পরাধীন পাঁজরে মুক্তির স্বপ্ন by সিদরাতুল সিনড্রেলা
১৯৭১ সাল। স্বামী যেন কোথায় গেছে। চারদিকে শুধু গোলাগুলির আওয়াজ। তার সঙ্গে ভেসে আসছে কিছু মানুষের হূদয়-নিংড়ানো কান্না। ভয় পেয়ে গেছে স্ত্রী। না জানি স্বামী কোথায় গেছে, কেমন আছে? ভয়ে, অস্থিরতায় এক বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে স্বামীর খোঁজে। না, ফিরে পায়নি সে তার স্বামীকে। বরং পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে হারিয়েছে প্রিয় সন্তান আর নিজের জীবন। ঝালকাঠির এ গৃহবধূর স্বামী হলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। এমনই যন্ত্রণাদায়ক অনেক কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হোসেনের জীবনে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু কষ্টগুলো মুছে যায়নি আবুল হোসেনের জীবন থেকে।
ঝালকাঠি জেলার তিফইতনগরে তাঁর বাড়ি ছিল একসময়। সত্ ভাই আর মায়েদের জ্বালায় গ্রাম ছেড়েছেন সেই ছোটবেলায়। ছাড়া বলতে কি, যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে পড়া।
বাবা সৈয়দ আজিজউদ্দীন আহেমদ করেছিলেন তিনটি বিয়ে। তাঁর বড় স্ত্রী দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মারা গেলে বিয়ে করে আনেন সৈয়দ আবুল হোসেনের মাকে। ‘মায়ের লগেও বাবার বেশি দিন টিকে নাই। ওই যে সত্ ভাইরা আমারে মারত। মা সইতে পারত না। তখন বাবার লগে ঝগড়া করত। তাই আরেকজনরে বিয়া কইরা আনলেন’ বলছিলেন আবুল হোসেন।
‘আমার জীবনে আমি যত কষ্ট করছি, তা শুনলে কেউ চউক্ষে পানি ধইরা রাখতে পারে না। সত্ ভাইরা আমাকে বাক্সে ভরে রাখত। চৌকির নিচে রেখে ঘরে তালা মেরে দিত। আরও অনেক কষ্ট দিত।’ নিজের কষ্টের কথাগুলো বলে যেন হালকা হতে চাইছিলেন আবুল হোসেন।
যখন আবুল হোসেনের বয়স এক বছর, তখন তাঁর এক মামা তাঁকে ৮০ টাকায় কোনো এক লোকের কাছে বিক্রি করে দেন। সেই লোকের কোনো সন্তান ছিল না। কিছু দিন পর তাঁর নিজের বাচ্চা হলে মর্যাদা কমে যায় আবুল হোসেনের। আবার বিক্রি হন তিনি পাঁচ-ছয় বছর বয়সে। আবার পুরোনো নাটকের পুনরাবৃত্তি। না, আর সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপন করা হয়নি তাঁর। খুলনায় চলে গেছেন সেই ‘বিক্রীত জীবন থেকে’ ১৪ বছর বয়সে। রিকশা চালিয়েছেন, আরও কিছু কাজ করে কষ্টে জীবন পার করেছেন। এমনও দিন গেছে, যখন খাবার জোটেনি কারও কাছ থেকে, ভাতের মাড় চেয়ে নিয়ে খেয়ে দিন পার করেছেন। দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তখন তাঁর বয়স ২৮ বছর। ঘরে স্ত্রী আর সন্তান। ঘরের টান তাঁর কাছে দেশের টানের থেকে বড় হয়নি। গিয়েছিলেন যুদ্ধে। ৯ নম্বর সেক্টরে করেছেন যুদ্ধ। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছেন স্ত্রী ও সন্তানকে। ‘মুক্তিযুদ্ধে কত ভয়ের কাজ করসি। গল্লামারি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছি, অস্ত্র সংগ্রহ করেছি, পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছি। বেশি কষ্ট পাইছি যখন আমাগো সাথের মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান মারা গেছে। আমারও মাথার ওপর দিয়ে গুলি গেছে। চামড়া ছিঁড়ে গেছে। অল্পের জন্য বাঁইচা গেছি।’ ভাই বা সন্তানতুল্য সহযোদ্ধাকে হারানোর কষ্টটা যেন এখনো ভুলতে পারেননি আবুল হোসেন।
স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে যেন পাগলপ্রায় হয়ে পড়েছিলেন। দীর্ঘদিন ছিলেন একা। পরে জীবনের তাগিদেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় আবার। এখন সেই স্ত্রী আর চার সন্তান নিয়ে ঢাকাতেই আছেন তিনি। প্রতিদিন এক হাজার টাকার ফল এনে যা লাভ হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো সত্যিই কষ্টকর। উপরন্তু বয়সও তো হলো আবুল হোসেনের, তাই রোগগুলো যেন জোঁকের মতো ধরেছে। তবু টাকা কোথায় যে চিকিৎসা হবে? ‘তাও তো বড় মাইয়া গার্মেন্টসে কাজ করে বইলা কিছু টাকা পাওন যায়।’ বড় মেয়ে মাহমুদা গার্মেন্টসে কাজ করে বলে মাস শেষে এক হাজার ৬০০ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে তো বাসা ভাড়াও হয় না। তার ওপর ছোট দুই মেয়ে ফিরোজা, রাজিয়া ও ছেলে নজরুলের পড়ার খরচ তো আছেই।
বাবাকে তো মনেই পড়ে না তাঁর। মা মারা গেছেন ১০ বছর হলো। গ্রামে আছে কেবল কয়েকজন অত্যাচারী সত্ ভাই আর তাদের ছেলেমেয়েরা। তাই গ্রামে যাওয়া বলতে কেবল এক বা দুই বছর পর পর, শ্বশুরবাড়ি যাওয়া। স্বাধীনতার দুই বছর পর আবুল হোসেন এসেছিলেন ঢাকায়, তখন থেকেই এই পান্থপথ এলাকায়। বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন তিনি। এখন রাস্তার পাশেই বসেন মৌসুমি ফল নিয়ে। সকাল আটটায় এসে বাড়ি ফিরেন রাত ১১টায়। এত ধকল আর এই শরীরে সয় না। এক দিন টানা কাজ করলে পরের দুই দিন অসুস্থ থাকেন। তাই তাঁর কাজে একটু সহযোগিতা করার জন্য প্রতিদিন রান্না শেষ করে খাবার নিয়ে এসে আবুল হোসেনকে খাইয়ে কিছুক্ষণ দোকানে বসেন স্ত্রী তহমিনা বেগম। ততক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নেন আবুল হোসেন, পরে আবার শুরু করেন কাজ। গ্রামের স্মৃতি তাঁর কষ্টদায়ক হলেও তিনি বলেন, ‘কিছু টাকা হইলে গ্রামে ছোট একটা বাড়ি বানামু। তারপর বউ-মাইয়া-পোলা লইয়া সুখে থাকমু।’
বুকের ওপরে তাঁর স্বাধীন দেশের মুক্তিযোদ্ধার ব্যাজ আর বুকের ভেতরে পরাধীনতার শেকল। সেই পরাধীন পাঁজরে বাসা বেঁধেছে হাঁপানি, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, কিডনির রোগ। ‘আশা দেয় সকলে। কেউ কিছু করে না। ওই বলে যে তোমাগো লাইগা কিছু করমু, আর যায় গা। পরে আর দেহিও না তাদের।’ মিথ্যে আশ্বাস পেতে পেতে বিরক্ত আবুল হোসেন। চিন্তার বলিরেখা আবুল হোসেনের অভিব্যক্তিতে। অসুখের জন্য এর আগে ১০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন। সেটাই শোধ করা হয়নি। কীভাবে কী করবেন তিনি? ‘যদি একটা ভ্যানগাড়ি কিনতে পারতাম, তবে ঘুরে ঘুরে ব্যবসাটা ভালো হইত।’ কে জানে, কবে তাঁর সে আশা পূরণ হবে? কেউ জানেন কি, স্বাধীন দেশে এই মানুষগুলোর পরাধীনতার শেকল ছিঁড়বে কবে?
ঝালকাঠি জেলার তিফইতনগরে তাঁর বাড়ি ছিল একসময়। সত্ ভাই আর মায়েদের জ্বালায় গ্রাম ছেড়েছেন সেই ছোটবেলায়। ছাড়া বলতে কি, যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে পড়া।
বাবা সৈয়দ আজিজউদ্দীন আহেমদ করেছিলেন তিনটি বিয়ে। তাঁর বড় স্ত্রী দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মারা গেলে বিয়ে করে আনেন সৈয়দ আবুল হোসেনের মাকে। ‘মায়ের লগেও বাবার বেশি দিন টিকে নাই। ওই যে সত্ ভাইরা আমারে মারত। মা সইতে পারত না। তখন বাবার লগে ঝগড়া করত। তাই আরেকজনরে বিয়া কইরা আনলেন’ বলছিলেন আবুল হোসেন।
‘আমার জীবনে আমি যত কষ্ট করছি, তা শুনলে কেউ চউক্ষে পানি ধইরা রাখতে পারে না। সত্ ভাইরা আমাকে বাক্সে ভরে রাখত। চৌকির নিচে রেখে ঘরে তালা মেরে দিত। আরও অনেক কষ্ট দিত।’ নিজের কষ্টের কথাগুলো বলে যেন হালকা হতে চাইছিলেন আবুল হোসেন।
যখন আবুল হোসেনের বয়স এক বছর, তখন তাঁর এক মামা তাঁকে ৮০ টাকায় কোনো এক লোকের কাছে বিক্রি করে দেন। সেই লোকের কোনো সন্তান ছিল না। কিছু দিন পর তাঁর নিজের বাচ্চা হলে মর্যাদা কমে যায় আবুল হোসেনের। আবার বিক্রি হন তিনি পাঁচ-ছয় বছর বয়সে। আবার পুরোনো নাটকের পুনরাবৃত্তি। না, আর সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপন করা হয়নি তাঁর। খুলনায় চলে গেছেন সেই ‘বিক্রীত জীবন থেকে’ ১৪ বছর বয়সে। রিকশা চালিয়েছেন, আরও কিছু কাজ করে কষ্টে জীবন পার করেছেন। এমনও দিন গেছে, যখন খাবার জোটেনি কারও কাছ থেকে, ভাতের মাড় চেয়ে নিয়ে খেয়ে দিন পার করেছেন। দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তখন তাঁর বয়স ২৮ বছর। ঘরে স্ত্রী আর সন্তান। ঘরের টান তাঁর কাছে দেশের টানের থেকে বড় হয়নি। গিয়েছিলেন যুদ্ধে। ৯ নম্বর সেক্টরে করেছেন যুদ্ধ। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছেন স্ত্রী ও সন্তানকে। ‘মুক্তিযুদ্ধে কত ভয়ের কাজ করসি। গল্লামারি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছি, অস্ত্র সংগ্রহ করেছি, পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছি। বেশি কষ্ট পাইছি যখন আমাগো সাথের মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান মারা গেছে। আমারও মাথার ওপর দিয়ে গুলি গেছে। চামড়া ছিঁড়ে গেছে। অল্পের জন্য বাঁইচা গেছি।’ ভাই বা সন্তানতুল্য সহযোদ্ধাকে হারানোর কষ্টটা যেন এখনো ভুলতে পারেননি আবুল হোসেন।
স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে যেন পাগলপ্রায় হয়ে পড়েছিলেন। দীর্ঘদিন ছিলেন একা। পরে জীবনের তাগিদেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় আবার। এখন সেই স্ত্রী আর চার সন্তান নিয়ে ঢাকাতেই আছেন তিনি। প্রতিদিন এক হাজার টাকার ফল এনে যা লাভ হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো সত্যিই কষ্টকর। উপরন্তু বয়সও তো হলো আবুল হোসেনের, তাই রোগগুলো যেন জোঁকের মতো ধরেছে। তবু টাকা কোথায় যে চিকিৎসা হবে? ‘তাও তো বড় মাইয়া গার্মেন্টসে কাজ করে বইলা কিছু টাকা পাওন যায়।’ বড় মেয়ে মাহমুদা গার্মেন্টসে কাজ করে বলে মাস শেষে এক হাজার ৬০০ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে তো বাসা ভাড়াও হয় না। তার ওপর ছোট দুই মেয়ে ফিরোজা, রাজিয়া ও ছেলে নজরুলের পড়ার খরচ তো আছেই।
বাবাকে তো মনেই পড়ে না তাঁর। মা মারা গেছেন ১০ বছর হলো। গ্রামে আছে কেবল কয়েকজন অত্যাচারী সত্ ভাই আর তাদের ছেলেমেয়েরা। তাই গ্রামে যাওয়া বলতে কেবল এক বা দুই বছর পর পর, শ্বশুরবাড়ি যাওয়া। স্বাধীনতার দুই বছর পর আবুল হোসেন এসেছিলেন ঢাকায়, তখন থেকেই এই পান্থপথ এলাকায়। বিভিন্ন ধরনের কাজ করেছেন তিনি। এখন রাস্তার পাশেই বসেন মৌসুমি ফল নিয়ে। সকাল আটটায় এসে বাড়ি ফিরেন রাত ১১টায়। এত ধকল আর এই শরীরে সয় না। এক দিন টানা কাজ করলে পরের দুই দিন অসুস্থ থাকেন। তাই তাঁর কাজে একটু সহযোগিতা করার জন্য প্রতিদিন রান্না শেষ করে খাবার নিয়ে এসে আবুল হোসেনকে খাইয়ে কিছুক্ষণ দোকানে বসেন স্ত্রী তহমিনা বেগম। ততক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নেন আবুল হোসেন, পরে আবার শুরু করেন কাজ। গ্রামের স্মৃতি তাঁর কষ্টদায়ক হলেও তিনি বলেন, ‘কিছু টাকা হইলে গ্রামে ছোট একটা বাড়ি বানামু। তারপর বউ-মাইয়া-পোলা লইয়া সুখে থাকমু।’
বুকের ওপরে তাঁর স্বাধীন দেশের মুক্তিযোদ্ধার ব্যাজ আর বুকের ভেতরে পরাধীনতার শেকল। সেই পরাধীন পাঁজরে বাসা বেঁধেছে হাঁপানি, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, কিডনির রোগ। ‘আশা দেয় সকলে। কেউ কিছু করে না। ওই বলে যে তোমাগো লাইগা কিছু করমু, আর যায় গা। পরে আর দেহিও না তাদের।’ মিথ্যে আশ্বাস পেতে পেতে বিরক্ত আবুল হোসেন। চিন্তার বলিরেখা আবুল হোসেনের অভিব্যক্তিতে। অসুখের জন্য এর আগে ১০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন। সেটাই শোধ করা হয়নি। কীভাবে কী করবেন তিনি? ‘যদি একটা ভ্যানগাড়ি কিনতে পারতাম, তবে ঘুরে ঘুরে ব্যবসাটা ভালো হইত।’ কে জানে, কবে তাঁর সে আশা পূরণ হবে? কেউ জানেন কি, স্বাধীন দেশে এই মানুষগুলোর পরাধীনতার শেকল ছিঁড়বে কবে?
No comments