দুই নেত্রীর সম্পদের হিসাব by বদিউল আলম মজুমদার
জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সম্পদের হিসাব দাবি করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছেন, খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের ৪৫টি কামরা ও এক ডজন বাথরুম-সংবলিত বাড়িতে ৬৪টি এসি, ৭১টি সোফাসেট, ১৭টি ফ্রিজ, সাত হাজার ২০০ বর্গফুট কার্পেটসহ অসংখ্য মূল্যবান মালামাল ছিল, যা ২৯টি গাড়িতে করে স্থানান্তর করা হয়। তিনি আরও বলেন, অ্যালুমিনিয়াম গ্লাস, দরজার গ্রিল, কমোড, বেসিন, আয়না, চৌকাঠসহ কাঠের দরজা, পানির ট্যাংক, ইতালিয়ান পর্দা, সিঁড়ির হাতল ইত্যাদি খালেদা জিয়া নিয়ে যেতে চান। এসব সম্পদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেওয়া সম্পদের হিসাবে উল্লেখ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী এনবিআর ও অর্থমন্ত্রীকে আহ্বান জানান (প্রথম আলো, ৯ ডিসেম্বর ২০১০)। পরদিন বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে শিষ্টাচারবহির্ভূত বলে আখ্যায়িত করেন এবং একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের আয় ও সম্পদের হিসাব দাবি করেন।
নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করেছিলাম, সম্পদের হিসাব প্রদানকে রাজনৈতিক ফুটবলে পরিণত না করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া, যাঁরা দুজন দু-দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন বা করছেন, স্বেচ্ছায় নিজের ও পরিবারের আয় ও সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবেন। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে তাঁদের সততা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে জনমনে অনেক সন্দেহের অবসান ঘটত। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে তাঁরা নিজেরাই জাতির কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন, নির্বাচনের পর তাঁরা সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারের দুই জায়গায় আওয়ামী লীগ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সম্পদের হিসাব প্রদানের অঙ্গীকার করেছিল। দিনবদলের সনদে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ শীর্ষক শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে।’ একই দলিলে পরবর্তী সময়ে ‘সুশাসন’ শীর্ষক শিরোনামে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎ স প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’ একইভাবে বিএনপি তার ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে শর্তহীনভাবে অঙ্গীকার করে, ‘নির্বাচনের পর শপথ গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে সকল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে হবে।’ নির্বাচনের দীর্ঘ দুই বছর পরও প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী তাঁদের অঙ্গীকার রক্ষা করেননি এবং তাঁদের নিজেদের ও অন্য ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করেননি।
গত নির্বাচনের আগে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে সম্পদের হিসাবসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদানের এবং তা প্রকাশের বিধান নির্বাচনী আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আইনের এ বিধানের ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থীকে হলফনামা দাখিল করতে হয়। আরও দাখিল করতে হয় তাঁদের আয়কর রিটার্নের কপি। আমাদের দুই নেত্রী কর্তৃক তাঁদের হলফনামা ও আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত তথ্য, যা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, পাশে জনগণের অবগতির জন্য তা তুলে ধরা হলো। আমরা শুধু হলফনামা ও আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত তথ্যই, যা ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে, তা তুলে ধরছি। নির্বাচন-পরবর্তী পরিবর্তনগুলো (যেমন—মামলা ও সম্পদের ক্ষেত্রে) এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি (জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্য প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্যের তূলনামূলক চিত্রের জন্য দেখুন: www.votebd.org)। জনগণকে অবহিত করা ছাড়াও এসব তথ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো তাঁদের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া (নিচে ছক আকারে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হিসাব তুলে দেওয়া হলো)।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁদের উভয়ের পেশাই রাজনীতি। তাঁদের দায়দেনা ও ঋণ নেই। তাঁরা উভয়েই কোটিপতি। শেখ হাসিনার নিট সম্পদের পরিমাণ সাড়ে তিন কোটির একটু বেশি এবং খালেদা জিয়ার প্রায় পৌনে চার কোটি। তবে এসব তথ্য অসম্পূর্ণ, কারণ অনেক সম্পদের বর্ণনা অসম্পূর্ণ এবং প্রদত্ত মূল্য অর্জনকালীন সময়ের, যার ফলে বর্তমানে কে কতটুকু সম্পদশালী, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা অসম্ভব। যেমন—খালেদা জিয়ার মইনুল রোডের (যে বাড়ি তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছে) ও গুলশানের স্থাবর সম্পদের অর্জনকালীন মূল্য যথাক্রমে ৫ ও ১০০ টাকা প্রদর্শন করা হয়েছে। অর্থবহ তুলনার স্বার্থে তাই হলফনামার ছকটিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে অনেক বৈসাদৃশ্যও লক্ষ করা যায়। যেমন—শেখ হাসিনার আয় যেখানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, সেখানে খালেদা জিয়ার আয় এর অর্ধেকেরও কম, প্রায় ১৩ লাখ টাকা। শেখ হাসিনার প্রদত্ত ট্যাক্স ছয় লাখ টাকার ওপরে হলেও খালেদা জিয়ার প্রদত্ত ট্যাক্স দুই লাখ টাকার কম। তবে খালেদা জিয়ার আয়কর রিটার্নে আগের কর বছরের জন্য ৪৪,১০,৩৮৯ টাকা কর পরিশোধ খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে। পক্ষান্তরে, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে একই কর বছরের কর পরিশোধ খাতে ৬,৮৭,৪৪১ টাকা প্রদর্শন করা হয়েছে।
এটি আজ স্পষ্ট যে জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বার্ষিক সম্পদের হিসাব প্রদান এবং জনসমক্ষে প্রকাশ এ লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বড় দুটি রাজনৈতিক দলই এ ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরও অঙ্গীকারবদ্ধ মাননীয় সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করতে। এই অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে সাবের হোসেন চৌধুরী গত বছর সংসদে একটি বেসরকারি বিল উত্থাপন করেছেন। বিলটি আইনে পরিণত এবং ফি বছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করা হলে নাগরিকেরা জানতে পারত, কোন কোন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংসদ সদস্যরা যুক্ত, কোথায় তাঁদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং তাঁদের কেউ বর্তমান পুঁজিবাজার-কলঙ্কের সঙ্গে জড়িত কি না, যে বিষয়ে এখন ব্যাপক গুজব বিরাজ করছে। কিন্তু গণমাধ্যমের সূত্রে আমরা জেনেছি, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি বিলটি আইনে পরিণত করার বিরুদ্ধে সুপারিশ করেছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাঁরা কি নিজেদের দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করছেন? আশা করি, জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে উভয় নেত্রী এসব বিষয়ে ভাববেন এবং যথার্থ উদ্যোগ নেবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন।
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার সম্পদের হিসাব
শেখ হাসিনা
শিক্ষাগত যোগ্যতা: বিএ
পেশা/জীবিকা: রাজনীতি
আয়ের উৎ সসমূহ ও পরিমাণ (বাৎ সরিক): কৃষি খাত: ৪,৫০,০০০/-, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন্যান্য ভাড়া: ৪,৪৮,০০০/-, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত: ২০,৭৯,০৬৭/-
প্রার্থীর নিজের নির্ভরশীল প্রার্থী এবং প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর সম্পদের বিবরণ: নগদ টাকা নিজ নামে: ১,৫০,০০০/-; স্বামীর নামে: ৬০,৬৭১/-, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ নিজ নামে: ৩,১৮,৮৪,৯০৪/-; স্বামীর নামে: ৩০,৭৪,৬০৩/-, বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল ইত্যাদির বিবরণী (পরিমাণ, অর্জনকালীন সময়ের মূল্যসহ) নিজ নামে: ৬,০০,০০০/-, স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু নিজ নামে: ১৩,২৫,০০০/-; স্বামীর নামে: ২,৫০০/-, আসবাবপত্র নিজ নামে: ৭,৪০,০০০/-; স্বামীর নামে: ১০,০০০/-
স্থাবর সম্পদ: কৃষি জমি নিজ নামে: ৪ একর, মূল্য: ১,৭৫,০০০/-; স্বামীর নামে: ৩ একর, মূল্য: ১৫,০০০/-, দালান/আবাসিক বা বাণিজ্যিক স্বামীর নামে: ৬৪,০৩,৯৫২/-
যৌথ মালিকানায় প্রার্থীর অংশ: যৌথ মালিকানা: পাঁচ একর কৃষি জমির ৫০%
দায়দেনাগুলোর বিবরণ ও পরিমাণ: নেই
প্রার্থীর ঋণ ও ঋণের পরিমাণ/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম: নেই
আয়কর বিবরণীতে দাখিলকৃত সম্পদ: অকৃষি সম্পত্তি: ১,৭৫,০০০/-, কৃষি সম্পত্তি: ৬,৭৮,০০০/-, মোটরযান (দুটি): ৬,০০,০০০/-, অলংকারাদি: ১৩,২৫,০০০/-, আসবাবপত্র: ৭,৪০,০০০/-, নগদ, ব্যাংক ও অন্যান্য: ৩,১৮,৮৪,৯০৪/-
নিট সম্পদ: ৩,৫৪,০২,৯০৪/-
মোট আয়: ২৯,৭৭,০৬৭/-
প্রদত্ত কর: ৬,০৬,৭৬৭/-
জীবনযাত্রার মান: যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ: ২০,০০০/-, আবাসিক বিদ্যুৎ বিল: ৬০,০০০/-, আবাসিক টেলিফোন বিল: ২৫,০০০/-
বেগম খালেদা জিয়া
শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্বশিক্ষিত
পেশা/জীবিকা: রাজনীতি
আয়ের উৎ সসমূহ ও পরিমাণ (বাৎ সরিক): বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন্যান্য ভাড়া: ৫,২৩,৮০০/-, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত: ৭,৭৩,৩৮৩/-, অন্যান্য: ১২,৯৭,১৮৩/-, নগদ টাকা: ৩৬,৫২,৮৪৫/-
প্রার্থীর নিজের নির্ভরশীল প্রার্থী এবং প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর সম্পদের বিবরণ: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ: ২,৭৫,৪২,২৮৫/-, বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল ইত্যাদির বিবরণী (পরিমাণ, অর্জনকালীন সময়ের মূল্যসহ): ৫৪,৪৫,০০০/-, ৫০ তোলা স্বর্ণ ও জহরত বিয়ের সময় উপহারপ্রাপ্ত, আসবাবপত্র: ২,৬০,০০০/-, ইলেকট্রনিক সামগ্রী: ৪,৩৫,০০০/-
স্থাবর সম্পদ: অকৃষি জমি: ১২,৩০০/-
যৌথ মালিকানায় প্রার্থীর অংশ: বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট যৌথ মালিকানায় মূল্য: ১০৫/- (প্রার্থীর ১/৩ অংশ)
দায়দেনাগুলোর বিবরণ ও পরিমাণ: প্রযোজ্য নয়
প্রার্থীর ঋণ ও ঋণের পরিমাণ/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম: প্রযোজ্য নয়
আয়কর বিবরণীতে দাখিলকৃত সম্পদ: অকৃষি সম্পত্তি: ১২,৪০৫/-, বিনিয়োগ: ১,৪৫,৬০,৬৪৫.১৩/-, মোটরযান (চারটি): ৫৪,৪৫,০০০/-, অলংকারাদি, মূল্য জানা নেই (৫০ তোলা), আসবাবপত্র: ২,৬০,০০০/-, ইলেকট্রনিক সামগ্রী (সাতটি এয়ারকুলারসহ): ৪,৩৫,০০০/-, নগদ, ব্যাংক ও অন্যান্য: ৩৬,৫২,৮৪৫/-, অন্যান্য পরিসম্পদ: ১,২৯,৮১,৬৪০/৬৭ (সঞ্চয়ী হিসাবের স্থিতি)
নিট সম্পদ: ৩,৭৩,৪৭,৫৩৫.৮০/-
মোট আয়: ১২,৯৭,১৮৩/-
প্রদত্ত কর: ১,৮৬,৭৯৬/-
জীবনযাত্রার মান: যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ: ৮৪,০০০/-, উৎ সব ব্যয় ও অন্যান্য: ৯৬,০০০/-, ব্যক্তি ও ভরণপোষণ খরচ: ১,২০,০০০/-, উৎ সে কর্তনসহ বিগত বছরের পরিশোধিত আয়কর: ৪৪,১০,৩৪৯/-
নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করেছিলাম, সম্পদের হিসাব প্রদানকে রাজনৈতিক ফুটবলে পরিণত না করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া, যাঁরা দুজন দু-দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন বা করছেন, স্বেচ্ছায় নিজের ও পরিবারের আয় ও সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবেন। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে তাঁদের সততা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে জনমনে অনেক সন্দেহের অবসান ঘটত। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে তাঁরা নিজেরাই জাতির কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন, নির্বাচনের পর তাঁরা সম্পদের হিসাব প্রকাশ করবেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারের দুই জায়গায় আওয়ামী লীগ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সম্পদের হিসাব প্রদানের অঙ্গীকার করেছিল। দিনবদলের সনদে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ শীর্ষক শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে।’ একই দলিলে পরবর্তী সময়ে ‘সুশাসন’ শীর্ষক শিরোনামে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎ স প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’ একইভাবে বিএনপি তার ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে শর্তহীনভাবে অঙ্গীকার করে, ‘নির্বাচনের পর শপথ গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে সকল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে হবে।’ নির্বাচনের দীর্ঘ দুই বছর পরও প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী তাঁদের অঙ্গীকার রক্ষা করেননি এবং তাঁদের নিজেদের ও অন্য ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করেননি।
গত নির্বাচনের আগে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে সম্পদের হিসাবসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদানের এবং তা প্রকাশের বিধান নির্বাচনী আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আইনের এ বিধানের ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থীকে হলফনামা দাখিল করতে হয়। আরও দাখিল করতে হয় তাঁদের আয়কর রিটার্নের কপি। আমাদের দুই নেত্রী কর্তৃক তাঁদের হলফনামা ও আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত তথ্য, যা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, পাশে জনগণের অবগতির জন্য তা তুলে ধরা হলো। আমরা শুধু হলফনামা ও আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত তথ্যই, যা ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে, তা তুলে ধরছি। নির্বাচন-পরবর্তী পরিবর্তনগুলো (যেমন—মামলা ও সম্পদের ক্ষেত্রে) এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি (জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্য প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্যের তূলনামূলক চিত্রের জন্য দেখুন: www.votebd.org)। জনগণকে অবহিত করা ছাড়াও এসব তথ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো তাঁদের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া (নিচে ছক আকারে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হিসাব তুলে দেওয়া হলো)।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁদের উভয়ের পেশাই রাজনীতি। তাঁদের দায়দেনা ও ঋণ নেই। তাঁরা উভয়েই কোটিপতি। শেখ হাসিনার নিট সম্পদের পরিমাণ সাড়ে তিন কোটির একটু বেশি এবং খালেদা জিয়ার প্রায় পৌনে চার কোটি। তবে এসব তথ্য অসম্পূর্ণ, কারণ অনেক সম্পদের বর্ণনা অসম্পূর্ণ এবং প্রদত্ত মূল্য অর্জনকালীন সময়ের, যার ফলে বর্তমানে কে কতটুকু সম্পদশালী, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা অসম্ভব। যেমন—খালেদা জিয়ার মইনুল রোডের (যে বাড়ি তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছে) ও গুলশানের স্থাবর সম্পদের অর্জনকালীন মূল্য যথাক্রমে ৫ ও ১০০ টাকা প্রদর্শন করা হয়েছে। অর্থবহ তুলনার স্বার্থে তাই হলফনামার ছকটিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে অনেক বৈসাদৃশ্যও লক্ষ করা যায়। যেমন—শেখ হাসিনার আয় যেখানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, সেখানে খালেদা জিয়ার আয় এর অর্ধেকেরও কম, প্রায় ১৩ লাখ টাকা। শেখ হাসিনার প্রদত্ত ট্যাক্স ছয় লাখ টাকার ওপরে হলেও খালেদা জিয়ার প্রদত্ত ট্যাক্স দুই লাখ টাকার কম। তবে খালেদা জিয়ার আয়কর রিটার্নে আগের কর বছরের জন্য ৪৪,১০,৩৮৯ টাকা কর পরিশোধ খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে। পক্ষান্তরে, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে একই কর বছরের কর পরিশোধ খাতে ৬,৮৭,৪৪১ টাকা প্রদর্শন করা হয়েছে।
এটি আজ স্পষ্ট যে জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বার্ষিক সম্পদের হিসাব প্রদান এবং জনসমক্ষে প্রকাশ এ লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বড় দুটি রাজনৈতিক দলই এ ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরও অঙ্গীকারবদ্ধ মাননীয় সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করতে। এই অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে সাবের হোসেন চৌধুরী গত বছর সংসদে একটি বেসরকারি বিল উত্থাপন করেছেন। বিলটি আইনে পরিণত এবং ফি বছর সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করা হলে নাগরিকেরা জানতে পারত, কোন কোন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংসদ সদস্যরা যুক্ত, কোথায় তাঁদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং তাঁদের কেউ বর্তমান পুঁজিবাজার-কলঙ্কের সঙ্গে জড়িত কি না, যে বিষয়ে এখন ব্যাপক গুজব বিরাজ করছে। কিন্তু গণমাধ্যমের সূত্রে আমরা জেনেছি, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি বিলটি আইনে পরিণত করার বিরুদ্ধে সুপারিশ করেছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাঁরা কি নিজেদের দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করছেন? আশা করি, জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে উভয় নেত্রী এসব বিষয়ে ভাববেন এবং যথার্থ উদ্যোগ নেবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন।
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার সম্পদের হিসাব
শেখ হাসিনা
শিক্ষাগত যোগ্যতা: বিএ
পেশা/জীবিকা: রাজনীতি
আয়ের উৎ সসমূহ ও পরিমাণ (বাৎ সরিক): কৃষি খাত: ৪,৫০,০০০/-, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন্যান্য ভাড়া: ৪,৪৮,০০০/-, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত: ২০,৭৯,০৬৭/-
প্রার্থীর নিজের নির্ভরশীল প্রার্থী এবং প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর সম্পদের বিবরণ: নগদ টাকা নিজ নামে: ১,৫০,০০০/-; স্বামীর নামে: ৬০,৬৭১/-, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ নিজ নামে: ৩,১৮,৮৪,৯০৪/-; স্বামীর নামে: ৩০,৭৪,৬০৩/-, বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল ইত্যাদির বিবরণী (পরিমাণ, অর্জনকালীন সময়ের মূল্যসহ) নিজ নামে: ৬,০০,০০০/-, স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু নিজ নামে: ১৩,২৫,০০০/-; স্বামীর নামে: ২,৫০০/-, আসবাবপত্র নিজ নামে: ৭,৪০,০০০/-; স্বামীর নামে: ১০,০০০/-
স্থাবর সম্পদ: কৃষি জমি নিজ নামে: ৪ একর, মূল্য: ১,৭৫,০০০/-; স্বামীর নামে: ৩ একর, মূল্য: ১৫,০০০/-, দালান/আবাসিক বা বাণিজ্যিক স্বামীর নামে: ৬৪,০৩,৯৫২/-
যৌথ মালিকানায় প্রার্থীর অংশ: যৌথ মালিকানা: পাঁচ একর কৃষি জমির ৫০%
দায়দেনাগুলোর বিবরণ ও পরিমাণ: নেই
প্রার্থীর ঋণ ও ঋণের পরিমাণ/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম: নেই
আয়কর বিবরণীতে দাখিলকৃত সম্পদ: অকৃষি সম্পত্তি: ১,৭৫,০০০/-, কৃষি সম্পত্তি: ৬,৭৮,০০০/-, মোটরযান (দুটি): ৬,০০,০০০/-, অলংকারাদি: ১৩,২৫,০০০/-, আসবাবপত্র: ৭,৪০,০০০/-, নগদ, ব্যাংক ও অন্যান্য: ৩,১৮,৮৪,৯০৪/-
নিট সম্পদ: ৩,৫৪,০২,৯০৪/-
মোট আয়: ২৯,৭৭,০৬৭/-
প্রদত্ত কর: ৬,০৬,৭৬৭/-
জীবনযাত্রার মান: যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ: ২০,০০০/-, আবাসিক বিদ্যুৎ বিল: ৬০,০০০/-, আবাসিক টেলিফোন বিল: ২৫,০০০/-
বেগম খালেদা জিয়া
শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্বশিক্ষিত
পেশা/জীবিকা: রাজনীতি
আয়ের উৎ সসমূহ ও পরিমাণ (বাৎ সরিক): বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন্যান্য ভাড়া: ৫,২৩,৮০০/-, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র/ব্যাংক আমানত: ৭,৭৩,৩৮৩/-, অন্যান্য: ১২,৯৭,১৮৩/-, নগদ টাকা: ৩৬,৫২,৮৪৫/-
প্রার্থীর নিজের নির্ভরশীল প্রার্থী এবং প্রার্থীর ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর সম্পদের বিবরণ: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ: ২,৭৫,৪২,২৮৫/-, বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল ইত্যাদির বিবরণী (পরিমাণ, অর্জনকালীন সময়ের মূল্যসহ): ৫৪,৪৫,০০০/-, ৫০ তোলা স্বর্ণ ও জহরত বিয়ের সময় উপহারপ্রাপ্ত, আসবাবপত্র: ২,৬০,০০০/-, ইলেকট্রনিক সামগ্রী: ৪,৩৫,০০০/-
স্থাবর সম্পদ: অকৃষি জমি: ১২,৩০০/-
যৌথ মালিকানায় প্রার্থীর অংশ: বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট যৌথ মালিকানায় মূল্য: ১০৫/- (প্রার্থীর ১/৩ অংশ)
দায়দেনাগুলোর বিবরণ ও পরিমাণ: প্রযোজ্য নয়
প্রার্থীর ঋণ ও ঋণের পরিমাণ/আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম: প্রযোজ্য নয়
আয়কর বিবরণীতে দাখিলকৃত সম্পদ: অকৃষি সম্পত্তি: ১২,৪০৫/-, বিনিয়োগ: ১,৪৫,৬০,৬৪৫.১৩/-, মোটরযান (চারটি): ৫৪,৪৫,০০০/-, অলংকারাদি, মূল্য জানা নেই (৫০ তোলা), আসবাবপত্র: ২,৬০,০০০/-, ইলেকট্রনিক সামগ্রী (সাতটি এয়ারকুলারসহ): ৪,৩৫,০০০/-, নগদ, ব্যাংক ও অন্যান্য: ৩৬,৫২,৮৪৫/-, অন্যান্য পরিসম্পদ: ১,২৯,৮১,৬৪০/৬৭ (সঞ্চয়ী হিসাবের স্থিতি)
নিট সম্পদ: ৩,৭৩,৪৭,৫৩৫.৮০/-
মোট আয়: ১২,৯৭,১৮৩/-
প্রদত্ত কর: ১,৮৬,৭৯৬/-
জীবনযাত্রার মান: যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ: ৮৪,০০০/-, উৎ সব ব্যয় ও অন্যান্য: ৯৬,০০০/-, ব্যক্তি ও ভরণপোষণ খরচ: ১,২০,০০০/-, উৎ সে কর্তনসহ বিগত বছরের পরিশোধিত আয়কর: ৪৪,১০,৩৪৯/-
No comments