পবিত্র আশুরার তাৎপর্য ও কারবালার চেতনা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
ইসলামের ইতিহাসে আরবি চান্দ্রবছর, তথা হিজরি সালের মহররম মাসের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরা ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যময় দিবস। বিশেষত, এদিন ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত স্মৃতিবিজড়িত কারবালার শোকাবহ, হূদয়বিদারক ও বিষাদময় ঘটনা সংঘটিত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ/৬১ হিজরি সালে আশুরার দিনেই ইরাকের কুফা নগরের অদূরে ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী স্বৈরশাসক ইয়াজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ও পরিবেষ্টিত হয়ে পরিবার-পরিজন এবং ৭২ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। সব বয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক তৃষ্ণার্ত নারী-পুরুষ, শিশুরা এক বিন্দু পানি থেকে বঞ্চিত হয়ে অমানবিক অবস্থায় কারবালার অন্যায়-অসম যুদ্ধে এবং শিশুপুত্র তাঁর কোলেই শত্রুর নিক্ষিপ্ত বিষাক্ত তীরের আঘাতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ বিসর্জন দেন। পরিশেষে ইমাম হোসাইন (রা.) আহত অবস্থায় একাকীই শত্রুবাহিনীর ওপর বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অসীম সাহসিকতার সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হন। আধিপত্যবাদ, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সুমহান আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের এ ঘটনার স্মরণে মুসলমানরা প্রধানত আশুরা পালন করে থাকেন। ইতিহাসের এই জঘন্য ও বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতার বেদনা কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামের অনুসারীরা বিস্মৃত হবেন না।
প্রাচীনকাল থেকে যুগে যুগে পবিত্র আশুরা দিবসে ঐতিহাসিক বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির কাজ এদিনই সম্পন্ন করেন। হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়াতে আগমন করেন এবং এদিনেই তাঁর তওবা কবুল হয়। ১০ মহররমে হজরত নূহ (আ.)-এর কিশতি মহাপ্লাবনের কবল থেকে রক্ষা পায়। হজরত দাউদ (আ.)-এর তওবা কবুল হয়। হজরত মূসা (আ.) ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি পান এবং ফিরাউন সদলবলে নীল নদে নিমজ্জিত হয়। এ পবিত্র আশুরার দিন হজরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের আগুন থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সেরে ওঠেন। হজরত ঈসা (আ.)-কে ঊর্ধ্বাকাশে উত্তোলন করার ঘটনাও পবিত্র আশুরার দিনে ঘটেছিল। ১০ মহররম আশুরা দিবসে কিয়ামত সংঘটিত হবে বলেও বর্ণিত আছে।
ইসলামের ইতিহাসে আশুরা দিবস বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতই এ দিবসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পবিত্র আশুরা দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালায় অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। তিনি অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনবাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাই কারবালা আমাদের অনুপ্রাণিত করে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে।
কারবালার এহেন অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হূদয়বিদারক ঘটনা থেকে মানবগোষ্ঠীর জন্য ইসলামের দৃষ্টিতে যেসব শিক্ষা রয়েছে, তন্মধ্যে প্রধান হচ্ছে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন, তবু ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। খিলাফতকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরে ইয়াজিদের ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ও মহান শিক্ষা রেখে গেছেন।
অত্যাচারী ইয়াজিদ মানুষের জীবনের আনন্দকে হত্যা করতে চেয়েছে, পবিত্রতাকে কলুষিত করতে চেয়েছে। পাষাণ হূদয় সীমারের খঞ্জর হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শিরশ্ছেদ করলেও মানুষের মহত্ত্ব, উদারতা, মহানুভবতা এবং পবিত্র ধ্যান-ধারণাকে হত্যা করতে পারেনি। ন্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ, এমনকি সত্যের পথে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্তরূপে আশুরা অনাগত যুগ-যুগান্তর ধরে সব মানুষের কাছে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য হবে।
ঐতিহাসিক ১০ মহররম চিরকাল বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যই কারবালায় নবী বংশের আত্মত্যাগ হয়েছিল। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতালিপ্সা ও লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের শাশ্বত নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত করলেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। তাই যথার্থই বলা হয়, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কি বাদ’ ইসলাম জীবিত হয় প্রতি কারবালার পর।
প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির জন্য অন্যায়কারীর সাময়িক বিজয় ইতিহাসে কোনো দিনই মর্যাদা পায়নি। জালিমের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা প্রবল এবং শাহাদাতবরণকারী হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও ইতিপূর্বে বিষ প্রয়োগে নিহত হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর প্রতি অপার শ্রদ্ধা-ভক্তি পবিত্র এই দিনটিতে পরিলক্ষিত হয়। সত্যের জন্য শাহাদাতবরণের এ অনন্য দৃষ্টান্ত সব আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে এর অন্তর্গত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ১০ মহররমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। পবিত্র আশুরা দিবসে কারবালার শিক্ষা হলো, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামীদের সামনে প্রতিপক্ষের তরফ থেকে কোনো সময় অর্থ, বিত্ত ও সম্মানের লোভনীয় প্রস্তাব এলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে আপসহীন মনোভাবের মাধ্যমে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী তাই আমাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
পবিত্র আশুরা এ মহান শিক্ষা দিয়েছে যে সত্য কখনো অবনত শির হতে জানে না। বস্তুত, কারবালা ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণতন্ত্রের। ইসলামি আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.); কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আপস করেননি। জীবনের চেয়ে সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য নবী-দৌহিত্রের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ জগতের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বিরল ঘটনা। কারবালার ঘটনায় চিরন্তন সত্যের মহাবিজয় হয়েছিল এবং বাতিলের পরাজয় ঘটেছিল। সুতরাং আশুরার এ মহিমান্বিত দিনে শুধু শোক বা মাতম নয়, প্রতিবাদের সংগ্রামী চেতনা নিয়ে হোক চির সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ। কারবালার কথকতা শুধু শোকের কালো দিবসই নয়, এর মধ্যে সুপ্ত রয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কঠিন শপথ নেওয়ার সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা।
মহররমের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত শিক্ষা অন্যায়-অবিচার-অসত্য ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সব সময় রুখে দাঁড়ানো। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই হোক কারবালার মূলমন্ত্র। পবিত্র আশুরা দিবসে কারবালার ত্যাগের শিক্ষা, অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার শিক্ষা আমাদের চিরন্তন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত। তাই মর্সিয়া ক্রন্দন নয়, কারবালার বাস্তব শিক্ষা, অর্থাৎ সত্যের জন্য আত্মত্যাগের যে অতুলনীয় শিক্ষা, তা সাদরে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’। আশুরার উদ্দীপ্ত চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হোক এবং সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার, হিংস্রতা-নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-কলহ দূরীভূত হয়ে সারা বিশ্বে শান্তি ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠিত হোক। আসুন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে আমরা সবাই মিলেমিশে কারবালার সুমহান আদর্শের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যায়-অবিচার, জুলুম, নিপীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রাচীনকাল থেকে যুগে যুগে পবিত্র আশুরা দিবসে ঐতিহাসিক বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির কাজ এদিনই সম্পন্ন করেন। হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়াতে আগমন করেন এবং এদিনেই তাঁর তওবা কবুল হয়। ১০ মহররমে হজরত নূহ (আ.)-এর কিশতি মহাপ্লাবনের কবল থেকে রক্ষা পায়। হজরত দাউদ (আ.)-এর তওবা কবুল হয়। হজরত মূসা (আ.) ফিরাউনের কবল থেকে মুক্তি পান এবং ফিরাউন সদলবলে নীল নদে নিমজ্জিত হয়। এ পবিত্র আশুরার দিন হজরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের আগুন থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে সেরে ওঠেন। হজরত ঈসা (আ.)-কে ঊর্ধ্বাকাশে উত্তোলন করার ঘটনাও পবিত্র আশুরার দিনে ঘটেছিল। ১০ মহররম আশুরা দিবসে কিয়ামত সংঘটিত হবে বলেও বর্ণিত আছে।
ইসলামের ইতিহাসে আশুরা দিবস বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতই এ দিবসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পবিত্র আশুরা দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালায় অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। তিনি অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনবাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাই কারবালা আমাদের অনুপ্রাণিত করে অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে।
কারবালার এহেন অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হূদয়বিদারক ঘটনা থেকে মানবগোষ্ঠীর জন্য ইসলামের দৃষ্টিতে যেসব শিক্ষা রয়েছে, তন্মধ্যে প্রধান হচ্ছে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন, তবু ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। খিলাফতকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরে ইয়াজিদের ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ও মহান শিক্ষা রেখে গেছেন।
অত্যাচারী ইয়াজিদ মানুষের জীবনের আনন্দকে হত্যা করতে চেয়েছে, পবিত্রতাকে কলুষিত করতে চেয়েছে। পাষাণ হূদয় সীমারের খঞ্জর হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শিরশ্ছেদ করলেও মানুষের মহত্ত্ব, উদারতা, মহানুভবতা এবং পবিত্র ধ্যান-ধারণাকে হত্যা করতে পারেনি। ন্যায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ, এমনকি সত্যের পথে লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করে দেওয়ার অপূর্ব দৃষ্টান্তরূপে আশুরা অনাগত যুগ-যুগান্তর ধরে সব মানুষের কাছে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য হবে।
ঐতিহাসিক ১০ মহররম চিরকাল বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যই কারবালায় নবী বংশের আত্মত্যাগ হয়েছিল। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতালিপ্সা ও লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের শাশ্বত নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত করলেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। তাই যথার্থই বলা হয়, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর কারবালা কি বাদ’ ইসলাম জীবিত হয় প্রতি কারবালার পর।
প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির জন্য অন্যায়কারীর সাময়িক বিজয় ইতিহাসে কোনো দিনই মর্যাদা পায়নি। জালিমের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা প্রবল এবং শাহাদাতবরণকারী হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও ইতিপূর্বে বিষ প্রয়োগে নিহত হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর প্রতি অপার শ্রদ্ধা-ভক্তি পবিত্র এই দিনটিতে পরিলক্ষিত হয়। সত্যের জন্য শাহাদাতবরণের এ অনন্য দৃষ্টান্ত সব আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে এর অন্তর্গত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ১০ মহররমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। পবিত্র আশুরা দিবসে কারবালার শিক্ষা হলো, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামীদের সামনে প্রতিপক্ষের তরফ থেকে কোনো সময় অর্থ, বিত্ত ও সম্মানের লোভনীয় প্রস্তাব এলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে আপসহীন মনোভাবের মাধ্যমে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী তাই আমাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।
পবিত্র আশুরা এ মহান শিক্ষা দিয়েছে যে সত্য কখনো অবনত শির হতে জানে না। বস্তুত, কারবালা ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণতন্ত্রের। ইসলামি আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.); কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আপস করেননি। জীবনের চেয়ে সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য নবী-দৌহিত্রের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ জগতের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বিরল ঘটনা। কারবালার ঘটনায় চিরন্তন সত্যের মহাবিজয় হয়েছিল এবং বাতিলের পরাজয় ঘটেছিল। সুতরাং আশুরার এ মহিমান্বিত দিনে শুধু শোক বা মাতম নয়, প্রতিবাদের সংগ্রামী চেতনা নিয়ে হোক চির সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ। কারবালার কথকতা শুধু শোকের কালো দিবসই নয়, এর মধ্যে সুপ্ত রয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কঠিন শপথ নেওয়ার সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা।
মহররমের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত শিক্ষা অন্যায়-অবিচার-অসত্য ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সব সময় রুখে দাঁড়ানো। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই হোক কারবালার মূলমন্ত্র। পবিত্র আশুরা দিবসে কারবালার ত্যাগের শিক্ষা, অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার শিক্ষা আমাদের চিরন্তন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত। তাই মর্সিয়া ক্রন্দন নয়, কারবালার বাস্তব শিক্ষা, অর্থাৎ সত্যের জন্য আত্মত্যাগের যে অতুলনীয় শিক্ষা, তা সাদরে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’। আশুরার উদ্দীপ্ত চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হোক এবং সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার, হিংস্রতা-নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-কলহ দূরীভূত হয়ে সারা বিশ্বে শান্তি ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠিত হোক। আসুন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে আমরা সবাই মিলেমিশে কারবালার সুমহান আদর্শের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যায়-অবিচার, জুলুম, নিপীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments