বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী এক বিরল পরশমণি by শাহজাহান মিয়া

আগস্ট মাস। বাঙালি জাতির শোকের মাস। পাকিস্তানি মানসিকতার ঘৃণ্য ধারক-বাহক সিমাররূপী ঘাতকের দল এ মাসটির ১৫ তারিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নারকীয় নির্মমতায় উন্মত্ত হয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছিল।


অনেক প্রতিকূল পরিবেশ ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গত ১৮ জুন প্রকাশিত হয়েছে। ঘাতকের বুলেট যেমন ক্ষণজন্মা এই মহামানবের জীবনের অস্বাভাবিক সমাপ্তি ঘটিয়েছিল, তেমনি নানা ব্যস্ততা ও সময়াভাবে বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবনী লেখাটাও অসমাপ্তই থেকে যায়। তবু নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত এ অমূল্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ মহান নেতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীরা তাঁকে তাঁর জীবনী লেখার কথা বলেন। সর্বোপরি বাংলাদেশের রাজনীতির মহাকবি ও প্রবাদপুরুষ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেসা (ডাক নাম রেনু) মুজিবের অনুরোধই তাঁকে তাঁর জীবনী লেখা শুরু করতে প্রেরণা জোগায়। লেখার জন্য বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়েছিলেন। তার পরই তিনি লিখতে শুরু করেন। অনেকেই হয়তো জানেন, তবু উল্লেখ করছি যে ১৯৩২ বা ১৯৩৩ সালে অনিবার্য পারিবারিক কারণে বঙ্গবন্ধু যখন ১২-১৩ বছরের কিশোর, তখন তিন বছর বয়সের রেনুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, '১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়।' বাবা ও মায়ের মতো, এ মহান নেতার জীবনে তাঁর স্ত্রীর অবদান অপরিসীম। তাই তো তিনি একজন মহীয়সী নারী।
আমার সাংবাদিক ভাই-বোনরা ছাড়াও আমার ঘনিষ্ঠ অনেকেই জানেন, আমি বঙ্গবন্ধুর একজন বড় ভক্ত। বঙ্গবন্ধু আমাকে চিনতেন না। তাঁর খুব কাছাকাছি যাওয়ার তেমন সুযোগও আমার হয়নি। যদিও ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় এই মহান ব্যক্তিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। তবে আমি একেবারে তাঁর সামনে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারিনি। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। বয়স সাড়ে ৯ বছর। নির্বাচন উপলক্ষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের বাড়ির কাছে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বালিগাঁওয়ে একটি বিরাট জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে একজন সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ কভার করাসহ আরো কয়েকটি অনুষ্ঠান কভার করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ছোটকালে বাবা এবং বাড়ির অন্যান্য মুরব্বির কাছে যা শুনেছি এবং পরে নিজে যা দেখেছি ও জেনেছি, তার ওপর ভিত্তি করেই এ মহান মানুষটি সম্পর্কে আমার নিজস্ব একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল, যা আজ পর্যন্তও অটুট আছে। মানুষের জন্য, বিশেষ করে দুঃখী মানুষের জন্য, বুকভরা নিখাদ ভালোবাসা, সীমাহীন দরদ ও মমতা, সততা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম ও হৃদয়ের বিশালতা কোটি কোটি বাঙালির মতো আমাকেও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত বানিয়েছে। তাঁর মনের মধ্যে কোনো ভাঁওতাবাজি বা ভণিতা ছিল না। মানুষের কল্যাণে যা কিছু প্রয়োজন, তাই তিনি করতেন। মানবিক গুণাবলির সমাহার তাঁর মধ্যে ঘটেছিল বলেই বাংলাদেশের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদকে পেছনে ফেলে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় ছাত্র-জনতা তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিল। জীবনের প্রথম দিক থেকেই তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে যে মহা দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন, তাতেই মানুষের মনে ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে একদিন শেখ মুজিবের কাজের স্বীকৃতি সোনালি আভায় উদ্ভাসিত হবেই। সত্যবাদিতা, স্পষ্টবাদিতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহস, প্রকৃত নেতার মতো সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, মেধা ও প্রজ্ঞা ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের চালিকাশক্তি। ত্যাগ-তিতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা এবং জেল-জুলুম সহ্য করার ধৈর্য ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। স্থির নিশানা ও নিশ্চিত লক্ষ্য অর্জনে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশ নামক দেশটির অভ্যুদয় ঘটে বলেই তিনি আজ জাতির পিতা। ২০০৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ ২০ জন বরেণ্য বাঙালি ব্যক্তিত্বের মধ্যে চূড়ান্ত বিবেচনায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির বিরল বরমালাটি বঙ্গবন্ধুকেই প্রদান করা হয়।
সত্যি কথা বলতে কী, জীবনভর যে নেতাকে শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি, তাঁর আত্মজীবনী পড়ে আমি আত্মহারাই হয়ে গেছি। অসমাপ্ত হলেও বইটি আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। যতই পড়েছি ততই বিমুগ্ধ হয়েছি। যদিও শেষ করার পর কোনো চমকপ্রদ ছোটগল্প পড়ার মতো মনে হয়েছে, শেষ হয়েও হলো না শেষ। তাই আত্মা অতৃপ্ত থেকেছে। বইটি পড়ার পর একটি কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। সর্বগুণে গুণান্বিত বঙ্গবন্ধু একজন মহান নেতাই শুধু নন, একজন মহামানবও। আমার ধারণা, বইটি যে পড়বে এই মহান নেতার প্রতি নিঃসন্দেহে তাঁর শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেড়ে যাবে। মানুষের ধারণার চেয়েও তিনি আরো অনেক বড়। অনেক বেশি মহিমাময়। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এই বইটি পড়ার জন্য আমি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
বইটি প্রকাশ করেছে খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত ও পাকিস্তান থেকে একযোগে বইটির ইংলিশ ভার্সন 'দ্য আনফিনিশড মেমোয়ারস' প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজবন্দি হিসেবে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বসে তিনি আত্মজীবনী লিখেছেন। নিদ্বির্ধায় বলা যায়, বইটি দেশের সব শ্রেণীর পাঠক মহলে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ পাঠককুল বঙ্গবন্ধুর প্রথম জীবনের অবিশ্বাস্য অজানা বিষয়গুলো জেনে চমৎকৃত হচ্ছেন। তাঁর সাহস, দেশপ্রেম, মানবিক গুণাবলি, বুদ্ধিমত্তা, মানবপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ও নেতৃত্ব দানের বলিষ্ঠতার কথা জেনে মানুষ তাঁকে তাদের হৃদয়ের গভীরে আরো আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। অনেক উচ্চ আসনে আসীন করেছে। ছাত্রজীবনে তাঁর নজিরবিহীন সাংগঠনিক ক্ষমতার কথা এবং পরবর্তীকালে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর ভূমিকাসহ তাঁর ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার অনেক অজানা তথ্য স্থান পেয়েছে বইটিতে। তিনি কিভাবে সব বিষয় হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন, উপলব্ধি করেছেন ও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তার সব কিছুই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীতে। তাঁর প্রত্যয়ী সংগ্রামী জীবন, নীতির প্রশ্নে আপসহীনতা ও ত্যাগের মহিমায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। পাকিস্তান আন্দোলনে এ মহান নেতার দৃঢ় ভূমিকা, ভাষা আন্দোলন ও শেষ পর্যন্ত প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সর্বোপরি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করার বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থানের কথাও জানা যায়। অসমাপ্ত হলেও গবেষকদের কাছে বইটি হয়ে দাঁড়াবে তাঁদের গবেষণার জন্য একটি মূল্যবান দলিল। আত্মজীবনীর শুরুটাও অদ্ভুত সুন্দর। একদম সহজ-সরল অথচ সাবলীল ভাষায় তিনি তাঁর নিজের কথা বলেছেন। তাঁর জীবনসঙ্গিনী যখন তাঁকে তাঁর জীবনকাহিনী লিখতে বলেছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'লিখতে যে পারি না, আর এমন কী করেছি, যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য আমরা সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।' অত্যন্ত বিনম্র ভাষায় এমন সহজ-সরল উক্তি তাঁকে করেছে মহান। তাঁর কীর্তির চেয়েও কীর্তিমান। মহীয়ান। একেবারে শুরুতেই ১৯৭৩ সালের ৩ মে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে ইংরেজিতে লেখা তাঁর ব্যক্তিগত নোটবুকের একটি পাতা প্রকাশ বইটিতে একটি অনন্য সংযোজন। তিনি ইংরেজিতেও যে ভালো ছিলেন তারই প্রকাশ ঘটেছে। তিনি লিখেছেন- 'একজন মানুষ হিসাবে মানবজাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কিছু আমাকে ভাবিয়ে তোলে। একজন বাঙালি হিসাবে বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছুই আমাকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তোলে। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।' বইটিতে বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে লেখা পাণ্ডুলিপির ১২টি চিত্রলিপি প্রকাশ প্রকাশনাটিকে সামগ্রিকভাবে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ তৎকালীন বহু বড় নেতার তিনি সানি্নধ্য লাভ করেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রতি তাঁর সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল বলে মনে হয়েছে। তিনি তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক গুরু বলেই মনে করতেন। তবে মওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলার প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছিল বেশ গভীর। ১৯৩৮ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব গোপালগঞ্জে সভা করতে গেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। পরের বছর সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কলকাতায় সাক্ষাৎ ঘটে। অল্প বয়সেই গ্লুকোমায় আক্রান্ত হলে তাঁর দুটি চোখেই অপারেশন করতে হয়। আরো অন্য অসুখের কারণে প্রায় বছর চারেক লেখাপড়া বন্ধ থাকে। তাই তাঁকে ১৯৩৬ সাল থেকেই চশমা পরতে হয়। নিজের কথা নিজেই বলেছেন যে তিনি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলেন। খেলাধুলা করতেন ও গান গাইতেন। ছোটবেলা থেকেই আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত নিয়মিত পড়তেন। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের প্রচণ্ড প্রতিবাদী দিকটির ইঙ্গিতও ছোটকাল থেকেই দেখা যায়। অল্প বয়সে, ১৯৩৮ সালেই, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মিথ্যা মামলায় আসামি হয়ে জেলে যেতে হয়েছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচানো যাবে না- এ লক্ষ্য অর্জনে তাঁর ধ্যানে-মনে শুধু ছিল মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগ। ১৯৪২ সালে ভালোভাবে ম্যাট্রিক পাস করে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি বিখ্যাত বেকার হোস্টেলে ওঠেন। কলেজে তিনি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ইসলামিয়া কলেজ ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। ওই সময়ই রাজনীতির সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে যান সবার প্রিয় তরুণ নেতা মুজিব। সোহরাওয়ার্দী সাহেবেরও খুবই প্রিয় হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। কথায় আছে, জহুরি জহর চেনে। তৎকালীন জননন্দিত নেতা সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে তরুণ মুজিবকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি। একবার সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথা কাটাকাটির ঘটনাও ঘটে যায়। কিন্তু প্রিয় জননেতা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কর্মীকে বুকে টেনে নেন। ১৯৪৩ সালে শুরু হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। লাখ লাখ লোক মারা যায়। ১০ টাকা মণের চাল ৪০-৫০ টাকা হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'যুদ্ধ করছে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরছে বাঙালি।' দুর্ভিক্ষের সময় জনগণ মানবতাবাদী মুজিবকে তাদের পাশে পায়। প্রগতিবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে মুসলিম লীগের মধ্যে দুটি দল হয়ে যায়। মুসলিম লীগ মূলত জমিদার ও জোতদার খানবাহাদুর ও নবাবদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। অবশ্য সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল।
১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে বঙ্গবন্ধু লাহোর গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পরই পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা, এমনকি সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়েছিল। একদিন লাহোরে পাকিস্তান টাইমস অফিসের কাছাকাছি রাস্তার এক জায়গায় চারজন সন্ত্রাসী বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে। একজন বঙ্গবন্ধুকে ঘুষি মারলে বাংলার বাঘ হাত দিয়ে ঘুষিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'যদি লড়তে হয় তবে একজন করে আসুন।' এ ঘটনা দেখে কয়েকজন এগিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা কেটে পড়ে। এ ঘটনাই বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতার স্বাক্ষর বহন করে। লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে, তার পরও সংক্ষেপে ১৯৫৪ সালে গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী বিত্তশালী ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নির্বাচনের বিষয়টি না বলে পারছি না। মূলত হেঁটে ইলেকশন করার সময় এক গরিব বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর কুঁড়েঘরে নিয়ে গিয়ে পাটি বিছিয়ে বসতে দেন। এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা সামনে ধরে মহিলা বলেন, 'খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।' ভালোবাসার বিরল প্রতীক হিসেবে গরিব ওই মহিলার 'চার আনা' পয়সা ছিল অমূল্য রতন। বঙ্গবন্ধুর চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। দুধ মুখে দিয়ে মহিলার পয়সার সঙ্গে কিছু টাকা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'তোমার দোয়াই আমার জন্য যথেষ্ট, তোমার দোয়ার মূল্য টাকা দিয়ে শোধ করা যায় না।' মহিলা টাকা না নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, 'গরিবের দোয়া তোমার জন্য আছে বাবা।' মহান নেতা ওই দিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, 'মানুষেরে ধোঁকা দিতে আমি পারব না।' বাংলার মানুষও দেখেছে বঙ্গবন্ধু কখনোই ধোঁকা দেওয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর ওপর জনগণের আস্থাই ছিল তাঁর বড় সম্পদ। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ভালোভাবেই জয়লাভ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের মে মাসে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই আদমজী জুট মিলে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা থামাতে বঙ্গবন্ধুকে নারায়ণগঞ্জ ছুটে যেতে হয়। ষড়যন্ত্রমূলক ওই ভয়াবহ দাঙ্গায় পাঁচ শতাধিক শ্রমিক প্রাণ হারায়। সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মিলে অবস্থান করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে মুক্তিলাভ করে তিনি লেখার সময় আর পাননি। আর সে জন্যই ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ও ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনসহ পরবর্তী সময়ের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করতে পারেননি। আর তাই স্বাধীনতার মহানায়কের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মনটা অতৃপ্ত থেকে যায়। লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে বলে মন খুলে সব বিষয়ে বিশদ লিখতে না পারার বেদনায়ও আমার আত্মা নিদারুণভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। আত্মজীবনীটির ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ঘটনাচক্রে, পিতার মতো কারাগারে বসেই তাঁকে বইয়ের ভূমিকা লিখতে হয়েছিল। অলৌকিকভাবে আত্মজীবনী হিসেবে লেখা নতুন চারটি খাতা শেখ হাসিনার হাতে আসে। সংগত কারণেই শেখ হাসিনা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়ার কথা মনে করে শেখ হাসিনা বলেছেন, "মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি, তারপরই এই প্রাপ্তি। মনে হলো যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি। আমার যে এখনো দেশের মানুষের জন্য... সেই মানুষ, যারা আমার পিতার ভাষায় বাংলার 'দুঃখী মানুষ',... সেই দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ বাকি, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাকি, সেই বার্তাই যেন আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন। যখন খাতাগুলোর পাতা উল্টাচ্ছিলাম আর হাতের লেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, আব্বা আমাকে যেন বলছেন, ভয় নেই মা, আমি আছি, তুই এগিয়ে যা, সাহস রাখ। আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক বাণী এসে পৌঁছাল আমার কাছে। এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝে যেন আলোর দিশা পেলাম।" ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে তিনি বাংলাদেশকে অনেক আগেই সোনার বাংলায় পরিণত করতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রী, আপনি সে কথাটি মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছেন। আল্লাহর নাম নিয়ে সে কথাটি উপলব্ধির কথা বলেছেন। সে জন্যই বলছি, বর্তমান সরকারের মেয়াদ আর দেড় বছরও নেই। তাই বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সাধের সোনার বাংলায় পরিণত করতে হলে আগামীবারও আপনার ক্ষমতায় আসার কোনো বিকল্প নেই। এবার সরকারের অনেক অর্জন থাকলেও অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না। আশপাশে সুচতুর চাটুকারদের অবস্থানসহ সরকারের দুর্বল জায়গাগুলো আপনার চেয়ে বেশি কারো বোঝার কথা নয়। তাই সেগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হলে সরকারের বাকি সময়টুকুতেও আরো কিছু সাফল্য অর্জন সম্ভব। ছাত্রলীগের সর্বস্তরের সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দাবিদাররা যাতে এই মহান নেতার নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ কোনো অনৈতিক কাজে কোনোভাবেই জড়িত না হয়, সে বিষয়ে আপনাকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখতে হবে। কঠোর হতে হবে। তাদের জন্য আপনার অনেক অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আর এই মহামূল্যবান গ্রন্থটি বঙ্গবন্ধুর অনুসারীসহ সাধারণ মানুষ যাতে পড়তে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যার কর্ণধাররা ্বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। কয়েক লাখ বই ছাপানোর পর সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বইগুলো কিনে নামমাত্র মূল্যে মানুষের কাছে বিক্রি করতে পারেন। তাতে মানুষ বইটি পড়ে বঙ্গবন্ধুকে আরো ভালোভাবে জানার সুযোগ পাবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.