বিদ্যুৎ লাইন পেতে মন্ত্রী এমপিদের দৌড়ঝাপ by নাজমুল ইমাম
নিজ সংসদীয় এলাকায় বিদ্যুতের লাইন পেতে মন্ত্রী-এমপিরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হক এমপির কাছে ডিও লেটার (চাহিদাপত্র) পাঠিয়েছেন অনেকেই। তার মধ্যে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহবুবুর রহমান এমপি একজন। চিঠিতে তিনি ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ঘিরে তার নির্বাচনী আসনের বিভিন্ন এলাকায় নতুন বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের অনুরোধ জানিয়েছেন। শুধু পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নন, তার মতো শতাধিক মন্ত্রী-এমপি-জনপ্রতিনিধির ডিও লেটার জমা পড়েছে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দফতরে। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ অথবা এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তারা এসব ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। নতুন লাইন নির্মাণের পাশাপাশি নতুন সংযোগের জন্যও মন্ত্রী-এমপিদের ডিও লেটার জমা পড়ছে হাজার হাজার।
প্রতিদিন ডিও লেটারের সংখ্যা বাড়ছে। মন্ত্রী-এমপিদের তদবিরের চাপে বেকায়দায় বিদ্যুৎ বিভাগ। চাপ সামলাতে মন্ত্রণালয় থেকে ডিও লেটারগুলো পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে (আরইবি) পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রী-এমপিদের দৌড়ঝাঁপের মূল কারণ হলো গ্রামে বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের জন্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প অনুমোদন হতে যাচ্ছে। অচিরেই সারাদেশে বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের কাজ শুরু হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মোঃ মাহবুবুর রহমান এমপি তার সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের নতুন লাইন নির্মাণের জন্য গত ৯ মে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বরাবর চিঠি দেন। এতে তিনি কয়েকটি এলাকায় বিতরণ লাইন নির্মাণের জন্য অনুরোধ জানান। এর মধ্যে রয়েছে কলাপাড়া উপজেলা সদরের বাদুরতলী ফিশারি থেকে ইটবাড়িয়া হয়ে বালিয়াতলী ফেরিঘাট। বালিয়াতলী স্টেশন থেকে বড় বাড়িয়াতলী, পণ্ডিতবাড়ি ও ইসলামিয়া মাদ্রাসা হয়ে বাবলাতলা বাজার কলেজ রোড হয়ে ধুলাশ্বর চাপলী বাজার। সেখান থেকে ইউনিয়ন পরিষদের ধোলাই বাজার হয়ে গঙ্গামতি সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত। ডিও লেটারে তিনি বলেছেন, ৫০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কৃষিভিত্তিক শিল্পাঞ্চল
হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার নির্বাচনী এলাকা সম্ভাবনাময় ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম ইদ্রিস আলী তার চিঠিতে বলেছেন, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নে বিএনপি আমলে ১-২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খাম্বা বসানো হলেও বিদ্যুৎ আসেনি। তিনি বাউশিয়া ইউনিয়নের গুদারাঘাট থেকে গুয়াগাছিয়া ইউনিয়ন পর্যন্ত নতুন লাইন চেয়েছেন।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের স্বল্পলাডুগ্রামে বিদ্যুতায়নের অনুরোধ জানিয়েছেন খন্দকার আবদুল বাতেন এমপি। বিদ্যুতের নতুন লাইন নির্মাণ অথবা সংযোগের জন্য স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, জামালপুর-৪ আসনের সাংসদ ডা. মোঃ মুরাদ হোসেন এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ নূরজাহান বেগমসহ প্রায় শতাধিক এমপি-জনপ্রতিনিধি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বরাবর অনুরোধ জানিয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন। নিয়মিত তদবির করছেন তারা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে দেশের বাইরে থাকলেও ডিও লেটার জমা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সংযোগের বিষয়ে ডিও দিয়েছেন পার্বত্য বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এমপি। পার্বত্য এলাকায় আরইবির লাইন নেই। সেখানে পিডিবি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
বিদ্যুৎ বিভাগ শুরুতে প্রত্যেক সাংসদের এলাকায় ১০০ কিলোমিটার করে নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণের কথা বললেও বিতর্কের আশঙ্কায় পরে প্রত্যেক উপজেলায় বিতরণ লাইন নির্মাণের কথা বলা হয়। এ জন্য নেওয়া প্রকল্পের কৌশলী নামও দেওয়া হয়। প্রকল্পের নাম হচ্ছে '১৮ লাখ গ্রাহক সংযোগ প্রকল্প'। আরইবি থেকে এখন বলা হচ্ছে, প্রত্যেক উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ নয়; বরং চাহিদার বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখেই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি হয়েছে।
বিগত চারদলীয় জোট সরকার আমলেও একইভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যেক সাংসদের এলাকায় নতুন বিতরণ লাইন টানা হয়। সেবার প্রত্যেক সাংসদের এলাকায় ১০০ কিলোমিটার নতুন লাইন টানার উদ্যোগ নিয়েও পরে লাইন টানা হয় নূ্যনতম ৪০ কিলোমিটার করে। খুঁটি পোতা আর নতুন লাইন টানার দিকে তখন বেশি ঝোঁক ছিল সরকারের। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর ছিল না। এ কারণে পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ ঘাটতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। বিদ্যুৎ ছাড়াই খুঁটির পর খুঁটি পড়ে থাকে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল লাভবান হয়।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারাদেশে পল্লী এলাকায় বিদ্যুতের বিতরণ লাইন বাড়ানোর জন্য আরইবি ইতিপূর্বে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে। বিদ্যুৎ বিভাগ এ প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। বর্তমানে এটি একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ৪৫৩টি উপজেলায় ৪৫ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন টানা হবে।
অভিযোগ উঠেছে, সমিতিগুলোর মাঠ পর্যায় থেকে জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ না করে শুধু মন্ত্রী-এমপিদের চাহিদার ভিত্তিতে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণ করা হলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর (পবিস) লোকসানের বোঝা আরও বেড়ে যাবে। বর্তমানে ৭০টি সমিতির ৬৫টিই লোকসানে চলছে। সেগুলো সরকারের পাওনা শোধ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) ভাঙিয়েও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি) ওই অর্থ শোধ করতে হচ্ছে। এতে সংস্থাটি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ কিনতেও সরকারকে ব্যাপক পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। নতুন করে আরইবির লোকসানের পরিমাণ বাড়লে বিদ্যুৎ খাতে ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত প্রকল্পটিকে রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে মনে করছেন। তারা বলেছেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মতো মন্ত্রী-এমপিদের এলাকায় বিতরণ লাইন ভাগাভাগি করে দিতেই এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। প্রয়োজনীয় স্থানে বিদ্যুতের লাইন বসানো উচিত। নতুবা বিদ্যুৎ খাত আবারও গভীর সংকটে পড়বে।
বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক পরিকল্পনার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ সমকালকে বলেছেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটিও রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। এ পথ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোনো এলাকা বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে সেই এলাকার আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থা ও জনসংখ্যার বিষয়টিকেই বিবেচনায় রাখা হয়। নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক পবিসে দায়িত্বরত পরামর্শককে দিয়ে এলাকা বাছাই করে নতুন লাইন নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু এসব বিষয়কে বাদ রেখে শুধু মন্ত্রী-এমপিদের চাহিদার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে সেটা বাস্তবসম্মত হবে না। এতে শুধু আরইবি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, গোটা বিদ্যুৎ খাতই বিপর্যয়ের কবলে পড়তে পারে।
তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই প্রকল্প নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরইবির চেয়ারম্যান ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে নতুন বিতরণ লাইন সম্প্রসারণের কাজ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ ঘাটতি বেশি থাকায় এতদিন নতুন লাইন নির্মাণের প্রয়োজন হয়নি। এখন বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ছে। নতুন লাইন নির্মাণও জরুরি হয়ে পড়েছে। চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, অনেক দিন ধরেই মন্ত্রী-এমপিদের আবেদন জমা পড়ছে। কিন্তু নতুন বিতরণ লাইন সম্প্রসারণের কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় তাদের আবেদনে সাড়া দেওয়া যায়নি। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে মন্ত্রী-এমপিদের চাহিদার ভিত্তিতে কোন এলাকায় কত কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মাণ করা হবে, সেটি চূড়ান্ত করা হবে। তিনি জানান, এখনও জনপ্রতিনিধিদের ডিও লেটার আসছে। পাশাপাশি অনেক এমপি সশরীরে এসে তদবির করছেন। আবার টেলিফোনেও কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নতুন লাইনের জন্য বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে অনুরোধ করছেন। মন্ত্রী-এমপিদের ডিও লেটারের ওপর বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে তার একান্ত সচিব মোঃ নূরুল আলম সুপারিশ করে তা আরইবির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
জানা যায়, একনেকের অনুমোদনের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে গত জুলাই মাসে নতুন বিতরণ লাইনের প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পবিসের মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য ও চাহিদাপত্র না নিয়েই উপজেলাওয়ারি কত লাইন বসবে সে হিসাব করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তাই প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার আগেই এমপিদের দেন-দরবার শুরু হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ডিও লেটার দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও কেউ একশ', কেউ ২০০, িকেউবা তার চেয়ে কম-বেশি কিলোমিটার নতুন বিদ্যুৎ লাইন চাচ্ছেন। কোন এমপি কত কিলোমিটার নতুন লাইন পাবেন তার প্রাথমিক হিসাব করা হলেও ঝামেলা এড়াতে বিদ্যুৎ বিভাগ ও আরইবি বিষয়টি গোপন রাখছে। কোন এমপির এলাকার জন্য কী পরিমাণ লাইন বরাদ্দ করা হবে তা আগে থেকে টের পেলে বিদ্যুৎ বিভাগ ও আরইবিকে আরও চাপের মুখে পড়তে হবে। সে জন্য এই সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
আরইবির লোকসান : সূত্র জানায়, সরকার আরইবির পবিসগুলোর মাঠ পর্যায়ের চাহিদার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরা যাতে তাদের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে পারেন, সে বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এর ফলে বর্তমানে লোকসানি সমিতিগুলোর অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। এমনিতেই গত ফেব্রুয়ারি এবং আগস্টে দু'দফায় বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির ফলে অনেক সমিতি চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। সমিতিগুলো বেশি দামে পিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনলেও গ্রাহকের কাছে কম দামেই তা বিক্রি করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারেরও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বিশেষ করে দ্রুত বেসরকারি বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে সরকারের ভর্তুকির বোঝা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ অবস্থার মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুতায়ন করা হলে পবিসগুলোর লোকসানের দায়ভার সরকারের কাঁধেই চাপবে।
পবিসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, সমিতির লাইনগুলো অনেক দীর্ঘ হয়। মন্ত্রী-এমপিদের তদবিরের কারণে অল্পসংখ্যক গ্রাহকের জন্যও দীর্ঘ লাইন টানতে হয়। যেখান থেকে বিনিয়োগ উসুল করা সম্ভব হয় না। এমন স্থানেও লাইন টানতে হয়, যেখানে কোনো শিল্প কলকারখানা থাকে না। এসব স্থানে লাইন টেনেই লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তাছাড়া পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা উল্লেখযোগ্য হারে সাবসিডি পায়। এ কারণেও অনেক সমিতিকে লোকসান গুনতে হয়। আরইবিতে লাভের চেয়ে বিদ্যুৎ সেবাটাই বড় করে দেখা হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন করে ৪৫ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন বাড়লে লোকসানের বোঝা আরও বাড়তে পারে বলে তারা মনে করেন। তবে দীর্ঘদিন নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ বন্ধ থাকায় কিছু এলাকায় বিদ্যুতায়ন প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা জানান। এ জন্য মাঠ থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রকল্প প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে সেটা বাস্তবসম্মত হতো।
নতুন করে ৪৫ হাজার লাইন নির্মাণ করা হলে তাতে সমিতিগুলোর লোকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে এর সঙ্গে সরাসরি দ্বিমত পোষণ না করে আরইবির চেয়ারম্যান সমকালকে বলেন, বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বাড়ানো হলে তেমন একটা লোকসান থাকবে না। তাছাড়া নতুন উপকেন্দ্র স্থাপনসহ জরাজীর্ণ বিতরণ ব্যবস্থা বদলে ফেলা হলে সিস্টেম লস কমবে। তবে পাইকারি মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য না বাড়ালে সমিতিগুলোর লোকসান আরও বাড়বে বলে তিনি স্বীকার করেন।
১৮ লাখ গ্রাহক সংযোগ প্রকল্প :দেশের সব গ্রামে বিদ্যুৎ পেঁৗছে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) যাত্রা শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ২৩ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন রয়েছে সরকারি এ সংস্থাটির হাতে। এর মাধ্যমে দেশের ৮৭ হাজার ৩৭২টি গ্রামের মধ্যে ৪৮ হাজার ৭৫৪টি গ্রামে বিদ্যুৎ-সুবিধা পেঁৗছানো হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পেঁৗছে দিতে আরইবির আরও এক লাখ ৯৮ হাজার নতুন বিতরণ লাইন লাগবে। এর মধ্যে বর্তমানে চলমান ৫টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮ হাজার ২০০ কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০১৪ সাল নাগাদ এই প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে নতুন করে আরও ৭ লাখ ২০ হাজার গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া যাবে। এসব প্রকল্প ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আরইবি তড়িঘড়ি করে আরও একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। '১৮ লাখ গ্রাহক সংযোগ প্রকল্পে'র প্রস্তাব বর্তমানে সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে আরইবির আওতাধীন এলাকা মফস্বল শহর ও গ্রামাঞ্চলে ১১ কেভি ক্ষমতার মোট ৪৫ হাজার কিলোমিটার নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া দুই হাজার কিলোমিটার নতুন ৩৩ কেভি লাইন তৈরি, ৫০০ কিলোমিটার পুরনো ৩৩ কেভি লাইন সংস্কার, ১০০ নতুন উপকেন্দ্র নির্মাণ এবং পাঁচটি পুরনো উপকেন্দ্র সংস্কার করা হবে। চার বছর মেয়াদি (জুলাই '১১ থেকে জুন ২০১৫) এই প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যাতে সরকার অর্থায়ন করবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে আরইবির সদস্য (পবিস) মোঃ মজিবুর রহমান সমকালকে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পেঁৗছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই বিতরণ লাইন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রত্যেক উপজেলায় বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ হবে।
আরইবির উর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, প্রথমে প্রত্যেক উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার করে নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরে সে সিদ্ধান্ত বাদ দেওয়া হয়। কারণ সাভার ও ধামরাইয়ের মতো অনেক উপজেলা আছে; যেখানে ১০০ কিলোমিটার করে নতুন লাইন প্রয়োজন নেই। সেসব উপজেলায় ৪০/৫০ কিলোমিটার লাইন বসালেই যথেষ্ট। আবার অনেক উপজেলা আছে যেখানে এখনও অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ পেঁৗছেনি। এ জাতীয় উপজেলার চাহিদা ৪/৫শ' কিলোমিটার থাকলেও সর্বোচ্চ ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লাইন টানা হতে পারে। নতুন লাইনের চাহিদা নিরূপণের ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত ভৌগোলিক এলাকার আয়তন ও জনসংখ্যার বিষয়টিকেই বিবেচনায় রাখা হয়েছে। তবে দ্রুত প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে গিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে কোনো তথ্য-উপাত্ত না নিয়েই এ সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ করা হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। যদিও নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক পবিসে দায়িত্বরত পরামর্শককে দিয়ে কোন কোন এলাকায় নতুন লাইন নির্মাণ করতে হবে এবং তাতে কত গ্রাহক উপকৃত হবে সে সম্পর্কে জরিপ চালানোর কথা। পবিস থেকে পাঠানো তাদের ওই জরিপ রিপোর্টের সঙ্গে আরইবির মহাপরিকল্পনা মিলিয়ে নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির কথা রয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, আরইবির কার্যক্রম না থাকায় তিন পার্বত্য জেলাকে বাদ রেখেই এই প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পে ব্যয়ের জন্য সরকারের কাছে গ্র্যাচুইটি হিসেবে সমুদয় অর্থ চাওয়া হয়েছে, যা সরকার চাওয়া মাত্র আরইবি ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। এ জন্য আরইবিকে কোনো সুদ দিতে হবে না।
মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মোঃ মাহবুবুর রহমান এমপি তার সংসদীয় আসনের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের নতুন লাইন নির্মাণের জন্য গত ৯ মে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বরাবর চিঠি দেন। এতে তিনি কয়েকটি এলাকায় বিতরণ লাইন নির্মাণের জন্য অনুরোধ জানান। এর মধ্যে রয়েছে কলাপাড়া উপজেলা সদরের বাদুরতলী ফিশারি থেকে ইটবাড়িয়া হয়ে বালিয়াতলী ফেরিঘাট। বালিয়াতলী স্টেশন থেকে বড় বাড়িয়াতলী, পণ্ডিতবাড়ি ও ইসলামিয়া মাদ্রাসা হয়ে বাবলাতলা বাজার কলেজ রোড হয়ে ধুলাশ্বর চাপলী বাজার। সেখান থেকে ইউনিয়ন পরিষদের ধোলাই বাজার হয়ে গঙ্গামতি সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত। ডিও লেটারে তিনি বলেছেন, ৫০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কৃষিভিত্তিক শিল্পাঞ্চল
হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার নির্বাচনী এলাকা সম্ভাবনাময় ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম ইদ্রিস আলী তার চিঠিতে বলেছেন, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নে বিএনপি আমলে ১-২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খাম্বা বসানো হলেও বিদ্যুৎ আসেনি। তিনি বাউশিয়া ইউনিয়নের গুদারাঘাট থেকে গুয়াগাছিয়া ইউনিয়ন পর্যন্ত নতুন লাইন চেয়েছেন।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের স্বল্পলাডুগ্রামে বিদ্যুতায়নের অনুরোধ জানিয়েছেন খন্দকার আবদুল বাতেন এমপি। বিদ্যুতের নতুন লাইন নির্মাণ অথবা সংযোগের জন্য স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, জামালপুর-৪ আসনের সাংসদ ডা. মোঃ মুরাদ হোসেন এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ নূরজাহান বেগমসহ প্রায় শতাধিক এমপি-জনপ্রতিনিধি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বরাবর অনুরোধ জানিয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন। নিয়মিত তদবির করছেন তারা। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে দেশের বাইরে থাকলেও ডিও লেটার জমা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সংযোগের বিষয়ে ডিও দিয়েছেন পার্বত্য বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এমপি। পার্বত্য এলাকায় আরইবির লাইন নেই। সেখানে পিডিবি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
বিদ্যুৎ বিভাগ শুরুতে প্রত্যেক সাংসদের এলাকায় ১০০ কিলোমিটার করে নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণের কথা বললেও বিতর্কের আশঙ্কায় পরে প্রত্যেক উপজেলায় বিতরণ লাইন নির্মাণের কথা বলা হয়। এ জন্য নেওয়া প্রকল্পের কৌশলী নামও দেওয়া হয়। প্রকল্পের নাম হচ্ছে '১৮ লাখ গ্রাহক সংযোগ প্রকল্প'। আরইবি থেকে এখন বলা হচ্ছে, প্রত্যেক উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ নয়; বরং চাহিদার বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখেই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি হয়েছে।
বিগত চারদলীয় জোট সরকার আমলেও একইভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যেক সাংসদের এলাকায় নতুন বিতরণ লাইন টানা হয়। সেবার প্রত্যেক সাংসদের এলাকায় ১০০ কিলোমিটার নতুন লাইন টানার উদ্যোগ নিয়েও পরে লাইন টানা হয় নূ্যনতম ৪০ কিলোমিটার করে। খুঁটি পোতা আর নতুন লাইন টানার দিকে তখন বেশি ঝোঁক ছিল সরকারের। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর ছিল না। এ কারণে পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ ঘাটতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। বিদ্যুৎ ছাড়াই খুঁটির পর খুঁটি পড়ে থাকে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল লাভবান হয়।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারাদেশে পল্লী এলাকায় বিদ্যুতের বিতরণ লাইন বাড়ানোর জন্য আরইবি ইতিপূর্বে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে। বিদ্যুৎ বিভাগ এ প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। বর্তমানে এটি একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায়। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ৪৫৩টি উপজেলায় ৪৫ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন টানা হবে।
অভিযোগ উঠেছে, সমিতিগুলোর মাঠ পর্যায় থেকে জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ না করে শুধু মন্ত্রী-এমপিদের চাহিদার ভিত্তিতে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণ করা হলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর (পবিস) লোকসানের বোঝা আরও বেড়ে যাবে। বর্তমানে ৭০টি সমিতির ৬৫টিই লোকসানে চলছে। সেগুলো সরকারের পাওনা শোধ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) ভাঙিয়েও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে (আরইবি) ওই অর্থ শোধ করতে হচ্ছে। এতে সংস্থাটি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ কিনতেও সরকারকে ব্যাপক পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। নতুন করে আরইবির লোকসানের পরিমাণ বাড়লে বিদ্যুৎ খাতে ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত প্রকল্পটিকে রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে মনে করছেন। তারা বলেছেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মতো মন্ত্রী-এমপিদের এলাকায় বিতরণ লাইন ভাগাভাগি করে দিতেই এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। প্রয়োজনীয় স্থানে বিদ্যুতের লাইন বসানো উচিত। নতুবা বিদ্যুৎ খাত আবারও গভীর সংকটে পড়বে।
বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক পরিকল্পনার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ সমকালকে বলেছেন, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটিও রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। এ পথ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোনো এলাকা বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে সেই এলাকার আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থা ও জনসংখ্যার বিষয়টিকেই বিবেচনায় রাখা হয়। নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক পবিসে দায়িত্বরত পরামর্শককে দিয়ে এলাকা বাছাই করে নতুন লাইন নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু এসব বিষয়কে বাদ রেখে শুধু মন্ত্রী-এমপিদের চাহিদার ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে সেটা বাস্তবসম্মত হবে না। এতে শুধু আরইবি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, গোটা বিদ্যুৎ খাতই বিপর্যয়ের কবলে পড়তে পারে।
তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় এই প্রকল্প নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরইবির চেয়ারম্যান ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে নতুন বিতরণ লাইন সম্প্রসারণের কাজ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ ঘাটতি বেশি থাকায় এতদিন নতুন লাইন নির্মাণের প্রয়োজন হয়নি। এখন বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ছে। নতুন লাইন নির্মাণও জরুরি হয়ে পড়েছে। চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, অনেক দিন ধরেই মন্ত্রী-এমপিদের আবেদন জমা পড়ছে। কিন্তু নতুন বিতরণ লাইন সম্প্রসারণের কাজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় তাদের আবেদনে সাড়া দেওয়া যায়নি। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে মন্ত্রী-এমপিদের চাহিদার ভিত্তিতে কোন এলাকায় কত কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মাণ করা হবে, সেটি চূড়ান্ত করা হবে। তিনি জানান, এখনও জনপ্রতিনিধিদের ডিও লেটার আসছে। পাশাপাশি অনেক এমপি সশরীরে এসে তদবির করছেন। আবার টেলিফোনেও কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নতুন লাইনের জন্য বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে অনুরোধ করছেন। মন্ত্রী-এমপিদের ডিও লেটারের ওপর বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে তার একান্ত সচিব মোঃ নূরুল আলম সুপারিশ করে তা আরইবির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
জানা যায়, একনেকের অনুমোদনের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে গত জুলাই মাসে নতুন বিতরণ লাইনের প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পবিসের মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য ও চাহিদাপত্র না নিয়েই উপজেলাওয়ারি কত লাইন বসবে সে হিসাব করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তাই প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার আগেই এমপিদের দেন-দরবার শুরু হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ডিও লেটার দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও কেউ একশ', কেউ ২০০, িকেউবা তার চেয়ে কম-বেশি কিলোমিটার নতুন বিদ্যুৎ লাইন চাচ্ছেন। কোন এমপি কত কিলোমিটার নতুন লাইন পাবেন তার প্রাথমিক হিসাব করা হলেও ঝামেলা এড়াতে বিদ্যুৎ বিভাগ ও আরইবি বিষয়টি গোপন রাখছে। কোন এমপির এলাকার জন্য কী পরিমাণ লাইন বরাদ্দ করা হবে তা আগে থেকে টের পেলে বিদ্যুৎ বিভাগ ও আরইবিকে আরও চাপের মুখে পড়তে হবে। সে জন্য এই সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
আরইবির লোকসান : সূত্র জানায়, সরকার আরইবির পবিসগুলোর মাঠ পর্যায়ের চাহিদার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরা যাতে তাদের নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে পারেন, সে বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এর ফলে বর্তমানে লোকসানি সমিতিগুলোর অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। এমনিতেই গত ফেব্রুয়ারি এবং আগস্টে দু'দফায় বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির ফলে অনেক সমিতি চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। সমিতিগুলো বেশি দামে পিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনলেও গ্রাহকের কাছে কম দামেই তা বিক্রি করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারেরও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বিশেষ করে দ্রুত বেসরকারি বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে সরকারের ভর্তুকির বোঝা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এ অবস্থার মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুতায়ন করা হলে পবিসগুলোর লোকসানের দায়ভার সরকারের কাঁধেই চাপবে।
পবিসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, সমিতির লাইনগুলো অনেক দীর্ঘ হয়। মন্ত্রী-এমপিদের তদবিরের কারণে অল্পসংখ্যক গ্রাহকের জন্যও দীর্ঘ লাইন টানতে হয়। যেখান থেকে বিনিয়োগ উসুল করা সম্ভব হয় না। এমন স্থানেও লাইন টানতে হয়, যেখানে কোনো শিল্প কলকারখানা থাকে না। এসব স্থানে লাইন টেনেই লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তাছাড়া পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা উল্লেখযোগ্য হারে সাবসিডি পায়। এ কারণেও অনেক সমিতিকে লোকসান গুনতে হয়। আরইবিতে লাভের চেয়ে বিদ্যুৎ সেবাটাই বড় করে দেখা হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন করে ৪৫ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন বাড়লে লোকসানের বোঝা আরও বাড়তে পারে বলে তারা মনে করেন। তবে দীর্ঘদিন নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ বন্ধ থাকায় কিছু এলাকায় বিদ্যুতায়ন প্রয়োজন রয়েছে বলে তারা জানান। এ জন্য মাঠ থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রকল্প প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে সেটা বাস্তবসম্মত হতো।
নতুন করে ৪৫ হাজার লাইন নির্মাণ করা হলে তাতে সমিতিগুলোর লোকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে এর সঙ্গে সরাসরি দ্বিমত পোষণ না করে আরইবির চেয়ারম্যান সমকালকে বলেন, বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বাড়ানো হলে তেমন একটা লোকসান থাকবে না। তাছাড়া নতুন উপকেন্দ্র স্থাপনসহ জরাজীর্ণ বিতরণ ব্যবস্থা বদলে ফেলা হলে সিস্টেম লস কমবে। তবে পাইকারি মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য না বাড়ালে সমিতিগুলোর লোকসান আরও বাড়বে বলে তিনি স্বীকার করেন।
১৮ লাখ গ্রাহক সংযোগ প্রকল্প :দেশের সব গ্রামে বিদ্যুৎ পেঁৗছে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) যাত্রা শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ২৩ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন রয়েছে সরকারি এ সংস্থাটির হাতে। এর মাধ্যমে দেশের ৮৭ হাজার ৩৭২টি গ্রামের মধ্যে ৪৮ হাজার ৭৫৪টি গ্রামে বিদ্যুৎ-সুবিধা পেঁৗছানো হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পেঁৗছে দিতে আরইবির আরও এক লাখ ৯৮ হাজার নতুন বিতরণ লাইন লাগবে। এর মধ্যে বর্তমানে চলমান ৫টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৮ হাজার ২০০ কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০১৪ সাল নাগাদ এই প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে নতুন করে আরও ৭ লাখ ২০ হাজার গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া যাবে। এসব প্রকল্প ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আরইবি তড়িঘড়ি করে আরও একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। '১৮ লাখ গ্রাহক সংযোগ প্রকল্পে'র প্রস্তাব বর্তমানে সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে আরইবির আওতাধীন এলাকা মফস্বল শহর ও গ্রামাঞ্চলে ১১ কেভি ক্ষমতার মোট ৪৫ হাজার কিলোমিটার নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া দুই হাজার কিলোমিটার নতুন ৩৩ কেভি লাইন তৈরি, ৫০০ কিলোমিটার পুরনো ৩৩ কেভি লাইন সংস্কার, ১০০ নতুন উপকেন্দ্র নির্মাণ এবং পাঁচটি পুরনো উপকেন্দ্র সংস্কার করা হবে। চার বছর মেয়াদি (জুলাই '১১ থেকে জুন ২০১৫) এই প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যাতে সরকার অর্থায়ন করবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে আরইবির সদস্য (পবিস) মোঃ মজিবুর রহমান সমকালকে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পেঁৗছে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই বিতরণ লাইন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রত্যেক উপজেলায় বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ হবে।
আরইবির উর্ধ্বতন আরেক কর্মকর্তা সমকালকে বলেছেন, প্রথমে প্রত্যেক উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার করে নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরে সে সিদ্ধান্ত বাদ দেওয়া হয়। কারণ সাভার ও ধামরাইয়ের মতো অনেক উপজেলা আছে; যেখানে ১০০ কিলোমিটার করে নতুন লাইন প্রয়োজন নেই। সেসব উপজেলায় ৪০/৫০ কিলোমিটার লাইন বসালেই যথেষ্ট। আবার অনেক উপজেলা আছে যেখানে এখনও অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ পেঁৗছেনি। এ জাতীয় উপজেলার চাহিদা ৪/৫শ' কিলোমিটার থাকলেও সর্বোচ্চ ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লাইন টানা হতে পারে। নতুন লাইনের চাহিদা নিরূপণের ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত ভৌগোলিক এলাকার আয়তন ও জনসংখ্যার বিষয়টিকেই বিবেচনায় রাখা হয়েছে। তবে দ্রুত প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে গিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে কোনো তথ্য-উপাত্ত না নিয়েই এ সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ করা হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। যদিও নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক পবিসে দায়িত্বরত পরামর্শককে দিয়ে কোন কোন এলাকায় নতুন লাইন নির্মাণ করতে হবে এবং তাতে কত গ্রাহক উপকৃত হবে সে সম্পর্কে জরিপ চালানোর কথা। পবিস থেকে পাঠানো তাদের ওই জরিপ রিপোর্টের সঙ্গে আরইবির মহাপরিকল্পনা মিলিয়ে নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির কথা রয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, আরইবির কার্যক্রম না থাকায় তিন পার্বত্য জেলাকে বাদ রেখেই এই প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পে ব্যয়ের জন্য সরকারের কাছে গ্র্যাচুইটি হিসেবে সমুদয় অর্থ চাওয়া হয়েছে, যা সরকার চাওয়া মাত্র আরইবি ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। এ জন্য আরইবিকে কোনো সুদ দিতে হবে না।
No comments