৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি by বদিউল আলম মজুমদার
বিখ্যাত গায়ক হায়দার হোসেনের অতি জনপ্রিয় গানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কলি, ‘৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।’ এ গানে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের আমাদের অর্জন সম্পর্কে তিনি তাঁর মনের আকুতি প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতা থেকে প্রাপ্তি নিয়ে শিল্পীর ভাষায় তিনি আক্ষেপ করেছেন। আক্ষেপ করেছেন জাতি হিসেবে আমাদের অসংখ্য ব্যর্থতা নিয়ে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘নেই বর্গি, নেই ইংরেজ, নেই পাকিস্তানি হানাদার/ আজ তবু কেন আমার মনে শূন্যতা আর হাহাকার/ আজ তবু কি লাখো শহীদের রক্ত যাবে বৃথা/ আজ তবু কি ভুলতে বসেছি স্বাধীনতার ইতিকথা।’
১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতার ৩৯তম বার্ষিকী পালন করলাম। আর কিছুদিন পরই স্বাধীনতার চার দশক পূর্ণ হবে। ৪০ বছর একটি জাতির জীবনে কম সময় নয়। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক অর্জন আমাদের ঘরে ওঠার কথা ছিল। কথা ছিল অনেক সমস্যা সমাধানের। কিন্তু তা কি হয়েছে? জাতি হিসেবে এ প্রশ্নের মুখোমুখি আজ আমাদের হওয়া প্রয়োজন। নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন আমাদের ব্যর্থতার কারণগুলো। তা না হলে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালন শুধু আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে আটকা পড়ে যাবে এবং এর সত্যিকারের ‘ইতিকথা’ আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যাবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এবং অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে। মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ছিল কতগুলো চেতনা ও মূল্যবোধ, যা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই অসংখ্য মানুষ আত্মত্যাগ করেছিল। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্জন-ব্যর্থতার মূল্যায়নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই মূলত আমাদের মাপকাঠি হওয়া উচিত।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বিতর্ক হয়। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে এটি স্লোগান হিসেবেও ব্যবহূত হয়। অভিযোগ তোলা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এমনকি পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই দলীয়করণের। কিন্তু আসলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো কী?
আমরা মনে করি, সততা, সমতা, একতা, ন্যায়পরায়ণতা, জনকল্যাণ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। এগুলো অর্জনের সম্মিলিত প্রত্যাশার ভিত্তিতেই দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষনির্বিশেষে আমরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যার যা কিছু ছিল, তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছিলাম এবং বিজয়ীও হয়েছিলাম। এসব চেতনা বা মূল্যবোধের অনেকগুলোই আমাদের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু গত ৩৯ বছরে এগুলো কি বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে?
সততার কথায় আসা যাক। পাকিস্তানিদের অনৈতিকতা, অসততা এবং আমাদের প্রতি অবিচারই মুক্তিযুদ্ধের পেছনের অন্যতম কারণ। তাই অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা ছিল, বাংলাদেশ হবে সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে গড়া একটি রাষ্ট্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যায়, অবিচার ও অনৈতিকতাই যেন আমাদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন হয়ে গেছে আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমরা পাঁচ-পাঁচবার পৃথিবীর সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছি। বর্তমানেও এ ক্ষেত্রে আমরা ভালো অবস্থানে নেই। বস্তুত, আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন দিবস পালন উপলক্ষে সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত তিন বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে দুর্নীতির কারণে আমাদের উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দুর্নীতি দূরীকরণে কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমাদের অতীতের কোনো সরকারেরই ছিল না। বরং অনেক সরকারই লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দুর্নীতি দূরীকরণের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এলেও বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। গত দুই বছরে কোনো ‘রুই-কাতলা’কে দুর্নীতির অভিযোগে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কথা আমরা শুনিনি। বরং আইন পরিবর্তন এবং অসহযোগিতার মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অকার্যকর করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া দিনবদলের সনদে ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব প্রদানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার সত্ত্বেও এ পর্যন্ত তা করা হয়নি। প্রণয়ন করা হয়নি আমাদের সাংসদদের জন্য আচরণবিধি, যাতে তাঁরা তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রকাশ করতে বাধ্য হতেন।
সমতা ও ন্যায়ানুগ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পেছনের অন্যতম প্রেরণা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গত ৩৯ বছরে আমরা একটি চরম অসম সমাজে পরিণত হয়েছি। ন্যায়পরায়ণতার ধারণাটি যেন আজ আমাদের কাছে অর্থহীন ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমাগত প্রকটতর হয়েছে। বৈষম্য আর বঞ্চনা আমাদের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের আজ যেন নিত্যদিনের সঙ্গী এবং আয়, সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্যই আমাদের দেশে দারিদ্র্যকে স্থায়িত্ব দিয়েছে। বস্তুত, ধনাঢ্যরাই আজ ‘রুলিং ক্লাসে’ বা রাষ্ট্রের অধিপতিতে পরিণত হয়েছেন এবং প্রায় সব সরকারি সুযোগ-সুবিধাই এখন তাঁদের করায়ত্ত। পুরো রাষ্ট্রই যেন এখন পরিচালিত হয় তাঁদের স্বার্থে এবং তাঁদের স্বার্থপরতা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। জনকল্যাণ এখন নিতান্তই স্লোগান মাত্র। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ এবং তাদের সন্তান হলেও তারা হয়ে গেছে আজ সমাজের উচ্চবিত্তদের করুণার পাত্র। এদের অনেকের জন্য আজ মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। অনেকের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতি আমাদের এক সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল একটি সম্মিলিত প্রত্যাশা এবং তার ভিত্তিতে একতা। শুধু ১৯৭১ সালেই নয়, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও আমাদের পুরো জাতি ছিল একতাবদ্ধ। অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, এমনকি একই ধর্ম হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে আজ আমরা দুটি ক্যাম্পে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এ দুই ক্যাম্পের মধ্যকার বিবাদের অন্যতম কারণ কতগুলো অর্থহীন স্লোগান এবং কৃত্রিম প্রতীক, যার ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে কতগুলো গুরুত্বহীন ইস্যু, যেমন—বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, আপাতত যার কোনো সমাধান নেই। বিভক্ত জাতি বেশি দূর এগোতে পারে না, আমরাও পারিনি।
ধর্মনিরপেক্ষতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হলেও ধর্মকেই অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে জাতিকে বিভক্ত করার এবং সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে। সামরিক শাসকেরা এ অপকর্মের সূচনা করলেও নির্বাচিত সরকারগুলো এ কাজ থেকে বিরত থাকেনি। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার স্বার্থে তারা ধর্মীয় উগ্রবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে, এমনকি তাদের সঙ্গে আঁতাত করতেও দ্বিধা করেনি। আর উগ্রবাদী শক্তি আমাদের প্রধান দুটি ক্যাম্পের মধ্যে বিরাজমান অসহিষ্ণুতামূলক ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির ঘোলা জলে মাছ শিকার করে নিজেদের ক্রমাগত পরিপুষ্ট করেছে। তারা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচারে বাধা দেওয়ার পাঁয়তারা করছে বলে অনেকের অভিযোগ।
গণতন্ত্রের বুলি আওড়াতে আওড়াতে অনেকের মুখে ফেনা উঠলেও নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্র মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতায় গিয়ে দলবাজি, ফায়দাবাজি, ধোঁকাবাজি এবং হরেক রকমের অনৈতিকতা ও অপকর্মের হাতিয়ার হিসেবেই আমাদের দেশে ব্যবহূত হয়েছে। এ ছাড়া আমরা নির্বাচিত সংসদকেন্দ্রিক ‘বড়লোকের গণতন্ত্র’ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। সম্পদ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে ‘লোকাল ডেমোক্রেসি’ বা তৃণমূলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘গরিবের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদের সমাজের অধিপতিদের কোনো আগ্রহই নেই। বলা বাহুল্য, একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার হলেই যেসব সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে, সেগুলোতে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সম্পদ, ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব যত জনগণের দোরগোড়ার সরকারের কাছে যায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণ সম্পৃক্ত হয়, তত তা বেশি তাদের কল্যাণে আসে। আর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘গণতন্ত্র যদি দরিদ্র্র জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থবহ না হয়, তার ভিত্তি দুর্বল থেকে যেতে বাধ্য’ (দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬, পৃ-১৫)। আর এ দুর্বলতার কারণেই আমাদের গণতন্ত্র বারবার খাদে পড়ে যাচ্ছে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আবশ্যক নাগরিকদের অধিকারের স্বীকৃতি, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা এবং কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার পদে পদে ভূলুণ্ঠিত হয়। পদদলিত হয় ব্যক্তিস্বাধীনতা। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা, এমনকি শিষ্টাচার বোধও আজ প্রায় অনুপস্থিত। জাতীয় সংসদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অকার্যকর, যার অন্যতম কারণ বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে এর অপারগতা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিচারালয়, যা আজ দলবাজির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ফলে বিচারের বাণী এখন নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। আর রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র না থাকলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশা করা দুরাশামাত্র। তাই গণতন্ত্র আজ সাধারণ মানুষের জন্য নিতান্তই স্লোগান, এমনকি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ কারণে পতিত স্বৈরাচার পর্যন্ত আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়ে মশকরা করতে সাহস পায়।
পরিশেষে, এ কথা অনস্বীকার্য যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা, যে আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, বহুলাংশে তা অপূর্ণ রয়ে গেছে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতা অর্জনের পর সাধারণত একটি জাতি একাগ্রচিত্তে নিবিষ্ট হয় জাতি গঠনে, যে চেতনার ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তাকে সমুন্নত রেখে, ছোটখাটো ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধভাবে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের বেলায় হয়েছে যেন তার সম্পূর্ণ উল্টো। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও আমরা যেন অযথা এবং অযৌক্তিকভাবে হানাহানিতে লিপ্ত এক কলহপ্রবণ জাতিতে পরিণত হয়েছি। জাতির অগ্রগতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাপরায়ণতাই যেন আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বিকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চার ফলে সমাজে আজ যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে, আমরা জানি না, তার পরিণতি কী। আশা করি, আমাদের দুই নেত্রী, যাঁরা দু-দুবার প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কিংবা করছেন এবং যাঁদের রয়েছে ব্যাপক গণসমর্থন, তাঁরা জানেন, জাতিকে কোন গন্তব্যে তাঁরা নিয়ে যাচ্ছেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতার ৩৯তম বার্ষিকী পালন করলাম। আর কিছুদিন পরই স্বাধীনতার চার দশক পূর্ণ হবে। ৪০ বছর একটি জাতির জীবনে কম সময় নয়। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক অর্জন আমাদের ঘরে ওঠার কথা ছিল। কথা ছিল অনেক সমস্যা সমাধানের। কিন্তু তা কি হয়েছে? জাতি হিসেবে এ প্রশ্নের মুখোমুখি আজ আমাদের হওয়া প্রয়োজন। নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন আমাদের ব্যর্থতার কারণগুলো। তা না হলে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালন শুধু আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে আটকা পড়ে যাবে এবং এর সত্যিকারের ‘ইতিকথা’ আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যাবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এবং অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে। মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ছিল কতগুলো চেতনা ও মূল্যবোধ, যা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই অসংখ্য মানুষ আত্মত্যাগ করেছিল। তাই স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্জন-ব্যর্থতার মূল্যায়নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই মূলত আমাদের মাপকাঠি হওয়া উচিত।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক বিতর্ক হয়। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে এটি স্লোগান হিসেবেও ব্যবহূত হয়। অভিযোগ তোলা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এমনকি পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই দলীয়করণের। কিন্তু আসলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো কী?
আমরা মনে করি, সততা, সমতা, একতা, ন্যায়পরায়ণতা, জনকল্যাণ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। এগুলো অর্জনের সম্মিলিত প্রত্যাশার ভিত্তিতেই দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষনির্বিশেষে আমরা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যার যা কিছু ছিল, তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছিলাম এবং বিজয়ীও হয়েছিলাম। এসব চেতনা বা মূল্যবোধের অনেকগুলোই আমাদের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু গত ৩৯ বছরে এগুলো কি বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে?
সততার কথায় আসা যাক। পাকিস্তানিদের অনৈতিকতা, অসততা এবং আমাদের প্রতি অবিচারই মুক্তিযুদ্ধের পেছনের অন্যতম কারণ। তাই অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা ছিল, বাংলাদেশ হবে সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে গড়া একটি রাষ্ট্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যায়, অবিচার ও অনৈতিকতাই যেন আমাদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন হয়ে গেছে আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমরা পাঁচ-পাঁচবার পৃথিবীর সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছি। বর্তমানেও এ ক্ষেত্রে আমরা ভালো অবস্থানে নেই। বস্তুত, আন্তর্জাতিক দুর্নীতি দমন দিবস পালন উপলক্ষে সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত তিন বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে দুর্নীতির কারণে আমাদের উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দুর্নীতি দূরীকরণে কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমাদের অতীতের কোনো সরকারেরই ছিল না। বরং অনেক সরকারই লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দুর্নীতি দূরীকরণের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এলেও বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। গত দুই বছরে কোনো ‘রুই-কাতলা’কে দুর্নীতির অভিযোগে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কথা আমরা শুনিনি। বরং আইন পরিবর্তন এবং অসহযোগিতার মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অকার্যকর করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া দিনবদলের সনদে ক্ষমতাধরদের সম্পদের হিসাব প্রদানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার সত্ত্বেও এ পর্যন্ত তা করা হয়নি। প্রণয়ন করা হয়নি আমাদের সাংসদদের জন্য আচরণবিধি, যাতে তাঁরা তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রকাশ করতে বাধ্য হতেন।
সমতা ও ন্যায়ানুগ একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পেছনের অন্যতম প্রেরণা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গত ৩৯ বছরে আমরা একটি চরম অসম সমাজে পরিণত হয়েছি। ন্যায়পরায়ণতার ধারণাটি যেন আজ আমাদের কাছে অর্থহীন ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমাগত প্রকটতর হয়েছে। বৈষম্য আর বঞ্চনা আমাদের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের আজ যেন নিত্যদিনের সঙ্গী এবং আয়, সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্যই আমাদের দেশে দারিদ্র্যকে স্থায়িত্ব দিয়েছে। বস্তুত, ধনাঢ্যরাই আজ ‘রুলিং ক্লাসে’ বা রাষ্ট্রের অধিপতিতে পরিণত হয়েছেন এবং প্রায় সব সরকারি সুযোগ-সুবিধাই এখন তাঁদের করায়ত্ত। পুরো রাষ্ট্রই যেন এখন পরিচালিত হয় তাঁদের স্বার্থে এবং তাঁদের স্বার্থপরতা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। জনকল্যাণ এখন নিতান্তই স্লোগান মাত্র। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ এবং তাদের সন্তান হলেও তারা হয়ে গেছে আজ সমাজের উচ্চবিত্তদের করুণার পাত্র। এদের অনেকের জন্য আজ মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। অনেকের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতি আমাদের এক সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল একটি সম্মিলিত প্রত্যাশা এবং তার ভিত্তিতে একতা। শুধু ১৯৭১ সালেই নয়, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও আমাদের পুরো জাতি ছিল একতাবদ্ধ। অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, এমনকি একই ধর্ম হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে আজ আমরা দুটি ক্যাম্পে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। এ দুই ক্যাম্পের মধ্যকার বিবাদের অন্যতম কারণ কতগুলো অর্থহীন স্লোগান এবং কৃত্রিম প্রতীক, যার ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে কতগুলো গুরুত্বহীন ইস্যু, যেমন—বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, আপাতত যার কোনো সমাধান নেই। বিভক্ত জাতি বেশি দূর এগোতে পারে না, আমরাও পারিনি।
ধর্মনিরপেক্ষতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হলেও ধর্মকেই অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে জাতিকে বিভক্ত করার এবং সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে। সামরিক শাসকেরা এ অপকর্মের সূচনা করলেও নির্বাচিত সরকারগুলো এ কাজ থেকে বিরত থাকেনি। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার স্বার্থে তারা ধর্মীয় উগ্রবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে, এমনকি তাদের সঙ্গে আঁতাত করতেও দ্বিধা করেনি। আর উগ্রবাদী শক্তি আমাদের প্রধান দুটি ক্যাম্পের মধ্যে বিরাজমান অসহিষ্ণুতামূলক ও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির ঘোলা জলে মাছ শিকার করে নিজেদের ক্রমাগত পরিপুষ্ট করেছে। তারা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচারে বাধা দেওয়ার পাঁয়তারা করছে বলে অনেকের অভিযোগ।
গণতন্ত্রের বুলি আওড়াতে আওড়াতে অনেকের মুখে ফেনা উঠলেও নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্র মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতায় গিয়ে দলবাজি, ফায়দাবাজি, ধোঁকাবাজি এবং হরেক রকমের অনৈতিকতা ও অপকর্মের হাতিয়ার হিসেবেই আমাদের দেশে ব্যবহূত হয়েছে। এ ছাড়া আমরা নির্বাচিত সংসদকেন্দ্রিক ‘বড়লোকের গণতন্ত্র’ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। সম্পদ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে ‘লোকাল ডেমোক্রেসি’ বা তৃণমূলের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘গরিবের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদের সমাজের অধিপতিদের কোনো আগ্রহই নেই। বলা বাহুল্য, একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার হলেই যেসব সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে, সেগুলোতে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সম্পদ, ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব যত জনগণের দোরগোড়ার সরকারের কাছে যায় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণ সম্পৃক্ত হয়, তত তা বেশি তাদের কল্যাণে আসে। আর আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘গণতন্ত্র যদি দরিদ্র্র জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থবহ না হয়, তার ভিত্তি দুর্বল থেকে যেতে বাধ্য’ (দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬, পৃ-১৫)। আর এ দুর্বলতার কারণেই আমাদের গণতন্ত্র বারবার খাদে পড়ে যাচ্ছে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আবশ্যক নাগরিকদের অধিকারের স্বীকৃতি, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা এবং কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে সাধারণ নাগরিকদের অধিকার পদে পদে ভূলুণ্ঠিত হয়। পদদলিত হয় ব্যক্তিস্বাধীনতা। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা, এমনকি শিষ্টাচার বোধও আজ প্রায় অনুপস্থিত। জাতীয় সংসদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ অকার্যকর, যার অন্যতম কারণ বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে এর অপারগতা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিচারালয়, যা আজ দলবাজির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ফলে বিচারের বাণী এখন নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। আর রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্র না থাকলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশা করা দুরাশামাত্র। তাই গণতন্ত্র আজ সাধারণ মানুষের জন্য নিতান্তই স্লোগান, এমনকি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ কারণে পতিত স্বৈরাচার পর্যন্ত আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়ে মশকরা করতে সাহস পায়।
পরিশেষে, এ কথা অনস্বীকার্য যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা, যে আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, বহুলাংশে তা অপূর্ণ রয়ে গেছে। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, স্বাধীনতা অর্জনের পর সাধারণত একটি জাতি একাগ্রচিত্তে নিবিষ্ট হয় জাতি গঠনে, যে চেতনার ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, তাকে সমুন্নত রেখে, ছোটখাটো ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধভাবে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের বেলায় হয়েছে যেন তার সম্পূর্ণ উল্টো। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও আমরা যেন অযথা এবং অযৌক্তিকভাবে হানাহানিতে লিপ্ত এক কলহপ্রবণ জাতিতে পরিণত হয়েছি। জাতির অগ্রগতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাপরায়ণতাই যেন আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বিকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চার ফলে সমাজে আজ যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে, আমরা জানি না, তার পরিণতি কী। আশা করি, আমাদের দুই নেত্রী, যাঁরা দু-দুবার প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন কিংবা করছেন এবং যাঁদের রয়েছে ব্যাপক গণসমর্থন, তাঁরা জানেন, জাতিকে কোন গন্তব্যে তাঁরা নিয়ে যাচ্ছেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
No comments