ফিরে দেখা তিন বছর by মাহবুবা নাসরীন
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। যেমন_ বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ বিভিন্ন নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা গ্রহণ ও সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করেছে, বাজেটেও তার প্রতিফলন ঘটছে। গঠন করা হয়েছে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও জেলাগুলোতেও নারী উন্নয়ন কার্যপদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও ভিশন ২০২১ তাদের সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের মাধ্যমে তারা পেয়েছিল জনগণের ম্যান্ডেট। পাশাপাশি ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার অঙ্গীকার জনগণের বিশাল অংশকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিন বছর পর পরিবহন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করে যে উপসংহারে আসা যায়, বর্তমান প্রবন্ধটি সেই বিষয়ের মধ্যে আবর্তিত।
দারিদ্র্য বিমোচন : মানব-উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেছে। সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা (২০০০-২০১৫) অর্জনে, বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা আনয়ন এবং সবার জন্য শিক্ষায় প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ অগ্রগতি সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত। নতুন শিক্ষানীতি সর্বজন সমাদৃত হয়েছে এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টা সর্বক্ষেত্রে আলোচিত বিষয়। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে শতকরা ৮০ ভাগ লক্ষ্যমাত্রায় পেঁৗছানো গেছে। নবজাত শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার মতো রোগব্যাধির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ, বনায়ন কার্যক্রমের প্রসার ইত্যাদি ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথেই রয়েছে। ২০১০ সালে শিশুমৃত্যুর হার কমানোর লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও ২০২০ সালের মধ্যে একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে সব উন্নয়ন পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। ২০১০-১১ অর্থবছরে বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বরাদ্দ হয়েছে শতকরা ৫৪ ভাগের ওপরে। বর্তমান সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) দারিদ্র্য বিমোচন, বিশেষত আঞ্চলিক দারিদ্র্য বিমোচনকে একটি প্রধান কৌশল হিসেবে ধরা হয়েছে। এর প্রধান দিকগুলো হচ্ছে_ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের বিভিন্নতার ভিত্তিতে দারিদ্র্য নিরসন, হতদরিদ্র অঞ্চলগুলোকে চিহ্নিত করা ইত্যাদি। পাশাপাশি উচ্চ জন্মহার রোধ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নকে উন্নয়ন কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে ধরা হয়েছে। এ অর্জনের জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের ভূমি অধিকারসহ অন্যান্য অসুবিধা দূর করে সমতা আনয়নের ক্ষেত্রগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। দরিদ্র জনসাধারণের অসমতার পেছনে অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালা যেমন_ নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১, জাতীয় শিশুনীতি-২০১০, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, জাতীয় কৃষিনীতি-২০১০, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জাতীয় নীতিমালা-২০১০ ইত্যাদি নারী, শিশু, হতদরিদ্র ও নাজুক জনগোষ্ঠীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভিশন-২০২১ অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা : খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচন_ এ দুটি বিষয়ের সঙ্গেই কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতি জড়িত, যা বিভিন্ন দুর্যোগ যেমন_ বন্যা, ঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও খরা দ্বারা প্রভাবিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে বলে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মতামত দিয়েছে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির নিয়ত লড়াই করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সারাবিশ্বের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশ চলমান ইউএনএফসিসিসির সব সমঝোতাবিষয়ক মিটিংয়ে কার্যকরীভাবে অংশগ্রহণ করে তার মতামত এবং দাবি জানিয়ে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশ উত্তরোত্তর পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সব কয়টি মন্ত্রণালয়ে 'জলবায়ু পরিবর্তন সেল' স্থাপিত করা হয়েছে। এই সেলের প্রধান উদ্দেশ্য হলো জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় কৌশল নির্ধারণ এবং অভিযোজনের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন।
২০০৮ সালে জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল ঘোষণা করা হয় এবং এর জন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা অভিযোজনের জন্য ২০০৮-০৯ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০০ কোটি টাকা। তা ছাড়া সরকার এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ট্রাস্ট ফান্ড নীতিমালার অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (ইধহমষধফবংয ঈষরসধঃব ঈযধহমব ঝঃৎধঃবমু ধহফ অপঃরড়হ চষধহ/ইঈঈঝঅচ) উন্মোচন করে। এই কর্মপরিকল্পনা বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত হয়েছে এবং যাকে বলা হয়েছে একটি 'জীবন্ত দলিল', যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন করা যাবে। এ পরিকল্পনায় আগামী ২০-২৫ বছরে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য দেশের সামর্থ্য ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১০ বছরব্যাপী পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলার জন্য সরাসরি কোনো জাতীয় নীতিমালা নেই। তথাপি বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরকার সোচ্চার এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তনকে সামনে রেখে তাদের নীতিমালাগুলো তৈরি করেছেন বা সংশোধন করছে। যেমন_ জাতীয় কৃষি নীতিমালা, কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা, জাতীয় পানিনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, শিল্পনীতি, খাদ্যনীতি, বননীতি, পরিবেশনীতি ইত্যাদি ২৩টি নীতিমালা পরিবর্তিত জলবায়ু এবং অভিযোজন ও নাজুকতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশ কৌশল (উরমরঃধষ ওঝউ রহ অপঃরড়হ/উইঝঅ, ২০০৯) নামে একটি কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে এগোতে একুশ শতকের বাংলাদেশ যাতে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে এ কৌশল। দুর্যোগ-পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতির সময় জনসাধারণ যাতে সঠিক তথ্য পায় ও পদক্ষেপ নিতে পারে তার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং এবং সুযোগ-সুবিধা পর্যবেক্ষণের ও নিশ্চিত করার জন্য উইঝঅ কাজ করছে। এ ছাড়াও দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আমরা পেয়েছি দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। প্রথমটি হচ্ছে দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি ও দ্বিতীয় দলিলটি হচ্ছে 'জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা (২০১০-২০১৫)', যা জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন তথা দুর্যোগ সংক্রান্ত ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচি কৌশল অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই পরিকল্পনায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিশেষত নারী শিশু ও 'প্রতিবন্ধী'দের বিশেষ চাহিদার কথা বিবেচনা করা হয়েছে। যা হোক, এসব উদ্যোগ ও নীতিমালার সার্থকতা নির্ভর করে লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, নৃগোষ্ঠী, শ্রেণী, বর্ণ, অঞ্চল নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ এবং তাদের ঘিরে যে জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি এসবের ওপর সমান গুরুত্ব দিয়ে তার বাস্তব প্রয়োগে সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর।
নারী উন্নয়ন : নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। যেমন_ বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ বিভিন্ন নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা গ্রহণ ও সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করেছে, বাজেটেও তার প্রতিফলন ঘটছে। গঠন করা হয়েছে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও জেলাগুলোতেও নারী উন্নয়ন কার্যপদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ একটি নারী উন্নয়ন নীতিমালা পেয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের বলা হয় দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দারিদ্র্যের বিভিন্ন মাত্রা নির্ধারণের ভিত্তিতে নারী-পুরুষ সমতা, শিক্ষা ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশও সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে বৈষম্যের অনুপাত ইতিমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা ০৮-এর বিপরীতে ০৯-এ নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত পরিকল্পনায় জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে বাজেটে পূর্ববর্তী বাজেটের তুলনায় জেন্ডার সংবেদনশীল করার জন্য জেন্ডার বাজেটিং ৪টি মন্ত্রণালয় থেকে বাড়িয়ে ১০টি মন্ত্রণালয়ে করা হয়েছে; এগুলো হলো_ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, পরিবেশ ও বন, মৎস্য ও পশুসম্পদ, ভূমি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়গুলো বেশ কয়েকটি নারী স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া ২০১০ সালের নারী উন্নয়ন নীতিমালায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় 'নারী ও দুর্যোগ' প্রসঙ্গটির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছরে শতকরা ০৮ ভাগ বাড়াতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন হবে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার ভিত্তিতে নীতিমালাগুলোর সঠিক প্রয়োগ। পাশাপাশি উন্নয়নের অংশীদার এবং জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে পড়বে। স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল অবলম্বন করার ওপরও নির্ভর করছে ভিশন ২০২১-এর লক্ষ্য অর্জন। সর্বোপরি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দূরত্ব ঘোচাতে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তার বোধগম্যতার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে শান্তির মডেল উপস্থাপন করে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন। এ মডেল তার নিজ দেশেও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এটি তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
মাহবুবা নাসরীন : অধ্যাপক ও সমন্বয়ক, সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা : খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচন_ এ দুটি বিষয়ের সঙ্গেই কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতি জড়িত, যা বিভিন্ন দুর্যোগ যেমন_ বন্যা, ঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও খরা দ্বারা প্রভাবিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে বলে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মতামত দিয়েছে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ ও অন্যান্য প্রজাতির নিয়ত লড়াই করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সারাবিশ্বের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশ চলমান ইউএনএফসিসিসির সব সমঝোতাবিষয়ক মিটিংয়ে কার্যকরীভাবে অংশগ্রহণ করে তার মতামত এবং দাবি জানিয়ে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশ উত্তরোত্তর পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সব কয়টি মন্ত্রণালয়ে 'জলবায়ু পরিবর্তন সেল' স্থাপিত করা হয়েছে। এই সেলের প্রধান উদ্দেশ্য হলো জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় কৌশল নির্ধারণ এবং অভিযোজনের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন।
২০০৮ সালে জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল ঘোষণা করা হয় এবং এর জন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা অভিযোজনের জন্য ২০০৮-০৯ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭০০ কোটি টাকা। তা ছাড়া সরকার এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ট্রাস্ট ফান্ড নীতিমালার অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (ইধহমষধফবংয ঈষরসধঃব ঈযধহমব ঝঃৎধঃবমু ধহফ অপঃরড়হ চষধহ/ইঈঈঝঅচ) উন্মোচন করে। এই কর্মপরিকল্পনা বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত হয়েছে এবং যাকে বলা হয়েছে একটি 'জীবন্ত দলিল', যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন করা যাবে। এ পরিকল্পনায় আগামী ২০-২৫ বছরে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য দেশের সামর্থ্য ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১০ বছরব্যাপী পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলার জন্য সরাসরি কোনো জাতীয় নীতিমালা নেই। তথাপি বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরকার সোচ্চার এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জলবায়ু পরিবর্তনকে সামনে রেখে তাদের নীতিমালাগুলো তৈরি করেছেন বা সংশোধন করছে। যেমন_ জাতীয় কৃষি নীতিমালা, কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা, জাতীয় পানিনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, শিল্পনীতি, খাদ্যনীতি, বননীতি, পরিবেশনীতি ইত্যাদি ২৩টি নীতিমালা পরিবর্তিত জলবায়ু এবং অভিযোজন ও নাজুকতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশ কৌশল (উরমরঃধষ ওঝউ রহ অপঃরড়হ/উইঝঅ, ২০০৯) নামে একটি কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে এগোতে একুশ শতকের বাংলাদেশ যাতে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে এ কৌশল। দুর্যোগ-পূর্ব, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতির সময় জনসাধারণ যাতে সঠিক তথ্য পায় ও পদক্ষেপ নিতে পারে তার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং এবং সুযোগ-সুবিধা পর্যবেক্ষণের ও নিশ্চিত করার জন্য উইঝঅ কাজ করছে। এ ছাড়াও দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আমরা পেয়েছি দুটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। প্রথমটি হচ্ছে দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি ও দ্বিতীয় দলিলটি হচ্ছে 'জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা (২০১০-২০১৫)', যা জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন তথা দুর্যোগ সংক্রান্ত ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচি কৌশল অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই পরিকল্পনায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিশেষত নারী শিশু ও 'প্রতিবন্ধী'দের বিশেষ চাহিদার কথা বিবেচনা করা হয়েছে। যা হোক, এসব উদ্যোগ ও নীতিমালার সার্থকতা নির্ভর করে লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, নৃগোষ্ঠী, শ্রেণী, বর্ণ, অঞ্চল নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ এবং তাদের ঘিরে যে জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি এসবের ওপর সমান গুরুত্ব দিয়ে তার বাস্তব প্রয়োগে সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর।
নারী উন্নয়ন : নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। যেমন_ বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ বিভিন্ন নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনা গ্রহণ ও সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করেছে, বাজেটেও তার প্রতিফলন ঘটছে। গঠন করা হয়েছে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও জেলাগুলোতেও নারী উন্নয়ন কার্যপদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ একটি নারী উন্নয়ন নীতিমালা পেয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের বলা হয় দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দারিদ্র্যের বিভিন্ন মাত্রা নির্ধারণের ভিত্তিতে নারী-পুরুষ সমতা, শিক্ষা ও টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশও সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে বৈষম্যের অনুপাত ইতিমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা ০৮-এর বিপরীতে ০৯-এ নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ২০০৯ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত পরিকল্পনায় জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে বাজেটে পূর্ববর্তী বাজেটের তুলনায় জেন্ডার সংবেদনশীল করার জন্য জেন্ডার বাজেটিং ৪টি মন্ত্রণালয় থেকে বাড়িয়ে ১০টি মন্ত্রণালয়ে করা হয়েছে; এগুলো হলো_ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, পরিবেশ ও বন, মৎস্য ও পশুসম্পদ, ভূমি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়গুলো বেশ কয়েকটি নারী স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া ২০১০ সালের নারী উন্নয়ন নীতিমালায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় 'নারী ও দুর্যোগ' প্রসঙ্গটির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে প্রবৃদ্ধির হার প্রতিবছরে শতকরা ০৮ ভাগ বাড়াতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন হবে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার ভিত্তিতে নীতিমালাগুলোর সঠিক প্রয়োগ। পাশাপাশি উন্নয়নের অংশীদার এবং জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি হয়ে পড়বে। স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল অবলম্বন করার ওপরও নির্ভর করছে ভিশন ২০২১-এর লক্ষ্য অর্জন। সর্বোপরি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দূরত্ব ঘোচাতে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তার বোধগম্যতার ক্ষেত্রে আন্তরিকতা প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে শান্তির মডেল উপস্থাপন করে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন। এ মডেল তার নিজ দেশেও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এটি তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
মাহবুবা নাসরীন : অধ্যাপক ও সমন্বয়ক, সেন্টার ফর ডিজাস্টার অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments