ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ by মামুন রশীদ
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে শতকরা দুই অঙ্কের বেশি মুনাফা অর্জিত হচ্ছে। বহু বছরের কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় বিকশিত হওয়ার সুবাদে দেশের ব্যাংক খাত বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তীব্র প্রতিযোগিতা এবং শেয়ারহোল্ডারদের আকর্ষণীয় লভ্যাংশ প্রদান করে দেশের ব্যাংক খাত এখন অনেকটা টেকসই প্রবৃদ্ধির প্রবণতায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও কিন্তু যৌক্তিক ও মৌলিক কর্মকাণ্ডের প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করতে না পারার ব্যর্থতা এবং মুনাফা অর্জনের ‘লোভ’-এর কারণে দেশের ব্যাংক খাতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে এবং এ নিয়ে জনগণের মনেও নানা প্রশ্ন আছে। বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের কেউ কেউ নিজ নিজ ব্যাংকের সুনাম ব্যবহার করে অনাকাঙ্ক্ষিত কীর্তিকলাপ চালানোর পাশাপাশি গোপন লেনদেনেও জড়িত থাকেন বলে পত্রপত্রিকায় সচরাচর সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে। একই সঙ্গে চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করায় ব্যাংক খাতের স্বাধীনভাবে পরিচালনা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত সব তথ্য ও নিয়ন্ত্রণমূলক কাগজপত্রগুলো কতটা সত্য বা নির্ভরযোগ্য, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে এমনও প্রশ্ন আছে যে অতিরিক্ত রেগুলেশনস বা বিধিবিধানই কি বিভিন্ন ব্যাংকের দৃশ্যত ভালো করার নেপথ্য রহস্য, নাকি বিধিবিধানের দুর্বলতা ও পরিবেশ-পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এসব ব্যাংক উতরে যাচ্ছে?
দেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সাম্প্রতিক কতিপয় ব্যাংক-মালিক সম্পর্কে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ায় এ আশঙ্কা যেন আরও জোরালো হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, এ কথা ঠিক। তা সত্ত্বেও অনেকের কাছে আমাদের ব্যাংকিং খাতের কার্যক্রম এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিকতায় রূপলাভ করার পথে শুধু ভাবমূর্তির সংকটই দায়ী নয়, বরং এ ক্ষেত্রে ‘টু পি’ (পিপল ও প্রডাক্ট বা মানবসম্পদ ও পণ্য), ‘থ্রি সি’ (কমপ্লায়েন্স অ্যান্ড এথিকস, কমপিটিশন ও চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট বা পরিপালনীয় শর্তাবলি মেনে চলা, প্রতিযোগিতা ও ব্যবসা মডেলের নিয়ত পরিবর্তন) এবং ‘ওয়ান টি’র (টেকনোলজি বা প্রযুক্তি) সমস্যাও কিন্তু রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে বর্তমানে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। প্রতিযোগিতার প্রবণতা অবশ্যই ভালো এবং সেটা যদি সুস্থ হয়, তাহলে তাকে স্বাগতও জানাই। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে যে তীব্র প্রতিযোগিতা সব সময় অর্থাৎ অব্যাহতভাবে ইতিবাচক হয় না বা থাকে না, কখনো কখনো নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে। অর্থাৎ অনেক সময়ই তা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভে অসুস্থ ও অনৈতিক চর্চাকেও উৎসাহিত করে। শুধু ব্যাংকগুলোর মধ্যেই নয়, বরং ব্যাংক বনাম অন্যান্য অব্যাংিকং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (নন-ব্যাংক ফিন্যানসিয়াল ইনস্টিটিউশনস—এনবিএফআই) ও ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফআই) মধ্যেও এমন প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়টি কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কারণ, ব্যাংক ও অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার অনৈতিক প্রতিযোগিতার বাইরেও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কোনো নীতি, খবরদারি বা হস্তক্ষেপ এবং গ্রাহকদের প্রচলিত বিধিবিধানের কথা না ভেবে মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। মানে তারাও ব্যাংকগুলোকে অনৈতিক প্রতিযোগিতার পথে ঠেলে দেয়। ব্যাংকগুলোও কখনো কখনো বিশেষ করে করপোরেট গ্রাহকদের মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করে তাদের ধরে রাখতে আইনকানুনকে পাশ কাটিয়ে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কারণ, অন্য কোনো ব্যাংক যদি বেশি সুবিধা দেয় এবং তা প্রচলিত নিয়মকানুনবহির্ভূত হলেও গ্রাহকেরা সচরাচর সেদিকেই চলে যেতে চায়। এভাবে এক ব্যাংককে অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গ্রাহককে ধরে রাখতে বা আকৃষ্ট করতে দেখে আরেক ব্যাংকও একই পথে হাঁটতে শুরু করে এবং সেটাই যেন এক ধরনের ‘নিয়মে’ পর্যবসিত হয়। আর চূড়ান্ত পরিণতিতে এটি গোটা ব্যাংক-ব্যবস্থায়ই এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তবে দেশের পুঁজিবাজারের দিক থেকেও ব্যাংক খাতের ওপর প্রভাব বা আঘাত আসে এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও তহবিল সংগ্রহের জন্য দিন দিন ইকুইটি মার্কেটে বা পুঁজিবাজারে আসার হার বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোর ‘কোর বিজনেস’ বা মৌলিক ব্যবসার ওপরই শুধু প্রভাব পড়ে না, বরং এর পাশাপাশি তাদের বাজার মূলধনের হার কমিয়ে দেয়। দেশের পুঁজিবাজারে ২০০৭ সালে যেখানে ব্যাংক খাতের বাজার মূলধনের হার ছিল ৫৯ শতাংশ, সেখানে চলতি সালের অক্টোবরে তা কমে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে।
আমরা সবাই অনুভব করি যে দেশের ব্যাংক খাতে এখন নিদারুণভাবেই দক্ষ মানবসম্পদের অভাব রয়েছে। কারণ, ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের শুধু পুরোনো বা প্রচলিত সেবা দিলেই চলে না, নিত্যনতুন পণ্যসেবাও প্রবর্তন করতে হয়। সে জন্য ব্যাংক খাতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে, যাতে নিত্যনতুন পণ্যসেবা উদ্ভাবন ও প্রচলনে সহায়ক হয়। তবে দক্ষ মানবসম্পদ ও নতুন পণ্যসেবা প্রবর্তনের পাশাপাশি ব্যাংক খাতকে অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও প্রচলিত আইনকানুন এবং বিধিবিধান পরিপালনের বিষয়েও অবধারিতভাবে সতর্ক ও যত্নশীল হতে হবে। দেশের সব ব্যাংকের জন্য বর্তমানে ব্যাসেল-২ এবং অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস বা স্বয়ংক্রিয় নিকাশঘর চালুর নিয়ম মেনে কাজ করতে হচ্ছে। তবে আইনকানুনের পরিবর্তনও বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জবিশেষ। কারণ, অনেক সময়ই সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অধস্তন ব্যাংকগুলোর পরিপালনীয় সক্ষমতা সম্পর্কে যথাযথ গবেষণা না করেই হঠাৎ হঠাৎ কোনো নিয়ম পরিবর্তন কিংবা নতুন নিয়ম প্রবর্তন করে বসে। এতে পরিবর্তিত বা প্রবর্তিত নিয়ম বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটে, সংশয় দেখা দেয় এবং সংশ্লিষ্ট অনেকেই নতুন উপায়ে ‘ম্যানেজ করে’ নতুন নিয়মকানুন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এতে যারা নিয়মকানুন মেনে কাজ করে, তাদের সঙ্গে এক ধরনের অন্যায্য ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়; যে কারণে পরিবর্তিত বা নতুন নিয়মকানুন প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা সম্পর্কে যেমন সংশয়-সন্দেহ দেখা দেয়, তেমনি এ নিয়ে অনেক হইচই হয় এবং কাজও হয় কম।
একজন আইন মান্যকারী হিসেবে আপনি হয়তো এই ভেবে অবাক হবেন যে বিধিবিধান পরিপালনের চেয়ে ‘ম্যানেজ করে চলাটা’ কেন সহজ? আরও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বিধিবিধান পরিপালনের চেয়ে ‘ম্যানেজ করে চলার’ কারণে কার ক্ষতিটা হয় বেশি? এর চূড়ান্ত জবাব হলো, দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই ক্ষতি হয়। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মাধ্যমে ব্যাংক খাত আমাদের একটি অহংকার হয়ে উঠতে পারে। সে জন্য অবশ্য নিয়ন্ত্রকদেরও সঠিক সময়ে সঠিক বিধিবিধান বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর একটি যথোপযুক্ত উদাহরণ হলো, দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন তাদের মূল ব্যবসায় নিম্নহারের প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজিবাজারের ব্যবসায় যোগ দিল, তখন সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ওইসব প্রতিষ্ঠানকে তাদের মার্চেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমকে আলাদা করে সাবসিডিয়ারি বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশ জারি করেছে। যেহেতু সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা ও তদারকির জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সেহেতু তাদের সৎ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং আনন্দের বিষয় যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দেরিতে হলেও তা উপলব্ধি করেছে। নিয়ন্ত্রকেরা, আইনি ব্যবস্থা সৎ হলে অতীতে যেসব অসৎ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে এই খাতে ভাবমূর্তির সংকট দেখা দিয়েছিল তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। প্রচলিত আইনকানুন ও বিধিবিধান পরিপালনের মাধ্যমে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেও দেশের ব্যাংক খাতকে টেকসই, লাভজনক ও ভবিষ্যৎমুখী করে তোলাটা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ ধরনের গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দ্রুতগতিতে আরও অনেক কিছু করতে হবে। দেশে সার্বিক সুশাসন ও জবাবদিহি-পরিস্থিতির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এই পথে এগোতে হবে আমাদের।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
No comments