তত্ত্বাবধায়কঃ সাবেক রায় বহাল হোক by আতাউস সামাদ
আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের উচিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার ব্যবস্থা ফেরত আনা। তাহলেও দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ কমবে। আর শাসক দলের আরও উচিত হবে, দেশের জনসাধারণের শান্তির স্বার্থে লুটপাট, দুর্নীতি ও অন্যায় কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকা আমাদের দেশে নতুন করে প্রাকৃতিক গ্যাসের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। গত সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে এই সুখবর জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর। দেশের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড বা সংক্ষেপে বাপেক্স ত্রিমাসিক জরিপ চালিয়ে যে তথ্য পেয়েছে তার ভিত্তিতে রশিদপুর, হরিপুর ও কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস পাওয়া যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
রশিদপুর থেকে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া প্রায় নিশ্চিত। এ ছাড়া নতুন গ্যাসক্ষেত্রে জরিপ করে বেশ ভালো পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার কথা আমরা শুনছি কিছুদিন ধরে। যত তাড়াতাড়ি গ্যাস তোলা শুরু করা যাবে ততই মঙ্গল। প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ বাড়লে এবং প্রস্তাবিত তিনটি কম্প্রেসার স্টেশন বসিয়ে বিদ্যমান গ্যাস সরবরাহ লাইনে চাপ বাড়ালে বিদ্যুৎ ও ইউরিয়া সার উৎপাদন করার পথে বড় দুটি সমস্যার অনেকখানি সুরাহা হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়মিতভাবে পাওয়া গেলে আমাদের সরকারি মালিকানার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন বাড়ানো যাবে। কমানো যাবে বেসরকারি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা। এই ভাড়ায় আনা বেসরকারি জেনারেটরগুলো থেকে খুব উঁচু দামে বিদ্যুৎ কিনছে সরকার। এ জন্য করদাতাদের পয়সা থেকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কোনো কোনো অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, ভাড়ায় আনা উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে তা জনগণের সাধ্যের মধ্যে বিক্রি করতে গিয়ে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে তা বাংলাদেশের বাজেটে ভারসাম্যহীনতা ধ্বংস করার একটি অন্যতম কারণ। এই সমস্যা থেকে কিছুটা বের হয়ে আসতে পারলেও বাঁচোয়া। অন্যদিকে যে পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যাচ্ছিল তার সবটাই ইলেকট্রিসিটি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হওয়ায় বছরের অনেকখানি সময় ইউরিয়া সার তৈরির সরকারি কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হলে সার উৎপাদনও চলবে নির্বিঘ্নে।
প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সকে অর্থ বরাদ্দ করা এবং জরুরি এই কাজটি করতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন। ২০০১-০৬ সাল মেয়াদে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী সরকার গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগী ছিল না। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য 'রিগ' কেনার টাকা বরাদ্দ করতে বাধা দেন বলে শুনেছি। তার অনীহা দূর করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দৃঢ় ভূমিকা নিতে সাহস করেননি সম্ভবত এই ভয়ে যে, তাহলে তাকে দুর্নীতির আরেকটা অভিযোগের মধ্যে পড়তে হতো। কিন্তু তবু কি তিনি গ্যাস আহরণ সংক্রান্ত 'নাইকো' মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন (নাইকো সংক্রান্ত অপর এক মামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অভিযুক্ত হয়েছিলেন)। তবে একই সঙ্গে লক্ষণীয়, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে যে সেনা আরোপিত সরকার বাংলাদেশ শাসন করল তারাও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে আরও গ্যাস খোঁজা বা সেখান থেকে উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করেনি। দুর্মুখেরা বলেন, কোনো এক দুষ্টচক্র রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের (অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া করার) ব্যবসার সব পথ খোলা রাখার জন্যই নাকি বাংলাদেশের নিজস্ব জ্বালানি সংগ্রহের উদ্যোগ ব্যর্থ করার জন্য তৎপর ছিল। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, বর্তমান সরকারও ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবসায়ীদের যত দূর সম্ভব পৃষ্ঠপোষকতা করা যায় সে ব্যবস্থা করে (যার মধ্যে একটি হচ্ছে এসবের জন্য বিদেশ থেকে তরল জ্বালানি আমদানি) দিয়ে অতঃপর দেশের গ্যাস খোঁজায় হাত দিয়েছে। তবে আগে হোক বা এখন হোক, আমরা চাই দেশে জ্বালানি অনুসন্ধান ও তা ব্যবহার করার ব্যবস্থা যেন অবশ্যই হয়। এ বিষয়ে কাজের বেলায় যেন জাতীয় ঐকমত্য থাকে।
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই সুযোগ পান তখনই বলছেন যে, তার সরকার প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। আমরা জানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়ার বেলায় রাজধানী ঢাকা শহরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বর্ষাকালে ধান চাষের পানি সেচ দেওয়ার জন্য শীত ও গ্রীষ্মের মতো বিদ্যুৎ লাগে না। তাও জানেন সবাই। তবু এবার বর্ষাকালে অবিরল বৃষ্টির সময়ও খোদ ঢাকাতে লোডশেডিং চলল কেন এবং বর্ষার শেষ প্রান্তে এখনও তা হচ্ছে কেন? মফস্বল শহরগুলো ও পল্লী অঞ্চল তো যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়েছে। শেখ হাসিনা ও তার সরকারের দাবির সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি মিলছে না প্রায়ই। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বড় কিন্তু তুলনামূলকভাবে পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখার ক্ষেত্রে হয় সরকারি উদ্যোগ তেমন একটা নেই, না হলে এক্ষেত্রে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর যেগুলো চালু হয়েছে (বেশ কয়েকটি চুক্তির সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও চালু হয়নি আর তার চেয়েও বেশিসংখ্যক কেন্দ্রে চুক্তির চেয়ে অনেক কম উৎপাদন হচ্ছে) তা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হলেও পুরনোগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকছে। ফলে যোগ-বিয়োগের পর থাকছে লোডশেডিং। দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও এ জন্য সরকারি কোষাগার থেকে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের পকেটে কত টাকা যাচ্ছে তার বিস্তারিত হিসাব এতদিনে প্রকাশ করা উচিত এই সরকারের। কারণ, এই খাত নিয়েই তো উন্নতির দাবি করা হচ্ছে বেশি বেশি এবং জোরে জোরে। তো আমরা দেশবাসী ভালো-মন্দ দুটিই জানতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তার ভাষণে একটা 'চমক' দিয়েছেন। ওই বক্তৃতায় তিনি বিশ্ব শান্তির জন্য একটি 'মডেল' উন্মোচন করেছেন। তিনি ওই ভাষণে বলেছেন, অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি শান্তির জন্য নির্ভীকভাবে যুদ্ধ করছেন। তিনি বিশ্বজুড়ে তো শান্তির জন্য যে ফর্মুলা বা মডেল প্রস্তাব করেছেন, তাতে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী ছয়টি পরস্পর সম্পৃক্ত ক্রিয়াশীল উপাদান রয়েছে। সেগুলো হলো_ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্য দূর করা, বঞ্চনা লাঘব, সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সামনের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং সন্ত্রাস নির্মূল (সূত্র, সমকাল, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১)। টেকসই শান্তি অর্জনের জন্য এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। মানব সভ্যতা অধিকতর অগ্রসর হওয়ার জন্য এবং সবাই খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য এই লক্ষ্যগুলো যে অর্জন করা দরকার তেমন বক্তব্যে অতীতেও রাষ্ট্রনায়করা ও চিন্তাবিদরা বলেছেন। তবে শেখ হাসিনার বক্তব্যে তাদের চেয়ে নতুন উপাদান হলো 'সন্ত্রাস নির্মূল'। এই মুহূর্তে এটা একটা জটিল বিষয়ও বটে। কারণ, একজনের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই অন্য আরেকজনের কাছে 'সন্ত্রাস'। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা জগতের অন্যান্য দেশ এবং ইহুদিবাদী, ইসরায়েলের কাছে 'সন্ত্রাস' হলো 'ইসলামী জঙ্গিবাদ'। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনা তার 'শান্তি মডেল' এ সন্ত্রাসের কী সংজ্ঞা দেবেন অনেকেই তা জানতে চাইবেন। তবে আমি একটু আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় শেখ হাসিনার শান্তি মডেলে যে ছয়টি ক্রিয়াশীল উপাদান বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশ একে অপরের সার্বভৌমত্ব, শ্রদ্ধা ও সংরক্ষণ করবে এই অতীব জরুরি কথাটি নেই দেখে। বিশ্বে যত অশান্তি আছে তার মধ্যে অনেক দেশে এর কারণ হলো, গৃহযুদ্ধ এবং স্বৈরশাসকদের নিপীড়ন আবার কোনো কোনো দেশে মাদক ব্যবসায়ীদের অত্যাচার ও সহিংসতা, একথা ঠিক। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ও ব্যাপক অশান্তি সৃষ্টি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অন্য স্বাধীন দেশ আক্রমণ করে, দখল করে বা অঘোষিত আগ্রাসন চালিয়ে। এর উদাহরণ, ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। ইরাকে মার্কিনিরা একটি প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস করেছে, লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, গোষ্ঠীগত সন্ত্রাস লাগিয়ে দিয়েছে এবং ওই দেশের খনিজ তেল সম্পদ লুট করেছে ও করছে। এক ওসামা বিন লাদেনকে ধরার বা হত্যা করার অভিযানের নামে তারা আফগানিস্তান দখল করে রেখেছে। ইরানকে তারা হুমকি দিয়েই চলেছে। পাকিস্তানে মার্কিনিদের উপস্থিতি অবশ্যই সেই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব করেছে। মধ্যপ্রাচ্য তো বস্তুত মার্কিনি অঙ্গুলি হেলনেই চলে। বাংলাদেশে ও আমাদের আশপাশের দেশগুলো সারাক্ষণই আছে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের নানা রকম হস্তক্ষেপের যন্ত্রণায়। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও কোনো না কোনো শক্তির দাদাগিরির হুমকি ক্রিয়াশীল রয়েছে। তাই যে কোনো 'শান্তি মডেল' দিলেন তাতে তো সব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ করা এবং তা সবরকম হুমকি থেকে মুক্ত রাখা অতি স্বাভাবিকভাবে হতে হবে এক নম্বর উপাদান। কী জানি হয়তো শেখ হাসিনা তার ভাষণের অন্যত্র সার্বভৌমত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে থাকতে পারেন বলে ওই ছয় উপাদানের মধ্যে তা পুনরুচ্চারণ করেননি। তবে আমাদের কাছে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন না করাই হলো বিশ্ব শান্তির প্রথম গ্যারান্টি এবং সে কথাটা সবখানে খুব স্পষ্ট করে বলে রাখা দরকার।
তবে ভাগ্যের পরিহাস হলো, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তি মডেল উন্মোচনের খবর এ দেশের পত্রিকাগুলোতে যেদিন (২৫.৯.১১) প্রধান সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হলো, সেদিনই সেই খবরের কাগজগুলোতেই পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশে অনেক অশান্তি, সমস্যা ও দুর্নীতির খবর। যেমন_ সমকাল পত্রিকায় শেখ হাসিনার জাতিসংঘে ওই ভাষণের পাশাপাশি যে খবর ছাপা হয় তার শিরোনাম ছিল 'মরে যাচ্ছে নদী'। এ খবরে সাবধান করা হয়েছে প্রকৃতির পরিবর্তন ও মানুষের যথেচ্ছাচারের ফলে বাংলাদেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে এবং দেশ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় সেদিন প্রধান খবরই ছিল 'দুইশ' কোটি টাকায় আমদানি করা তিনটি ড্রেজারই অকেজো, কেনা দামের চেয়ে মেরামতে খরচ পড়বে বেশি'। ওই পত্রিকায় এ খবরটির নিচের সংবাদটির শিরোনাম_ 'নাটোরে বিএনপি নেতাকে জবাই করে হত্যা'। প্রথম আলো পত্রিকায় সেদিন প্রধান খবর ছিল, 'সরকারি সিদ্ধান্তের আগেই চিনির দাম বাড়াল ব্যবসায়ীরা'। কালের কণ্ঠ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম, 'তিতাসের সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা 'নাই'। প্রধানমন্ত্রীর নিজের দেশে যখন এই অবস্থা তখন তার বিশ্ব শান্তি মডেল অন্য দেশের মানুষ খুব জরুরিভাবে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরঞ্চ তার নিজের দেশে অশান্তির কারণগুলো দূর করতে সচেষ্ট হলে সাধুবাদ পাবেন। তাছাড়া আগে তো নিজের দেশ, তাই নয় কি!
মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকার দেশে একটার পর একটা নৃশংস ও বর্বরোচিত আচরণের নজির স্থাপন করে চলেছে। পুলিশ হেফাজতে সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এম ইউ আহমেদের মৃত্যু, বস্তুতপক্ষে অসুস্থতা সত্ত্বেও তাকে মাঝরাতে গ্রেফতার করে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া, থানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ওপর বিনাদোষে অকথ্য নির্যাতন ও বিক্ষোভকারীকে মাটিতে ফেলে পুলিশ তার বুকে বুট চেপে ধরা। পুলিশি অবহেলায় শবেবরাতের ভোররাতে ঢাকার শহরতলিতে গণপিটুনিতে ছয় ছাত্রের মৃত্যু এসব যেন যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে যোগ হলো জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং ওই দলের প্রচার সম্পাদক, সোনার বাংলা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের পরিচালক তাসনীম আলমকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা। জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ও সমর্থকদের সঙ্গে ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারপর তাদের হাতে হাতকড়া লাগানো হয়। আর গত পরশু মঙ্গলবার তাদের খুন বা ডাকাতির দুর্ধর্ষ আসামি, যাদের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের মতো করে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালত ও জনগণের সামনে হাজির করল আওয়ামী লীগ সরকার। জামায়াতে ইসলামীকে আমি সমর্থন করি না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশ, আমার বন্ধু, সহকর্মী, শিক্ষক ও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাদের ভয়াবহ আচরণের কথা আমি বা আমার পরিবারের সদস্যরা ভুলি না কখনও। কিন্তু তারপরও যা বাস্তব তা হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে একটি আইনত স্বীকৃত রাজনৈতিক দল। এমনকি আওয়ামী লীগ ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। ১৯৯৬-এর জুনে নির্বাচিত জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে জামায়াতে ইসলামীকে তিনটি আসন দিয়েছিল। সেই দলের দুই নেতাকে আদালতের অনুমতি না নিয়ে, প্রকাশে কোনো ব্যাখ্যা বা কারণ না জানিয়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জনসমক্ষে হাজির করা হলো। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমাদের যত মতবিরোধই থাকুক না কেন আমরা তাদের দুই নেতার সঙ্গে সরকারের মধ্যযুগীয় বর্বর আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ না জানিয়ে পারছি না। একই সঙ্গে আমরা বর্তমান সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি যে, এই ধরনের রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অসভ্য আচরণ দেশে নীচ চরিত্রের মানুষদের আরও বর্বর আচরণ করতে উৎসাহিত করবে এবং বহুদিন পর্যন্ত অশান্তি সৃষ্টি করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তি মডেল তখন আপনা থেকেই অকার্যকর হয়ে যাবে।
গত পরশু (মঙ্গলবার) বিএনপি ও তাদের মিত্ররা ঢাকার নয়াপল্টনে যে জনসমাবেশ করে তা ওই স্থানে অনুষ্ঠিত এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জনসভা। মেঘ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষ জমায়েত হয়েছিল ওই বিশাল জনসভায়। বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি সমর্থকদের ক্ষমতাসীন দলের লোকদের বাধা অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ডাকা দেশজুড়ে হরতাল পালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পুলিশ সেদিন পিকেটারদের রাস্তায় নামতে দেয়নি। বরঞ্চ হরতালের বিপক্ষে পুলিশ পাহারায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছে। কিন্তু দোকানপাট ও স্কুল-কলেজ খোলেনি। চলেনি দূরপাল্লার বাস বা ব্যক্তিগত মোটরযান। দেশ স্থবির ছিল। ওই হরতাল আর গত পরশুর বিশাল সমাবেশ দেখার পরও যদি আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোট মিত্রদের দেশের পরিস্থিতি এবং জনগণের মনোভাব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে তা হবে দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বিএনপি গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথে এ কথা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে যে, দেশের বহু মানুষ সরকারের ক্রিয়াকলাপ সমর্থন করছে না। গত পরশুর সমাবেশে খালেদা জিয়া বেশ পরিষ্কারভাবেই জনগণের কষ্টের কথা ও বিরোধী দলের দাবি তুলে ধরেছেন। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের উচিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার ব্যবস্থা ফেরত আনা। তাহলেও দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ কমবে। আর শাসক দলের আরও উচিত হবে, দেশের জনসাধারণের শান্তির স্বার্থে লুটপাট, দুর্নীতি ও অন্যায় কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকা। তবে দেশটা একেবারে ধ্বংস করতে চাইলে জনগণ তা মানবে কেন?
খালেদা জিয়া অক্টোবর মাসের জন্য বিরোধী দলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তাতে হরতাল নেই। আছে মিছিল, লংমার্চ ও জনসমাবেশ। আশা করি, সরকার এতে কোনো বাধা দেবে না।
আতাউস সামাদ : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সকে অর্থ বরাদ্দ করা এবং জরুরি এই কাজটি করতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন। ২০০১-০৬ সাল মেয়াদে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী সরকার গ্যাস অনুসন্ধানে মনোযোগী ছিল না। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য 'রিগ' কেনার টাকা বরাদ্দ করতে বাধা দেন বলে শুনেছি। তার অনীহা দূর করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দৃঢ় ভূমিকা নিতে সাহস করেননি সম্ভবত এই ভয়ে যে, তাহলে তাকে দুর্নীতির আরেকটা অভিযোগের মধ্যে পড়তে হতো। কিন্তু তবু কি তিনি গ্যাস আহরণ সংক্রান্ত 'নাইকো' মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন (নাইকো সংক্রান্ত অপর এক মামলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অভিযুক্ত হয়েছিলেন)। তবে একই সঙ্গে লক্ষণীয়, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে যে সেনা আরোপিত সরকার বাংলাদেশ শাসন করল তারাও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে আরও গ্যাস খোঁজা বা সেখান থেকে উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করেনি। দুর্মুখেরা বলেন, কোনো এক দুষ্টচক্র রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের (অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া করার) ব্যবসার সব পথ খোলা রাখার জন্যই নাকি বাংলাদেশের নিজস্ব জ্বালানি সংগ্রহের উদ্যোগ ব্যর্থ করার জন্য তৎপর ছিল। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, বর্তমান সরকারও ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবসায়ীদের যত দূর সম্ভব পৃষ্ঠপোষকতা করা যায় সে ব্যবস্থা করে (যার মধ্যে একটি হচ্ছে এসবের জন্য বিদেশ থেকে তরল জ্বালানি আমদানি) দিয়ে অতঃপর দেশের গ্যাস খোঁজায় হাত দিয়েছে। তবে আগে হোক বা এখন হোক, আমরা চাই দেশে জ্বালানি অনুসন্ধান ও তা ব্যবহার করার ব্যবস্থা যেন অবশ্যই হয়। এ বিষয়ে কাজের বেলায় যেন জাতীয় ঐকমত্য থাকে।
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই সুযোগ পান তখনই বলছেন যে, তার সরকার প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। আমরা জানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়ার বেলায় রাজধানী ঢাকা শহরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বর্ষাকালে ধান চাষের পানি সেচ দেওয়ার জন্য শীত ও গ্রীষ্মের মতো বিদ্যুৎ লাগে না। তাও জানেন সবাই। তবু এবার বর্ষাকালে অবিরল বৃষ্টির সময়ও খোদ ঢাকাতে লোডশেডিং চলল কেন এবং বর্ষার শেষ প্রান্তে এখনও তা হচ্ছে কেন? মফস্বল শহরগুলো ও পল্লী অঞ্চল তো যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়েছে। শেখ হাসিনা ও তার সরকারের দাবির সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতি মিলছে না প্রায়ই। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বড় কিন্তু তুলনামূলকভাবে পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখার ক্ষেত্রে হয় সরকারি উদ্যোগ তেমন একটা নেই, না হলে এক্ষেত্রে তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর যেগুলো চালু হয়েছে (বেশ কয়েকটি চুক্তির সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও চালু হয়নি আর তার চেয়েও বেশিসংখ্যক কেন্দ্রে চুক্তির চেয়ে অনেক কম উৎপাদন হচ্ছে) তা থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হলেও পুরনোগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকছে। ফলে যোগ-বিয়োগের পর থাকছে লোডশেডিং। দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও এ জন্য সরকারি কোষাগার থেকে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের পকেটে কত টাকা যাচ্ছে তার বিস্তারিত হিসাব এতদিনে প্রকাশ করা উচিত এই সরকারের। কারণ, এই খাত নিয়েই তো উন্নতির দাবি করা হচ্ছে বেশি বেশি এবং জোরে জোরে। তো আমরা দেশবাসী ভালো-মন্দ দুটিই জানতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তার ভাষণে একটা 'চমক' দিয়েছেন। ওই বক্তৃতায় তিনি বিশ্ব শান্তির জন্য একটি 'মডেল' উন্মোচন করেছেন। তিনি ওই ভাষণে বলেছেন, অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি শান্তির জন্য নির্ভীকভাবে যুদ্ধ করছেন। তিনি বিশ্বজুড়ে তো শান্তির জন্য যে ফর্মুলা বা মডেল প্রস্তাব করেছেন, তাতে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী ছয়টি পরস্পর সম্পৃক্ত ক্রিয়াশীল উপাদান রয়েছে। সেগুলো হলো_ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্য দূর করা, বঞ্চনা লাঘব, সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সামনের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং সন্ত্রাস নির্মূল (সূত্র, সমকাল, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১)। টেকসই শান্তি অর্জনের জন্য এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। মানব সভ্যতা অধিকতর অগ্রসর হওয়ার জন্য এবং সবাই খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য এই লক্ষ্যগুলো যে অর্জন করা দরকার তেমন বক্তব্যে অতীতেও রাষ্ট্রনায়করা ও চিন্তাবিদরা বলেছেন। তবে শেখ হাসিনার বক্তব্যে তাদের চেয়ে নতুন উপাদান হলো 'সন্ত্রাস নির্মূল'। এই মুহূর্তে এটা একটা জটিল বিষয়ও বটে। কারণ, একজনের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই অন্য আরেকজনের কাছে 'সন্ত্রাস'। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা জগতের অন্যান্য দেশ এবং ইহুদিবাদী, ইসরায়েলের কাছে 'সন্ত্রাস' হলো 'ইসলামী জঙ্গিবাদ'। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনা তার 'শান্তি মডেল' এ সন্ত্রাসের কী সংজ্ঞা দেবেন অনেকেই তা জানতে চাইবেন। তবে আমি একটু আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় শেখ হাসিনার শান্তি মডেলে যে ছয়টি ক্রিয়াশীল উপাদান বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশ একে অপরের সার্বভৌমত্ব, শ্রদ্ধা ও সংরক্ষণ করবে এই অতীব জরুরি কথাটি নেই দেখে। বিশ্বে যত অশান্তি আছে তার মধ্যে অনেক দেশে এর কারণ হলো, গৃহযুদ্ধ এবং স্বৈরশাসকদের নিপীড়ন আবার কোনো কোনো দেশে মাদক ব্যবসায়ীদের অত্যাচার ও সহিংসতা, একথা ঠিক। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ও ব্যাপক অশান্তি সৃষ্টি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অন্য স্বাধীন দেশ আক্রমণ করে, দখল করে বা অঘোষিত আগ্রাসন চালিয়ে। এর উদাহরণ, ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। ইরাকে মার্কিনিরা একটি প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংস করেছে, লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, গোষ্ঠীগত সন্ত্রাস লাগিয়ে দিয়েছে এবং ওই দেশের খনিজ তেল সম্পদ লুট করেছে ও করছে। এক ওসামা বিন লাদেনকে ধরার বা হত্যা করার অভিযানের নামে তারা আফগানিস্তান দখল করে রেখেছে। ইরানকে তারা হুমকি দিয়েই চলেছে। পাকিস্তানে মার্কিনিদের উপস্থিতি অবশ্যই সেই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব করেছে। মধ্যপ্রাচ্য তো বস্তুত মার্কিনি অঙ্গুলি হেলনেই চলে। বাংলাদেশে ও আমাদের আশপাশের দেশগুলো সারাক্ষণই আছে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের নানা রকম হস্তক্ষেপের যন্ত্রণায়। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও কোনো না কোনো শক্তির দাদাগিরির হুমকি ক্রিয়াশীল রয়েছে। তাই যে কোনো 'শান্তি মডেল' দিলেন তাতে তো সব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরঙ্কুশ করা এবং তা সবরকম হুমকি থেকে মুক্ত রাখা অতি স্বাভাবিকভাবে হতে হবে এক নম্বর উপাদান। কী জানি হয়তো শেখ হাসিনা তার ভাষণের অন্যত্র সার্বভৌমত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে থাকতে পারেন বলে ওই ছয় উপাদানের মধ্যে তা পুনরুচ্চারণ করেননি। তবে আমাদের কাছে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন না করাই হলো বিশ্ব শান্তির প্রথম গ্যারান্টি এবং সে কথাটা সবখানে খুব স্পষ্ট করে বলে রাখা দরকার।
তবে ভাগ্যের পরিহাস হলো, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তি মডেল উন্মোচনের খবর এ দেশের পত্রিকাগুলোতে যেদিন (২৫.৯.১১) প্রধান সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হলো, সেদিনই সেই খবরের কাগজগুলোতেই পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশে অনেক অশান্তি, সমস্যা ও দুর্নীতির খবর। যেমন_ সমকাল পত্রিকায় শেখ হাসিনার জাতিসংঘে ওই ভাষণের পাশাপাশি যে খবর ছাপা হয় তার শিরোনাম ছিল 'মরে যাচ্ছে নদী'। এ খবরে সাবধান করা হয়েছে প্রকৃতির পরিবর্তন ও মানুষের যথেচ্ছাচারের ফলে বাংলাদেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে এবং দেশ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় সেদিন প্রধান খবরই ছিল 'দুইশ' কোটি টাকায় আমদানি করা তিনটি ড্রেজারই অকেজো, কেনা দামের চেয়ে মেরামতে খরচ পড়বে বেশি'। ওই পত্রিকায় এ খবরটির নিচের সংবাদটির শিরোনাম_ 'নাটোরে বিএনপি নেতাকে জবাই করে হত্যা'। প্রথম আলো পত্রিকায় সেদিন প্রধান খবর ছিল, 'সরকারি সিদ্ধান্তের আগেই চিনির দাম বাড়াল ব্যবসায়ীরা'। কালের কণ্ঠ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম, 'তিতাসের সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা 'নাই'। প্রধানমন্ত্রীর নিজের দেশে যখন এই অবস্থা তখন তার বিশ্ব শান্তি মডেল অন্য দেশের মানুষ খুব জরুরিভাবে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরঞ্চ তার নিজের দেশে অশান্তির কারণগুলো দূর করতে সচেষ্ট হলে সাধুবাদ পাবেন। তাছাড়া আগে তো নিজের দেশ, তাই নয় কি!
মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকার দেশে একটার পর একটা নৃশংস ও বর্বরোচিত আচরণের নজির স্থাপন করে চলেছে। পুলিশ হেফাজতে সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এম ইউ আহমেদের মৃত্যু, বস্তুতপক্ষে অসুস্থতা সত্ত্বেও তাকে মাঝরাতে গ্রেফতার করে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া, থানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ওপর বিনাদোষে অকথ্য নির্যাতন ও বিক্ষোভকারীকে মাটিতে ফেলে পুলিশ তার বুকে বুট চেপে ধরা। পুলিশি অবহেলায় শবেবরাতের ভোররাতে ঢাকার শহরতলিতে গণপিটুনিতে ছয় ছাত্রের মৃত্যু এসব যেন যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে যোগ হলো জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম এবং ওই দলের প্রচার সম্পাদক, সোনার বাংলা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের পরিচালক তাসনীম আলমকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা। জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ও সমর্থকদের সঙ্গে ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারপর তাদের হাতে হাতকড়া লাগানো হয়। আর গত পরশু মঙ্গলবার তাদের খুন বা ডাকাতির দুর্ধর্ষ আসামি, যাদের পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের মতো করে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালত ও জনগণের সামনে হাজির করল আওয়ামী লীগ সরকার। জামায়াতে ইসলামীকে আমি সমর্থন করি না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশ, আমার বন্ধু, সহকর্মী, শিক্ষক ও অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাদের ভয়াবহ আচরণের কথা আমি বা আমার পরিবারের সদস্যরা ভুলি না কখনও। কিন্তু তারপরও যা বাস্তব তা হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে একটি আইনত স্বীকৃত রাজনৈতিক দল। এমনকি আওয়ামী লীগ ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। ১৯৯৬-এর জুনে নির্বাচিত জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে জামায়াতে ইসলামীকে তিনটি আসন দিয়েছিল। সেই দলের দুই নেতাকে আদালতের অনুমতি না নিয়ে, প্রকাশে কোনো ব্যাখ্যা বা কারণ না জানিয়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে জনসমক্ষে হাজির করা হলো। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আমাদের যত মতবিরোধই থাকুক না কেন আমরা তাদের দুই নেতার সঙ্গে সরকারের মধ্যযুগীয় বর্বর আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ না জানিয়ে পারছি না। একই সঙ্গে আমরা বর্তমান সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি যে, এই ধরনের রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অসভ্য আচরণ দেশে নীচ চরিত্রের মানুষদের আরও বর্বর আচরণ করতে উৎসাহিত করবে এবং বহুদিন পর্যন্ত অশান্তি সৃষ্টি করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তি মডেল তখন আপনা থেকেই অকার্যকর হয়ে যাবে।
গত পরশু (মঙ্গলবার) বিএনপি ও তাদের মিত্ররা ঢাকার নয়াপল্টনে যে জনসমাবেশ করে তা ওই স্থানে অনুষ্ঠিত এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক জনসভা। মেঘ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষ জমায়েত হয়েছিল ওই বিশাল জনসভায়। বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি সমর্থকদের ক্ষমতাসীন দলের লোকদের বাধা অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ডাকা দেশজুড়ে হরতাল পালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পুলিশ সেদিন পিকেটারদের রাস্তায় নামতে দেয়নি। বরঞ্চ হরতালের বিপক্ষে পুলিশ পাহারায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছে। কিন্তু দোকানপাট ও স্কুল-কলেজ খোলেনি। চলেনি দূরপাল্লার বাস বা ব্যক্তিগত মোটরযান। দেশ স্থবির ছিল। ওই হরতাল আর গত পরশুর বিশাল সমাবেশ দেখার পরও যদি আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোট মিত্রদের দেশের পরিস্থিতি এবং জনগণের মনোভাব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে তা হবে দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বিএনপি গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথে এ কথা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে যে, দেশের বহু মানুষ সরকারের ক্রিয়াকলাপ সমর্থন করছে না। গত পরশুর সমাবেশে খালেদা জিয়া বেশ পরিষ্কারভাবেই জনগণের কষ্টের কথা ও বিরোধী দলের দাবি তুলে ধরেছেন। আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের উচিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার ব্যবস্থা ফেরত আনা। তাহলেও দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ কমবে। আর শাসক দলের আরও উচিত হবে, দেশের জনসাধারণের শান্তির স্বার্থে লুটপাট, দুর্নীতি ও অন্যায় কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকা। তবে দেশটা একেবারে ধ্বংস করতে চাইলে জনগণ তা মানবে কেন?
খালেদা জিয়া অক্টোবর মাসের জন্য বিরোধী দলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তাতে হরতাল নেই। আছে মিছিল, লংমার্চ ও জনসমাবেশ। আশা করি, সরকার এতে কোনো বাধা দেবে না।
আতাউস সামাদ : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
No comments