গল্প- 'স্বপ্ন' by তাওহীদুর রহমান
বাবা-মা খুব শখ করে ওর নাম রেখেছিল রাজা। একদিন সত্যিই ও রাজা হবে এমন স্বপ্নও হয়তো দেখতো তারা।
কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।
রাজার মা একজন আয়া। মানুষের বাড়িতে সে সকাল সন্ধ্যা কাজ করে। তাতে সামান্য যা আয় হয় তা দিয়েই মা-ছেলের কোন রকম দিন চলে।
এক বস্তিতে রাজারা ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করে থাকে। মাসে সাতশ পঞ্চাশ টাকা ভাড়া। রাজার বাবা আছে কি নেই তা কেউ জানে না। রাজাও না, রাজার মাও না। কাজের খুঁজে সেই যে একদিন বেরিয়ে গেল, তারপর আর ফিরে আসেনি। রাজার বয়সী প্রায় সবারই বাবা আছে। ওরা বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বস্তির মোড়ের দোকান থেকে বিস্কুট, চকলেট কিনে খায়। রাজা এই টাকা পায় মা’র কাছ থেকে, বাবার অভাবটা মা ওকে বুঝতে দেয় না। রাজার বন্ধুদের বাবারা ওদেরকে ঈদে নতুন জামা কিনে দেয়, বেড়াতে নিয়ে যায়। রাজাকে দেয় ওর মা। বাবার সব চাহিদাই পূরণ করে ওর মা। হঠাৎ করেই একদিন বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিল। অভাবের মাত্রাটা ওদের বেড়ে গেল কয়েক গুণ। রাজার মা অনেক বলে কয়েও কোন বাড়ি থেকে নিজের বেতনটা সামান্যও বাড়াতে পারল না, দ্রব্যমূল্যের যা অবস্থা! বস্তি ছেড়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। রাজার মা পড়ল মহা ফাঁপরে।
আগে রাজা যা চাইতো মা খুব কষ্ট করে হলেও দেয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু এখন কিছু চাইতে গেলেই মা কেমন যেন রেগে যায়।
ওর বন্ধুরা যখন দোকান থেকে এক টাকায় একটা বিস্কুট কিনে মহানন্দে খেতে থাকে তখন ওর তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। গত ঈদেও কোনো নতুন জামা পায়নি ও। কিন্তু ওর বন্ধুরা ঠিকই পেয়েছে।
বারেককে কত দিন যে চকলেট আর বিস্কুট খাইয়েছে রাজা, তার হিসেব নেই। কিন্তু ওর কাছে একটা টাকা চাইতেই কেমন ধমকে উঠল সে,
‘ব্যাটা নাম তো রাজা আর কামে ফাঁকা। যা কাম কর। কাম করলেই ট্যাকা পাবি। তারপর বিস্কুট আর চকলেট খাইতে পারবি ম্যালা।’ বারেক কথাটা অবজ্ঞা করে বললেও সেটা মনে ধরল রাজার । হ্যাঁ কাজ করবে সে। কাজ করলেই টাকা পাবে। তাহলে আর মা’র কাছে টাকা চাইতে হবে না।
রাজা মাকে না জানিয়ে কিছুই করে না। কাজের কথা মাকে বলতেই মা কেঁদে ফেলল। এতটুকু ছেলে কী কাজ করবে। মা চায় না রাজা এই ছোট্ট বয়সে কাজ করুক। মা চায় রাজা স্কুলে যাক, পড়ালেখা করুক।
কোনো উপায় না দেখে মাও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল।
কিন্তু ছোট বলে কেউ কাজ দিতে চায় না ওকে। শেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর কাজ পেল একটা, চায়ের দোকানে। রাজাদের বস্তি থেকে অল্প দূরে একটা বাজারে দোকানটা। থাকা-খাওয়া দুটোই মালিকের। সাথে মাসে আশি টাকা বেতন। দ্বিতীয়টাই বেশি আকৃষ্ট করে রাজাকে।
রাতে ভাজি আর ডাল দিয়ে পেট পুরে ভাত খেল ও। এখন শোবার পালা। রাজা ছাড়াও এখানে আরও তিনজন আছে। একজন বাবুর্চি, যে চা, শিঙ্গাড়া, পিঁয়াজু, চপ, পুরি ইত্যাদি বানায়। আর বাকি দু’জন ওর মতোই ওয়েটার।
বেশ কয়েকটা পাটের বস্তা একসাথে সেলাই করে নেয়া হয়েছে। যার আকৃতিটা ঠিক তোশকের মতো। এটিই ওদের বিছানা। তেল চিটচিটে চারটি বালিশ, আর পুরাতন একটি কাঁথা।
ওরা চারজন শুয়ে পড়ল। কাঁথাটা এত ছোট যে চারজনের ঠিকমতো হয় না। রাজা ছোট আর নতুন বলে ওই বঞ্চিত হলো কাঁথার ভাগ থেকে। তবুও ওর মনে এতটুকু কষ্ট নেই। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে ঠিকই। কিন্তু কাজ পেয়েছে, বেতন পাবে এটিই যেন ওর কাছে সবচেয়ে বড় সুখ।
বাবুর্চি ফিসফিস করে কী যেন বলে আর বাকি দু’জন শব্দ করে হেসে ওঠে। রাজা বুঝতে পারে না ওরা কেন হাসছে।
বাবুর্চি রাজাকে বিভিন্ন কাজ বুঝিয়ে দেয়। কাস্টামারের সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে- সব শিখিয়ে দেয় ওকে। এক সময় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। শুধু রাজা ছাড়া।
টিকটিক শব্দে সময় বাড়ে। রাত গভীর হয়। রাজার চোখে কোনো ঘুম নেই।
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে ও। রঙিন স্বপ্ন। তাই ঘুমাতে পারছে না। কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়ে মন খারাপ হচ্ছে। মাকে ছাড়া এই প্রথম রাত কাটাচ্ছে সে।
আবার স্বপ্ন দেখে কষ্টটা দূর করার চেষ্টা করে ও। মাস শেষে আশি টাকা হাতে পাবে। তার পুরোটাই জমাবে ও। একটা মাটির ব্যাংক কিনবে। তাতে টাকা জমাবে। অনেক টাকা হবে। মাসে আশি টাকা করে বছরে কত টাকা হয় তা হিসেব করতে পারে না। তবে মন মনে একটা হিসেব করে নেয় ও, অনেক টাকা হবে। ঈদের আগেই ব্যাংকটা ভাঙা হবে। সেই টাকা দিয়ে নতুন জামা কিনবে। তার জন্য মাকে আর টাকা খরচ করতে হবে না। মাকেও কিছু কিছু টাকা জমাতে বলবে। তারপর টাকা জমতেই থাকবে, জমতেই থাকবে, জমতেই থাকবে। এক সময় সে বড় হয়ে যাবে। অন্য একটা কাজ করবে। অনেক টাকা বেতন পাবে। সব টাকা জমাবে। জমতে জমতে অনেক অনেক টাকা হবে। তারপর এক সময় সে আসলেই রাজা হয়ে যাবে। তখন মাকে তার জন্য আর কষ্ট করতে হবে না। ইশ মা তার জন্য কত কষ্ট করে! না এই দিন আর থাকবে না। এভাবে রঙিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে ও।
সকালে লোকজন আসে নাশতা করতে। একজনের কাছে শুনে বস্তিতে আগুন লেগেছে। ধক করে ওঠে রাজার বুকের ভেতরটা। কোন বস্তিতে সেটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আরও কয়েকজনের কাছে শুনে ও নিশ্চিত হয় ওদের বস্তিতেই আগুন লেগেছে। সাথে সাথে রাজা দৌড়ে ছুটে যায় বস্তিতে। দেখে লোকজনের অনেক ভিড়। ভিড় ঠেলে একটু সামনে যেতেই দেখে পুলিশ। পুলিশ দেখে রাজা একটু ভয় পায়। তবুও সামনে যায় ও। সামনে গিয়ে দেখে, দেখার মতো কিছুই নেই। শুধু ছাই আর পোড়া-আধপোড়া লাঠি-বাঁশ। ওদের ঘরটা কোথায় ছিল বোঝার চেষ্টা করে। বুঝতে পারে না। ছুটে যায় ভিড়ের মধ্যে। মাকে খুঁজ করে। কিন্তু পায় না। আবার ছুটে যায় আগের জায়গাতে। কোথায় ছিল ওদের ঘরটা। বুঝতে পারে না। ছুটে যায় আবার ভিড়ের মধ্যে। মাকে খুঁজ করে, পায় না। পরিচিত কাউকেই পায় না। আবার ছোটে আসে আগের জায়গাটাতে। অর্থহীন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। সামনে ছাইয়ের স্তূপ।
বিবর্ণ ছাইয়ের মতোই রাজার রঙিন স্বপ্নগুলো হঠাৎ করেই বিবর্ণ হয়ে যায়।
=============================
গল্প- 'আবিরের মাধবী লতা' by নিয়াজুল হাসান জুয়েল মোল্লা ফিচার- 'ঝাড়ুদার মাছ' by আরিফ হাসান গল্প- 'এগিয়ে যাবার স্বপ্ন' by মাহফুজা জাহান তাকিয়া গল্প- 'লাল ফ্রক' by আবু রায়হান মিকাঈল প্রবন্ধ- ‘আর নয় শিশুশ্রম' by জাকারিয়া হাবিব পাইলট কিশোর ফিচার- 'আমার ঘুড়ি আকাশ জুড়ি' by মাসুম কবির কিশোর ফিচার- 'চাই চীনাবাদাম' by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া আলোচনা- 'ধর্মীয় আবেগের আচ্ছাদনে রাজনীতি' by এবিএম মূসা অদ্ভুত ফিচার- 'সাপের সঙ্গে বসবাস' কিশোর আলোচনা- 'দুর্ভাগা হিরোশিমা-নাগাসাকি' by মীর আমজাদ আলী কল্পিত বিজ্ঞান কাহিনী- 'আবিষ্কার কাজী' by মাসুম বিল্লাহ কল্পিত বিজ্ঞান কাহিনী- 'ছায়াহীন আগন্তুক' by আমিনুল ইসলাম আকন্দ কল্পিত বিজ্ঞান কাহিনী- 'জায়ান্ট হান্টার' by মহিউদ্দিন আকবর গল্প- 'হাসে বাঁকা চাঁদ' by আহসান হাবিব বুলবুল গল্প- 'বড়বাড়ির জঙ্গলে' by শরীফ আবদুল গোফরান
কিশোরকন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ তাওহীদুর রহমান
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
No comments