প্রাথমিক শিক্ষাঃ কতজন ঝরে পড়ছে by মাহফুজুর রহমান মানিক
শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই বলে আসছেন, দেশে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪০ ভাগের ওপরে। অবশ্য এটাও তারা কোন গবেষণা থেকে পেয়েছেন জানি না সল্ফপ্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আফছারুল আমীন তার মন্ত্রণালয়ের ২০১১-১২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাসংক্রান্ত অনেকগুলো বিষয় তুলে ধরেছেন, তার মধ্যে ঝরে পড়া বা ড্রপ আউট অন্যতম। মাননীয় মন্ত্রী বিষয়টা নিয়ে এক নতুন অশ্চর্যজনক তথ্য দিয়েছেন_ প্র্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার ২১ শতাংশ।
'২১' কোনো আহামরি সংখ্যা নয় যে তা হতে পারবে না কিংবা এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতে হবে। প্রশ্ন হলো, কিসের ভিত্তিতে মন্ত্রী এ তথ্য দিয়েছেন। অবশ্য মন্ত্রীর সচিব বিষয়টার ন্যায্যতার চেষ্টা করছেন_ 'এটা কোনো জাতীয় গণনা নয়, আমরা ৩৪ হাজার বিদ্যালয়ের তথ্য বিশেল্গষণ করে এটা পেয়েছি। বলার বিষয় হলো, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) সর্বশেষ (২০০৯) তথ্য মতে, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮১ হাজার ৫০৮টি। ৩৪ হাজার যার অর্ধেকও নয়। আবার সচিবের কথামতো এটা জাতীয় গণনাও নয়। অথচ এর ওপর ভিত্তি করেই মন্ত্রী গোটা দেশের চিত্র বলে দিলেন!
সমস্যাটা আসলে এখানে নয়। সমস্যা হলো শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই বলে আসছেন দেশে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪০ ভাগের ওপরে। অবশ্য এটাও তারা কোন গবেষণা থেকে পেয়েছেন জানি না। তবু এ সংখ্যাটা ধরলেও রাতারাতি ঝরে পড়ার হার ২১ শতাংশ তথা অর্ধেক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে বলে কেউ জানে না। প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার নির্ণয়ে সবশেষে গবেষণা হয়েছে ২০০৮ সালে। চধৎঃরপরঢ়ধঃড়ৎু ঊাধষঁধঃরড়হ : ঈধঁংবং ড়ভ চৎরসধৎু ঝপযড়ড়ষ উৎড়ঢ়-ঙঁঃ শিরোনামে গবেষণাটি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। গবেষণার প্রতিবেদনটি এখনও যে কেউ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে দেখতে পারেন। ২০০৯-এ গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এখানে দেখানো হয়েছে ৫০.৭ ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে, অর্থাৎ ঝরে পড়ার হার ৪৯.৩। এটা সরকারি গবেষণার ফল। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণসাক্ষরতা অভিযানের এডুকেশন ওয়াচ প্রতিবেদন ২০০৮ অনুযায়ী পঞ্চম শ্রেণী শেষ করতে পারে ৫০.১০ ভাগ শিক্ষার্থী। দুটি গবেষণার কোনোটিই ৪৯ ভাগের কম শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে, এ কথা বলতে পারছে না। তবে দুই বছরে অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তাই বলে তার ২১ শতাংশ হয়ে গেছে এটা অবিশ্বাস্য।
লক্ষণীয়, বাংলাদেশে শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে কেবল জরিপ টাইপের গবেষণা হয়, যার মাধ্যমে শুধু একটা সুপারফিসিয়াল তথ্য পাওয়া যায়। যেমন বাংলাদেশর শিক্ষার হার কত, কতভাগ মানুষ স্যানিটেশন পাচ্ছে কিংবা জনসংখ্যা কত। গুণগত মান পরিবর্তনে বিস্তর গবেষণা কমই হয়। গত বছর থেকে যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষা শুরু হলো এর জন্য কোনো গবেষণা হয়েছে বলে কেউ জানে না। প্রাথমিক শিক্ষার সাম্প্রতিক ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা আগেও বলছি, এর ফলে ২১ ভাগে ঝরে পড়া নেমে আসার কথা নয়। সরকার দাবি করছে, বিদ্যালয় গমনোপযোগী (৬-১০ বছর বয়সী) শিশুদের ৯৯.৪৭ ভাগ এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। এ সংখ্যা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আবার কিছুদিন আগে সাক্ষরতা দিবসে (৮ সেপ্টেম্বর) এই মন্ত্রীই বলেছিলেন, সাক্ষরতার হার ৫৮ ভাগ, যদিও সরকারের গবেষণায় রয়েছে ৫৩। এ নিয়েও গণমাধ্যম সমালোচনা করেছে।
এভাবে সবকিছুর হারকে শুধু শুধু বাড়িয়ে বললে কাজের কাজ তো কিছুই হবে না। জনগণকে ফাঁকি দেওয়া বা দাতাগোষ্ঠীকে এভাবে খুশি করানোর চেষ্টা আসলে বৃথা। এখন সবাই সচেতন। আর ইচ্ছামতো বলাটা একদিকে যেমন ক্রেডিটের প্রশ্ন, অন্যদিকে বিষয়গুলো হাস্যকর। প্রাথমিক শিক্ষা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য পিইডিপি-৩ নামে ইতিহাসের রেকর্ড ২৩ হাজার কোটি টাকার একটা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এই মুহূর্তে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর ঝরে পড়ার এরকম তথ্যে খারাপ প্রভাব পড়বে কি-না বোদ্ধারই বলতে পারবেন। তবে মন্ত্রীরা কি সাবধান হবেন না!
মাহফুজুর রহমান মানিক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাবি
সমস্যাটা আসলে এখানে নয়। সমস্যা হলো শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সাম্প্রতিক সময়ে প্রায়ই বলে আসছেন দেশে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪০ ভাগের ওপরে। অবশ্য এটাও তারা কোন গবেষণা থেকে পেয়েছেন জানি না। তবু এ সংখ্যাটা ধরলেও রাতারাতি ঝরে পড়ার হার ২১ শতাংশ তথা অর্ধেক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছে বলে কেউ জানে না। প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার নির্ণয়ে সবশেষে গবেষণা হয়েছে ২০০৮ সালে। চধৎঃরপরঢ়ধঃড়ৎু ঊাধষঁধঃরড়হ : ঈধঁংবং ড়ভ চৎরসধৎু ঝপযড়ড়ষ উৎড়ঢ়-ঙঁঃ শিরোনামে গবেষণাটি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। গবেষণার প্রতিবেদনটি এখনও যে কেউ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে দেখতে পারেন। ২০০৯-এ গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এখানে দেখানো হয়েছে ৫০.৭ ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে, অর্থাৎ ঝরে পড়ার হার ৪৯.৩। এটা সরকারি গবেষণার ফল। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণসাক্ষরতা অভিযানের এডুকেশন ওয়াচ প্রতিবেদন ২০০৮ অনুযায়ী পঞ্চম শ্রেণী শেষ করতে পারে ৫০.১০ ভাগ শিক্ষার্থী। দুটি গবেষণার কোনোটিই ৪৯ ভাগের কম শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে, এ কথা বলতে পারছে না। তবে দুই বছরে অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তাই বলে তার ২১ শতাংশ হয়ে গেছে এটা অবিশ্বাস্য।
লক্ষণীয়, বাংলাদেশে শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে কেবল জরিপ টাইপের গবেষণা হয়, যার মাধ্যমে শুধু একটা সুপারফিসিয়াল তথ্য পাওয়া যায়। যেমন বাংলাদেশর শিক্ষার হার কত, কতভাগ মানুষ স্যানিটেশন পাচ্ছে কিংবা জনসংখ্যা কত। গুণগত মান পরিবর্তনে বিস্তর গবেষণা কমই হয়। গত বছর থেকে যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি পরীক্ষা শুরু হলো এর জন্য কোনো গবেষণা হয়েছে বলে কেউ জানে না। প্রাথমিক শিক্ষার সাম্প্রতিক ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা আগেও বলছি, এর ফলে ২১ ভাগে ঝরে পড়া নেমে আসার কথা নয়। সরকার দাবি করছে, বিদ্যালয় গমনোপযোগী (৬-১০ বছর বয়সী) শিশুদের ৯৯.৪৭ ভাগ এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। এ সংখ্যা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আবার কিছুদিন আগে সাক্ষরতা দিবসে (৮ সেপ্টেম্বর) এই মন্ত্রীই বলেছিলেন, সাক্ষরতার হার ৫৮ ভাগ, যদিও সরকারের গবেষণায় রয়েছে ৫৩। এ নিয়েও গণমাধ্যম সমালোচনা করেছে।
এভাবে সবকিছুর হারকে শুধু শুধু বাড়িয়ে বললে কাজের কাজ তো কিছুই হবে না। জনগণকে ফাঁকি দেওয়া বা দাতাগোষ্ঠীকে এভাবে খুশি করানোর চেষ্টা আসলে বৃথা। এখন সবাই সচেতন। আর ইচ্ছামতো বলাটা একদিকে যেমন ক্রেডিটের প্রশ্ন, অন্যদিকে বিষয়গুলো হাস্যকর। প্রাথমিক শিক্ষা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য পিইডিপি-৩ নামে ইতিহাসের রেকর্ড ২৩ হাজার কোটি টাকার একটা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। এই মুহূর্তে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর ঝরে পড়ার এরকম তথ্যে খারাপ প্রভাব পড়বে কি-না বোদ্ধারই বলতে পারবেন। তবে মন্ত্রীরা কি সাবধান হবেন না!
মাহফুজুর রহমান মানিক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাবি
No comments