প্রান্তিক ভাষা বাংলা ও মাতৃভাষার অধিকার by আনু মুহাম্মদ
একুশে ফেব্রুয়ারি যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তত দিনে বাজার অর্থনীতির চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যে বাংলাদেশেই বাংলা ভাষার বাজারদর একদম নিচের দিকে। অতএব যে বাংলা ভাষার জন্য লড়াইকে কেন্দ্র করে একুশে ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ দিন হয়ে উঠল সেই ভাষা মোটামুটি পরিত্যক্ত পর্যায়ে আসার সময়েই দিনটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। যথার্থই একটি আনন্দের বিষয়, আবার একটি পরিহাসের বিষয়ও বটে।
এটা বলা অনাবশ্যক দেশে দেশে জনগণের যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, এর মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা থাকেই। প্রতিটি দেশে মানুষ লড়াই করেন তার নিজে দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে। প্রতিটি দেশের মানুষ লড়াই করেন নিজের ভূমিতে তার জায়গা তৈরির জন্য। কিন্তু এসব লড়াই ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে কখনো সঙ্গে সঙ্গে, কখনো একটু বিলম্বে। প্রতিটি দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক লড়াই অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে শক্তি জোগায়। এক দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন অন্য দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তির জন্য হুমকি হয়ে ওঠে।
আমরা সবাই জানি যে একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জনগণের লড়াইয়ের দিবস। কিন্তু এটি শুধু বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল না। এটি ছিল সব জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় কথা বলা, লেখা ও ভাব প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও। সে জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই একটি আন্তর্জাতিক বহুজাতিক দিবস। এই অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশই ঘটল এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে। এটা এমন এক সময় যখন মাতৃভাষায় শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও ভাব প্রকাশের অধিকার বিশ্বের অনেক মানুষই কার্যকর করতে পারছেন না। অধিকাংশ ভাষাই এখন হুমকির সম্মুখীন। অধিকাংশ ভাষাভাষী মানুষই বর্তমানে পরাজিত, বিপর্যস্ত অবস্থায় প্রাণপণে চেষ্টা করছেন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁদের সে চেষ্টাতেই একটি প্রতীকী অবলম্বন।
বেশির ভাগ জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে এ রকম প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রধান উন্নয়ন ধারার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। এই প্রত্যক্ষ সম্পর্ক অনুসন্ধান করতে গেলে আমরা এটাও উপলব্ধি করব যে যাকে আমরা বিশ্ব্বায়ন বলে জানি তা আসলে একচেটিয়াকরণ। কেননা বিশ্বের সব অঞ্চলের সব মানুষের জায়গা করে দিয়ে এই বিশ্বায়ন ঘটছে না। বর্তমান ধারার বিশ্বায়ন বস্তুত সব অঞ্চলের মানুষকে শৃঙ্খলিত করে ক্ষুদ্র অংশের একক ভাষা, সংস্কৃতি, মতাদর্শ, রুচি এবং একচেটিয়া মালিকানা সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আরেক নাম।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমরা এর প্রকাশ দেখি, পুরো বিশ্বকে কতিপয় বহুজাতিক সংস্থার করতলগত করার মধ্যে; মতাদর্শিক ক্ষেত্রে আমরা এর প্রকাশ দেখি শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতিগত, বর্ণগত নিপীড়ন ও মতাদর্শের স্পষ্ট-অস্পষ্ট একটি কাঠামোর আধিপত্য সৃষ্টির মধ্যে এবং আমরা এর প্রকাশ দেখি অন্য সব ভাষার ওপর কয়েকটি ভাষার বিশেষত একটি ভাষার একচেটিয়া আধিপত্যের মধ্যে।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উপনিবেশ-উত্তর দেশে ঔপনিবেশিক ভাষার যে আধিপত্য দেখা যায় তা এক ঐতিহাসিক আধিপত্যেরই ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশে ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষাও প্রধান ভাষা হয়ে উঠতে পারত যদি এই অঞ্চলের ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স বা স্পেন ইত্যাদি হতো। ইংরেজি এ অঞ্চলে এখন প্রভুভাষা কারণ ব্রিটিশরা এখানে ঔপনিবেশিক প্রভু ছিল। ইংরেজি এখন সারা বিশ্বের প্রভুভাষা কারণ পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এখন কেন্দ্রীয় ও প্রধান শক্তি ইংরেজিভাষী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিটিশ ইংরেজি থেকে মার্কিন ইংরেজিতে স্থানান্তরের পেছনেও বিশ্ব ক্ষমতার বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস সম্পর্কিত।
ইংরেজি ভাষা এখন শুধু একটি ভাষাই নয়, এটি একটি ক্ষমতার প্রতীকও। ইংরেজি ভাষা জানা মানে সেই ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া, এই ভাষা জানা মানে অনেক সুযোগের দরজা খুলে যাওয়া, এই ভাষা জানা মানে হীন দীন অবস্থা থেকে সমৃদ্ধ শক্তিধর অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া। বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা জানলে শুধু ক্ষমতার স্বাদই পাওয়া যায় তা নয়, কর্মসংস্থান ও উপার্জনের বিভিন্ন রাস্তার সঙ্গেও তার যোগ প্রত্যক্ষ। ইংরেজি ভাষা জানা না থাকলে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ, বিশ্বের খবরাখবর, এমনকি শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যোগাযোগও বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলা ভাষায় এগুলোর স্বচ্ছন্দ রূপান্তরও কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি।
বাংলা ভাষার তাহলে সমস্যা কী? বাংলা ভাষায় এই কাজগুলো হয় না কেন? এটা কি ভাষার গাঠনিক সমস্যা না এই ভাষা যে সমাজের, তার অবস্থান ও গতিপ্রকৃতির প্রকাশ? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে অন্যান্য ভাষার এবং অন্য ভাষাভাষীদের অবস্থাও আমাদের দেখতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের হিন্দি ভাষার কি একই অবস্থা? না। হিন্দি ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অধিপতি ভাষা। বিশ্বেও তার প্রভাব বাড়ছে। হিন্দি ভাষাতে বিভিন্ন ভাষা থেকে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত এবং শক্তিশালী থাকায় কেউ শুধু হিন্দি ভাষাভাষী হলেও তার বিশ্ব-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। ইংরেজির দাপট সেখানেও আছে কিন্তু হিন্দি পাল্টা দাপটের জায়গাও তৈরি করেছে। পাশাপাশি হিন্দি ভাষা ভারতের মধ্যেও অন্যান্য ভাষার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। কারণ হিন্দিভাষী একচেটিয়া মালিকদের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়ছে।
আরবি ভাষাভাষীদের অবস্থাও অতটা করুণ নয়। এই ভাষাটিও সচল, সক্রিয় এবং বিশ্বের গতিধারাকে ধারণ করার মতো গতিশীলতা সেখানে আমরা দেখি। চীনা ও জাপানি ভাষা এখন বিশ্ব পরিসরে পাল্টা ক্ষমতার জায়গা তৈরি করছে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে জাতিসংঘ পর্যন্ত সর্বত্র এই চেষ্টা উপলব্ধি করা যায়। এ ছাড়া কোরিয়া বা থাইল্যান্ডও ইংরেজি দিয়ে ভেসে যায়নি। এসব দেশের মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষা নিয়ে যুদ্ধ করে টিকে থাকছে, বিকশিত হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যে দেশ, পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক যে কাঠামোতেই হোক না কেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে বা করছে অথচ সে দেশের জনগণের ভাষা পরিত্যক্ত হয়েছে। চীন, জাপান তো বটেই এমনকি দুর্বলতর কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বা লাতিন আমেরিকা সর্বত্রই আমরা দেখি জোরদারভাবে তাদের জনগণের ভাষা যথেষ্ট গুরুত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে টিকে আছে। আর সেসব দেশেই ঔপনিবেশিক প্রভুর ভাষার দাপট একচেটিয়া, যেসব দেশে উন্নয়নের কোনো শেকড় তৈরি হয়নি। যে দেশে শাসক শ্রেণী পরগাছার মতো ঝুলে থাকে, সে দেশে শাসক শ্রেণীর পরজীবী লুণ্ঠন/পাচারপ্রক্রিয়ায় মাতৃভাষা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ভাষা হিসেবে কোণঠাসা হয়ে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এই ঘটনাই দেখি।
বাংলাদেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা যে রীতিমতো প্রান্তিক বা অপাঙেক্তয় ভাষায় পরিণত হয়েছে তার অনেকখানি ব্যাখ্যা তাই এ দেশের শাসকশ্রেণীর অবস্থান ও ঐতিহাসিক ধারা থেকে পাওয়া যাবে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রান্তিক এবং এই প্রান্তিক অবস্থান তৈরি হয়েছে ও টিকে থাকছে এ দেশের পরজীবী শাসকশ্রেণীর কারণে। এই শ্রেণী তার গঠনপ্রকৃতি ও বিকাশধারার কারণে দেশে উত্পাদনশীল ভিত্তি নির্মাণ করার চেয়ে দ্রুত লুণ্ঠন, দখল ও দুর্নীতি করে সম্পদ গঠন ও পাচারেই বেশি আগ্রহী।
উত্পাদনশীল ভিত্তি যে দেশে টেকসইভাবে নির্মিত হতে পারে না সে দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সাধারণ ভিত্তি নির্মাণের তাগিদও তৈরি হয় না। তৈরি হয় না দেশীয় কর্মসংস্থানের ভিত্তি। তৈরি হয় না জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। সুতা দিয়ে ঝুলে থাকা শাসকশ্রেণী এ দেশে প্রতিনিধিত্ব করে বাইরের ক্ষমতার, এই ক্ষমতাই দেশের ভেতরে তার দাপট নিশ্চিত করে। নিজস্ব পরিচয়, নিজস্ব সক্ষমতা নিয়ে দাঁড়ানোয় তার ক্ষমতা নেই, ভরসা নেই। মধ্যবিত্তের আত্মবিনাশী হীনম্মন্যতাবোধ এর সঙ্গে যোগ হয়ে এই শেকড়বিচ্ছিন্নতা আরও বৃদ্ধি করে। সে জন্য তাদের আধিপত্য থাকা অবস্থায় সামগ্রিকভাবে যে নৈরাজিক ধ্বংসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে দেশীয় ভাষা বা ভাষাসমূহ বাদ যায় না।
ক্ষমতার চর্চা হয় তার পরও। প্রান্তিক অবস্থানে কোণঠাসা বাংলা ভাষা দিয়ে আবার ক্ষমতার চর্চা হয় দুর্বলতর জাতিগোষ্ঠীর ওপর। মাতৃভাষার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলা ভাষাকে শাসকশ্রেণী অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার খর্ব করার কাজে লাগায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার সাংবিধানিক অধিকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখনো নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ এখনো যথাযথভাবে সমর্থিত হয়নি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকৃতপক্ষে আমাদের সামনে অনেক প্রশ্ন হাজির করে। অনেক বিষয়কে সামনে আনে। শুধু উত্সব আর সংবর্ধনা দিয়ে এই প্রশ্নগুলো ঢাকা যায় না যে:
কেন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষ এখনো নিজের মাতৃভাষার বর্ণমালা চেনেন না বা তার কার্যকর ব্যবহার করতে সক্ষম নন?
কেন এ দেশের মানুষ মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করতে পারেন না?
কেন এ দেশে বাংলা ভাষা নিজেই একটি প্রান্তিক, কোণঠাসা এবং অবিরাম অপমানের ভাষা হিসেবে পরিগণিত?
বাংলা ভাষা কোনটি? তার অস্তিত্ব কোন জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য?
কেন এ দেশে বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার আইনগতভাবেও স্বীকৃত নয়?
তরল আবেগ, প্রতারণা আর প্রহসনের আনুষ্ঠানিকতা থেকে বেরিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে চাইলে এই প্রশ্নগুলোর জবাব সন্ধান করেই আমাদের এগোতে হবে।
আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এটা বলা অনাবশ্যক দেশে দেশে জনগণের যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, এর মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা থাকেই। প্রতিটি দেশে মানুষ লড়াই করেন তার নিজে দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে। প্রতিটি দেশের মানুষ লড়াই করেন নিজের ভূমিতে তার জায়গা তৈরির জন্য। কিন্তু এসব লড়াই ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে কখনো সঙ্গে সঙ্গে, কখনো একটু বিলম্বে। প্রতিটি দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক লড়াই অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে শক্তি জোগায়। এক দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন অন্য দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তির জন্য হুমকি হয়ে ওঠে।
আমরা সবাই জানি যে একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জনগণের লড়াইয়ের দিবস। কিন্তু এটি শুধু বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল না। এটি ছিল সব জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় কথা বলা, লেখা ও ভাব প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও। সে জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই একটি আন্তর্জাতিক বহুজাতিক দিবস। এই অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশই ঘটল এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে। এটা এমন এক সময় যখন মাতৃভাষায় শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও ভাব প্রকাশের অধিকার বিশ্বের অনেক মানুষই কার্যকর করতে পারছেন না। অধিকাংশ ভাষাই এখন হুমকির সম্মুখীন। অধিকাংশ ভাষাভাষী মানুষই বর্তমানে পরাজিত, বিপর্যস্ত অবস্থায় প্রাণপণে চেষ্টা করছেন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁদের সে চেষ্টাতেই একটি প্রতীকী অবলম্বন।
বেশির ভাগ জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে এ রকম প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রধান উন্নয়ন ধারার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। এই প্রত্যক্ষ সম্পর্ক অনুসন্ধান করতে গেলে আমরা এটাও উপলব্ধি করব যে যাকে আমরা বিশ্ব্বায়ন বলে জানি তা আসলে একচেটিয়াকরণ। কেননা বিশ্বের সব অঞ্চলের সব মানুষের জায়গা করে দিয়ে এই বিশ্বায়ন ঘটছে না। বর্তমান ধারার বিশ্বায়ন বস্তুত সব অঞ্চলের মানুষকে শৃঙ্খলিত করে ক্ষুদ্র অংশের একক ভাষা, সংস্কৃতি, মতাদর্শ, রুচি এবং একচেটিয়া মালিকানা সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আরেক নাম।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমরা এর প্রকাশ দেখি, পুরো বিশ্বকে কতিপয় বহুজাতিক সংস্থার করতলগত করার মধ্যে; মতাদর্শিক ক্ষেত্রে আমরা এর প্রকাশ দেখি শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতিগত, বর্ণগত নিপীড়ন ও মতাদর্শের স্পষ্ট-অস্পষ্ট একটি কাঠামোর আধিপত্য সৃষ্টির মধ্যে এবং আমরা এর প্রকাশ দেখি অন্য সব ভাষার ওপর কয়েকটি ভাষার বিশেষত একটি ভাষার একচেটিয়া আধিপত্যের মধ্যে।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উপনিবেশ-উত্তর দেশে ঔপনিবেশিক ভাষার যে আধিপত্য দেখা যায় তা এক ঐতিহাসিক আধিপত্যেরই ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশে ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষাও প্রধান ভাষা হয়ে উঠতে পারত যদি এই অঞ্চলের ঔপনিবেশিক প্রভু ফ্রান্স বা স্পেন ইত্যাদি হতো। ইংরেজি এ অঞ্চলে এখন প্রভুভাষা কারণ ব্রিটিশরা এখানে ঔপনিবেশিক প্রভু ছিল। ইংরেজি এখন সারা বিশ্বের প্রভুভাষা কারণ পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এখন কেন্দ্রীয় ও প্রধান শক্তি ইংরেজিভাষী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিটিশ ইংরেজি থেকে মার্কিন ইংরেজিতে স্থানান্তরের পেছনেও বিশ্ব ক্ষমতার বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস সম্পর্কিত।
ইংরেজি ভাষা এখন শুধু একটি ভাষাই নয়, এটি একটি ক্ষমতার প্রতীকও। ইংরেজি ভাষা জানা মানে সেই ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া, এই ভাষা জানা মানে অনেক সুযোগের দরজা খুলে যাওয়া, এই ভাষা জানা মানে হীন দীন অবস্থা থেকে সমৃদ্ধ শক্তিধর অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া। বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা জানলে শুধু ক্ষমতার স্বাদই পাওয়া যায় তা নয়, কর্মসংস্থান ও উপার্জনের বিভিন্ন রাস্তার সঙ্গেও তার যোগ প্রত্যক্ষ। ইংরেজি ভাষা জানা না থাকলে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ, বিশ্বের খবরাখবর, এমনকি শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যোগাযোগও বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলা ভাষায় এগুলোর স্বচ্ছন্দ রূপান্তরও কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি।
বাংলা ভাষার তাহলে সমস্যা কী? বাংলা ভাষায় এই কাজগুলো হয় না কেন? এটা কি ভাষার গাঠনিক সমস্যা না এই ভাষা যে সমাজের, তার অবস্থান ও গতিপ্রকৃতির প্রকাশ? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে অন্যান্য ভাষার এবং অন্য ভাষাভাষীদের অবস্থাও আমাদের দেখতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের হিন্দি ভাষার কি একই অবস্থা? না। হিন্দি ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অধিপতি ভাষা। বিশ্বেও তার প্রভাব বাড়ছে। হিন্দি ভাষাতে বিভিন্ন ভাষা থেকে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত এবং শক্তিশালী থাকায় কেউ শুধু হিন্দি ভাষাভাষী হলেও তার বিশ্ব-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই। ইংরেজির দাপট সেখানেও আছে কিন্তু হিন্দি পাল্টা দাপটের জায়গাও তৈরি করেছে। পাশাপাশি হিন্দি ভাষা ভারতের মধ্যেও অন্যান্য ভাষার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। কারণ হিন্দিভাষী একচেটিয়া মালিকদের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়ছে।
আরবি ভাষাভাষীদের অবস্থাও অতটা করুণ নয়। এই ভাষাটিও সচল, সক্রিয় এবং বিশ্বের গতিধারাকে ধারণ করার মতো গতিশীলতা সেখানে আমরা দেখি। চীনা ও জাপানি ভাষা এখন বিশ্ব পরিসরে পাল্টা ক্ষমতার জায়গা তৈরি করছে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে জাতিসংঘ পর্যন্ত সর্বত্র এই চেষ্টা উপলব্ধি করা যায়। এ ছাড়া কোরিয়া বা থাইল্যান্ডও ইংরেজি দিয়ে ভেসে যায়নি। এসব দেশের মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষা নিয়ে যুদ্ধ করে টিকে থাকছে, বিকশিত হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যে দেশ, পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক যে কাঠামোতেই হোক না কেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে বা করছে অথচ সে দেশের জনগণের ভাষা পরিত্যক্ত হয়েছে। চীন, জাপান তো বটেই এমনকি দুর্বলতর কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন বা লাতিন আমেরিকা সর্বত্রই আমরা দেখি জোরদারভাবে তাদের জনগণের ভাষা যথেষ্ট গুরুত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে টিকে আছে। আর সেসব দেশেই ঔপনিবেশিক প্রভুর ভাষার দাপট একচেটিয়া, যেসব দেশে উন্নয়নের কোনো শেকড় তৈরি হয়নি। যে দেশে শাসক শ্রেণী পরগাছার মতো ঝুলে থাকে, সে দেশে শাসক শ্রেণীর পরজীবী লুণ্ঠন/পাচারপ্রক্রিয়ায় মাতৃভাষা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ভাষা হিসেবে কোণঠাসা হয়ে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এই ঘটনাই দেখি।
বাংলাদেশে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা যে রীতিমতো প্রান্তিক বা অপাঙেক্তয় ভাষায় পরিণত হয়েছে তার অনেকখানি ব্যাখ্যা তাই এ দেশের শাসকশ্রেণীর অবস্থান ও ঐতিহাসিক ধারা থেকে পাওয়া যাবে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রান্তিক এবং এই প্রান্তিক অবস্থান তৈরি হয়েছে ও টিকে থাকছে এ দেশের পরজীবী শাসকশ্রেণীর কারণে। এই শ্রেণী তার গঠনপ্রকৃতি ও বিকাশধারার কারণে দেশে উত্পাদনশীল ভিত্তি নির্মাণ করার চেয়ে দ্রুত লুণ্ঠন, দখল ও দুর্নীতি করে সম্পদ গঠন ও পাচারেই বেশি আগ্রহী।
উত্পাদনশীল ভিত্তি যে দেশে টেকসইভাবে নির্মিত হতে পারে না সে দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সাধারণ ভিত্তি নির্মাণের তাগিদও তৈরি হয় না। তৈরি হয় না দেশীয় কর্মসংস্থানের ভিত্তি। তৈরি হয় না জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। সুতা দিয়ে ঝুলে থাকা শাসকশ্রেণী এ দেশে প্রতিনিধিত্ব করে বাইরের ক্ষমতার, এই ক্ষমতাই দেশের ভেতরে তার দাপট নিশ্চিত করে। নিজস্ব পরিচয়, নিজস্ব সক্ষমতা নিয়ে দাঁড়ানোয় তার ক্ষমতা নেই, ভরসা নেই। মধ্যবিত্তের আত্মবিনাশী হীনম্মন্যতাবোধ এর সঙ্গে যোগ হয়ে এই শেকড়বিচ্ছিন্নতা আরও বৃদ্ধি করে। সে জন্য তাদের আধিপত্য থাকা অবস্থায় সামগ্রিকভাবে যে নৈরাজিক ধ্বংসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে দেশীয় ভাষা বা ভাষাসমূহ বাদ যায় না।
ক্ষমতার চর্চা হয় তার পরও। প্রান্তিক অবস্থানে কোণঠাসা বাংলা ভাষা দিয়ে আবার ক্ষমতার চর্চা হয় দুর্বলতর জাতিগোষ্ঠীর ওপর। মাতৃভাষার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলা ভাষাকে শাসকশ্রেণী অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার খর্ব করার কাজে লাগায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার সাংবিধানিক অধিকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখনো নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ এখনো যথাযথভাবে সমর্থিত হয়নি।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকৃতপক্ষে আমাদের সামনে অনেক প্রশ্ন হাজির করে। অনেক বিষয়কে সামনে আনে। শুধু উত্সব আর সংবর্ধনা দিয়ে এই প্রশ্নগুলো ঢাকা যায় না যে:
কেন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষ এখনো নিজের মাতৃভাষার বর্ণমালা চেনেন না বা তার কার্যকর ব্যবহার করতে সক্ষম নন?
কেন এ দেশের মানুষ মাতৃভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করতে পারেন না?
কেন এ দেশে বাংলা ভাষা নিজেই একটি প্রান্তিক, কোণঠাসা এবং অবিরাম অপমানের ভাষা হিসেবে পরিগণিত?
বাংলা ভাষা কোনটি? তার অস্তিত্ব কোন জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য?
কেন এ দেশে বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার আইনগতভাবেও স্বীকৃত নয়?
তরল আবেগ, প্রতারণা আর প্রহসনের আনুষ্ঠানিকতা থেকে বেরিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে চাইলে এই প্রশ্নগুলোর জবাব সন্ধান করেই আমাদের এগোতে হবে।
আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments