বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ by সাইফুদ্দীন চৌধুরী
প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দায়ী করা হয় ছাত্র-শিক্ষকদের। নির্জলা মিথ্যা কথা কেউই হয়তো একে বলবেন না। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে আমাদের এই দেশের সব ক্ষেত্রেই এদের রয়েছে অনেক বড় ভূমিকা। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পরপরই পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসনের বিষয়গুলো শনাক্ত হলে তার প্রতিকারের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে ছাত্র এবং তাদের পরামর্শদাতা শিক্ষকেরা। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ অবধি সব আন্দোলন, মিছিল, সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক। স্বাধীনতাযুদ্ধের মদদদাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চিহ্নিত করে শীর্ষস্থানীয় অধ্যাপকদের হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামেই শুধু নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই শিক্ষকেরা অধ্যয়ন করেন, অধ্যাপনা করেন, গবেষণা করেন। নিজে শিখে ছাত্রদের শেখান। নতুন নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন সকল পর্যায়ের শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর ন্যস্ত এই দায়ভারের চাপটা একটু বেশিই। এই শিক্ষকেরাই শিক্ষার্থীর লুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তুলে কর্মজীবনে প্রবেশের পথ তৈরি করে দেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক স্বশাসন রক্ষার লক্ষ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়—এসব প্রতিষ্ঠানে যাতে আধুনিক সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ বহাল থাকে। সামান্য কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলেও স্বীকার করতেই হবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এই অধ্যাদেশ আসলেই অপরিহার্য। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়ভার নিয়ে পরিচালিত হলেও এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও তৃতীয় বিশ্বের আমাদের মতো রাষ্ট্রে একজন সাধারণ নাগরিক ছাড়া কিছু নয়। তাঁরা শিক্ষক হয়ে পেশাদারির ভূমিকা পালন করেন, রাষ্ট্রের অন্যদের মতো চাকরি করেন না। দেশে দেশে এই শিক্ষকদের কিন্তু অনেক বেশিই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম দেশীয় পণ্ডিত হেনরি অ্যাডাম তো বলেছেনই, ‘এই শিক্ষকদের প্রভাব নেই কোথায়?’
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী শিক্ষকদের এটি একটি মৌলিক সনদ। ইউনেসকোর এই সনদে বলা হয়, শিক্ষকেরা সব কর্মকাণ্ডের কারিগর, জাতি গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তাঁদেরই। মর্যাদাবান ও উপযুক্ত নাগরিক তাঁরাই তৈরি করেন। এই শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মর্যাদার ক্ষেত্রে যেন কোনো ত্রুটি না ঘটে, রাষ্ট্রকে তা দেখতে হবে।
প্যারিস কনভেনশন সূত্রে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকেরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কতটা অধিকার ভোগ করে থাকেন, তার জবাব অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। কতটা লজিস্টিক সুবিধা পান রাষ্ট্রের কাছ থেকে এই শিক্ষকেরা? এই শিক্ষকদের এক একজন যথার্থ একাডেমিশিয়ান হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে প্রধান অন্তরায় হলো অর্থসংকট। শিক্ষকেরা যাতে ওই দায় মেটাতে বহির্মুখী না হন, এমনকি অধিক অর্থ পাওয়ার প্রত্যাশায় দেশত্যাগ না করেন, রাষ্ট্রের উচিত তার প্রেক্ষিত অনুসন্ধান করা।
হয়তো এসব কথা চিন্তা করেই বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বছর খানেক আগে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন যে শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি বেতনকাঠামো প্রদানের বিষয় বিবেচনা করা হবে। এমন কথাও শোনা গিয়েছিল যে সার্কভুক্ত অন্য সব দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে ওই বেতনকাঠামো প্রণীত হবে। কার্যত তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় অনেকে মনে করছেন, আমলাতন্ত্রের কুদৃষ্টিতে পড়ে তা ‘শীতল প্রকোষ্ঠে’ চলে গেছে। আরও বলা হয়, এই আমলাতন্ত্রই হায়ারারকি বিধি প্রণয়ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা নিচে নামিয়ে রাখছে। এ জন্য প্রচলিত ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে’ দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা আসন গ্রহণ করছেন ঊনবিংশতিতম কাতারে, অপরদিকে তস্য ছাত্র শীর্ষ আমলা হওয়ার সুবাদে বসেছেন তিন কাতার সামনে। তাই-ই শুধু নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরাও বসছেন ওই আমলার পেছনের সারিতে। দেশের পদস্থ সরকারি চাকরিজীবীদের এ অবস্থানে এসে পৌঁছানোর অবশ্য শক্তিশালী প্রেক্ষাপটও আছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সমগ্র উপমহাদেশেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে আমলাতন্ত্রের একটি পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এ দেশে তাদের অনুগত রাজকর্মচারীদের নাম রাজধানী কলকাতার ক্যালকাটা গেজেট পত্রিকায় প্রকাশ করত। ইংল্যান্ডের মহারানির আশীর্বাদপুষ্ট ভাগ্যবানেরা হতেন ওই গেজেটে প্রকাশিত গেজেটেড অফিসার। নেটিভদের ইংরেজ সরকারের কাজ করানোর ঐতিহ্য এখনো আমাদের দেশের সরকার রাজপুরুষ সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বহাল রেখেছে বলেই তারা কুলীন-গেজেটেড অফিসার। কতগুলো সাধারণ ঘটনা চোখে পড়লে বিব্রত হতে হয়। দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষকের কোনো সরকারি দলিলের ছায়ালিপিতে সত্যায়ন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, যত জুনিয়রই হোক, রাজকর্মচারীর সত্যায়ন বৈধ। বিষয়গুলো বিসদৃশ নয় কি? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিষয়টির প্রতি সরকারের নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো অবস্থা চাইলে দরকার দক্ষ শিক্ষক, আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকর্ম। নজর দিতে হবে, কোনো অবস্থায়ই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়, মর্যাদাহানিকর কোনো ঘটনা যেন না ঘটে। ব্রেইন-ড্রেইন ঘটিয়ে তাঁরা যেন অন্যত্র চলে যেতে না চান, দেশত্যাগ না করেন। নিজেদের অর্জিত অভিজ্ঞতা, মেধা যেন নিজের দেশেই তাঁরা প্রয়োগ করার সুযোগ পান। এসবের ব্যত্যয় ঘটলেই তো ঘটে যায় যত সব বিপত্তি। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এসব বিষয় ভাবারই পথ তৈরি করে দিয়েছে। নতুন নতুন জ্ঞানের জন্য, বিজ্ঞানের অভিনব উদ্ভাবনের জন্য, সমাজের পরিবর্তন আনার জন্য এই শিক্ষকদের ভূমিকা অটুট রাখার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। এই শিক্ষকদের অবস্থা কোনো কারণেই যেন কলুষিত না হয়, রাষ্ট্রকেই তা দেখতে হবে।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী শিক্ষকদের এটি একটি মৌলিক সনদ। ইউনেসকোর এই সনদে বলা হয়, শিক্ষকেরা সব কর্মকাণ্ডের কারিগর, জাতি গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তাঁদেরই। মর্যাদাবান ও উপযুক্ত নাগরিক তাঁরাই তৈরি করেন। এই শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মর্যাদার ক্ষেত্রে যেন কোনো ত্রুটি না ঘটে, রাষ্ট্রকে তা দেখতে হবে।
প্যারিস কনভেনশন সূত্রে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকেরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কতটা অধিকার ভোগ করে থাকেন, তার জবাব অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। কতটা লজিস্টিক সুবিধা পান রাষ্ট্রের কাছ থেকে এই শিক্ষকেরা? এই শিক্ষকদের এক একজন যথার্থ একাডেমিশিয়ান হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে প্রধান অন্তরায় হলো অর্থসংকট। শিক্ষকেরা যাতে ওই দায় মেটাতে বহির্মুখী না হন, এমনকি অধিক অর্থ পাওয়ার প্রত্যাশায় দেশত্যাগ না করেন, রাষ্ট্রের উচিত তার প্রেক্ষিত অনুসন্ধান করা।
হয়তো এসব কথা চিন্তা করেই বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বছর খানেক আগে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন যে শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি বেতনকাঠামো প্রদানের বিষয় বিবেচনা করা হবে। এমন কথাও শোনা গিয়েছিল যে সার্কভুক্ত অন্য সব দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে ওই বেতনকাঠামো প্রণীত হবে। কার্যত তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় অনেকে মনে করছেন, আমলাতন্ত্রের কুদৃষ্টিতে পড়ে তা ‘শীতল প্রকোষ্ঠে’ চলে গেছে। আরও বলা হয়, এই আমলাতন্ত্রই হায়ারারকি বিধি প্রণয়ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা নিচে নামিয়ে রাখছে। এ জন্য প্রচলিত ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে’ দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা আসন গ্রহণ করছেন ঊনবিংশতিতম কাতারে, অপরদিকে তস্য ছাত্র শীর্ষ আমলা হওয়ার সুবাদে বসেছেন তিন কাতার সামনে। তাই-ই শুধু নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরাও বসছেন ওই আমলার পেছনের সারিতে। দেশের পদস্থ সরকারি চাকরিজীবীদের এ অবস্থানে এসে পৌঁছানোর অবশ্য শক্তিশালী প্রেক্ষাপটও আছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সমগ্র উপমহাদেশেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে আমলাতন্ত্রের একটি পরিকাঠামো গড়ে ওঠে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এ দেশে তাদের অনুগত রাজকর্মচারীদের নাম রাজধানী কলকাতার ক্যালকাটা গেজেট পত্রিকায় প্রকাশ করত। ইংল্যান্ডের মহারানির আশীর্বাদপুষ্ট ভাগ্যবানেরা হতেন ওই গেজেটে প্রকাশিত গেজেটেড অফিসার। নেটিভদের ইংরেজ সরকারের কাজ করানোর ঐতিহ্য এখনো আমাদের দেশের সরকার রাজপুরুষ সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বহাল রেখেছে বলেই তারা কুলীন-গেজেটেড অফিসার। কতগুলো সাধারণ ঘটনা চোখে পড়লে বিব্রত হতে হয়। দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষকের কোনো সরকারি দলিলের ছায়ালিপিতে সত্যায়ন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, যত জুনিয়রই হোক, রাজকর্মচারীর সত্যায়ন বৈধ। বিষয়গুলো বিসদৃশ নয় কি? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিষয়টির প্রতি সরকারের নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভালো অবস্থা চাইলে দরকার দক্ষ শিক্ষক, আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকর্ম। নজর দিতে হবে, কোনো অবস্থায়ই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়, মর্যাদাহানিকর কোনো ঘটনা যেন না ঘটে। ব্রেইন-ড্রেইন ঘটিয়ে তাঁরা যেন অন্যত্র চলে যেতে না চান, দেশত্যাগ না করেন। নিজেদের অর্জিত অভিজ্ঞতা, মেধা যেন নিজের দেশেই তাঁরা প্রয়োগ করার সুযোগ পান। এসবের ব্যত্যয় ঘটলেই তো ঘটে যায় যত সব বিপত্তি। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এসব বিষয় ভাবারই পথ তৈরি করে দিয়েছে। নতুন নতুন জ্ঞানের জন্য, বিজ্ঞানের অভিনব উদ্ভাবনের জন্য, সমাজের পরিবর্তন আনার জন্য এই শিক্ষকদের ভূমিকা অটুট রাখার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। এই শিক্ষকদের অবস্থা কোনো কারণেই যেন কলুষিত না হয়, রাষ্ট্রকেই তা দেখতে হবে।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
No comments