, তার আশাও ক্ষীণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ধাপ এগিয়ে এসে প্রধান দুই দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবটা বিরোধী দলের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তবে বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড়। ঈদের পর সে দাবিতে ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে তুলে সরকার পতনের ডাক দেওয়া হবে বলেই তিনি আবার ঘোষণা করে রেখেছেন। সেই সঙ্গে ঈদের পর ত্রয়োদশ সংশোধনীর ভিত্তিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে বলেও তাঁর দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এদিকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে জাতীয় সংলাপের প্রত্যাশা এখনো সুদূরপরাহতই মনে হচ্ছে। শাসক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ধরনসংক্রান্ত আলোচনার শুরুতেই তাতে পানি ঢেলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এত আগে নির্বাচন নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। এর আগে বিরোধী দলকে তাদের মানসিকতা পাল্টাতে হবে। তবে আওয়ামী লীগ আগাগোড়া এই কথাই বলে আসছে, বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, এখানেও সেভাবেই হবে। বিরোধী দলকে তাদের প্রস্তাব নিয়ে সংসদে যাওয়ারও আহ্বান জানাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচন অনুষ্ঠানে সামনে অনেক বাধাবিঘ্ন, অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। তার পরও দেশের সচেতন মানুষ মাত্রই বলছে, নির্বাচন যেকোনো মূল্যে হতেই হবে। দেশজুড়ে বর্তমান সময়ে যে নৈরাজ্য-অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে, সচেতন মহল বুঝছে, নির্দিষ্ট সময়ে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ার অর্থই দাঁড়াবে সে অবস্থার আরো অবনতি ঘটা, দেশ একেবারে ধ্বংসের কিনারায় চলে যাওয়া।
নির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে হলে শাসক দল ও বিরোধী দল, উভয়ের সামনেই অন্তত চারটি অবশ্যকরণীয় কর্তব্য রয়েছে- ১. বিদ্যমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বশক্তি দিয়ে টিকিয়ে রাখা, ২. সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি সর্বতোভাবে মেনে চলা, ৩. সংসদীয় গণতন্ত্র যে অন্য যেকোনো আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত, সভ্য ও জনকল্যাণকর- এই প্রতিষ্ঠিত সত্য, আদর্শ ও চেতনা সমুন্নত রাখা এবং ৪. দেশ পরিচালনা তথা দেশ শাসনের যে দর্শন এই ব্যবস্থার পেছনে কাজ করে, তাকে বিতর্কিত ও কলুষিত না করা, তার সীমাবদ্ধতা ঘুচিয়ে তাকে ক্রমেই জোরদার করে তোলা।
আমাদের বিশ্বাস, অনেক ব্যর্থতা, ব্যত্যয় ও ভুলত্রুটি ঘটা সত্ত্বেও শাসক জোট কিংবা বিরোধী জোট- কোনো পক্ষই সংসদীয় গণতন্ত্রের দুই দশকেরও বেশি সময় এখন পর্যন্ত উল্লিখিত করণীয়গুলোর একটিকেও নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বাদ দেয়নি।
সমাজদেহে আজ যে ভয়াবহ নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে, আগামী নতুন জাতীয় সংসদকে হতে হবে তার চির অবসান ঘটানো এবং নতুন উন্নত সমাজ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ দেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের পর পাকিস্তানি আমল এবং তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘ স্বৈরশাসন, সামরিক শাসন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ঘৃণ্য ক্ষমতালিপ্সু ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের শাসন, সব কালো অধ্যায় চিরতরে শেষ করতেই আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। প্রতিবেশী ভারতসহ বহু গণতান্ত্রিক দেশ নিরবচ্ছিন্ন সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জোরেই উন্নতির শিখরে আরোহণ করে বিশ্বসভায় মর্যাদার স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। আর শক্তিশালী ও কার্যকর সংসদ না থাকায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার বিপর্যস্ত হওয়ার দরুনই আমরা অনেক পেছনে পড়ে রয়েছি, শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্যই নয়। এ পশ্চাৎপদতা ঘোচাতেই আগামী সংসদ নির্বাচন হতে হবে।
১২.৮.২০১২
সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সংসদকে কার্যকর করতে পারেনি। দিনবদল ও সমাজবদলের হাতিয়ার হিসেবে সংসদকে আওয়ামী লীগ কাজে লাগাতে পারেনি। অথচ আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, স্বাধীনতার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে, সংসদীয় গণতন্ত্রকে তারই তো এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ছিল।
আওয়ামী লীগ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতেও যেন ইতস্ততই করছে। হয়তো পরিস্থিতির উন্নতির আশায় সময়ক্ষেপণ করতে চাইছে। দেখতে চাইছে, পদ্মা সেতু করে ফেলার পথে লক্ষণীয় অগ্রগতি হাসিল করা যায় কি না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করে অন্তত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের আইনানুযায়ী শাস্তি কার্যকর করার মতো জায়গায় আসা যায় কি না। জিনিসপত্রের দাম এই এখনকার মতো কৃত্রিমভাবে নয়, স্থায়ীভাবেই সহনীয় ও নিয়ন্ত্রিত রাখার ব্যবস্থা করা যায় কি না। আইনশৃঙ্খলার একটা লক্ষণীয় উন্নতি সাধন করা যায় কি না। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডসহ সাংবাদিক হত্যার কিনারায় নিদারুণ ব্যর্থতার কালিমা কিছুটা হলেও মুছে ফেলা যায় কি না। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো এই শেষ সময়ে এখন আবার শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একের পর এক ধুম গণ্ডগোল, যা কোনো দিন চিন্তাও করা যায়নি। উপাচার্য আর উপউপাচার্য নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ধুন্ধুমার আন্দোলন হচ্ছে, সহিংসতা, পুলিশের সঙ্গে মারপিটে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস বন্ধ পর্যন্ত করে দিতে হচ্ছে। ওদিকে সিলেটে কলেজ ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেওয়ার মতো বেদনাদায়ক ও ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটে গেছে। এসবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শাসক মহাজোটের এ আমলের উজ্জ্বলতম অর্জন শিক্ষাসংস্কার ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তন নিজেদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কালিমা লিপ্ত হয়েই ম্লান হয়ে গেল। এ দেশের এযাবৎকালের একজন শ্রেষ্ঠ দেশ পরিচালক হয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিদারুণ অসহায়ত্বই ব্যক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা ভেতর থেকে হয়নি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক উন্নয়নের, ব্যর্থতার দায় ঘাড়ে করে মহাজোট সরকার মন্ত্রণালয় ভাঙাগড়া করল, নতুন প্রতিশ্রুতিশীল যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব দিল অপেক্ষাকৃত তরুণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে। মাথা খুঁড়ে মরছেন তিনি। সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য দৌড়াদৌড়ি করে সরেজমিনে গিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইছেন। এর পরও তাঁর সব উদ্যোগে যে শাসক মহাজোটের রাজনৈতিক ব্যর্থতা, সংসদকে কার্যকর করার ব্যর্থতাই শেষ পর্যন্ত পানি ঢেলে দেবে না, তা হলফ করে বলা যায় না। বিশ্লেষকরা বলছেন, তাঁর অবস্থা হয়েছে গ্রিক পুরাণের অভিশপ্ত সিসিফাসের মতো। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পাথরটাকে ঠেলে ওপরে তুলে ঠিক জায়গায় রাখছে, পরমুহূর্তেই তা আবার নিচে গড়িয়ে পড়ছে। আসলে পরিবর্তনটা যে সর্বত্র ভেতর থেকেই হতে হবে, এ বোধটুকু শাসক মহাজোটের
হলো না।
একটা সুস্থ সমাজদেহের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তাসহ শক্তিশালী সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। এ ব্যবস্থা কবে হবে?
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ধরনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, ঈদের আগে তার মীমাংসা হচ্ছে না। ঈদের পরও যে মীমাংসা হবে, তার আশাও ক্ষীণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ধাপ এগিয়ে এসে প্রধান দুই দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবটা বিরোধী দলের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তবে বিরোধী দল বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড়। ঈদের পর সে দাবিতে ধাপে ধাপে আন্দোলন গড়ে তুলে সরকার পতনের ডাক দেওয়া হবে বলেই তিনি আবার ঘোষণা করে রেখেছেন। সেই সঙ্গে ঈদের পর ত্রয়োদশ সংশোধনীর ভিত্তিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে বলেও তাঁর দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এদিকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে জাতীয় সংলাপের প্রত্যাশা এখনো সুদূরপরাহতই মনে হচ্ছে। শাসক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ধরনসংক্রান্ত আলোচনার শুরুতেই তাতে পানি ঢেলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এত আগে নির্বাচন নিয়ে আলোচনার দরকার নেই। এর আগে বিরোধী দলকে তাদের মানসিকতা পাল্টাতে হবে। তবে আওয়ামী লীগ আগাগোড়া এই কথাই বলে আসছে, বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, এখানেও সেভাবেই হবে। বিরোধী দলকে তাদের প্রস্তাব নিয়ে সংসদে যাওয়ারও আহ্বান জানাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
নির্বাচন অনুষ্ঠানে সামনে অনেক বাধাবিঘ্ন, অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। তার পরও দেশের সচেতন মানুষ মাত্রই বলছে, নির্বাচন যেকোনো মূল্যে হতেই হবে। দেশজুড়ে বর্তমান সময়ে যে নৈরাজ্য-অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে, সচেতন মহল বুঝছে, নির্দিষ্ট সময়ে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ার অর্থই দাঁড়াবে সে অবস্থার আরো অবনতি ঘটা, দেশ একেবারে ধ্বংসের কিনারায় চলে যাওয়া।
নির্দিষ্ট সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে হলে শাসক দল ও বিরোধী দল, উভয়ের সামনেই অন্তত চারটি অবশ্যকরণীয় কর্তব্য রয়েছে- ১. বিদ্যমান সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বশক্তি দিয়ে টিকিয়ে রাখা, ২. সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি সর্বতোভাবে মেনে চলা, ৩. সংসদীয় গণতন্ত্র যে অন্য যেকোনো আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত, সভ্য ও জনকল্যাণকর- এই প্রতিষ্ঠিত সত্য, আদর্শ ও চেতনা সমুন্নত রাখা এবং ৪. দেশ পরিচালনা তথা দেশ শাসনের যে দর্শন এই ব্যবস্থার পেছনে কাজ করে, তাকে বিতর্কিত ও কলুষিত না করা, তার সীমাবদ্ধতা ঘুচিয়ে তাকে ক্রমেই জোরদার করে তোলা।
আমাদের বিশ্বাস, অনেক ব্যর্থতা, ব্যত্যয় ও ভুলত্রুটি ঘটা সত্ত্বেও শাসক জোট কিংবা বিরোধী জোট- কোনো পক্ষই সংসদীয় গণতন্ত্রের দুই দশকেরও বেশি সময় এখন পর্যন্ত উল্লিখিত করণীয়গুলোর একটিকেও নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বাদ দেয়নি।
সমাজদেহে আজ যে ভয়াবহ নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে, আগামী নতুন জাতীয় সংসদকে হতে হবে তার চির অবসান ঘটানো এবং নতুন উন্নত সমাজ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এ দেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের পর পাকিস্তানি আমল এবং তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘ স্বৈরশাসন, সামরিক শাসন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, ঘৃণ্য ক্ষমতালিপ্সু ও সামরিক-বেসামরিক আমলাদের শাসন, সব কালো অধ্যায় চিরতরে শেষ করতেই আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। প্রতিবেশী ভারতসহ বহু গণতান্ত্রিক দেশ নিরবচ্ছিন্ন সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জোরেই উন্নতির শিখরে আরোহণ করে বিশ্বসভায় মর্যাদার স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। আর শক্তিশালী ও কার্যকর সংসদ না থাকায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার বিপর্যস্ত হওয়ার দরুনই আমরা অনেক পেছনে পড়ে রয়েছি, শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্যই নয়। এ পশ্চাৎপদতা ঘোচাতেই আগামী সংসদ নির্বাচন হতে হবে।
১২.৮.২০১২
No comments