আলোচনা- মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব? by শফিউল আলম ভুইয়া

সাম্প্রতিক কালে একটি বিষয় কানে আসছে। বিষয়টি বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে একটি মধ্যবিত্তশ্রেণীর উত্থান ঘটেছে। এর প্রমাণ হচ্ছে, রাজধানীর অভিজাত হোটেলগুলোতে খাবারের জন্য এমনকি ইফতারের জন্য অসংখ্য মানুষের ভিড়, কারও কারও জায়গা না পেয়ে ফিরে যাওয়া, ঈদ বা ছুটি কাটানোর উদ্দেশে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এবং দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ।
এই ভ্রমণকারীর সংখ্যার স্ফীতি এমন মাত্রায় ঘটেছে যে এটি চোখে পড়ার মতো। এই মধ্যবিত্তের অনেকেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী। এ লক্ষণগুলোকে যদি সত্য হিসেবে ধরি, তবে কি আমরা দাবি করতে পারি যে বাংলাদেশে একটি মধ্যবিত্তশ্রেণীর উত্থান হয়েছে? না, আমরা তা পারি না।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতাই এ ধরনের উপসংহার টানতে আমাদের বাধা দেয়। আমরা আসলে বলতে পারি, বাংলাদেশে একটি ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। আমরা কনজ্যুমার ক্যাপিটালিজম বা ভোক্তা পুঁজিবাদের পথে যাত্রা শুরু করেছি জোরকদমে। উপরিউক্ত লক্ষণগুলো এ যাত্রারই খণ্ড খণ্ড প্রমাণ। আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, কেন আমি এভাবে ভাবছি?
প্রথমেই শুরু করি মধ্যবিত্ত শ্রেণীধারণাটির তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীধারণাটির তাত্ত্বিক ভিত্তি একটু নড়বড়ে। শ্রেণীধারণার যিনি পুরোধা, যিনি অনেকের কাছে নন্দিত ও অনেকের দ্বারা নিন্দিত, সেই কার্ল মার্ক্স আসলে দুটি শ্রেণীর কথা বলেছিলেন, মালিকশ্রেণী বা শাসকশ্রেণী ও শ্রমিকশ্রেণী বা শোষিতশ্রেণী। মার্ক্সের শ্রেণীধারণার বিশ্লেষণ ও ব্যবহারিক প্রয়োগ আলোচনা করে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেইবার মধ্যবিত্ত-মধ্যবর্তী শ্রেণীর কথা জোরেশোরে বলেছেন। ভেইবার যুক্তি দেন, শুধু দুটি শ্রেণী বিশ্লেষণের মধ্যে একটি সমাজের সব মানুষকে ফেলা যায় না। মার্ক্সের শ্রেণীধারণাটি আবর্তিত হয়েছে উৎপাদনপদ্ধতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। যাঁরা উৎপাদনপদ্ধতির মালিক, তাঁরা শাসকশ্রেণী আর যাঁরা এই উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় শ্রম বিক্রি করেন, তাঁরা শ্রমিক। কিন্তু সমাজে এমন অনেক লোক থাকেন, যাঁরা উৎপাদনপদ্ধতির মালিকও নন আবার শ্রমও বিক্রি করেন না—তাঁরা কোন শ্রেণীতে পড়বেন? বিষয়টি সমাধানের জন্যই মধ্যবিত্ত শ্রেণীধারণাটি উদ্ভূত।
তবে যাঁরা পরবর্তী সময়ে মার্ক্সের চিন্তাচেতনায় কাজ করেছেন, তাঁদের অনেকেই আবার শ্রেণীধারণাটি পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরা মনে করিয়ে দেন যে শ্রেণীধারণাটির সঙ্গে ব্যক্তিচেতনার বিষয়টিও জড়িত। মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একজন ব্যক্তি কলকারখানায় শ্রম বিক্রি করলে তিনি শ্রমিক। তাঁকে শ্রমিকশ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে তাঁর শ্রেণীচেতনা থাকতে হবে। চেতনার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিলে মধ্যবিত্তশ্রেণীর সদস্যদের মার্ক্সের দুটি শ্রেণীর যেকোনোটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
মার্ক্স বা ভেইবার যখন শ্রেণী নিয়ে লিখেছেন, সেই থেকে মানবসমাজ অনেক পথ অতিক্রম করেছে। পুঁজিবাদের ধরনে এসেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন। বর্তমান পুঁজিবাদকে বলা হচ্ছে ভোক্তা-পুঁজিবাদ। আর সমাজ হচ্ছে ভোক্তা-পুঁজিবাদী সমাজ। যেখানে সবাই ভোক্তা এবং বাজারের কাজ হচ্ছে ভোক্তার চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা অনুসারে পণ্য সরবরাহ করা। এই ভোক্তা-পুঁজিবাদ বিশ্বায়নের অংশ হিসেবে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সারা দুনিয়ায় বিস্তৃত হয়েছে।
বাংলাদেশে এর বিস্তার শুরু হয়েছে নব্য উদারবাদী অর্থনৈতিক ধ্যানধারণার চর্চা থেকে, যা দুই দশক ধরে বেশ জোরেশোরেই চলছে। এই ধ্যানধারণার মূলে রয়েছে দুটি প্রক্রিয়া—প্রাইভেটাইজেশন বা রাষ্ট্রের মালিকানাধীন সম্পদ, যেমন কলকারখানা নামমাত্র মূল্যে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া ও ব্যক্তিমালিকানার বিকাশ ঘটানো এবং লিবারেলাইজেশন বা বাজারকে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীর জন্য উন্মুক্ত করা। এ দুটি প্রক্রিয়া সুচারুরূপে পরিচালনা করাই রাষ্ট্রের মূল কাজ। এ দুটি প্রক্রিয়ার প্রভাবে আমাদের সমাজে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে এটি হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিকাশ, এগুলোতে চাকুরের সংখ্যাবৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পদের সংকোচন ও তার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের বেকার হয়ে যাওয়া এবং প্রধানত ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের চাকুরেদের শেয়ারবাজারের ফুলেফেঁপে ওঠা।
এ অর্থনৈতিক পরিবর্তনগুলোর সমান্তরালে ব্যক্তিমালিকানাধীন দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো, যাদের অনুষ্ঠানসূচির একটি বড় অংশজুড়েই থাকে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের এটা-ওটা কিনতে বলে। আমাদের ভোক্তা বানাতে চায়। কেননা, পুঁজিবাদের হাত ধরেই সমাজে ভোক্তা তৈরির জন্য বিজ্ঞাপনকলার জন্ম হয়েছিল। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ তার আয়ের তারতম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন মাত্রায় ভোগ করে। কেউ বেশি ভোগ করে, কেউ কম করে আবার কেউ কেউ অভুক্ত থাকে।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ভোক্তাশ্রেণীটি আগের চেয়ে বড় হয়েছে। এর পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যও বেড়েছে। কেউ কেউ ঈদ-পার্বণ উপভোগ করার জন্য ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। আবার অনেকে খোলাবাজারে স্বল্পমূল্যে চাল কেনার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন এবং বিত্তবান প্রতিবেশীর কাছে হাত বাড়াচ্ছেন সেমাই কিংবা মাংসের জন্য।
চেতনাগত দিক থেকে ও উৎপাদনপদ্ধতির মালিকানার আলোকে আমি ভোক্তাশ্রেণীকে শাসকশ্রেণীতে ফেলার পক্ষে। মার্ক্সের সময়ের তুলনায় মালিকানার ধরনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন অনেক প্রতিষ্ঠানেরই একক মালিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাই হচ্ছে শেয়ারহোল্ডার ও তাঁদের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা পর্ষদের হাতে। তাই, যে ভোক্তাশ্রেণীর বেড়ে ওঠায় শেয়ারবাজারের ভূমিকা অপরিসীম, সেই শ্রেণী শাসকশ্রেণীই। আর শাসকশ্রেণী হিসেবে তাঁরা তাঁদের মতো করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে যাঁরা খোলাবাজারে স্বল্পমূল্যে চালের জন্য লাইন দিচ্ছেন, তাঁরাও তাঁদের চালের নিশ্চয়তা প্রদানকারী রাষ্ট্রব্যবস্থা চাইবেন। এ দুই চাওয়ার টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজনীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হবে।
=======================
হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. শফিউল আলম ভুইয়া
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.