গ্রামীণ ব্যাংক- ড. ইউনূস রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নন by মোজাম্মেল খান
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি তার সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গত বছর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু বিধি বছরের পর বছর ভঙ্গের অভিযোগ এনে অধ্যাপক ইউনূসকে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক থেকে অপসারণ করা হয়।
সে সময়ে আমি ডেইলি স্টার-এ ‘অধ্যাপক ইউনূসের অপসারণ: এক নিষ্প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ শিরোনামে এক নিবন্ধে সরকারি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম।
গত বছর দেশের গণমাধ্যমে জাতির সবচেয়ে গৌরবময় মানুষটির বিরুদ্ধে এমনই অপপ্রচারের মাঝখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে সেই মানুষটি সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেটা একাধারে অপ্রত্যাশিত এবং অন্যধারে প্রধানমন্ত্রীর পদের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের অবস্থান তাঁর নিবেদিত সমর্থকদেরও অসহায় অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। যেহেতু তাঁর আক্রমণের শিকার অধ্যাপক ইউনূসের মতো বিশ্ববিখ্যাত একজন মানুষ, তাই তাঁর উক্তি বিশ্ব গণমাধ্যমে ভীষণভাবে অনুরণিত হয়েছিল, যার কোনোটাই প্রধানমন্ত্রীর জন্য কোনো আনন্দ সংবাদ বয়ে আনেনি। এটা আশা করা গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর বেমানান বক্তব্যের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস ‘নো কমেন্টস’ বলে যে মানানসই উত্তর দিয়েছিলেন, সেটা অনুধাবন করে হয়তো সরকারের পরবর্তী কার্যকলাপ পরিচালিত হবে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেটা হয়নি।
এমনকি গত মাসে বিবিসির হার্ডটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কেন তাঁকে গরিবের রক্তচোষা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন?’ প্রধানমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, ‘আমি কি তাঁর নাম উল্লেখ করেছিলাম? আমি করিনি। আমি বলেছিলাম, কেউ একজন।’ নিজের বক্তব্যকে ধূম্রজালে লুকিয়ে প্রধানমন্ত্রী কাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করেছেন? অবশ্য পরমুহূর্তেই তিনি যুক্তি দেখালেন, ‘আপনি বাংলাদেশে যান, নিজের চোখে দেখে আসেন এবং তাহলেই আপনি দেখবেন।’ তদুপরি তিনি তাঁর উল্লেখ করা সুদের হারের সংখ্যা দিয়ে সত্যকে বিকৃত করলেন: ‘গরিবের কাছ থেকে ৪০ শতাংশ, ৩০ শতাংশ বা ৪৫ শতাংশ সুদ নেওয়া কি ঠিক? এটা ঠিক নয়। তাহলে এই গরিব মানুষগুলো কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে? আপনি যদি টাকা ধার দিয়ে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ সুদ নেন, সেটা লজ্জাজনক।’ পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সুদের হার সম্পূর্ণ ভুল হিসেবে উল্লেখ করে জানিয়েছে, তাদের দেওয়া ঋণের সুদের হার বাংলাদেশে সর্বনিম্ন। গ্রামীণ ব্যাংকের পাঁচ ধরনের ঋণে রয়েছে পাঁচ ধরনের সুদের হার। তাদের সর্বোচ্চ সুদের হার হলো ২০ শতাংশ, যেটা তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ক্ষুদ্রঋণ দানকারী সংস্থার জন্য সরকারের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সুদের চেয়ে ৭ শতাংশ কম। তাদের সমহার সুদ হলো ১০ শতাংশ এবং বাড়ি নির্মাণের জন্য ৮ শতাংশ। উচ্চশিক্ষার জন্য নেওয়া ঋণ যত দিন পর্যন্ত শিক্ষা শেষ না হয়, তত দিন সুদবিহীন ও শিক্ষা শেষে সুদের হার হলো ৫ শতাংশ। আমরা এখন প্রর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক প্রদত্ত সুদের হার চ্যালেঞ্জ করে বা বিবিসিকে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সুদের হারের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি গণমাধ্যমে দেখিনি।
এর সম্পূর্ণ বিপরীতে জাতি জানল মন্ত্রিসভার এক অপ্রত্যাশিত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ সিদ্ধান্তের খবর, যেটাতে ১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যে সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যাংকের সরকার নিয়োজিত চেয়ারম্যানকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে আরও ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সিদ্ধান্তটি অপ্রত্যাশিত এই কারণে যে প্রস্তাবিত সংশোধনী মোটামুটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে ব্যাংকের বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান করবে। গ্রামীণ ব্যাংক শুধু বেসরকারি ব্যাংক নয়, এটা জনগণের ব্যাংকও, যার ১২ জন বোর্ড সদস্যের তিন-চতুর্থাংশ সদস্য ব্যাংকের ৮৩ লাখ সদস্যের মধ্য থেকে তাঁদেরই ভোটে নির্বাচিত হন এবং তাঁরাই ব্যবস্থ্যাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা রাখেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁর এক সহকর্মীর ব্যাংকটিকে সম্পূর্ণভাবে সরকারি কর্তৃত্বে নিয়ে আসার প্রস্তাবের বিপরীতে বক্তব্য দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী জানালেন, মন্ত্রিসভাকে বিশ্বনেতাদের মতামতকে বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গত বছর আকস্মিকভাবে অধ্যাপক ইউনূসকে অপসারণের পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিশ্বব্যাপী উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করা হয়েছে ব্যাংকটির স্বকীয়তা ও গণতান্ত্রিক প্রশাসনব্যবস্থা বজায় রাখার ব্যাপারে, যে ব্যাংকটি আজ পৃথিবীর বহু দেশে অনুকরণীয় ব্যাংক হিসেবে সুদৃঢ় স্থান করে নিয়েছে। বিদেশি নেতাদের উদ্বিগ্নতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি গত বছর ৫ এপ্রিল ডেইলি স্টার-এ এক নিবন্ধে তাঁদের উদ্বিগ্নতাকে উড়িয়ে দিয়েছিলাম এবং তাঁদের একটি দেশের নিজস্ব একটা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন কীভাবে চলবে, সে ব্যাপারে অনধিকার নাক গলানোর দায়ে সূক্ষ্মভাবে অভিযুক্ত করেছিলাম। আজ প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ সংশোধনের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, আমাদের বিদেশি বন্ধুরাই আমাদের নির্বাচিত নেতাদের অসৎ উদ্দেশ্য আঁচ করার ব্যাপারে, আমরা যাঁরা তাঁদের নির্বাচিত করি, তাঁদের তুলনায় অনেক বেশি পারদর্শী।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে চরম প্রতিহিংসাপরায়ণতা প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অবসরের বয়স ৬০ বছর পার হওয়ার পর অধ্যাপক ইউনূস ব্যাংক থেকে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন এবং সেটা ব্যাংকের আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না। মন্ত্রিসভা অর্থ মন্ত্রণালয়কে আরও নির্দেশ দিয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি ওয়েজ আর্নার স্কিমে কোনো বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছেন কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে। এটা কি একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? এটা দেখে কি মনে হচ্ছে না যে সরকার ওই মানুষটির চরিত্র হননের মানসে এক সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, যে মানুষটি বিশ্বব্যাপী, অন্যান্য গুণাবলির সঙ্গে সঙ্গে, সাধারণ ও কৃচ্ছ্র জীবনযাপনের জন্য সুপরিচিত এবং সুপ্রশংসিত? তাঁর ব্যাংকিং দর্শনের সঙ্গে অনেকের মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু তাঁরাও, তিনি যে সৎ ও সততা নিজের জীবনে প্রতিফলিত করে চলেছেন, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করেন না।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের আকস্মিকতায় স্বাভাবিক কারণেই অধ্যাপক ইউনূস বাকরুদ্ধ। দেশের মানুষের প্রতি এক তাৎক্ষণিক আবেদনে তিনি বলেছেন, ‘আমি এতটাই বিমর্ষ যে আমি আমার অনুভূতি প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমি বাংলাদেশের জনগণ, যাঁরা আমারই মতো বিমর্ষ, তাঁদের কাছে অনুরোধ রাখছি, তাঁরা যেন সরকারকে বলেন যে তারা এক বিরাট ভুল সংঘটিত করতে যাচ্ছে এবং সে ভুল করা থেকে সরকারকে বিরত করার চেষ্টা করেন।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কি তাঁর দেশের মানুষের কথায় কর্ণপাত করবেন? যে সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়, তার কাছে জনগণের আদালতই মুখ্য। ভুক্তভোগী অন্য পক্ষের বারংবার সাদা পতাকা দেখানোর আহ্বান সত্ত্বেও বর্তমান সরকার নিশ্চিন্তভাবেই এমন এক যুদ্ধ শুরু করেছে, সে একপক্ষীয় যুদ্ধে কোনো দিনও জেতা সম্ভব নয়। সরকার এমন এক প্রতিপক্ষকে বেছে নিয়েছে, যাঁর মহৎ কীর্তি, তাঁর মস্তিষ্কশিশু গ্রামীণ ব্যাংকের ভাগ্যে যেটাই ঘটুক না কেন, তাঁকে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের লাখো কোটি মানুষ মনে রাখবে।
মোজাম্মেল খান: অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, শেরিডান বিশ্ববিদ্যালয়, টরন্টো, কানাডা।
No comments