আলোচনা- শিক্ষারমান ও সমকালীন প্রেক্ষাপট by দেওয়ান আযাদ রহমান

শিক্ষা মানুষের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করে, মেধা ও মননশীলতার বিকাশ ঘটায়, কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দৃষ্টি ভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটায়। দেশের বিরাট জনশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার মূল হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার সার্বিক ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের ধারা বিকশিত হয়। এ জন্য প্রয়োজন বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যবহার। তাই শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত হওয়া খুবই প্রয়োজন।
ইউনেস্কো গুণগত শিক্ষাকে একটি রাষ্ট্রের জনগণের দৃষ্টিপট, সমাজে বাস্তবে রূপদান সামর্থ্যতা বাড়িয়ে টেকসই উন্নয়ন সাধনের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে অখ্যায়িত করেছেন। মানসম্মত শিক্ষা শিক্ষার্থীর জ্ঞান, জীবন দক্ষতা ও পরিপ্রেক্ষিতে, দৃষ্টিভঙ্গী ও মূল্যবোধ বিকশিত করে। এ শিক্ষা অস্থির সমাজকে স্থিতিশীল সমাজে রূপান্তরের উপাদান সৃষ্টি করে। এ শিক্ষা মানুষের মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়, নীতিবোধ ও মূল্যবোধ জাগ্রত করে। এ শিক্ষা মানুষকে আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা এ লক্ষ্যে অর্জিত হচ্ছে কিনা তা সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক কেন্দ্রিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের দিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। সিলেবাসের বিশালতা, পাঠ্য বিষয়ের জটিল, অস্বচ্ছ ও অনাকর্ষণীয় লেখন পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতির ত্রুটি এবং পাঠদানে নিষ্ঠার প্রচণ্ড অভাব আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে জরাগ্রস্থ করেছে। স্পুনফিডিং, নিয়ন্ত্রিত পড়াশোনা, কোচিং সেন্টারের টেকনিক ইত্যাদি কারণে ভাল নম্বর পেয়ে যাচ্ছে কিন্তু শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ শিখছে না। অপরদিকে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদন থেকে বঞ্চিত হয়ে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে গড়ে উঠছে। এ কারণে সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ও নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটছে না। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অব্যবস্থাপনার অনুপ্রবেশ ঘটছে। শিক্ষার্থীরা পরিণত বয়সে নৈতিক শিক্ষার অপরিপূর্ণতার কারণে দুর্নীতিসহ নানাবিধ খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইন করেও ইভটিজিং বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পত্র পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হচ্ছে। সেমিনার সিম্পোজিয়ামসহ নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও এর প্রতিকার সম্ভব হচ্ছে না। এর মূল কারণ শিক্ষার গুণগত মান ও নৈতিক শিক্ষার বিকাশ নিশ্চিত না হওয়া। তাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা ও সমাজের অস্থিরতা দূরীকরণের জন্য শিক্ষার গুণগত মান ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্বের পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের প্রতিটি স্তরে নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য উপাদানসমূহ হল (ক) আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, (খ) পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক, (গ) প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষাদান সামগ্রী ও ভৌত অবকাঠামো, (ঘ) যথার্থ শিক্ষণ- শিখন পদ্ধতি, (ঙ) কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান, (চ) গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ, (ছ) উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি, (জ) ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার পরিমাণগত দিক কিছুটা অর্জিত হলেও এর গুণগত দিকে এখনও উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনের মান অত্যন্ত হতাশ ব্যঞ্জক। মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থাও প্রাথমিক শিক্ষার মত। মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ: বাড়লেও গুণগতমান হতাশাজনক অবস্থায় রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনে বাংলাদেশ দারুণভাবে পিছিয়ে আছে। মাদ্রাসা শিক্ষাতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রেও হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজমান। বস্তুতপক্ষে সকল স্তরে শিক্ষাতেই তাত্তি্বক ধারাটি প্রাধান্য বিস্তার করছে। শিক্ষার্থী জীবন কেন্দ্রিক ও সমাজ উন্নয়ন সহযোগী শিক্ষাধারা বাংলাদেশে এখনও বেগমান হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় বেকার সৃষ্টির কারখানায় পরিণত হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতির পেছনে অনেকগুলো কারণ জড়িয়ে আছে। গুণগত শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পূর্বশর্তগুলো বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব লাভ করছে না। মেধাবী শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি সম্ভব নয়। মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে তাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক নিশ্চয়তা না থাকলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আকৃষ্ট হতে চান না, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী ছাত্ররা বিভিন্ন পেশায় চলে যান। তার অন্যতম কারণ শিক্ষকতা পেশায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা, চাকরির নিরাপত্তাহীনতা আর সামাজিক অমর্যাদা। তাই মেধাশূন্য শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। শিক্ষকদের মানসম্মত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা আবশ্যক। যুক্তিসঙ্গত শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ও শিক্ষকদের যুক্তিসঙ্গত বেতনভাতা প্রদান করতে হবে এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের সময়োপযোগী শিক্ষক প্রশিক্ষণ চালু রাখা, যথাযথ মনিটরিং ও ফিডব্যাগ শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য খুবই প্রয়োজন। উন্নত একাডেমিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ থাকা জরুরী। পৃথিবীর অনেক দেশেই মাঠবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কল্পনা করা যায় না। শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক, অভিভাবক, ছাত্র ত্রিমুখী প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া সচল রাখতে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক নিবিড়তর হতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘন ঘন একাডেমিক তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং গ্রামীণ ও শহরে শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য দূর করতে হবে। জীবনমুখী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রমের কপি প্রেরণ করা প্রয়োজন। সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের পরামর্শকমে প্রয়োজন শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে যুগোপযোগী করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের সাথে সম্পূরক শিখন সামগ্রী ব্যবহার করা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষা উপকরণ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অপরিকল্পিত ও অবিবেচনা প্রসূত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রশ্ন পদ্ধতি: ক্রটি শিক্ষার ক্রমাবনতির জন্য দায়ী। গঠনকালীন ও চূড়ান্ত উভয় ধরনের মূল্য যাচাইয়ে যথোপযুক্ত, পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। শিক্ষার্থীর কৃতিত্বমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ফিডব্যাক প্রদান, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর জন্য নিরাময়মূলক শিক্ষণ ও শিক্ষার্থীকে পরামর্শ সেবা প্রদান করা প্রয়োজন। সমাজ চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষানীতি প্রণয়নের উপর শিক্ষার মান নির্ভর করে। সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত শিক্ষানীতিতে তথ্য প্রযুক্তিসহ বেশ কিছু যুগোপযোগী সুপারিশ করা হয়েছে যা সর্বস্তরের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পদ্ধতি যা শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। স্বচ্ছ ও গতিশীল প্রশাসন ব্যবস্থা, পেশাজীবীদের দায়িত্ব পালনে সুযোগ সৃষ্টি ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ রাখতে হবে। শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও বরাদ্দকৃত অর্থ যথাযথভাবে খরচ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
=============================
বিজয় দিবসঃ অর্জন ও সম্ভাবনা  একটি ট্রেন জার্নির ছবি ও মাইকেলের জীবন দর্শন  ডক্টর ইউনূসকে নিয়ে বিতর্ক  উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনা  বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন  ক্ষুদ্রঋণ ও বাংলাদেশের দারিদ্র্য  শেয়ারবাজারে লঙ্কাকাণ্ড  মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার  শক্ত ভিত ছাড়া উঁচু ভবন হয় না  ট্রেন টু বেনাপোল  বনের নাম দুধপুকুরিয়া  নথি প্রকাশ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার অ্যাসাঞ্জের  ছিটমহলবাসীর নাগরিক অধিকার  শিক্ষা আসলে কোনটা  জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ দেওয়ান আযাদ রহমান
গবেষক ও প্রবন্ধকার


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.