নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন প্রয়োজন by তোফায়েল আহমেদ
সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় শহরের ওপর প্রকাশিত এক সমীক্ষায় ঢাকাকে ‘বসবাসের অযোগ্য’ না হলেও বসবাসের যোগ্যতার মাপকাঠিতে অতি নিম্নস্তরে স্থান দেওয়া হয়েছে। দেশ ও ঢাকা শহরের সমস্যা নিয়ে সরকার ও জনগণের উদ্বেগ লক্ষণীয়। সমস্যার প্রকার ও প্রকৃতি প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে, বাড়ছে তীব্রতা। কিন্তু সমাধানের পদক্ষেপ নিয়ে নেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। নেই ন্যূনতম মতৈক্য। এমনকি মতৈক্য সৃষ্টির উদ্যোগ বা লক্ষণও নেই।
ঢাকা সিটি করপোরেশন ও অধিকাংশ নগরকেন্দ্রগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ, নির্বাচন হয়নি প্রায় আড়াই বছর। এখন ২৬৯ নগরকেন্দ্রে বিলম্বিত সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনিশ্চিত রেখে সিটি করপোরেশনকে ভেঙে দুই বা চারটি করপোরেশনে রূপান্তর এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগের বিধানের কথা ভাবা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নিয়ে এ ভাবনা নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। অবশ্য সরকার ও জনগণ কেউ হয়তো কারও ইচ্ছা ও অভিব্যক্তি পুরোপুরি অবগত নয়। এ অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে মতামত দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ অথবা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। তবে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই যে ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ দেশের সব নগর সরকার বা নগর ব্যবস্থাপনা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন দরকার।
প্রথমত, ঢাকার ক্ষেত্রে বলতে হয়, ঢাকা ১৬ কোটি মানুষের যে একটি দেশ, সে দেশের রাজধানী ও প্রধান নগর। দেশের শিল্প-বাণিজ্য কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যে প্রবৃদ্ধি, তাতে ঢাকার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তা ছাড়া দেশের সরকার-অবস্থান কেন্দ্র ঢাকা। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অন্যান্য নগরের সঙ্গে ঢাকার স্পষ্ট একটি পার্থক্য রয়েছে। তা ছাড়া বহির্বিশ্বে পুরো দেশকে চেনার ক্ষেত্রে ওই দেশের প্রধান নগর ও রাজধানীর একটি সরাসরি সম্পর্ক থাকে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরের যেসব সমস্যা, সেসব সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবিত বিভাজন ও প্রশাসক নিয়োগের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে, তা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। কারণ, ৩৬০ বর্গকিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার সমস্যার উৎপত্তি, বিস্তার ও সর্বশেষ এর সমাধান ওই সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকা মহানগরের পর্বতপ্রমাণ সমস্যা সারা দেশের সমস্যার একটি পুঞ্জীভূত রূপ। তাই এ মহানগরের সমস্যাগুলো শুধু মহানগরের প্রশাসনিক কাঠামোতে সমাধানের চেষ্টা সফল হওয়ার নয়।
মহানগরের সরকার হিসেবে ডিসিসি একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান নয়। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, এ মহানগরের প্রধান নাগরিক সেবাগুলো নগর সরকার বা ডিসিসি দিতে পারবে, এ সামর্থ্য ডিসিসির গড়ে ওঠেনি। ঢাকা মহানগরে ডিসিসি ছাড়া আরও ৫০টির বেশি সরকারি সংস্থা রয়েছে, যাদের নগরবাসীকে বিভিন্ন সেবা সরবরাহের ম্যান্ডেট রয়েছে। এখানে সেবাদানে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং একের সঙ্গে অন্যের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের অভাব সেবার গুণগতমান রক্ষিত না হওয়া ও সময়মতো সেবা না পাওয়ার জন্য দায়ী। ঢাকা শহরে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে কমপক্ষে তিনটি কর্তৃপক্ষ (সড়ক ও জনপথ, রাজউক ও ডিসিসি), গৃহায়ণে তিন-চারটি কর্তৃপক্ষ, ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনুরূপ—এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে একাধিক কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান।
ঢাকা মহানগর বা দেশের সব মহানগরের নগর ব্যবস্থাপনা সংস্থা সিটি করপোরেশনগুলো মেয়রসর্বস্ব। মেয়ররা প্রেষণে নিয়োজিত বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে করপোরেশন পরিচালনা করে থাকেন। এখানে সত্যিকার অর্থে মহিলা কিংবা পুরুষ কমিশনারদের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা থাকে না। মেয়রের সুনজরে থাকলেই কাউন্সিলররা কিছুটা গুরুত্ব পান। কাউন্সিলরদের মধ্যেও সে ভূমিকা পালনের তাগিদ নেই। তারা ঠিকাদারির ভাগাভাগি, বাজার-হাট বসানো, এর বখরা আদায়, জমিজমা দখল-বেদখলে অনেক বেশি আগ্রহী থাকে। তা ছাড়া শহরে আনুষ্ঠানিক প্রশাসনের পাশাপাশি এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক একটি শাসনকাঠামো গড়ে উঠেছে। কমিশনাররা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওই অনানুষ্ঠানিক শাসন কাঠামোর অংশ হয়ে যান। অপরাধ জগতের সঙ্গে রয়েছে ওই অনানুষ্ঠানিক শাসনকাঠামোর একটি নিবিড় সংযোগ।
আমাদের ঢাকার মেয়রের মর্যাদা একজন মন্ত্রীর সমপর্যায়ের। তবে তিনি মন্ত্রী নন। স্থানীয় সরকারসহ বহু মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের অধীনেই প্রকৃত অর্থে তাঁকে কাজ করতে হয়। তবে করপোরেশনের অভ্যন্তরে তিনি সর্বেসর্বা। ১৫ জন এমপির নির্বাচনী এলাকা নিয়ে একজন মেয়রের নির্বাচনী এলাকা। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির কোনো নেতা ওই নির্বাচনে প্রার্থী হন। জয়লাভ করলে তিনি মন্ত্রী হওয়ার বদলে মেয়র হন। তাঁর মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা সদা জাগ্রত থাকে। ঢাকার মেয়ররা একসময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এভাবে ডিসিসি আইনগতভাবে একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সার্বিক ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সাম্রাজ্য বিস্তারের মনোবৃত্তি ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ দেশের সব স্থানীয় সরকারের বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। তাই বিষয়টিকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে।
দেশে সামগ্রিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ নীতি কাঠামোর অধীনে নগর ও নগর-প্রশাসন শুধু নয়, সর্বত্র মৌলিক সেবাব্যবস্থাকে সাজিয়ে সবাই সেবা পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই বা চার ভাগ করে দু-চারজন মেয়র সৃষ্টি করে নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিজয় নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু সেবা সরবরাহে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আশা করা বোধ হয় বাতুলতা হবে।
রাজধানী হিসেবে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে পুনর্গঠন করে এর বিকেন্দ্রীকরণের জন্য বর্তমান সিটি করপোরেশন ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন আনা যেতে পারে নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করে। কলকাতার মতো ঢাকায়ও সিটি করপোরেশনে আইন ও নির্বাহী দুটি বিভাগ বা স্তর সৃষ্টি করা যায়। এখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের আদলের প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সর্বেসর্বা মেয়র ব্যবস্থার পরিবর্তে মেয়র-ইন-কাউন্সিল পদ্ধতির প্রবর্তন করা যায়। এখানে মেয়র ও ডেপুটি মেয়ররা সরাসরি নির্বাচিত হবেন না। সবাই প্রথমে কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন এবং কাউন্সিলররা প্রথম অধিবেশনে মেয়র ও ডেপুটি মেয়র নির্বাচন করবেন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র তাঁরই আস্থাভাজন ১০ জন কাউন্সিলর নিয়ে একটি নির্বাহী কাউন্সিল তৈরি করবেন। সেই নির্বাহী কাউন্সিল মেয়রের নেতৃত্বে করপোরেশন পরিচালনা করবে। মেয়রসহ প্রতিটি নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্যদের অধীনে করপোরেশনের একেকটি দপ্তর পরিচালিত হবে। নির্বাহী কাউন্সিলের বাইরে যেসব কাউন্সিলর থাকবেন, তাঁরা ডিসিসির সাধারণ কাউন্সিল হিসেবে কাজ করবেন। দুজন ডেপুটি মেয়রের একজন ওই সভার স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ডিসিসির সাধারণ কাউন্সিলে ডিসির বাজেট, ব্যয় বরাদ্দ ও আইনকানুন পাস হবে। মেয়রসহ নির্বাহী কাউন্সিল সাধারণ কাউন্সিলরের কাছে দায়ী থাকবে। সাধারণ কাউন্সিলে আস্থা হারালে মেয়র নিজের কাউন্সিলে অপসারিত হবেন এবং নতুন আস্থাভাজন কাউন্সিল গঠিত হবে।
তা ছাড়া ডিসিসি বর্তমানে ১০টি অঞ্চলে বিভক্ত। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে অঞ্চলভিত্তিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। অঞ্চল ও ওয়ার্ড পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমানে মেয়র ও কাউন্সিল কারও কোনো জবাবদিহি নেই।
ডিসিসি বর্তমানে কিছু রাজনৈতিক ঠিকাদার ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে জিম্মি। তা ছাড়া নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির সব অনাচার করপোরেশনের ঘাড়ে চেপে আছে। এ রকম একটি অবস্থায় ওই সব অনাচারের বিকেন্দ্রীকরণ করে যার যা লাভ হওয়ার হবে কিন্তু জনগণের খুব উপকার হবে বলে মনে হয় না।
ঢাকা ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি শহর। সেই ৪০০ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে নিযুক্তকারী কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ তাই সাধারণভাবে নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা একক প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য না ভেঙে এর মধ্যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সেবা সরবরাহের বিকেন্দ্রীকরণ করার পদক্ষেপ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। এ বিষয়ে সরকার এককভাবে দায়ভার কাঁধে না নিয়ে নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে পারে।
তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।
ঢাকা সিটি করপোরেশন ও অধিকাংশ নগরকেন্দ্রগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ, নির্বাচন হয়নি প্রায় আড়াই বছর। এখন ২৬৯ নগরকেন্দ্রে বিলম্বিত সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনিশ্চিত রেখে সিটি করপোরেশনকে ভেঙে দুই বা চারটি করপোরেশনে রূপান্তর এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগের বিধানের কথা ভাবা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নিয়ে এ ভাবনা নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। অবশ্য সরকার ও জনগণ কেউ হয়তো কারও ইচ্ছা ও অভিব্যক্তি পুরোপুরি অবগত নয়। এ অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে মতামত দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ অথবা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো। তবে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই যে ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ দেশের সব নগর সরকার বা নগর ব্যবস্থাপনা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন দরকার।
প্রথমত, ঢাকার ক্ষেত্রে বলতে হয়, ঢাকা ১৬ কোটি মানুষের যে একটি দেশ, সে দেশের রাজধানী ও প্রধান নগর। দেশের শিল্প-বাণিজ্য কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যে প্রবৃদ্ধি, তাতে ঢাকার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তা ছাড়া দেশের সরকার-অবস্থান কেন্দ্র ঢাকা। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অন্যান্য নগরের সঙ্গে ঢাকার স্পষ্ট একটি পার্থক্য রয়েছে। তা ছাড়া বহির্বিশ্বে পুরো দেশকে চেনার ক্ষেত্রে ওই দেশের প্রধান নগর ও রাজধানীর একটি সরাসরি সম্পর্ক থাকে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরের যেসব সমস্যা, সেসব সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবিত বিভাজন ও প্রশাসক নিয়োগের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে, তা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না। কারণ, ৩৬০ বর্গকিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার সমস্যার উৎপত্তি, বিস্তার ও সর্বশেষ এর সমাধান ওই সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকা মহানগরের পর্বতপ্রমাণ সমস্যা সারা দেশের সমস্যার একটি পুঞ্জীভূত রূপ। তাই এ মহানগরের সমস্যাগুলো শুধু মহানগরের প্রশাসনিক কাঠামোতে সমাধানের চেষ্টা সফল হওয়ার নয়।
মহানগরের সরকার হিসেবে ডিসিসি একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান নয়। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, এ মহানগরের প্রধান নাগরিক সেবাগুলো নগর সরকার বা ডিসিসি দিতে পারবে, এ সামর্থ্য ডিসিসির গড়ে ওঠেনি। ঢাকা মহানগরে ডিসিসি ছাড়া আরও ৫০টির বেশি সরকারি সংস্থা রয়েছে, যাদের নগরবাসীকে বিভিন্ন সেবা সরবরাহের ম্যান্ডেট রয়েছে। এখানে সেবাদানে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং একের সঙ্গে অন্যের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের অভাব সেবার গুণগতমান রক্ষিত না হওয়া ও সময়মতো সেবা না পাওয়ার জন্য দায়ী। ঢাকা শহরে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে কমপক্ষে তিনটি কর্তৃপক্ষ (সড়ক ও জনপথ, রাজউক ও ডিসিসি), গৃহায়ণে তিন-চারটি কর্তৃপক্ষ, ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনুরূপ—এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে একাধিক কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান।
ঢাকা মহানগর বা দেশের সব মহানগরের নগর ব্যবস্থাপনা সংস্থা সিটি করপোরেশনগুলো মেয়রসর্বস্ব। মেয়ররা প্রেষণে নিয়োজিত বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে করপোরেশন পরিচালনা করে থাকেন। এখানে সত্যিকার অর্থে মহিলা কিংবা পুরুষ কমিশনারদের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা থাকে না। মেয়রের সুনজরে থাকলেই কাউন্সিলররা কিছুটা গুরুত্ব পান। কাউন্সিলরদের মধ্যেও সে ভূমিকা পালনের তাগিদ নেই। তারা ঠিকাদারির ভাগাভাগি, বাজার-হাট বসানো, এর বখরা আদায়, জমিজমা দখল-বেদখলে অনেক বেশি আগ্রহী থাকে। তা ছাড়া শহরে আনুষ্ঠানিক প্রশাসনের পাশাপাশি এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক একটি শাসনকাঠামো গড়ে উঠেছে। কমিশনাররা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওই অনানুষ্ঠানিক শাসন কাঠামোর অংশ হয়ে যান। অপরাধ জগতের সঙ্গে রয়েছে ওই অনানুষ্ঠানিক শাসনকাঠামোর একটি নিবিড় সংযোগ।
আমাদের ঢাকার মেয়রের মর্যাদা একজন মন্ত্রীর সমপর্যায়ের। তবে তিনি মন্ত্রী নন। স্থানীয় সরকারসহ বহু মন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের অধীনেই প্রকৃত অর্থে তাঁকে কাজ করতে হয়। তবে করপোরেশনের অভ্যন্তরে তিনি সর্বেসর্বা। ১৫ জন এমপির নির্বাচনী এলাকা নিয়ে একজন মেয়রের নির্বাচনী এলাকা। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির কোনো নেতা ওই নির্বাচনে প্রার্থী হন। জয়লাভ করলে তিনি মন্ত্রী হওয়ার বদলে মেয়র হন। তাঁর মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা সদা জাগ্রত থাকে। ঢাকার মেয়ররা একসময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এভাবে ডিসিসি আইনগতভাবে একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সার্বিক ত্রুটিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সাম্রাজ্য বিস্তারের মনোবৃত্তি ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ দেশের সব স্থানীয় সরকারের বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। তাই বিষয়টিকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে।
দেশে সামগ্রিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ নীতি কাঠামোর অধীনে নগর ও নগর-প্রশাসন শুধু নয়, সর্বত্র মৌলিক সেবাব্যবস্থাকে সাজিয়ে সবাই সেবা পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই বা চার ভাগ করে দু-চারজন মেয়র সৃষ্টি করে নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি বিজয় নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু সেবা সরবরাহে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আশা করা বোধ হয় বাতুলতা হবে।
রাজধানী হিসেবে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে পুনর্গঠন করে এর বিকেন্দ্রীকরণের জন্য বর্তমান সিটি করপোরেশন ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন আনা যেতে পারে নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করে। কলকাতার মতো ঢাকায়ও সিটি করপোরেশনে আইন ও নির্বাহী দুটি বিভাগ বা স্তর সৃষ্টি করা যায়। এখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের আদলের প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত সর্বেসর্বা মেয়র ব্যবস্থার পরিবর্তে মেয়র-ইন-কাউন্সিল পদ্ধতির প্রবর্তন করা যায়। এখানে মেয়র ও ডেপুটি মেয়ররা সরাসরি নির্বাচিত হবেন না। সবাই প্রথমে কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন এবং কাউন্সিলররা প্রথম অধিবেশনে মেয়র ও ডেপুটি মেয়র নির্বাচন করবেন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র তাঁরই আস্থাভাজন ১০ জন কাউন্সিলর নিয়ে একটি নির্বাহী কাউন্সিল তৈরি করবেন। সেই নির্বাহী কাউন্সিল মেয়রের নেতৃত্বে করপোরেশন পরিচালনা করবে। মেয়রসহ প্রতিটি নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্যদের অধীনে করপোরেশনের একেকটি দপ্তর পরিচালিত হবে। নির্বাহী কাউন্সিলের বাইরে যেসব কাউন্সিলর থাকবেন, তাঁরা ডিসিসির সাধারণ কাউন্সিল হিসেবে কাজ করবেন। দুজন ডেপুটি মেয়রের একজন ওই সভার স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ডিসিসির সাধারণ কাউন্সিলে ডিসির বাজেট, ব্যয় বরাদ্দ ও আইনকানুন পাস হবে। মেয়রসহ নির্বাহী কাউন্সিল সাধারণ কাউন্সিলরের কাছে দায়ী থাকবে। সাধারণ কাউন্সিলে আস্থা হারালে মেয়র নিজের কাউন্সিলে অপসারিত হবেন এবং নতুন আস্থাভাজন কাউন্সিল গঠিত হবে।
তা ছাড়া ডিসিসি বর্তমানে ১০টি অঞ্চলে বিভক্ত। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে অঞ্চলভিত্তিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। অঞ্চল ও ওয়ার্ড পর্যায়ে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমানে মেয়র ও কাউন্সিল কারও কোনো জবাবদিহি নেই।
ডিসিসি বর্তমানে কিছু রাজনৈতিক ঠিকাদার ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে জিম্মি। তা ছাড়া নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির সব অনাচার করপোরেশনের ঘাড়ে চেপে আছে। এ রকম একটি অবস্থায় ওই সব অনাচারের বিকেন্দ্রীকরণ করে যার যা লাভ হওয়ার হবে কিন্তু জনগণের খুব উপকার হবে বলে মনে হয় না।
ঢাকা ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি শহর। সেই ৪০০ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে নিযুক্তকারী কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ তাই সাধারণভাবে নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা একক প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য না ভেঙে এর মধ্যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সেবা সরবরাহের বিকেন্দ্রীকরণ করার পদক্ষেপ অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। এ বিষয়ে সরকার এককভাবে দায়ভার কাঁধে না নিয়ে নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে পারে।
তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সদস্য, স্থানীয় সরকার কমিশন।
No comments