গুটিয়ে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি শিল্প by আবু সাউদ মাসুদ
নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র হোসিয়ারি শিল্প ক্রমেই গুটিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের লোডশেডিং, লঞ্চ টার্মিনাল সদরঘাটে স্থানান্তর ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এখন বেহাল দশা হোসিয়ারি শিল্পের। গত কয়েক বছর ক্রমাগত শ্রমিক অসন্তোষ ছিল এখানকার প্রধান সমস্যা। সেই সময়ে মূলত অনেক হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায় ঢাকার কেরানীগঞ্জে। সেই থেকে আজও নারায়ণগঞ্জ থেকে সরে যাচ্ছে হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে কেরানীগঞ্জে বিশাল বিশাল মার্কেট নির্মাণ করে চলছে পাইকারি হোসিয়ারি ব্যবসা।
ফলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারদের একটি বিরাট অংশ এখন তাদের সেটারের জন্য কেরানীগঞ্জ থেকে মাল ক্রয় করেন। বেশ কয়েকজন হোসিয়ারি মালিকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, নারায়ণগঞ্জ ছিল বাংলাদেশের একমাত্র ক্ষুদ্র হোসিয়ারি মালামাল প্রস্তুতকারক এলাকা। দেশের সব এলাকার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে তাদের গেঞ্জি পাইকারি ক্রয় করে নিয়ে যেত। নানাবিধ সমস্যা ও কালের পরিবর্তনে নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি মালিকদের তাদের প্রস্তুতকৃত গেঞ্জি এখন ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও চকসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকার শোরুমে নিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। অনেকেই আবার তাদের পুরো উৎপাদনই কেরানীগঞ্জের শোরুমগুলোতে আগাম বিক্রি করে দিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জে যখন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল সে সময় বেশ কিছুদিন হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে। সে সময় এখানকার চিহিৃত কিছু শ্রমিক নেতা নামধারীরা ফায়দা লুটে নেয়। যাদের কেউ কেউ এখন রফতানিমুখী গার্মেন্ট শিল্পের অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তাদের আশঙ্কা এসব শ্রমিক নেতাকে আশকারা দিলে হোসিয়ারি শিল্পের মতোই নারায়ণগঞ্জ থেকে গার্মেন্ট শিল্পও গুটিয়ে যাবে। মাসিক বেতনে কর্মচারী খাটিয়ে বিদ্যুতের অসহনীয় লোডশেডিংয়ের কারণে তাদের লোকসান গুনতে হয় সারা মাস। মূলত পূজা ও ঈদ সামনে রেখে বর্তমানে হোসিয়ারি শিল্পগুলো কোনো রকমে টিকে আছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ প্রবেশ করতে অসহনীয় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হওয়ায় পাইকাররা এখন বিরক্ত। ফলে শেষ আশা পূজা ও ঈদ মৌসুমও বোধহয় হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হতে চলেছে। তাদের দাবি দ্রুত যানজটের সমস্যাটি সমাধান না করা গেলে বর্তমান যে প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও নারায়ণগঞ্জে আছে তা আগামী মৌসুমে থাকতে পারবে না। ফলে নারায়ণগঞ্জ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে হোসিয়ারি শিল্প। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে স্বল্প পরিমাণে মধ্যপ্রাচ্যে গেঞ্জি রফতানি শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে তারা বেশ কয়েকটি চালান পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে একজন জানালেন, ব্যাংক সুবিধা পাওয়া গেলে হোসিয়ারি শিল্প দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ধরে রাখা সম্ভব হবে। এখানে হোসিয়ারি শিল্পের একটি উজ্জ্বল বাজার রয়েছে। রফতানিমুখী গার্মেন্টের কার্টপিস থেকে এখন বাচ্চাদের জন্য তৈরি নীট পোশাক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ আমদানি করছে। ৫০০ থেকে ৩ হাজার পিস পর্যন্ত তারা বাংলাদেশ থেকে ফ্যাশন বেবি পোশাক নিচ্ছে। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের ক্রেতারা এখন তাদের নিজেদের ডিজাইনে পোশাক প্রস্তুত করে নিতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছে। ফলে এক্ষেত্রে ব্যাংকঋণ ছাড়া অনেক হোসিয়ারি মালিকের পক্ষেই সম্ভব হবে না অর্ডার নেয়া। তাই তাদের দাবি ক্ষুদ্র হোসিয়ারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকঋণ প্রদান করে রফতানি খাতে কাজে লাগানো। যে কারণে নারায়ণগঞ্জ ছিল হোসিয়ারি ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র ১৯২৮ সালে বিভূতি চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন বিডি আর মিল ও কুন্ডরা গড়ে তোলেন কুন্ডু ব্রাদার্স। নারায়ণগঞ্জ শহরে যখন বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় আনা হয় তখনই মূলত ব্যাপক প্রসার লাভ করে হোসিয়ারি শিল্পের। ১৯৪০ সালের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হোসিয়ারি ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা হয়। সেসময় থেকে নারায়ণগঞ্জের হাজার হাজার গেঞ্জি আসাম ও বার্মায় যেত। নারায়ণগঞ্জের প্রস্তুতকৃত গেঞ্জি ব্যাপক চাহিদা লাভ করে আসাম ও বার্মায়। মূলত হোসিয়ারি ব্যবসায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরাই এগিয়ে ছিল। ১৯৪৭ সালের আগে মাত্র ৪টি হোসিয়ারি প্রতিষ্ঠান ছিল মুসলমান মালিকানাধীন। নারায়ণগঞ্জে হোসিয়ারি ব্যবসা দ্রুত প্রসারতা লাভের নেপথ্যে রয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি। গেঞ্জির কাপড় বডি বা নিটিং মেশিনে প্রস্তুত করা হয়। পরে একে ধোলাই করতে হয়, যা আজকের দিনে ডাইং ইন্ডাষ্ট্রিগুলো করছে। সে সময় শীতলক্ষ্যার পানি ও বাংলা সাবান ব্যহৃত হতো কাপড় ধোলাইয়ে। সে কারণে পাবনা ও চট্টগ্রামে প্রস্তুতকৃত গেঞ্জি থেকে নারায়ণগঞ্জের গেঞ্জি সুন্দর, পরিষ্কার ও ধবধবে সাদা হতো। এছাড়াও এ অঞ্চলে শ্রমিক পাওয়া যেত সস্তায়। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, সুতা সরবরাহের প্রতিষ্ঠান, কটন মিল, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও টেক্সটাইল মিলগুলোর বেশিরভাগ ছিল নারায়ণগঞ্জে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এ শিল্প প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে থাকায় বাংলাদেশের ইতিহাসে হোসিয়ারি শিল্পের সঙ্গে নিজেকে সম্মানের আসনে ধরে রেখেছে নারায়ণগঞ্জ। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে ছোট ও মাঝারি কয়েক হাজার হোসিয়ারি শিল্প রয়েছে। ব্যবসায়ী প্রয়োজনে ১৯৪৭ সালে ইষ্ট বেঙ্গল হোসিয়ারি এসোসিয়েশন গড়ে ওঠে।
No comments