টম গান্-এর কবিতা : ‌’যিশু ও তার মা’

সবেধন পুত্র মোর, আমার চেয়েও বেশি ঈশ্বরের তুই
থেকে যা এখানে এই নাশপাতি গাছের বাগানে।
সুপ্রচুর ফলভারে এইখানে গাছেরা আনত
তৃপ্ত আর পরিমিত রঙের বাহারে উদ্ভাসিত;
বার্ধক্যপীড়িত হয়ে তারা যেই কাঁদে, নোনাজল
নয় কোনো, সুমধুর অলস সিরাপে অশ্রু ঝরে।

“আমার নিজের আমি আর আমি থাকি না নিজের”

তাকে দেখে মনে হতো বেগানা নাগর,
চুপচাপ সে-বিদেশি,পদ্মডাঁটা হাতে নিয়ে
এসেছিল আমার দুয়ারে;
ঈশ্বরের জোড়াচক্ষু, ইউসুফেরও চোখের অধিক গনগনে
তার চোখে চোখ রেখে
কী হলো আমার আমি কী করে বোঝাই?

ছিলাম নিজের আমি আর আমি থাকিনি নিজের।

আর এই জনাবারো শ্রমশীল লোক, এরা কারা?
তোর কথা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না:
শিখিয়েছি আমি তোকে বুলি; রেখেছি পাখির নামগুলি
যে কোনো শিশুর মতো তুই
দেখাতি ওদের যারা দীর্ঘ পরিযায়ী।
ভিড় থেকে দূরে গিয়ে তুই ফের হয়ে যারে চুপ

“আমার নিজের আমি আর আমি থাকি না নিজের”

আমি যেই কথা বলি মুখভার কেন তোর বাপ?
এই তোর মালামাল, চাকু ও করাত
আর এই হাতুড়িটা বেঞ্চির ওপর। দিনে দিনে
হয় মাপা এইখানে তোর এ-জীবন,
মাপজোক নিয়ে তুই আসবাব বানাস যেমন;
আর আমি পত্নী হেন তোকে দেবো পাঠ;

আমার নিজের হবো আর হবো কেবলই আমার

ইচ্ছেমতো যথাতথা বয়ে চলে বেয়াড়া বাতাস
দিলখোশ না হলে কি কেউ চলে তার অনুরূপ?
আজও মনে পড়ে, তুই গিয়েছিলি আলাপ জমাতে
পশমের আলখাল্লাধারী যতো পণ্ডিতের সাথে।
কানে এলো শহরের তীব্র হট্টগোল;
এ-অশুভ যন্ত্রখানি কে বয়ে বেড়ায়?

“সে তার নিজের আর নয় সে নিজের”

মাড়িয়ে সবুজ আর দ্রুত-তৃণ গালিচা মাড়িয়ে
দেখি এক আজগুবি ছায়া এসে পড়ে
ও মানিক, এই পেটে তোকে আমি ধরেছি রে একা!
ছিলো না নিকটে কোনো কবিরাজ নাড়ি কাটবার;
ডাকবো না তোকে আমি প্রভু বলে ওরে
সবেধন পুত্র মোর, দে আমায় সাড়া!

“আমার নিজের আমি আর আমি নই তো নিজের।”

(Jesus And His Mother)
========================
(টম গান (Thom Gunn; ১৯২৯-২০০৪)
টম গান্-এর জন্ম ১৯২৯ সালে, ইংল্যান্ডের কেন্ট অঞ্চলের গ্রেইভসেন্ড-এ। বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন সাংবাদিক। তাদের যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় টমের বয়স তখন ১০। আর টমের যখন ১৫ বছরে পা, তার মা হলেন আত্মঘাতী। মহিলা ছিলেন যাকে বলে সাহিত্য-শিল্পকলার উঁচু দরের সমঝদার। অল্প বয়সেই টমের মধ্যে তিনি সঞ্চারিত করেন সাহিত্যপ্রেম। এ-সুবাদে ওই বয়সেই মার্লো, মিল্টন, শেলি, কিটস, শেক্সপিয়র, টেনিসনদের কবিতা আর মহৎ সব লেখকের গদ্যরসে আপ্লুত হয় তার মন.!
১৯৫০ সাল। টম গান্ ভর্তি হন ক্যাম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। এর আগের দু’বছর কাটান সেনাদলে আর ৬ মাস পারিতে। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই ফাইটিং টার্ম। বোদ্ধা পাঠক-সমালোচক মহলে দারুণ সাড়া জাগায় তা। প্রখ্যাত সমালোচক জন প্রেস লেখেন, ‘এই বই যুদ্ধোত্তরকালে প্রকাশিত হাতেগোনা বইগুলোর একটি যা প্রত্যেক সিরিয়াস পাঠকের সংগ্রহে রেখে পড়া চাই।’ গত শতকের মধ্য পঞ্চাশে টম তার সমকামী প্রেমিকের সঙ্গে পাড়ি জমান আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে। সান ফ্রান্সিসকো হয় তার পরবর্তী জীবনের ঠিকানা। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভর উইন্টার্সের সঙ্গে এক বছরের ফেলোশিপও করেন।
পরের দশকগুলোতে প্রকাশিত তার কবিতা-বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : দ্য সেন্স অব মুভমেন্ট (১৯৫৭), মাই স্যাড ক্যাপ্টেনস (১৯৬৯), টাচ্ (১৯৬৭), মোলি (১৯৭১), টু দ্য এয়ার (১৯৭৪), জ্যাক স্ট্র’জ ক্যাসল্ (১৯৭৬), সিলেকটেড পোয়েমস ১৯৫০-১৯৭৫ (১৯৭৯), দ্য প্যাসেজেস অব জয় (১৯৮৩), ম্যান উইথ দ্য নাইট সোয়েটস (১৯৯২), সিলেকটেড পোয়েমস অব টম গান্ অ্যান্ড টেড হিউজ (১৯৬২)।
১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে টমের কবিতা আবর্তিত হতে থাকে তার ঝড়ো ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা, ড্রাগাসক্তি, সমকাম আর এইডস-এর মতো আপাত বিসদৃশ বিষয়কে ঘিরে। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ম্যান উইথ দ্য নাইট সোয়েটস তার এইডস-আক্রান্ত বন্ধুদের নিয়ে লেখা এক আধুনিক শোকগাথা। এই বই আধুনিক ইংরেজি কবিতার একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত। এই বইয়ের মধ্য দিয়ে ‘‘টম গান কবিতাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন হারিয়ে যাওয়া সেই লাবণ্য যা একালের কবিতায় বিরলদৃষ্ট।’’
বইটির ব্যাপারে সমালোচক নিল পাওয়েলের সপ্রশংস মন্তব্য:‘‘টম গান কবিতাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন সে-ই কেন্দ্রে যা সে প্রায় হারাতে বসেছিল।’’ এ-বইয়ের জন্য ১৯৯৩ সালে টম গান লেনর মার্শাল কবিতা পুরস্কারে (Lenore Marshall Poetry Prize) ভূষিত হন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে তার আরও বেশ কটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বস কিউপিড (২০০০), ফ্রন্টিয়ার্স গসিপ (১৯৯৮), কালেকটেড পোয়েমস (১৯৯৪)। প্রবন্ধের বইও লিখেছেন টম গান। এদের একটির নাম কবিতার মুহূর্ত (Occassions of Poetry, UK edition 1982, US edition1999)
প্রচলিত বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে টম গান এমন এমন বিষয়কে কবিতার উপজীব্য করেছেন এক কথায় যেগুলোকে বলা যায় বিসদৃশ আর অভাবিতপূর্ব। কখনো কখনো সেগুলো খ্রিষ্টীয় ক্যাথলিক বিশ্বাসের পায়ে কুড়াল হেনেছে অবলীলায়। সমালোচকদের ভাষায় যেগুলো ‘daring subject matter’। কিন্তু আপাত বিসদৃশ বিষয়বস্তুকেও তিনি করে তোলেন শিল্প। এ কবি বরাবরই ছিলেন পুরনো আঙ্গিকপ্রেমী। ছন্দ ছিলো তার ব্যসন ও আনন্দ। কালেভদ্রে মুক্তছন্দের পথে পা বাড়ালেও চিরকাল প্রচলিত ছন্দো-সৌষ্ঠবেই সমর্পিত থেকেছেন এই কবি।
২০০৪ সালে তার দ্বিতীয় স্বদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জীবনাবসান হয় টম গান্-এর।
====================


bdnews24 এর সৌজন্যে
অনুবাদ: জুয়েল মাজহার

এই কবিতা গুলো পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.