ময়মনসিংহে খালেদা জিয়াঃ বড় কর্মসূচি আসছে, তরুণদের অংশ নেওয়ার আহ্বান by তানভীর সোহেল ও মো. কামরুজ্জামান
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশকে অন্যের হাতে তুলে দিতে দেওয়া হবে না। এ জন্য আন্দোলন করতে হবে। আর কয়েকটি রোডমার্চ শেষ হওয়ার পর আরও বৃহত্তর কর্মসূচি দেওয়া হবে। সেই কর্মসূচিতে শরিক হওয়ার জন্য তরুণ প্রজন্মসহ সবাইকে আহ্বান জানান তিনি। ময়মনসিংহে সার্কিট হাউস ময়দানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলের জনসভায় গতকাল প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া। সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ জনসভা করা হয়।
এর আগে ঢাকা ও সিলেট অভিমুখে রোডমার্চ করেছে চার দল। খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি যুদ্ধ ঘোষণা করেছি দেশ ও জনগণকে রক্ষার জন্য।’ বিরোধীদলীয় নেতা অভিযোগ করেন, ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডর দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এত দিন শুনেছি, করিডর দিলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। কিন্তু হয়েছে সিকিম।’ তিনি জানতে চান, ‘ট্রানজিট দেওয়ায় বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কত টাকা পেয়েছে?’
সম্প্রতি খালেদা জিয়া সিলেট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচির বিভিন্ন পথসভা ও জনসভায় একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামী ও তাঁর দলের নেতাদের মুক্তির দাবি জানান। ১৯ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জের জনসভায় তিনি জামায়াতের নেতা নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, কামারুজ্জামান ও বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মুক্তি দাবি করে বলেন, এরা স্বাধীনতাবিরোধী নয়, বরং আওয়ামী লীগই স্বাধীনতাবিরোধী। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্নও তোলেন।
খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য নিয়ে গত বুধবার ক্ষমতাসীন মহাজোটের সাংসদরা সংসদে অভিযোগ করেন, খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছেন। তাঁদের কেউ কেউ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করারও দাবি তোলেন।
তবে খালেদা জিয়া গতকাল এ বিষয়ে সরাসরি কিছু না উল্লেখ করে বলেন, ‘এই সরকার এখন দিশেহারা। তাই পার্লামেন্টে উল্টোপাল্টা কথা বলছে। বিএনপির আন্দোলন দেখে ভয় পেয়েছে তারা।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা তাদের বিরুদ্ধে হওয়া উচিত, যারা দেশের জমি অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে, দেশকে অন্য দেশের প্রদেশে রূপান্তর করার চেষ্টা করছে।’
তবে গতকালের জনসভায় চার দলের নেতারা উপস্থিত থাকলেও খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তিনি বিএনপির নেতা আবদুস সালাম পিন্টু ও লুৎফুজ্জামান বাবরের নাম উল্লেখ করে তাঁদের মুক্তি দাবি করেন। অবশ্য জামায়াতে ইসলামী ও জোটের অন্যান্য শরিক দলের যেসব নেতা-কর্মী আটক, তাঁদেরও মুক্তি দাবি করেন তিনি।
জনসভায় প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্যে বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ওয়াদা ভঙ্গকারী, দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ। দেশের তরুণদের জন্য নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়তে, শেয়ারবাজার লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য, বিনিয়োগ বাড়াতে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার্থে, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার সরকারকে হটাতে, সন্ত্রাস-দুর্নীতি বন্ধ করতে তাঁর এ যুদ্ধ। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে যারা দেশকে প্রদেশ বানাতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। যারা ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর কথা বলেছে, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছে, বিনা মূল্যে সার দেওয়ার কথা বলেছে, কিন্তু দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ।’ তিনি অভিযোগ করেন, এই সরকার দেশকে দেউলিয়া করে ফেলছে।
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিএনপির আমলে পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু হয়নি। এই সরকারে দুর্নীতির কারণে সাহায্য বন্ধ হয়েছে। কারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের নাম আমাদের জানা। সময়মতো তুলে ধরব। বিদেশিরা বলেছে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই যদি হয়, এদের দিয়ে কিছু হবে না।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, তিনি নারায়ণগঞ্জে গিয়ে মানুষকে বলেছেন, ‘আপনারা টাকা নেবেন, কিন্তু ভোট দেবেন না।’ এ বক্তব্যের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত। খালেদা জিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে বাধ্য হবে। সবার মতামত নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, গত তিন বছরেও এ সরকার ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোনো উন্নয়ন করেনি। তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে ময়মনসিংহ বিভাগ, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ও আনন্দ মোহন কলেজকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হবে। তিনি নেত্রকোনার বিরিশিরিতে শতবর্ষী গাছ কাটার সমালোচনা করে অভিযোগ করেন, এর সঙ্গে সরকারদলীয়রা জড়িত।
জনসভায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমান বলেন, তাঁর দলের নেতারা যুদ্ধাপরাধ করেননি, বরং আওয়ামী লীগই যুদ্ধাপরাধ করেছে।
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হলে এ সরকারের বিচার করতে হবে। কারণ এরা যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়েছিল।
বিজেপির সভাপতি আন্দালিব রহমান বলেন, সরকার পদ্মা সেতু খাওয়ার পর এখন মনোরেল প্রকল্প খাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এরা কিছুই তৈরি করতে পারবে না।
ময়মনসিংহ জেলা বিএনপির (দক্ষিণ) সভাপতি এ কে এম মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে জনসভায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খেলাফত মজলিসের সভাপতি মো. ইসাহাক, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আ স ম হান্নান শাহ, মঈন খান, গয়েশ্বর রায়, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ জেড এম জাহিদ হোসেন প্রমুখ।
উৎসাহ-উদ্দীপনা: খালেদা জিয়ার আগমনে ময়মনসিংহ শহর ও আশপাশের এলাকাজুড়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল। বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাতটি জেলার ৩৯টি নির্বাচনী এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে জনভায় আসেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। জামায়াতে ইসলামীর একাধিক মিছিল সকাল থেকে জনসভাস্থলে এসে উপস্থিত হতে থাকে। শহরজুড়ে শতাধিক তোরণ নির্মাণ করা হয়। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ আসার পথে বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মীরা খালেদা জিয়াকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। ভালুকায় সংবর্ধনাও দেন স্থানীয় নেতারা। শহরে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও জিয়াউর রহমানের পোস্টার, ব্যানারে ছিল পরিপূর্ণ। জামায়াতের নেতাদের মুক্তি চেয়েও প্রচুর ব্যানার-পোস্টার শহরে দেখা গেছে।
খালেদা জিয়া ও স্থানীয় বিএনপির নেতারা অভিযোগ করেছেন, সমাবেশে আসার পথে বিভিন্ন স্থানে তাঁদের নেতা-কর্মীদের বাধা দিয়েছে সরকারদলীয় সমর্থকেরা। তবে তাঁরা পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেন।
No comments