সিপিএম ও কিছু পর্যবেক্ষণ by তানভীর মোকাম্মেল
২০১১-এর প্রথম পর্বে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মধ্যে সাধারণ অনুভূতি হচ্ছে যে আগামী নির্বাচনে সিপিএমকেন্দ্রিক বাম জোট সরকার নির্বাচনে হেরে যাবে। প্রায় ৩২ বছর ধরে শাসন করতে থাকা সিপিএমের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন।
এটা স্বীকৃত সত্য যে আমরা বাঙালিরা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে তেমন ভালো নই বা কষ্টেসৃষ্টে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেলেও তা বেশি দিন টেকে না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে না ভেঙে টিকে রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিপিএম। সিপিএমের একটা সর্বভারতীয় কাঠামো থাকলেও দলটির শক্তির ভরকেন্দ্র মূলত বাংলায় এবং বাঙালি কমরেডরাই দলটির ভিত্তি ও প্রসারে মূল। কিন্তু আজ দলটির ভবিষ্যৎই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে শাসনের একটা নিজস্ব ধারা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে, সে ধারায় বড় রকম ভাঙন লেগেছে এবং নতুন চর জাগছে মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর তৃণমূলের ভোটব্যাংকে। আর বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের সে দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন সিপিএমের নেতা-কর্মীদের কারও কারও দাদাগিরি ও দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ বাঙালি ভদ্রলোক মধ্যবিত্ত, সাবেক চীনপন্থী ও মহাশ্বেতা দেবীর মতো রাজনীতিসচেতন বুদ্ধিজীবীরা, আছে ভোট না-পাওয়া কংগ্রেসি, পশ্চিমবঙ্গের পুরোনো বনেদি বড়লোক পরিবারগুলো, মায় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরাও। এমনকি মমতার পক্ষে যাঁরা দলে দলে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্রেফ সুযোগসন্ধানীরাও এবং ‘চিরন্তন সরকারি দলের’(!) সম্ভাব্য লোকজন। মমতা ব্যানার্জির মা-মাটি-মানুষের ভূয়োদর্শনের পেছনে পাড়ায় পাড়ায় আরও জমায়েত হচ্ছে ‘ওলটপালট করে দে মা লুটেপুটে খাই’ দর্শনের লুম্পেনরাও।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সিপিএমকে সমর্থন করার আর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। গত দুই দশকে বাজার অর্থনীতির যেটুকু সুফল তাঁরা ভোগ করা শুরু করেছেন এবং যে বৈষয়িক সম্ভাবনা সামনে দেখছেন, তার ফলে ষাট ও সত্তরের দশকের ত্যাগ ও সংগ্রামের মানসিকতায় তাঁরা আর নেই। সিপিএমকে তাঁদের আসলেই আর প্রয়োজন নেই। আর ভারতের অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিকাশে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পশ্চিমবঙ্গেও সচ্ছল মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে সিপিএমের নেতৃত্বটা মধ্যবিত্ত হলেও কর্মী-বাহিনী ও ভোটব্যাংকের বড় অংশটাই তো ছিল কৃষক, শ্রমজীবী ও সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। তাদের মধ্যে সিপিএমের সমর্থন কেন ও কতটা কমেছে? এ বিষয়টা এখনো কিছুটা ধোঁয়াশা এবং এ বিষয়টার ওপরই নির্ভর করছে সিপিএম আগামী নির্বাচনে সুনিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচতে পারবে কি না।
এখন প্রশ্ন, একসময়ের এত দৃঢ় গণভিত্তিক দল সিপিএমের হলোটা কী? কেন তাদের কর্মী ও নেতাদের মধ্যেও ইদানীং এক ধরনের হতাশা ও পরাজয়বাদিতার ঝোঁক? মাত্র কয়েকটি পুরসভা ও স্থানীয় ছোটখাটো নির্বাচনে হেরেই কেন মনে হচ্ছে যে সিপিএমের দম ফুরিয়ে আসছে? বিরোধীরা যতই প্রচার করুক, সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা এখনো সৎ ও সাধারণ জীবনযাপন করেন। তবে নিম্ন ও মধ্যস্তরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগটা আবার বেশ ব্যাপক। তা ছাড়া একটা দল হিসেবেই সিপিএম যেন আজ কিছুটা তাত্ত্বিক সংকটে পড়েছে। সিপিএম বরাবরই ছিল একটা প্রায়োগিক দল। অর্থাৎ কোনো সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ ছাড়া অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার দল। এতে বিভিন্ন সময় নির্বাচনে জিততে ও সরকার চালাতে তাদের কিছুটা সুবিধা জুটেছিল বটে, কিন্তু মতাদর্শের দৃঢ়তা ছাড়া কোনো একশিলাভূত পার্টি দীর্ঘদিন চালানো কঠিন। সিপিএমকে আজ হয়তো সেই মূল্যটাই দিতে হচ্ছে।
তা ছাড়া ইতিহাসের একাধিক বাসে সময়মতো চড়তে সিপিএম ব্যর্থ হয়েছে। ভূমি সংস্কার ও অপারেশন বর্গা করে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের নিচুতলার মানুষদের সিপিএম ক্ষমতায়িত করতে পেরেছিল বটে, কিন্তু প্রয়োজন ছিল জনগণের চেতনা উন্নয়নে পরবর্তী স্তরে যাওয়া। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কিছু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ নেওয়া, যা তারা পারেনি বা করেনি। শিক্ষার ক্ষেত্রে সিপিএম যা করেছে তা হচ্ছে, শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়েছে বা নতুন আরও দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক হিসেবে চাকরি দিয়েছে। এসব কাজ জনগণের কাছে কোনো ‘শিক্ষা-বিপ্লব’ নয়, বরং পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বা শিক্ষাকে দলীয়করণ বলেই মনে হয়েছে কেবল।
সিপিএম অবশ্য তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে ক্ষমতার পরিখা-যুদ্ধ বলে ভেবেছে। ফলে জনগণের যত কমিটি ছিল, তা পাড়ার পূজা কমিটি হোক বা শ্মশান কমিটিই, সবকিছুই দলীয় কর্মীদের দ্বারা দখল করার চেষ্টা করেছে। এতে জনগণ কেবল বিরক্তই হয়েছে বা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগগুলো হারিয়ে গেছে। বোঝা যায়, ক্ষমতার পরিখা-যুদ্ধ সম্পর্কে গ্রামসির ধারণাটা সিপিএমের নেতারা নেননি বা নিলেও ভুল পাঠ নিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের আরেক সমস্যা হচ্ছে, দলটির সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরোতে বাংলার বাইরের নেতাদের খবরদারি ও ছড়ি ঘোরানো। সিপিএমের এই সর্বভারতীয় নেতাদের সরকার চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের মতামতই পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের অনেকেরই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতারও অভাব আছে এবং বিষয়গুলো তাঁরা দেখতে চেষ্টা করে থাকেন বিমূর্ত তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে। সর্বভারতীয় সিপিএমের নেতারা একসময় জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি এবং তাতে বাংলার ভাবমূর্তি ও রাজনীতির ক্ষতিই হয়েছে। আজও পারমাণবিক চুক্তি ও অন্যান্য কিছু প্রশ্নে বাংলার বাইরের সিপিএমের নেতারা এমন গোঁ ধরে বসে থাকেন, যেসব ইস্যুর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ তাদের বাস্তব জীবন ও স্বার্থের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ দেখতে পায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে, পশ্চিম বাংলার সিপিএমের নেতারা, যাঁরা সারা ভারতের সিপিএম দলটির সবচেয়ে বড় অংশ, তাঁরা অবাঙালি এসব নেতার খবরদারি মেনে চলেন কেন? একটা কারণ বোধহয় যা কিছু পশ্চিমা, তার প্রতি আমাদের বাঙালিদের সহজাত হীনম্মন্যতাবোধ! আরেকটা কারণ, এ ধরনের সভায় উপস্থিত থেকেছেন সিপিএমের এমন এক নেতা যেটা বললেন তা হচ্ছে, সিপিএমের বাঙালি নেতাদের ইংরেজি ভাষাটা কম জানা। সর্বভারতীয় পর্যায়ে নেতা হতে হলে ইংরেজিতে ভালো বলিয়ে-কইয়ে হতেই হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের নেতারা তাঁদের এক ‘আদিপাপে’ ভুগছেন। তাঁরা নিজেরাই একসময় পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করেছিলেন। আর তার কারণে বিশ্বায়নের এই যুগে পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিপিএমের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও বেড়েছে মফস্বলীয়তা, যা একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী মার্কসবাদী দলের জন্য এক বড় সীমাবদ্ধতা।
সাধারণভাবে বামপন্থার প্রতি যাঁরা এত দিন আকর্ষণ বোধ করেছেন, দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের সেসব লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীও আজ সিপিএমের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলছেন অথবা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে বুদ্ধিজীবীদের ভেতর সিপিএমের বিরুদ্ধে ও তৃণমূল কংগ্রেসের সপক্ষে সবচেয়ে বড় সমর্থক হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে যাঁদের ‘আনন্দবাজার গোষ্ঠীর লেখক-সাহিত্যিক’ বলা হয়। সৎ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আনন্দবাজার পত্রিকাটির অবশ্য তেমন সুনাম নেই। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যসহ সিপিএমের নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, আনন্দবাজার অনেক মিথ্যা ও অর্ধসত্য খবর ছাপে। আনন্দবাজার সিপিএমের নেতাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যর্থতা ও দুর্নীতি ফলাও করে প্রচার করে থাকে, কিন্তু একজন প্রশাসক হিসেবে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যর্থতাগুলোকে বেমালুম চেপে যায়। ভারতের সাম্প্রতিক রেল দুর্ঘটনাগুলোর সংখ্যা ও ভয়াবহতা স্মরণ করুন! যা হোক, আনন্দবাজার সম্পর্কে সিপিএম একটা কৌতুক চালু করেছে এবং তা পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং বেশ চলছে। কৌতুকটা হচ্ছে, মর্ত্যে কেউ কোনো মিথ্যা কথা বললে স্বর্গে ঢং করে একটা ঘণ্টা বেজে ওঠে। একদিন রাত ১২টার দিকে শোনা গেল স্বর্গে ঢং ঢং করে খুব ঘন ঘন ঘণ্টা বাজছে এবং বেজেই চলছে। অনেকটা জেলখানার পাগলা ঘণ্টির মতো। দেবতারা যে যেখানে ছিলেন, সব ফেলে ছুটে ভগবানের কাছে এলেন, কী ব্যাপার? ভগবান খুব শান্তভাবে সবাইকে বললেন, ‘ও কিছু না। মর্ত্যের কলকাতা শহরে আনন্দবাজার পত্রিকা ছাপা হচ্ছে!’
তবে যে পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ১২ লাখ, তার একটা ব্যাপক প্রভাব জনমানসের ওপর পড়েই। আর বাংলার এপারেই হোক কিংবা ওপারে, ছাপার অক্ষরে কিছু দেখলে বাঙালি কি আর নেপথ্যের সত্যটা জানতে চায়? বাঙালি চিরকালই বিশ্বাসপ্রবণ জাতি!
আগামী নির্বাচনে তৃণমূল অবশ্য একা সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়বে না। তার সাথি হবে কংগ্রেস। যাঁকে দিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্বের উত্তরসূরি ভাবা হয়, সেই রাহুল গান্ধী তাই ঘন ঘনই পশ্চিমবঙ্গ সফর করছেন। কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে এখন অবশ্য অনেকটাই মরা হাতি। তবে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা (তা যত সাদাই হোক না কেন!) সিপিএমের নেতাদের চেয়ে স্নিকার্স পরা এবং জর্জ ক্লুনির মতো তিন দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়িসহ সুদর্শন তরুণ রাহুল গান্ধীর একটা আলাদা আবেদন তো আছেই করপোরেট-জগতে চাকরি করা বা চাকরি খোঁজা তরুণ-তরুণীদের কাছে! তা ছাড়া কেন্দ্রে রয়েছে কংগ্রেস সরকার। সেটাও পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের পালে কিছু হাওয়া জোগাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের আজ এক বড় সমস্যা জঙ্গলমহল ও লালগড় অঞ্চলে মাওবাদীদের সশস্ত্র তৎপরতা। একজনের পর একজন আঞ্চলিক সিপিএমের নেতা মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন ও হচ্ছেন। সিপিএমও ছেড়ে কথা কইছে না। তবে মাওবাদীদের সঙ্গে দহরম-মহরম করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোধহয় আগুন নিয়েই খেলছেন। পশ্চিম মেদিনীপুর-ঝাড়খন্ড অঞ্চলের এসব মাওবাদীর সঙ্গে বাংলাদেশের মাধ্যমে আইএসআইয়ের যোগাযোগ বিচিত্র নয়। পুরুলিয়ায় জঙ্গলে অস্ত্র ফেলতে যে বিমান গিয়েছিল, তা বাংলাদেশ থেকেই উড়ে গিয়েছিল। সে ঘটনা এখনো রহস্যাবৃত। চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক মামলার মতো এ ঘটনারও সঠিক তদন্ত হলে এই অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও তাদের পেছনে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সম্পর্ক উন্মোচিত হলে বিস্মিত হব না। ফলে জঙ্গলমহলের সশস্ত্র মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের নেত্রী যেভাবে খায়খাতির করছেন, তার জন্য তাঁকে আখেরে মূল্য দিতে হতে পারে। ভারতের বা যেকোনো দেশেরই ভরসা হচ্ছে গণতন্ত্র, সশস্ত্র সংঘাত নয়।
পশ্চিমবঙ্গের আরেক অস্থির এলাকা দার্জিলিং। পাহাড়ি মানুষের প্রতি দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বঞ্চনার ফলে সেখানেও অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। মমতা ব্যানার্জি দার্জিলিংয়ে গিয়ে যথারীতি পাহাড়িদের নানা গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। এসব প্রতিশ্রুতি হয়তো সাবধানে দেওয়া ভালো। কারণ, নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেলে এসব প্রতিশ্রুতি যে তাঁকেই পূরণ করতে হবে!
যেটা প্রশ্ন, এই সার্বিক ক্ষয়ের বিরুদ্ধে সিপিএম কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? তৃণমূল যতটা আবেগায়িত একটা দল, ততটা সুসংগঠিত নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তাদের অন্য কোনো নেতাও তেমন নেই। আর কেবল সিপিএমের বিরোধিতা ছাড়া তৃণমূলের কোনো মৌলিক বা নীতিগত বক্তব্যও নেই। এ রকম নীতি ছাড়া একদল কেবল সিপিএমের বিরোধিতার আবেগ দিয়ে কতটা কী করতে পারবে, সেটাও দেখার বিষয়। সম্প্রতি কিছু ভিন্ন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। যে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের জমি রক্ষার আন্দোলন করে তৃণমূল সিপিএমকে বেকায়দায় ফেলা হয়েছিল, আজ সেখানে রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কারখানা গড়তে চাইলে সিপিএমের লোকজনই ‘জমি রক্ষা কমিটি’ গড়েছেন! পাশার দান উল্টে যাচ্ছে! তা ছাড়া সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে সিপিএমের সমর্থক ছাত্রসংগঠনই জিতেছে। বোঝা যাচ্ছে, সুশিক্ষিত তরুণদের কাছে সিপিএমের আবেদন খুব কমেনি, বরং তৃণমূলের স্থূল আবেগময়তাই তেমন কল্কে পাচ্ছে না। তা ছাড়া নির্বাচন এখনো কয়েক মাস বাকি। এর মধ্যে অনেক হিসাব-নিকাশ ও অনুপাতই পাল্টে যেতে পারে। সিপিএম একটা সংগঠিত বড় দল। একটা নির্বাচনে হারলেই তাদের সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে না। তবে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে সিপিএময়ের অনেকে বসে পড়তে বা দলত্যাগ করতে পারে, যেমনটি ইঁঁদুরেরা পালিয়ে যায় ডুবন্ত জাহাজ থেকে। অবশ্য তাতে সিপিএমের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার খুব কারণ নেই। ৩২ বছর অবিচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় থাকার ফলে নানা রকম সুবিধাবাদীদের বেনোজল যেভাবে দলটিতে ঢুকেছিল, তারা বেরিয়ে গেলে দলটা বরং সুস্থই হবে।
আবার এর বিপরীতটাও ঘটতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লে একটা একশিলাভূত পার্টি কিন্তু তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়তে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির দুই কোটি সদস্য ছিল। মাত্র কয়েক সপ্তাহে তা প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। সিপিএমের সামনে সে বিপদটাও আছে।
সম্প্রতি কলকাতায় সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হালচাল কেমন বুঝছেন? তিনি তখন আমাকে তাঁর একটা ছড়া শোনালেন:
‘আঙ্গুলে ছাপ বোতামে চাপ
এদিকে পাপ ওদিকে পাপ
এদিকের পাপ হো’ল অনেকদিন
ওদিকে পাপকে এবার সুযোগ দিন’;
আমার যা বোঝার আমি বুঝলাম!
আগামী কয়েক মাস আসলেই তাই পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্য একটা কৌতূহলী সময়। আর সিপিএমের জন্য এ তো এক অগ্নিপরীক্ষা। কারণ, আগামী নির্বাচন দলটির জন্য কেবল একটা বিশেষ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন নয়, একটা মতাদর্শের সমস্যা ও সম্ভাবনারও এক ধরনের ফয়সালা তা।
তানভীর মোকাম্মেল: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
এটা স্বীকৃত সত্য যে আমরা বাঙালিরা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে তেমন ভালো নই বা কষ্টেসৃষ্টে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেলেও তা বেশি দিন টেকে না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে না ভেঙে টিকে রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিপিএম। সিপিএমের একটা সর্বভারতীয় কাঠামো থাকলেও দলটির শক্তির ভরকেন্দ্র মূলত বাংলায় এবং বাঙালি কমরেডরাই দলটির ভিত্তি ও প্রসারে মূল। কিন্তু আজ দলটির ভবিষ্যৎই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে শাসনের একটা নিজস্ব ধারা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে, সে ধারায় বড় রকম ভাঙন লেগেছে এবং নতুন চর জাগছে মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর তৃণমূলের ভোটব্যাংকে। আর বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের সে দীর্ঘ তালিকায় রয়েছেন সিপিএমের নেতা-কর্মীদের কারও কারও দাদাগিরি ও দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ বাঙালি ভদ্রলোক মধ্যবিত্ত, সাবেক চীনপন্থী ও মহাশ্বেতা দেবীর মতো রাজনীতিসচেতন বুদ্ধিজীবীরা, আছে ভোট না-পাওয়া কংগ্রেসি, পশ্চিমবঙ্গের পুরোনো বনেদি বড়লোক পরিবারগুলো, মায় মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরাও। এমনকি মমতার পক্ষে যাঁরা দলে দলে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্রেফ সুযোগসন্ধানীরাও এবং ‘চিরন্তন সরকারি দলের’(!) সম্ভাব্য লোকজন। মমতা ব্যানার্জির মা-মাটি-মানুষের ভূয়োদর্শনের পেছনে পাড়ায় পাড়ায় আরও জমায়েত হচ্ছে ‘ওলটপালট করে দে মা লুটেপুটে খাই’ দর্শনের লুম্পেনরাও।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সিপিএমকে সমর্থন করার আর কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। গত দুই দশকে বাজার অর্থনীতির যেটুকু সুফল তাঁরা ভোগ করা শুরু করেছেন এবং যে বৈষয়িক সম্ভাবনা সামনে দেখছেন, তার ফলে ষাট ও সত্তরের দশকের ত্যাগ ও সংগ্রামের মানসিকতায় তাঁরা আর নেই। সিপিএমকে তাঁদের আসলেই আর প্রয়োজন নেই। আর ভারতের অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিকাশে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পশ্চিমবঙ্গেও সচ্ছল মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে সিপিএমের নেতৃত্বটা মধ্যবিত্ত হলেও কর্মী-বাহিনী ও ভোটব্যাংকের বড় অংশটাই তো ছিল কৃষক, শ্রমজীবী ও সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। তাদের মধ্যে সিপিএমের সমর্থন কেন ও কতটা কমেছে? এ বিষয়টা এখনো কিছুটা ধোঁয়াশা এবং এ বিষয়টার ওপরই নির্ভর করছে সিপিএম আগামী নির্বাচনে সুনিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচতে পারবে কি না।
এখন প্রশ্ন, একসময়ের এত দৃঢ় গণভিত্তিক দল সিপিএমের হলোটা কী? কেন তাদের কর্মী ও নেতাদের মধ্যেও ইদানীং এক ধরনের হতাশা ও পরাজয়বাদিতার ঝোঁক? মাত্র কয়েকটি পুরসভা ও স্থানীয় ছোটখাটো নির্বাচনে হেরেই কেন মনে হচ্ছে যে সিপিএমের দম ফুরিয়ে আসছে? বিরোধীরা যতই প্রচার করুক, সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা এখনো সৎ ও সাধারণ জীবনযাপন করেন। তবে নিম্ন ও মধ্যস্তরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগটা আবার বেশ ব্যাপক। তা ছাড়া একটা দল হিসেবেই সিপিএম যেন আজ কিছুটা তাত্ত্বিক সংকটে পড়েছে। সিপিএম বরাবরই ছিল একটা প্রায়োগিক দল। অর্থাৎ কোনো সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ ছাড়া অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার দল। এতে বিভিন্ন সময় নির্বাচনে জিততে ও সরকার চালাতে তাদের কিছুটা সুবিধা জুটেছিল বটে, কিন্তু মতাদর্শের দৃঢ়তা ছাড়া কোনো একশিলাভূত পার্টি দীর্ঘদিন চালানো কঠিন। সিপিএমকে আজ হয়তো সেই মূল্যটাই দিতে হচ্ছে।
তা ছাড়া ইতিহাসের একাধিক বাসে সময়মতো চড়তে সিপিএম ব্যর্থ হয়েছে। ভূমি সংস্কার ও অপারেশন বর্গা করে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের নিচুতলার মানুষদের সিপিএম ক্ষমতায়িত করতে পেরেছিল বটে, কিন্তু প্রয়োজন ছিল জনগণের চেতনা উন্নয়নে পরবর্তী স্তরে যাওয়া। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কিছু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ নেওয়া, যা তারা পারেনি বা করেনি। শিক্ষার ক্ষেত্রে সিপিএম যা করেছে তা হচ্ছে, শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়েছে বা নতুন আরও দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক হিসেবে চাকরি দিয়েছে। এসব কাজ জনগণের কাছে কোনো ‘শিক্ষা-বিপ্লব’ নয়, বরং পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি বা শিক্ষাকে দলীয়করণ বলেই মনে হয়েছে কেবল।
সিপিএম অবশ্য তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে ক্ষমতার পরিখা-যুদ্ধ বলে ভেবেছে। ফলে জনগণের যত কমিটি ছিল, তা পাড়ার পূজা কমিটি হোক বা শ্মশান কমিটিই, সবকিছুই দলীয় কর্মীদের দ্বারা দখল করার চেষ্টা করেছে। এতে জনগণ কেবল বিরক্তই হয়েছে বা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগগুলো হারিয়ে গেছে। বোঝা যায়, ক্ষমতার পরিখা-যুদ্ধ সম্পর্কে গ্রামসির ধারণাটা সিপিএমের নেতারা নেননি বা নিলেও ভুল পাঠ নিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের আরেক সমস্যা হচ্ছে, দলটির সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় পলিটব্যুরোতে বাংলার বাইরের নেতাদের খবরদারি ও ছড়ি ঘোরানো। সিপিএমের এই সর্বভারতীয় নেতাদের সরকার চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের মতামতই পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম সরকারের কোনো কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের অনেকেরই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতারও অভাব আছে এবং বিষয়গুলো তাঁরা দেখতে চেষ্টা করে থাকেন বিমূর্ত তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে। সর্বভারতীয় সিপিএমের নেতারা একসময় জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি এবং তাতে বাংলার ভাবমূর্তি ও রাজনীতির ক্ষতিই হয়েছে। আজও পারমাণবিক চুক্তি ও অন্যান্য কিছু প্রশ্নে বাংলার বাইরের সিপিএমের নেতারা এমন গোঁ ধরে বসে থাকেন, যেসব ইস্যুর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ তাদের বাস্তব জীবন ও স্বার্থের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ দেখতে পায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে, পশ্চিম বাংলার সিপিএমের নেতারা, যাঁরা সারা ভারতের সিপিএম দলটির সবচেয়ে বড় অংশ, তাঁরা অবাঙালি এসব নেতার খবরদারি মেনে চলেন কেন? একটা কারণ বোধহয় যা কিছু পশ্চিমা, তার প্রতি আমাদের বাঙালিদের সহজাত হীনম্মন্যতাবোধ! আরেকটা কারণ, এ ধরনের সভায় উপস্থিত থেকেছেন সিপিএমের এমন এক নেতা যেটা বললেন তা হচ্ছে, সিপিএমের বাঙালি নেতাদের ইংরেজি ভাষাটা কম জানা। সর্বভারতীয় পর্যায়ে নেতা হতে হলে ইংরেজিতে ভালো বলিয়ে-কইয়ে হতেই হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের নেতারা তাঁদের এক ‘আদিপাপে’ ভুগছেন। তাঁরা নিজেরাই একসময় পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করেছিলেন। আর তার কারণে বিশ্বায়নের এই যুগে পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিপিএমের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও বেড়েছে মফস্বলীয়তা, যা একটি আন্তর্জাতিকতাবাদী মার্কসবাদী দলের জন্য এক বড় সীমাবদ্ধতা।
সাধারণভাবে বামপন্থার প্রতি যাঁরা এত দিন আকর্ষণ বোধ করেছেন, দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের সেসব লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীও আজ সিপিএমের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলছেন অথবা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে বুদ্ধিজীবীদের ভেতর সিপিএমের বিরুদ্ধে ও তৃণমূল কংগ্রেসের সপক্ষে সবচেয়ে বড় সমর্থক হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে যাঁদের ‘আনন্দবাজার গোষ্ঠীর লেখক-সাহিত্যিক’ বলা হয়। সৎ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আনন্দবাজার পত্রিকাটির অবশ্য তেমন সুনাম নেই। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যসহ সিপিএমের নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, আনন্দবাজার অনেক মিথ্যা ও অর্ধসত্য খবর ছাপে। আনন্দবাজার সিপিএমের নেতাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যর্থতা ও দুর্নীতি ফলাও করে প্রচার করে থাকে, কিন্তু একজন প্রশাসক হিসেবে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যর্থতাগুলোকে বেমালুম চেপে যায়। ভারতের সাম্প্রতিক রেল দুর্ঘটনাগুলোর সংখ্যা ও ভয়াবহতা স্মরণ করুন! যা হোক, আনন্দবাজার সম্পর্কে সিপিএম একটা কৌতুক চালু করেছে এবং তা পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং বেশ চলছে। কৌতুকটা হচ্ছে, মর্ত্যে কেউ কোনো মিথ্যা কথা বললে স্বর্গে ঢং করে একটা ঘণ্টা বেজে ওঠে। একদিন রাত ১২টার দিকে শোনা গেল স্বর্গে ঢং ঢং করে খুব ঘন ঘন ঘণ্টা বাজছে এবং বেজেই চলছে। অনেকটা জেলখানার পাগলা ঘণ্টির মতো। দেবতারা যে যেখানে ছিলেন, সব ফেলে ছুটে ভগবানের কাছে এলেন, কী ব্যাপার? ভগবান খুব শান্তভাবে সবাইকে বললেন, ‘ও কিছু না। মর্ত্যের কলকাতা শহরে আনন্দবাজার পত্রিকা ছাপা হচ্ছে!’
তবে যে পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ১২ লাখ, তার একটা ব্যাপক প্রভাব জনমানসের ওপর পড়েই। আর বাংলার এপারেই হোক কিংবা ওপারে, ছাপার অক্ষরে কিছু দেখলে বাঙালি কি আর নেপথ্যের সত্যটা জানতে চায়? বাঙালি চিরকালই বিশ্বাসপ্রবণ জাতি!
আগামী নির্বাচনে তৃণমূল অবশ্য একা সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়বে না। তার সাথি হবে কংগ্রেস। যাঁকে দিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্বের উত্তরসূরি ভাবা হয়, সেই রাহুল গান্ধী তাই ঘন ঘনই পশ্চিমবঙ্গ সফর করছেন। কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে এখন অবশ্য অনেকটাই মরা হাতি। তবে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা (তা যত সাদাই হোক না কেন!) সিপিএমের নেতাদের চেয়ে স্নিকার্স পরা এবং জর্জ ক্লুনির মতো তিন দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়িসহ সুদর্শন তরুণ রাহুল গান্ধীর একটা আলাদা আবেদন তো আছেই করপোরেট-জগতে চাকরি করা বা চাকরি খোঁজা তরুণ-তরুণীদের কাছে! তা ছাড়া কেন্দ্রে রয়েছে কংগ্রেস সরকার। সেটাও পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের পালে কিছু হাওয়া জোগাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের আজ এক বড় সমস্যা জঙ্গলমহল ও লালগড় অঞ্চলে মাওবাদীদের সশস্ত্র তৎপরতা। একজনের পর একজন আঞ্চলিক সিপিএমের নেতা মাওবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন ও হচ্ছেন। সিপিএমও ছেড়ে কথা কইছে না। তবে মাওবাদীদের সঙ্গে দহরম-মহরম করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোধহয় আগুন নিয়েই খেলছেন। পশ্চিম মেদিনীপুর-ঝাড়খন্ড অঞ্চলের এসব মাওবাদীর সঙ্গে বাংলাদেশের মাধ্যমে আইএসআইয়ের যোগাযোগ বিচিত্র নয়। পুরুলিয়ায় জঙ্গলে অস্ত্র ফেলতে যে বিমান গিয়েছিল, তা বাংলাদেশ থেকেই উড়ে গিয়েছিল। সে ঘটনা এখনো রহস্যাবৃত। চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক মামলার মতো এ ঘটনারও সঠিক তদন্ত হলে এই অস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও তাদের পেছনে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সম্পর্ক উন্মোচিত হলে বিস্মিত হব না। ফলে জঙ্গলমহলের সশস্ত্র মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের নেত্রী যেভাবে খায়খাতির করছেন, তার জন্য তাঁকে আখেরে মূল্য দিতে হতে পারে। ভারতের বা যেকোনো দেশেরই ভরসা হচ্ছে গণতন্ত্র, সশস্ত্র সংঘাত নয়।
পশ্চিমবঙ্গের আরেক অস্থির এলাকা দার্জিলিং। পাহাড়ি মানুষের প্রতি দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বঞ্চনার ফলে সেখানেও অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। মমতা ব্যানার্জি দার্জিলিংয়ে গিয়ে যথারীতি পাহাড়িদের নানা গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। এসব প্রতিশ্রুতি হয়তো সাবধানে দেওয়া ভালো। কারণ, নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গেলে এসব প্রতিশ্রুতি যে তাঁকেই পূরণ করতে হবে!
যেটা প্রশ্ন, এই সার্বিক ক্ষয়ের বিরুদ্ধে সিপিএম কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? তৃণমূল যতটা আবেগায়িত একটা দল, ততটা সুসংগঠিত নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া তাদের অন্য কোনো নেতাও তেমন নেই। আর কেবল সিপিএমের বিরোধিতা ছাড়া তৃণমূলের কোনো মৌলিক বা নীতিগত বক্তব্যও নেই। এ রকম নীতি ছাড়া একদল কেবল সিপিএমের বিরোধিতার আবেগ দিয়ে কতটা কী করতে পারবে, সেটাও দেখার বিষয়। সম্প্রতি কিছু ভিন্ন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। যে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের জমি রক্ষার আন্দোলন করে তৃণমূল সিপিএমকে বেকায়দায় ফেলা হয়েছিল, আজ সেখানে রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কারখানা গড়তে চাইলে সিপিএমের লোকজনই ‘জমি রক্ষা কমিটি’ গড়েছেন! পাশার দান উল্টে যাচ্ছে! তা ছাড়া সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে সিপিএমের সমর্থক ছাত্রসংগঠনই জিতেছে। বোঝা যাচ্ছে, সুশিক্ষিত তরুণদের কাছে সিপিএমের আবেদন খুব কমেনি, বরং তৃণমূলের স্থূল আবেগময়তাই তেমন কল্কে পাচ্ছে না। তা ছাড়া নির্বাচন এখনো কয়েক মাস বাকি। এর মধ্যে অনেক হিসাব-নিকাশ ও অনুপাতই পাল্টে যেতে পারে। সিপিএম একটা সংগঠিত বড় দল। একটা নির্বাচনে হারলেই তাদের সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে না। তবে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে সিপিএময়ের অনেকে বসে পড়তে বা দলত্যাগ করতে পারে, যেমনটি ইঁঁদুরেরা পালিয়ে যায় ডুবন্ত জাহাজ থেকে। অবশ্য তাতে সিপিএমের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার খুব কারণ নেই। ৩২ বছর অবিচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় থাকার ফলে নানা রকম সুবিধাবাদীদের বেনোজল যেভাবে দলটিতে ঢুকেছিল, তারা বেরিয়ে গেলে দলটা বরং সুস্থই হবে।
আবার এর বিপরীতটাও ঘটতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লে একটা একশিলাভূত পার্টি কিন্তু তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়তে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির দুই কোটি সদস্য ছিল। মাত্র কয়েক সপ্তাহে তা প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। সিপিএমের সামনে সে বিপদটাও আছে।
সম্প্রতি কলকাতায় সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হালচাল কেমন বুঝছেন? তিনি তখন আমাকে তাঁর একটা ছড়া শোনালেন:
‘আঙ্গুলে ছাপ বোতামে চাপ
এদিকে পাপ ওদিকে পাপ
এদিকের পাপ হো’ল অনেকদিন
ওদিকে পাপকে এবার সুযোগ দিন’;
আমার যা বোঝার আমি বুঝলাম!
আগামী কয়েক মাস আসলেই তাই পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্য একটা কৌতূহলী সময়। আর সিপিএমের জন্য এ তো এক অগ্নিপরীক্ষা। কারণ, আগামী নির্বাচন দলটির জন্য কেবল একটা বিশেষ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন নয়, একটা মতাদর্শের সমস্যা ও সম্ভাবনারও এক ধরনের ফয়সালা তা।
তানভীর মোকাম্মেল: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
No comments