আমেরিকানদের প্রিয় কবিতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফি বছর একজন রাজকবি (Poet Laureate) নিয়োগ দেয়া হয়। মার্কিন কংগ্রেস এই নিয়োগ দেয়। ১৯৯৭ সালে ৩৯ তম রাজকবি হিসেবে নিয়োগ পান রবার্ট পিনস্কি (Robert Pinsky)। তিনি আমেরিকানদের প্রিয় কবিতা (American’s Favorite Poem Project) নামে একটি প্রকল্প হাতে নেন। মার্কিনিদের প্রিয় কবিতা কোনটি এবং কেন — তা জানাতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন।

এক বছরের মধ্যে ১৮,০০০-এরও বেশি সাড়া মেলে। ৫ থেকে ৯৫ বছর বয়েসী মাকির্নিরা এতে অংশ নেয়। সেসব থেকে বাছাই করে তিনি ক’টি সংকলন বার করেন। এগুলো হলো — Americans’ Favorite Poems ও Poems to Read।
দারুণ দোলা দেয়ার এই কবিতাগুলো, একই সাথে দুর্দান্ত মন্তব্যগুলোও। নানান বয়েসী ও ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও অভিবাসী মার্কিনিদের জীবনে কবিতা কী ভূমিকায় তার কিছু সই-সাবুদ এতে পাওয়া যাবে। মার্কিন রাজ্য বলতে যে কেবল বুশ অ্যান্ড কোং বোঝায় না তারও কিছু নমুনা পাওয়া যাবে এসব কবিতা থেকে।
----------

দণ্ড
আন্না আখমাতোভা

আর পাথর শব্দগুলো পড়ছিল
আমার আজো স্পন্দিত বুকের ওপর
তাতে কী, আমি তো প্রস্তুতই ছিলাম
যেভাবেই হোক মানিয়ে নেবো।

আজ আমার অনেক কিছুই আছে করবার
আমি ধ্বংস করে ফেলবো স্মৃতিসত্তাকে, চিরতরে
ন্ধদয়কে বানাবো পাথর
আমাকে শিখতেই হবে কীভাবে পুনর্বার বেঁচে উঠতে হয়।

যদি না .. … .. গ্রীষ্মের দগ্ধ মর্মরধ্বনি
উৎসবে রূপ নেয় আমার জান্‌লার বাইরে
কতো দি-ই-ন ধরে এ স্বপ্ন দেখছি আমি
নান্দনিক দিন, ঊষর ঘরবাড়ি।

মন্তব্য:
আমার কাছে এ কবিতা অসাধারণ তাৎপর্যমণ্ডিত। কেননা ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে যখন আমি কবিতাটি পড়ি তখন তা আমাকে তেমনই তীব্র ধাক্কা দিয়েছিল যেরকম ট্রমা (সুতীব্র মানসিক আঘাত) সহ্য করতে হয়েছিল আমার নিজের ভাইসহ সমস্ত ভিয়েতনাম যোদ্ধাদের।

১৯৬৯ সালে সবচেয়ে কম বয়েসীদের অন্যতম হিসেবে আর্মিতে কমিশন্ড হয়েছিল আমার ভাই ডেভিড (১৯)। সে ছিল আমুদে, সপ্রতিভ আর প্রতিশ্রুতিশীল। নিজের জন্য বেছে নিয়েছিল সামরিক ক্যারিয়ার। স্বেচ্ছায় অংশ নিয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। ‘৬৯ সালেই সে বিয়ে করে তার দীর্ঘ দিনের প্রেমিকাকে। তাদের একটা ছেলেও হলো। ১৯৭০-এর জানুয়ারিতে সে ভিয়েতনামের উদ্দেশে যাত্রা করে। টানা একবছর মরণপণ লড়াই করে সে বাড়ি ফেরে ২১ বছরের এক উচ্চপ্রশংসিত বীর এবং একই সাথে একজন ‘ভঙ্গুর মানুষ’ হিসেবে।

কবিতাটি পড়ার পর মনে হলো এতে যে জীবনের কথা বলা হয়েছে সে তো আমার ভাইয়েরই জীবন। যে আর কোনো দিন জানতে পারেনি কীভাবে বেঁচে উঠতে হয়, কারণ যুদ্ধটা ছিল খুবই নির্মম আর ভয়াবহ।

– ন্যান্সি নার্সিসিয়ান (৫১), অধ্যাপক, কগনিটিভ সায়ান্স, জর্জিয়া, আটলান্টা।

[আন্না আখমাতোভা (১৮৮৯-১৯৬৬) রুশ ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।]

কে তুমি বলো আমার কণ্ঠস্বরে
মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি

সমস্ত দিনমান ভেবে ভেবে আকুল আমি এখন রাত্রে বলছি শোনো,
কোথা থেকে এসেছি আর কেনই বা
আমি তার কিছুই জানি না
আমার আত্মা এসেছে অন্য কোথাও থেকে, হ্যাঁ আমি নিশ্চিত
এবং আখেরে সেখানেই ফিরতে চাই

আমার এই উন্মত্ততার শুরু অন্য কোনো পান্থশালা থেকে
তার চৌহদ্দির ভেতর পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই
পুরোদস্তুর স্বাভাবিক হয়ে উঠবো আমি
এ পাখিরাজ্যে আমি যেন এক ভিন্ মহাদেশী আগন্তুক

সময় ঘনিয়ে আসছে আমার উড়ে যাবার
কিন্তু এ কে ভর করেছে আমার কর্ণমূলে
কে শুনছে আমার কথা
কে বলে কথা আমার কণ্ঠস্বরে?

এ কে যে দেখছে আমার চোখ দিয়ে? আত্মা কী?
এ প্রশ্নগুলো না করে পারি না আমি
অন্তত একটি উত্তরের এক কণা স্বাদও যদি চাখতে পারতাম
তবে এ নেশার গারদ ভেঙে বেরুতে পারতাম

এখানে স্বেচ্ছায় আসিনি আমি, যাবোও না
যে এনেছে ফিরিয়ে নেবার দায় তার

আমি মোটেই জানি না এখানে, এ কবিতায় কি বলতে চেয়েছি
এ প্রকল্প আমার নয়
আর যখন এ কথাগুলো বলতে পারি না
আমি নিপাট শান্ত হয়ে যাই এবং
আদৌ কথাই বলি না

মন্তব্য
এ কবিতা আমার হৃদয়ের ঠিক সে অংশটার কথা বলে, যার দৌলতেই এখনো ঠিকসে চলছি আমি। এটা ছাড়া আমি বাঁচবো না এবং একে নিয়েই মরতে হবে।
– অ্যন্ড্রু নাজেন (৪৮), কাপড় ব্যবসায়ী

[মওলানা জালালুদ্দিন রুমি (১২০৭-১২৭৩) বিশ্বখ্যাত ফার্সি কবি, সাধক। তার অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবি।]

খোকার প্রতি মা
ল্যাংস্টন হিউজ

শোন্ খোকা, তোকে বলছি
জীবন আমার জন্য স্ফটিকস্বচ্ছ সিঁড়ি নয়
এ পথে পেরেক বিছানো
এবং কাচ চূর্ণে ভরা
আর ভাঙা-চোরা তক্তাসহ
এমন কিছু জায়গা
যার মেঝেতে কার্পেট বিছানো নেই
নাঙ্গা।

কিন্তু সবসময়ই
আমি উঠছি উঠছি
ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছাচ্ছি
বাঁকগুলো পেরোচ্ছি
আর কখনো কখনো ঘুপচিতে পৌঁছাচ্ছি
যেখানে আলো নেই।
তাই খোকা, কখনো পেছনে তাকাবি না
সিঁড়িতে বসে পড়বি না
ভেঙে পড়িস না যেন
দেখ, সোনা, আমি এখনো চলছি
এখনো উঠছি
আর জীবনের পথে আমার
জন্য স্ফটিকের সিঁড়ি বিছানো নেই

মন্তব্য
১.
বাবা-মা যদি আমাকে তাদের নিজেদের কথা পদ্যের ভাষায় বলতো তবে নিশ্চয় এ কবিতার ভাষায়ই বলতো। ১৪ বছর আগে এখানে অভিবাসী বাবা-মার সন্তান হিসেবে আমি শুধু কল্পনাই করতে পারি স্থানীয় ভাষা জানা নেই এমন একটি দেশে নূতন করে জীবন শুরু করতে গিয়ে কী নিদারুণ সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়েছিল তাদের। যদিও তারা সে সংগ্রামে জিতেছেন এবং আমাকে এমন একটা শিক্ষাজীবন উপহার দিতে পেরেছেন যা তাদের দেশে সম্ভব ছিল না। যখনই আমি ব্যর্থ হই বা হাল ছেড়ে দেই অথবা সন্তুষ্ট হয়ে উঠি তখনই আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিই তাদের জীবন সংগ্রামের কথা এবং এটাই আমাকে রসদ যোগায় আগামী পথের।

– ইউন এলিজাবেথ জি (২৪), অপারেশন ম্যানেজার, হনলুলু, হাওয়াই।

২.
এ কবিতাটা আমার সবসময়ের প্রিয়। কিন্তু এর প্রকৃত তাৎপর্য ধরা পড়ে ১৯৭৬ সালে যখন আমি কমিউনিটিতে একটা বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে কাজ শুরু করি। অনেকেই স্কুলে ফিরেছে অনেক বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে । তাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে পরিবার থেকে ‘পাশ করার অনুপযুক্ত’ এজন্য পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়ার সাথে। তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে দারিদ্র্য, আত্মসম্মানবোধ ও কল্যাণ কর্মসূচির দৈন্যের সাথে এবং বেঁচে থাকার পথে সবধরনের অপব্যবহার থেকে। কারণ তারা যথার্থ শিক্ষা পায়নি।

– শিলা হাইটাওয়ার অ্যালেন (৪৪), বয়স্ক শিক্ষা নির্দেশক, অগাস্টা, জর্জিয়া

৩.
আমার কাছে এটা একটা ‘দৃঢ় সংকল্পের’ কবিতা। চলার পথে যা কিছু ঘটুক না কেন, যাই পাওয়া যাক না কেন, লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথে ধাবিত হতেই হবে, এটাই এ কবিতার শিক্ষা।

– লি সন্ডার্স (১৯), বিক্রয়কর্মী , জ্যাকসন, মিসিসিপি

কুড়ি খণ্ড আত্মহত্যা দলিলের ভূমিকা
ইমামু আমিরি বারাকা

অবশেষে আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। যেভাবে
ধরণী দ্বিধা হয় আর আমাকে পুরে নেয় খামের ভেতর
যখন আমি কুকুরটাকে নিয়ে বেড়াতে বের হই
অথবা বাতাস যে রকম ভোতা ধারালা বোকা সুর তোলে
যখন আমি বাস ধরতে ছুটি.. .. ..

বিষয়গুলো সেরকমই দাঁড়িয়েছে

আর এখন প্রতি রাতে আমি তারা গুনি
এবং প্রতি রাতেই তাদের সংখ্যা একই থাকে
আর যখন গণনা সমান হয় না
আমি গুনি তাদের ফেলে যাওয়া গহ্বরগুলো

কারো মুখে আর শুনি না গান
অতঃপর গত রাতে সন্তর্পণে
আমার মেয়ের ঘরের পাশে কান পেতে শুনতে পেলাম
সে যেন কার সাথে কথা বলছে, এবং যখন আমি
দরজা খুলে ফেলি, দেখলাম সেখানে কেউই নেই
কেবল সে, হাঁটুতে থুতনি রেখে ত্রস্তে তাকালো

তার হাতগুলো জড়িয়ে আছে একে অপরকে

মন্তব্য
৩০ বছর আগে An Anthology of Negro Poetry বইয়ে আমি প্রথম এ কবিতাটি পড়ি। আমার বয়েস তখন ১১ বছর। পড়ে আমি স্তম্ভিত। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম। বুঝতে পারলাম যে কবিতারও মানে হয়, আছে উপযোগীতা এবং তা কারো জীবনও বাঁচাতে পারে ।

– পিটার লায়োটা (৪২), সেনা কর্মকর্তা, নিউপোর্ট, রোড আইল্যান্ড

ভালবাসতাম
আলেকজান্ডার পুশকিন

তোমাকে ভালবাসতাম, বোধকরি এখনো বাসি
সে দীপশিখাটি নিভেনি আজো, অবশ্য
এটা আমার ভেতর এখন এতো শান্তভাবে জ্বলছে যে
তোমার বিব্রত বোধ করার কোনো কারণ নেই
নীরবে প্রতিদানহীনভাবে তোমাকে চেয়েছিলাম
খুব ঈর্ষা হতো কখনো, কখনো শরমিন্দা
ঈশ্বর যেন তোমাকে এমন একজন মিলিয়ে দেন
যে তোমাকে ভালবাসবে ঠিক আমারই মতো
সন্তর্পণে ও বিশ্বস্ততায়।

মন্তব্য
সব নারীই স্বপ্ন দেখে এমন ভালবাসার।

– ঝানা মাতসেরাত (৬৫), শিক্ষিকা, সেন্ট জোন্স, ক্যালিফোর্নিয়া

জীবনবৃত্তান্ত
ডরোথি পার্কার

ক্ষুর দেয় বেদনা তোমায়
নদীগুলো হাজা-মজা
এসিড পুড়ে কলংক ছায়
ড্রাগে প্রাণ ভাজা-ভাজা।

বন্দুকগুলো আইনসম্মত নয়
ফাঁসির দড়ি দড় ছিল কবে
গ্যাসে গন্ধ ভরা ভয়
তবুও তোমায় বাঁচতে হবে।

মন্তব্য

১.
কী ভয়ানক বিদ্রুপাত্মক আর শীতল! তবুও এতে আমি ভীষণ মজা পাই।

– ইলেন প্রুসিনিস্কি (১৮), ছাত্র

২.
পার্কারের এই ধারালো ছুরির মতো ভাষা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।

– সুজান হেল্ড (৬১), কাউন্টি অফিসের করণিক।

[ডরোথি পার্কার (১৮৯৩-১৯৬৭), আমেরিকান কবি।]
===================


bdnews24 এর সৌজন্যে
অনুবাদ: মিল্লাত হোসাইন

এই কবিতা গুলো পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.