খাবার মানেই বিষ by তৌফিক মারুফ
ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে লিচু বাগানের সরু পথ ধরে সামনের জমির দিকে এগিয়ে যান মহেশপুর গ্রামের মজিবর। কাঁধে বয়ে নেওয়া ভারের দুই দিকে ঝোলানো ধানের চারার গোছা। পাশের আরেক জমিতেও তাজা সবুজ চারা। 'লিচু বাগানের জমিতে ধান এত ভালো হয়?' প্রশ্ন করলে মজিবর ধানের চারায় হাত বুলিয়ে বলেন,
'যখন বিচন ফেলাইছি, তখন ভিটামিন ছিটাছি, এখন চাড়া ভাঙা দিবু, ফিরিয়া ভিটামিন ছিটাবু। শেষে দিবু বিষ। পোকামাকড়া কাছে আসিবু না, ধান ভালো হবু।'
কাছেই মনসুর আলী নিজের ছোট্ট মুদি দোকানের ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে বলেন, 'এবার এখানে লিচু অনেক ভালো হয়েছে। রংও ভালো হয়েছে। লিচুতে আচ্ছামতো বিষ দিতে পারায় কোনো পোকামাকড় গাছের ধারেও আসেনি।' বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় একই দোকানে আশ্রয় নেওয়া হাফিজুর রহমান আরো বেশি উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেন, 'বিষ আছে তো ফলন আছে। বিষ ছাড়া আমাদের চলেই না!' তিনি জানান, মাদ্রাজি, বোম্বাই, কাঁঠালি, চায়না, এলাচি জাতের সবুজ গাছগুলোর পাতার ফাঁকে ফাঁকে কয়েক দিন আগেও ঝুলেছে থোকায় থোকায় লিচু। একেকটি গাছে লিচু ধরে গড়ে আট-দশ হাজার। ঠিকমতো ভিটামিন আর বিষ দিতে পারলে ফলন আরো বাড়ে।
সরেজমিনে ঘুরে বোঝা যায়, এই বিরল উপজেলায় বিষ ছাড়া বাড়ি পাওয়াই বিরল ঘটনা। দিনাজপুরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশাল লিচুরাজ্য। আর আছে নানা জাতের ধান। লিচুগাছের নিচে ধানক্ষেত। এর সঙ্গে শাকসবজি, আম-কাঁঠালের বাগানও আছে কমবেশি। তবে সবার নজর এবার বেশি পড়েছিল দিনাজপুরের লিচুর ওপর। কারণ গত মাসে বিচ্ছিন্নভাবে ১৩টি শিশুর প্রাণহানি ঘটে এ জেলায়। ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলেও সবার উপসর্গ ছিল একই ধরনের। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১ থেকে ২৪ জুনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া শিশুদের বয়স ছিল দুই থেকে ১০ বছরের মধ্যে। শরীরে উপসর্গ শুরু হওয়ার পর তাদের একেকজনকে দেখে কোনো কবিরাজ বলেছেন 'ভূতে ধরেছে', কোনো স্থানীয় চিকিৎসক বলেছেন 'সাপে কেটেছে' আবার কেউ বলেছেন 'মৃগী রোগী'। তবে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা উপসর্গ দেখে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টিকে লিচুতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের বিষক্রিয়া বলে ধারণা পেয়েছেন। চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য কিছু নমুনা পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ল্যাবরেটরিতে।
আইইডিসিআরের পরিচালক ড. মাহামুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দিনাজপুরে শিশুদের মৃত্যুর ওই ঘটনা জানতে পেরে আমরা একটি বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থলে পাঠাই। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছে, শিশুদের শরীরে কীটনাশকের বিষক্রিয়া ঘটেছিল। তবে ঠিক কোন ধরনের কীটনাশক তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। ওই এলাকায় ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশকের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।' তিনি বলেন, উপসর্গ দেখে এবং নমুনা পরীক্ষা করে জোরালো ধারণা জন্মেছে, শিশুরা কীটনাশকবাহী লিচু খাওয়ার মাধ্যমে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল।
ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, কেবল লিচু বা ধান নয়, কিংবা কেবল দিনাজপুর এলাকায়ই নয়, বরং সারা দেশে বিভিন্ন ফল-ফসলে এখন বেপরোয়াভাবে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কীটনাশক বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানুষের শরীরে প্রবেশ করে অনেককে তাৎক্ষণিকভাবে আবার অনেককে নীরবে মৃত্যু কিংবা নানা জটিল রোগ-ব্যাধির দিকে ঠেলে দেয়।
দেশে এখন মানুষের নিরাপদ খাবারের সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কোনো খাবারই নিরাপদ নয় বললেই চলে। বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, প্রায় সব খাবারেই কোনো না কোনোভাবে মিশে যাচ্ছে বিষ। পাওয়া যাচ্ছে একের পর এক তথ্য-উপাত্ত। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবারে বিষাক্ত দ্রব্য মেশানোর প্রমাণ পাচ্ছে। অপরাধীরা হাতেনাতে ধরাও পড়ছে। এর পরও খাবারে বিষ প্রয়োগ বন্ধ হচ্ছে না।
খাদ্যে বিষ ও ভেজাল প্রতিরোধে অনেক দিন ধরে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন'-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের বাজারঘাট-দোকানপাটে বিষাক্ত সাইক্লোমেট দিয়ে ভাজা টোস্ট বিস্কুট; বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল (আম, কলা, আনারস ইত্যাদি); বিষাক্ত উপকরণ দিয়ে তৈরি রুটি, বিস্কুট, সেমাই, নুডলস; ক্ষতিকর রং দেওয়া ডিম; মেয়াদোত্তীর্ণ আইসক্রিম, মিষ্টান্ন; ডিডিটি দেওয়া শুঁটকি; ইউরেনিয়াম দেওয়া চাল; ফরমালিন দেওয়া মাছ-সবজি; মবিল দিয়ে ভাজা চানাচুর, জিলাপি; ক্ষতিকর রং দেওয়া ডাল; ডালডা ও অপরিশোধিত পাম অয়েলমিশ্রিত সয়াবিন তেল; ভেজাল দেওয়া সরিষার তেল; রঙ ও ভেজালমিশ্রিত ঘি; পাম অয়েলমিশ্রিত কনডেন্সড মিল্ক; ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি প্যাকেটজাত জুস, মিনারেল ওয়াটার; মরা মুরগির মাংস; গন্ধকের ধোঁয়া দেওয়া সুপারি; রাসায়নিক মিশ্রিত জর্দা, আয়োডিনবিহীন লবণ, ইউরিয়া সারের পানি দেওয়া চিঁড়া-মুড়ি দেদার বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দুধের মধ্যে ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, বোরিক এসিড, স্যালিসাইলিক, ইউরিয়া, চিনি, লবণ, সোডিয়াম বেনজোয়েট, সোডিয়াম কার্বনেট, ক্ষতিকর রং, আটা-ময়দা, ভাতের মাড়, এরারুট, শ্বেতসার ও স্কিম মিল্ক পাউডার মিশিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। মরিচের গুঁড়ায় ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক রং ও ইটের গুঁড়ো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন যেভাবে নতুন নতুন অনেক ধরনের রাসায়নিক বিষাক্ত উপাদান ফলে, ফসলে, খাদ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে, এসবের বিষক্রিয়ার সঠিক চিকিৎসা দেওয়াও জটিল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকে না।
গত ২২ জুলাই দিনাজপুরের বিরল, চিরিরবন্দর ও দিনাজপুর সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাওয়া যায় বেপরোয়াভাবে কীটনাশক ব্যবহারের নানামুখী চিত্র। ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগই ব্যবহৃত কীটনাশকের নাম জানেন না। এই বিষ যে মানুষের প্রাণঘাতী হতে পারে সে বিষয়ে তাঁদের নেই কোনো সচেতনতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কীটনাশকের প্যাকেটের ওপরে লেখা অবশ্য পালনীয় বিধিনিষেধ বা নির্দেশিকা পড়তে জানেন না তাঁরা। যাঁরা জানেন তাঁরা আবার তা পালন করেন না। যে যাঁর খুশিমতো মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করেন, ব্যবহারের পর যেখানে-সেখানে কীটনাশকের বিষাক্ত প্যাকেট ফেলে রাখেন কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন।
মৃত ১৩ শিশুর মধ্যে বিরলের মহেশপুর গ্রামের আইনুল হকের সাড়ে চার বছর বয়সী মেয়ে নিভা এবং একই গ্রামের সোহাগ হোসেনের ছয় বছরের মেয়ে সায়লা। মহেশপুরের লিচুবাগানের ভেতর সায়লাদের ঝুপড়ি ঘরের উঠানে যেতেই চোখে পড়ে, সায়লার যমজ বোন সুমনা ও ছোট ভাই নাঈম 'থিওভিটা' লেখা একটি সুদৃশ্য ফয়েল প্যাকেট নিয়ে খেলায় ব্যস্ত। প্যাকেটটির গায়ে পরিষ্কারভাবে লেখা : কীটনাশক, ব্যবহারের পর প্যাকেট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। এ ছাড়া এই প্যাকেটের দ্রব্য ব্যবহারের সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখাসহ নানান সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া আছে।
সায়লার মা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা নুরেসা বেগম জানান, তাঁর স্বামী সোহাগ মানুষের জমিতে চাষবাসের কাজ করেন। সায়লার মৃত্যুর সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নুরেসা বলেন, 'ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাতে অন্যদিনের মতোই সায়লা আমার কাছে ঘুমায়। রাত ৩টার দিকে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর গা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়, খিঁচুনি দেখা দেয়। প্রথমে গ্রামের মাহাত কবিরাজের কাছে নিয়ে যাই। কবিরাজ বলে, সায়লাকে ভুতে ধরেছে। কিছু পানিপড়া আর তেলপড়া দেয়। কিন্তু সকাল পর্যন্ত অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে নিয়ে যাই বিরল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে ওরা রোগীকে রাখতে রাজি হয়নি। শুক্রবার হাসপাতালে কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না বলে তারা জানায়। এরপর বিরলের জাহিদুল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তিনি বলেন, কফ বসে গেছে। কিছু ওষুধ দিয়ে সেগুলো খাওয়াতে বলেন। ওই ওষুধ খাওয়ানোর পর খিঁচুনিটা কমে, কিন্তু জ্ঞান আসেনি। কিছু সময় পর অবস্থা আবার খারাপ দেখে নিয়ে যাই দিনাজপুর মেডিক্যালে। সেখানে কিছু সময় চিকিৎসার একপর্যায়ে সায়লার মৃত্যু ঘটে।'
নুরেসা জানান, সায়লা যখন হাসপাতালে ছিল তখন সেখানে আরো দু-তিনটি শিশুকে একই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। তাদেরও মৃত্যু ঘটে। একই গ্রামের মৃত শিশু নিভার বাবা আইনুল হক, চিরিরবন্দর উপজেলার কিষান বাজারের মৃত সাগরের বাবা মারকুষ আলী, দিনাজপুর সদরের সুন্দরবন গ্রামের মৃত নার্গিসের বাবা কাছির আহম্মেদসহ অন্যরা জানান, সবার উপসর্গ একই রকম ছিল। বাগানে কুড়িয়ে পাওয়া লিচু খাওয়ার পর থেকেই এসব শিশুর মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তবে একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে কয়েকটি শিশু হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে যায়। এই উপসর্গে জুন মাসে মারা যাওয়া অন্য শিশুরা হচ্ছে বিরলের রুনিয়া গ্রামের কিবরিয়া, মাধবাটির বোরহান, দিনাজপুর সদরের পারগাওয়ের নয়ন, একবারপুরের ধনঞ্জয়, খানসামার রেজাউল, চিরিরন্দরের তাজমীর, ফরহাদ, বড়ইলের সুর্বনা ও পীরগঞ্জের তাপসী।
মাধবাটির একটি লিচুবাগানের মালিক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, লিচুগাছে কয়েক দফায় ভিটামিন ও বিষ দেওয়া হয় ফলন ভালো হওয়া এবং পোকা দমনের জন্য। এগুলো না দিয়ে উপায় নেই। কারণ লিচু দেখতে ভালো না হলে এবং পোকা ধরলে বড় লোকসান হয়। তবে এবার নতুন একধরনের কীটনাশক বাজারে পাওয়া গিয়েছিল। এটা নাকি ওপারের চোরাই কীটনাশক (ভারত থেকে চোরইপথে আনা) ছিল। অনেক লিচুবাগানে আগের কীটনাশকের পাশাপাশি নতুন বিষটিও প্রয়োগ করা হয়েছে।
দিনাজপুর সদরের চাষি সুলতান হোসেন বলেন, বিষ দেওয়ার কমপক্ষে ১৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ না করা বা খাওয়া নিষেধ থাকলেও তা কেউ মানেনি। দেখা গেছে, অনেকেই যেদিন সকালে বিষ দিয়েছে, সেদিন বিকেলে বা পরদিনই ফল সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া বিষ দেওয়া গাছ বা ফল থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মানুষকে সতর্ক বা নিরাপদে থাকতে বাগানে তেমন কোনো ব্যবস্থা থাকে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিরল সদরের একাধিক কীটনাশক বিক্রেতা কালের কণ্ঠকে জানান, শুধু লিচু নয়, আমসহ আরো কিছু ফলে এবং ধানসহ বিভিন্ন ফসলে দেওয়ার জন্য নানা নামের বালাইনাশক, ফলন বৃদ্ধিমূলক ও কীটনাশক বেচাকেনা হয়। এ ছাড়া ভারতীয় কিছু অবৈধ কীটনাশকও বেচাকেনা চলে। এবার লিচু মৌসুমে এ অঞ্চলে কোনো কোনো ভারতীয় কীটনাশক খুব বেশি চালু ছিল।
আইইডিসিআরএর বিশেজ্ঞদল দিনাজপুর এলাকা থেকে বেশ কিছু কীটনাশকের স্যাম্পল সংগ্রহ করে নিয়ে যায় গবেষণার জন্য। দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কান্তা রায় রিমি কালের কণ্ঠকে জানান, লিচু, আমসহ সারা বছর ধরেই ফল-ফসলে কীটনাশকের ছড়াছড়ি থাকে। এর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অহরহ রোগী আসছে চিকিৎসা নিতে। আক্রান্তদের বেশির ভাগই শিশু। সব ক্ষেত্রেই যে তাদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে তা বলা যাবে না, কারণ ঠিক কোন কীটনাশক বা কোন ধরনের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্লান্ট প্রটেকশন ইউংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ মো. আবু হানিফ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা যত দূর জেনেছি সাধারণত চায়ে ব্যবহার উপযোগী এক ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে দিনাজপুরের লিচুবাগানে। তিনি বলেন, আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মীরা চাষিদের কীটনাশক ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবু খুব একটা কাজ হচ্ছে না। এ সচেতনতা না বাড়াতে পারলে সবাইকে এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন মনে হয় কোনো খাদ্যদ্রব্যই বাদ নেই; সব কিছুতেই বিষ বা ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। আবার যে ভেজাল মেশানো হয় তাতেও থাকে বিষাক্ত উপাদান। আমরা আগে সরকারের বিভিন্ন ল্যাবরেটরি টেস্টের মাধ্যমে প্রতিবেদন সংগ্রহ করে তা পর্যবেক্ষণ করতাম। কিন্তু এখন নিজেরাই ফরমালিন পরীক্ষাসহ আরো কিছু বিষ শনাক্তকরণের কাজ শুরু করেছি। এতে দেখছি পরিস্থিতির দ্রুত অবনিত ঘটছে, যদিও প্রশাসন আগের চেয়ে কিছুটা তৎপর।'
আবু নাসের খান জানান, এ বিষাক্ত ও ভেজাল খাবারের মাধ্যমে দেশে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি-লিভারের রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ শিশুরা জটিল রোগ নিয়ে পৃথিবীতে আসছে।
কাছেই মনসুর আলী নিজের ছোট্ট মুদি দোকানের ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে বলেন, 'এবার এখানে লিচু অনেক ভালো হয়েছে। রংও ভালো হয়েছে। লিচুতে আচ্ছামতো বিষ দিতে পারায় কোনো পোকামাকড় গাছের ধারেও আসেনি।' বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় একই দোকানে আশ্রয় নেওয়া হাফিজুর রহমান আরো বেশি উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেন, 'বিষ আছে তো ফলন আছে। বিষ ছাড়া আমাদের চলেই না!' তিনি জানান, মাদ্রাজি, বোম্বাই, কাঁঠালি, চায়না, এলাচি জাতের সবুজ গাছগুলোর পাতার ফাঁকে ফাঁকে কয়েক দিন আগেও ঝুলেছে থোকায় থোকায় লিচু। একেকটি গাছে লিচু ধরে গড়ে আট-দশ হাজার। ঠিকমতো ভিটামিন আর বিষ দিতে পারলে ফলন আরো বাড়ে।
সরেজমিনে ঘুরে বোঝা যায়, এই বিরল উপজেলায় বিষ ছাড়া বাড়ি পাওয়াই বিরল ঘটনা। দিনাজপুরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশাল লিচুরাজ্য। আর আছে নানা জাতের ধান। লিচুগাছের নিচে ধানক্ষেত। এর সঙ্গে শাকসবজি, আম-কাঁঠালের বাগানও আছে কমবেশি। তবে সবার নজর এবার বেশি পড়েছিল দিনাজপুরের লিচুর ওপর। কারণ গত মাসে বিচ্ছিন্নভাবে ১৩টি শিশুর প্রাণহানি ঘটে এ জেলায়। ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলেও সবার উপসর্গ ছিল একই ধরনের। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১ থেকে ২৪ জুনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া শিশুদের বয়স ছিল দুই থেকে ১০ বছরের মধ্যে। শরীরে উপসর্গ শুরু হওয়ার পর তাদের একেকজনকে দেখে কোনো কবিরাজ বলেছেন 'ভূতে ধরেছে', কোনো স্থানীয় চিকিৎসক বলেছেন 'সাপে কেটেছে' আবার কেউ বলেছেন 'মৃগী রোগী'। তবে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা উপসর্গ দেখে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টিকে লিচুতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের বিষক্রিয়া বলে ধারণা পেয়েছেন। চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য কিছু নমুনা পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ল্যাবরেটরিতে।
আইইডিসিআরের পরিচালক ড. মাহামুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দিনাজপুরে শিশুদের মৃত্যুর ওই ঘটনা জানতে পেরে আমরা একটি বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থলে পাঠাই। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছে, শিশুদের শরীরে কীটনাশকের বিষক্রিয়া ঘটেছিল। তবে ঠিক কোন ধরনের কীটনাশক তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। ওই এলাকায় ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশকের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।' তিনি বলেন, উপসর্গ দেখে এবং নমুনা পরীক্ষা করে জোরালো ধারণা জন্মেছে, শিশুরা কীটনাশকবাহী লিচু খাওয়ার মাধ্যমে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল।
ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, কেবল লিচু বা ধান নয়, কিংবা কেবল দিনাজপুর এলাকায়ই নয়, বরং সারা দেশে বিভিন্ন ফল-ফসলে এখন বেপরোয়াভাবে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কীটনাশক বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানুষের শরীরে প্রবেশ করে অনেককে তাৎক্ষণিকভাবে আবার অনেককে নীরবে মৃত্যু কিংবা নানা জটিল রোগ-ব্যাধির দিকে ঠেলে দেয়।
দেশে এখন মানুষের নিরাপদ খাবারের সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কোনো খাবারই নিরাপদ নয় বললেই চলে। বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, প্রায় সব খাবারেই কোনো না কোনোভাবে মিশে যাচ্ছে বিষ। পাওয়া যাচ্ছে একের পর এক তথ্য-উপাত্ত। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবারে বিষাক্ত দ্রব্য মেশানোর প্রমাণ পাচ্ছে। অপরাধীরা হাতেনাতে ধরাও পড়ছে। এর পরও খাবারে বিষ প্রয়োগ বন্ধ হচ্ছে না।
খাদ্যে বিষ ও ভেজাল প্রতিরোধে অনেক দিন ধরে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন'-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের বাজারঘাট-দোকানপাটে বিষাক্ত সাইক্লোমেট দিয়ে ভাজা টোস্ট বিস্কুট; বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল (আম, কলা, আনারস ইত্যাদি); বিষাক্ত উপকরণ দিয়ে তৈরি রুটি, বিস্কুট, সেমাই, নুডলস; ক্ষতিকর রং দেওয়া ডিম; মেয়াদোত্তীর্ণ আইসক্রিম, মিষ্টান্ন; ডিডিটি দেওয়া শুঁটকি; ইউরেনিয়াম দেওয়া চাল; ফরমালিন দেওয়া মাছ-সবজি; মবিল দিয়ে ভাজা চানাচুর, জিলাপি; ক্ষতিকর রং দেওয়া ডাল; ডালডা ও অপরিশোধিত পাম অয়েলমিশ্রিত সয়াবিন তেল; ভেজাল দেওয়া সরিষার তেল; রঙ ও ভেজালমিশ্রিত ঘি; পাম অয়েলমিশ্রিত কনডেন্সড মিল্ক; ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি প্যাকেটজাত জুস, মিনারেল ওয়াটার; মরা মুরগির মাংস; গন্ধকের ধোঁয়া দেওয়া সুপারি; রাসায়নিক মিশ্রিত জর্দা, আয়োডিনবিহীন লবণ, ইউরিয়া সারের পানি দেওয়া চিঁড়া-মুড়ি দেদার বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দুধের মধ্যে ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, বোরিক এসিড, স্যালিসাইলিক, ইউরিয়া, চিনি, লবণ, সোডিয়াম বেনজোয়েট, সোডিয়াম কার্বনেট, ক্ষতিকর রং, আটা-ময়দা, ভাতের মাড়, এরারুট, শ্বেতসার ও স্কিম মিল্ক পাউডার মিশিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। মরিচের গুঁড়ায় ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক রং ও ইটের গুঁড়ো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন যেভাবে নতুন নতুন অনেক ধরনের রাসায়নিক বিষাক্ত উপাদান ফলে, ফসলে, খাদ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে, এসবের বিষক্রিয়ার সঠিক চিকিৎসা দেওয়াও জটিল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকে না।
গত ২২ জুলাই দিনাজপুরের বিরল, চিরিরবন্দর ও দিনাজপুর সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাওয়া যায় বেপরোয়াভাবে কীটনাশক ব্যবহারের নানামুখী চিত্র। ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগই ব্যবহৃত কীটনাশকের নাম জানেন না। এই বিষ যে মানুষের প্রাণঘাতী হতে পারে সে বিষয়ে তাঁদের নেই কোনো সচেতনতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কীটনাশকের প্যাকেটের ওপরে লেখা অবশ্য পালনীয় বিধিনিষেধ বা নির্দেশিকা পড়তে জানেন না তাঁরা। যাঁরা জানেন তাঁরা আবার তা পালন করেন না। যে যাঁর খুশিমতো মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করেন, ব্যবহারের পর যেখানে-সেখানে কীটনাশকের বিষাক্ত প্যাকেট ফেলে রাখেন কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন।
মৃত ১৩ শিশুর মধ্যে বিরলের মহেশপুর গ্রামের আইনুল হকের সাড়ে চার বছর বয়সী মেয়ে নিভা এবং একই গ্রামের সোহাগ হোসেনের ছয় বছরের মেয়ে সায়লা। মহেশপুরের লিচুবাগানের ভেতর সায়লাদের ঝুপড়ি ঘরের উঠানে যেতেই চোখে পড়ে, সায়লার যমজ বোন সুমনা ও ছোট ভাই নাঈম 'থিওভিটা' লেখা একটি সুদৃশ্য ফয়েল প্যাকেট নিয়ে খেলায় ব্যস্ত। প্যাকেটটির গায়ে পরিষ্কারভাবে লেখা : কীটনাশক, ব্যবহারের পর প্যাকেট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। এ ছাড়া এই প্যাকেটের দ্রব্য ব্যবহারের সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখাসহ নানান সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া আছে।
সায়লার মা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা নুরেসা বেগম জানান, তাঁর স্বামী সোহাগ মানুষের জমিতে চাষবাসের কাজ করেন। সায়লার মৃত্যুর সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নুরেসা বলেন, 'ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাতে অন্যদিনের মতোই সায়লা আমার কাছে ঘুমায়। রাত ৩টার দিকে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর গা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়, খিঁচুনি দেখা দেয়। প্রথমে গ্রামের মাহাত কবিরাজের কাছে নিয়ে যাই। কবিরাজ বলে, সায়লাকে ভুতে ধরেছে। কিছু পানিপড়া আর তেলপড়া দেয়। কিন্তু সকাল পর্যন্ত অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে নিয়ে যাই বিরল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে ওরা রোগীকে রাখতে রাজি হয়নি। শুক্রবার হাসপাতালে কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না বলে তারা জানায়। এরপর বিরলের জাহিদুল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তিনি বলেন, কফ বসে গেছে। কিছু ওষুধ দিয়ে সেগুলো খাওয়াতে বলেন। ওই ওষুধ খাওয়ানোর পর খিঁচুনিটা কমে, কিন্তু জ্ঞান আসেনি। কিছু সময় পর অবস্থা আবার খারাপ দেখে নিয়ে যাই দিনাজপুর মেডিক্যালে। সেখানে কিছু সময় চিকিৎসার একপর্যায়ে সায়লার মৃত্যু ঘটে।'
নুরেসা জানান, সায়লা যখন হাসপাতালে ছিল তখন সেখানে আরো দু-তিনটি শিশুকে একই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। তাদেরও মৃত্যু ঘটে। একই গ্রামের মৃত শিশু নিভার বাবা আইনুল হক, চিরিরবন্দর উপজেলার কিষান বাজারের মৃত সাগরের বাবা মারকুষ আলী, দিনাজপুর সদরের সুন্দরবন গ্রামের মৃত নার্গিসের বাবা কাছির আহম্মেদসহ অন্যরা জানান, সবার উপসর্গ একই রকম ছিল। বাগানে কুড়িয়ে পাওয়া লিচু খাওয়ার পর থেকেই এসব শিশুর মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তবে একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে কয়েকটি শিশু হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে যায়। এই উপসর্গে জুন মাসে মারা যাওয়া অন্য শিশুরা হচ্ছে বিরলের রুনিয়া গ্রামের কিবরিয়া, মাধবাটির বোরহান, দিনাজপুর সদরের পারগাওয়ের নয়ন, একবারপুরের ধনঞ্জয়, খানসামার রেজাউল, চিরিরন্দরের তাজমীর, ফরহাদ, বড়ইলের সুর্বনা ও পীরগঞ্জের তাপসী।
মাধবাটির একটি লিচুবাগানের মালিক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, লিচুগাছে কয়েক দফায় ভিটামিন ও বিষ দেওয়া হয় ফলন ভালো হওয়া এবং পোকা দমনের জন্য। এগুলো না দিয়ে উপায় নেই। কারণ লিচু দেখতে ভালো না হলে এবং পোকা ধরলে বড় লোকসান হয়। তবে এবার নতুন একধরনের কীটনাশক বাজারে পাওয়া গিয়েছিল। এটা নাকি ওপারের চোরাই কীটনাশক (ভারত থেকে চোরইপথে আনা) ছিল। অনেক লিচুবাগানে আগের কীটনাশকের পাশাপাশি নতুন বিষটিও প্রয়োগ করা হয়েছে।
দিনাজপুর সদরের চাষি সুলতান হোসেন বলেন, বিষ দেওয়ার কমপক্ষে ১৫ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ না করা বা খাওয়া নিষেধ থাকলেও তা কেউ মানেনি। দেখা গেছে, অনেকেই যেদিন সকালে বিষ দিয়েছে, সেদিন বিকেলে বা পরদিনই ফল সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া বিষ দেওয়া গাছ বা ফল থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মানুষকে সতর্ক বা নিরাপদে থাকতে বাগানে তেমন কোনো ব্যবস্থা থাকে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিরল সদরের একাধিক কীটনাশক বিক্রেতা কালের কণ্ঠকে জানান, শুধু লিচু নয়, আমসহ আরো কিছু ফলে এবং ধানসহ বিভিন্ন ফসলে দেওয়ার জন্য নানা নামের বালাইনাশক, ফলন বৃদ্ধিমূলক ও কীটনাশক বেচাকেনা হয়। এ ছাড়া ভারতীয় কিছু অবৈধ কীটনাশকও বেচাকেনা চলে। এবার লিচু মৌসুমে এ অঞ্চলে কোনো কোনো ভারতীয় কীটনাশক খুব বেশি চালু ছিল।
আইইডিসিআরএর বিশেজ্ঞদল দিনাজপুর এলাকা থেকে বেশ কিছু কীটনাশকের স্যাম্পল সংগ্রহ করে নিয়ে যায় গবেষণার জন্য। দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কান্তা রায় রিমি কালের কণ্ঠকে জানান, লিচু, আমসহ সারা বছর ধরেই ফল-ফসলে কীটনাশকের ছড়াছড়ি থাকে। এর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অহরহ রোগী আসছে চিকিৎসা নিতে। আক্রান্তদের বেশির ভাগই শিশু। সব ক্ষেত্রেই যে তাদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে তা বলা যাবে না, কারণ ঠিক কোন কীটনাশক বা কোন ধরনের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্লান্ট প্রটেকশন ইউংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ মো. আবু হানিফ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা যত দূর জেনেছি সাধারণত চায়ে ব্যবহার উপযোগী এক ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে দিনাজপুরের লিচুবাগানে। তিনি বলেন, আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মীরা চাষিদের কীটনাশক ব্যবহারের ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবু খুব একটা কাজ হচ্ছে না। এ সচেতনতা না বাড়াতে পারলে সবাইকে এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন মনে হয় কোনো খাদ্যদ্রব্যই বাদ নেই; সব কিছুতেই বিষ বা ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। আবার যে ভেজাল মেশানো হয় তাতেও থাকে বিষাক্ত উপাদান। আমরা আগে সরকারের বিভিন্ন ল্যাবরেটরি টেস্টের মাধ্যমে প্রতিবেদন সংগ্রহ করে তা পর্যবেক্ষণ করতাম। কিন্তু এখন নিজেরাই ফরমালিন পরীক্ষাসহ আরো কিছু বিষ শনাক্তকরণের কাজ শুরু করেছি। এতে দেখছি পরিস্থিতির দ্রুত অবনিত ঘটছে, যদিও প্রশাসন আগের চেয়ে কিছুটা তৎপর।'
আবু নাসের খান জানান, এ বিষাক্ত ও ভেজাল খাবারের মাধ্যমে দেশে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি-লিভারের রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ শিশুরা জটিল রোগ নিয়ে পৃথিবীতে আসছে।
No comments