মুক্তিযুদ্ধ- মহান মুক্তিযুদ্ধঃ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি by গাউসুর রহমান

দেশপ্রেমিক মানুষের শিরায় শিরায় প্রবাহিত মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতির সামনে খুলে গিয়েছিলো এক স্বর্ণদুয়ার। সে দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে আমরা যুগসঞ্চিত জঞ্জাল ও পরাধীনতার দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম সুখী, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরও স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেয়া সম্ভব হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত এবং বস্তুগত_এই দু'টি উদ্দেশ্যের কোনোটারই বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারি না আমরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিক সাফল্য আসলেও তা স্বপ্নপূরণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক মুক্তি জাতির জন্য এখনও স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণের কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
পরাধীনতা থেকে মুক্ত হলেও জাতির ভাগ্য নির্ধারণে এখনও পরাশক্তি অন্যায় হস্তক্ষেপ করে বিভিন্নভাবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৈদেশিক শক্তি এবং দাতাগোষ্ঠী অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে। আমরা বিনা প্রতিবাদে তা মেনেও নেই। জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারিত করতে পারিনি আমরা। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় আমরা কবে উত্তীর্ণ হতে পারবো, কে জানে?
আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি নীতিহীন। ব্যক্তিস্বার্থ থেকে দেশ-জাতির স্বার্থকে আমরা এখনও বড় করে দেখতে অভ্যস্ত নই। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী-সুবিধাভোগী শ্রেণী এখনও সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুস্থরূপ নেই, পরমত সহিষ্ণুতার বড়ই অভাব। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সদিচ্ছার অভাবে যে প্রশ্নটিকে সামনে আনে, সেটি হচ্ছে আমরা কী সত্যিই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালোবাসি? মাতৃভূমির জন্য আমাদের দেশপ্রেম কী যথেষ্ট?
দারিদ্র্য বিমোচনের বিপরীতে দারিদ্র্যের আপাতন দিনে বাড়ছে। এখনও দেশের উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। ধনী-গরীবের বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে। মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার থেকে দেশের মানুষ বছরের পর বছর বঞ্চিত। কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করায় দ্রব্যমূল্যের ঊধর্্বগতি কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বরং দফায় দফায় লাফিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। বাড়ছে জীবন-যাত্রার ব্যয়।
পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, পানি দূষণ, মনোদূষণ _শুধু দূষণ আর দূষণ। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে শাসনের নামে শোষণ। ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। কিন্তু শোষণ থামে না, শোষণের মাত্রা কমে না, শাসকের কণ্ঠস্বর বদলায় না। রাজনীতিবিদ আদর্শ বিচু্যত হচ্ছে বার বার। ফলে নীতিহীন রাজনীতি আমাদের দেশটিকে আদর্শগত কিংবা বস্তুগত কোনোভাবেই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না। রাজনীতিবিদগণ দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি, কর্মসূচি, অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করেন না। রাজনীতিবিদদের এ মনোভাব পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের চেতনা নিয়ে নিজের আখের গোছানোর প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে জনকল্যাণে নিবেদিত হতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও মনে রাখতে হবে যে, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তাঁরা বেতন পান। আর তাই জনস্বার্থের অনুকূলে কাজ করতে হবে তাদের- কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা দলের অনুকূলে নয়। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ধনিক শ্রেণী তথা সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকে ঘুষ, দুনর্ীতি, অনিয়মের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সকল ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বেকার সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ ও কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। সেই কর্মসূচির বাস্তবায়নও করতে হবে। ধনী-গরীবের ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্যে শিল্প, কল-কারখানার উৎপাদন, দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ভূমি সংস্কারের জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে হবে। শহরমুখী জনসে াত কমানোর পাশাপাশি গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়াতে হবে। নাগরিক সুবিধা জনগণের অধিকার। সে অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত তথ্যসেবা নিশ্চিত ও সহজ করতে হবে। রাজনৈতিক দুবর্ৃত্তায়ন রোধ করার পাশাপাশি সমাজ জীবনের ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। নিজস্ব সংস্কৃতির লালন, চর্চা, বিকাশে আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অপসংস্কৃতির কবল থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। তবেই অবকাঠামোগত ও উপরি-কাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জাতীয় জীবনের মূল-প্রণোদন মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম। আমাদের স্বাধীনতা দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তির সঙ্গে যাতে একাত্ম হতে পারে, সেজন্যে আমাদের সকলকে যার-যার অবস্থানে থেকে কাজ করে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে কেউ যেন অবনমনের ঘৃণ্য ও দুঃসাহস দেখাতে না পারে, সেজন্যে আমরা সকলেই আপোষহীন থাকবো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক জীবনেকে যেন জারিত করে নেয়।
========================
রহস্যের পর্দা সরিয়ে দ্যুতিময় এমিলি ডিকিনসন  বেগম রোকেয়াঃ নারী জাগরণের বিস্ময়কর প্রতিভা  শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট  বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ গাউসুর রহমান
কবি, প্রাবন্ধিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.