ভাঙা হাড় জোড়া লাগাতে ‘তেলমালিশ চিকিৎসা’ by আনোয়ার পারভেজ

কোমরের ব্যথা, হাড়গোড় ভাঙা ও মচকানোর চিকিৎসার নামে দেওয়া হয় তেলমালিশ। কথিত এই চিকিৎসা নিতে কম করে হলেও প্রতিদিন আড়াই শ মানুষ আসেন কবিরাজবাড়িগুলোতে। জনপ্রতি ফি হিসেবে ১৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এর বাইরে ওষুধের (তেল) দাম তো আছেই।


জমজমাট এই কবিরাজি ব্যবসা চলছে বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে বুজরুকবাড়িয়া মহল্লার চারটি বাড়িতে।
কবিরাজবাড়ির লোকজন জানান, ভেঙে যাওয়া হাড় জোড়া লাগানোর এ চিকিৎসা তাঁদের পূর্ব-পুরুষের স্বপ্নে পাওয়া। এরপর বংশপরম্পরায় চলে আসছে এ পেশা। এক কবিরাজ দাবি করেন, তিনি রোগীর গায়ে হাত বুলিয়েই হাড় ভেঙে না মচকে গেছে বুঝতে পারেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন এ বি এম আব্দুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, কবিরাজি চিকিৎসা বিজ্ঞানসমঞ্চত নয়। এটা হাতুড়ে চিকিৎসা। সাধারণত একশ্রেণীর প্রতারক কবিরাজি চিকিৎসার নামে ফাঁদ পেতে গ্রামাঞ্চলের সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো বা প্রতিস্থাপনের চেষ্টা থেকে রোগী সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন বলে মন্তব্য করেন এই চিকিৎসক।
৩ আগস্ট সরেজমিনে বুজরুকবাড়িয়ার কবিরাজ বাড়িগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, হাত-পা ভাঙা ও মচকানো এবং কোমরের ব্যথা নিয়ে আসা নানা বয়সী রোগী এখানে ভিড় করছেন। রোগীদের বেশির ভাগই গ্রাম থেকে আসা। কবিরাজ সামছুল সরকার জানান, ১৯৫০ সালের দিকে প্রয়াত কবিরাজ ইব্রাহীম সরকার স্বপ্নে পাওয়া এ চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। বর্তমানে চারটি কবিরাজবাড়িতে তিনি নিজেসহ মানিক সরকার, আবদুল হান্নান সরকার ও জলিল সরকার কথিত এই চিকিৎসা দিচ্ছেন।
বেলা ১১টার দিকে মানিক সরকারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ময়লা-আবর্জনামাখা একটি বেঞ্চে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি হিসেবে ব্যবহার করা ধারালো দা, বাঁশের কিছু ফালি এবং গজ-ব্যান্ডেজ রাখা রয়েছে। পাশেই দুই তরুণ দা দিয়ে বাঁশের ফালি কেটে চিকিৎসা নিতে আসা এক কিশোরের ভাঙা হাতে গজ-ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে দিচ্ছেন। গজ-ব্যান্ডেজ বাঁধার আগে ভাঙা স্থানে তেল মালিশ করে দেন তাঁরা। কবিরাজবাড়ির ব্যবস্থাপক আবদুল মান্নান সেই কাজের তদারকি করছেন। কিশোরের চিকিৎসা শেষ না হতেই গাবতলী থেকে পাঁচ বছরের ছেলে সাগরকে সঙ্গে নিয়ে আসা সালেহা বেগম (৩৫) ব্যবস্থাপককে তাগাদা দিয়ে বলেন, ‘দুইবার চিকিৎসা নিয়ে গেছি, কাজ হয়নি। আজ অপারেশন (অস্ত্রোপচার) করার কথা। অপারেশন করাতেই ছেলেকে নিয়ে আসছি।’ সালেহা বেগম অস্ত্রোপচারের কথা বলতেই কবিরাজ-ঘরের পেছনে নজর গেল। সেখানে খাস কামরা।
রোগীরা জানান, এ কামরায় জটিল রোগীদের চিকিৎসা ও মালিশ করে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারও করা হয়। এ জন্য হাসপাতালের আদলে কয়েকটি শয্যাও রয়েছে সেখানে। স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, মানিকের এ কবিরাজ বাড়িতে প্রতিদিন অন্তত ৫০-৬০ জন রোগী আসেন। রোগীদের কাছ থেকে দেড় শ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ফি নেওয়া হয়।
ব্যবস্থাপক আবদুল মান্নান বলেন, ভালো হলে রোগীরা খুশি হয়ে ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বকশিশ দেন। কবিরাজ সামছুল সরকার বলেন, ‘রোগীর গায়ে হাত দিলেই বুঝতে পারি ভেঙে না মচকে গেছে। এরপর জোড়া প্রতিস্থাপন করে ব্যান্ডেজ করে দিই। খাওয়ার কোনো ওষুধও নেই এখানে। তবে ৪০০ টাকা কেজি দরে মালিশ-তেল দেওয়া হয়। দূর-দূরান্ত থেকে এ চার কবিরাজবাড়িতে গড়ে প্রতিদিন আড়াই শ রোগী আসে।’
জেলা সিভিল সার্জন খলিলুর রহমান বলেন, কবিরাজবাড়িগুলোতে যা হচ্ছে সেটা শতভাগ অপচিকিৎসা। কিছু মানুষ না বুঝেই এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এটা অত্যন্ত বেআইনি কাজ। জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদ বলেন, শহরের উপকণ্ঠে চিকিৎসার নামে এ ধরনের অপচিকিৎসার তৎপরতা কোনোক্রমেই মেনে নেওয়া হবে না। হাতুড়ে চিকিৎসা বন্ধে সিভিল সার্জন ব্যবস্থা না নিলে প্রয়োজনে সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.