নাসির ভাইকে খুব মনে পড়ে -স্মরণ by পান্না বালা
ঠিক এক বছর আগে ২ নভেম্বর ভোরে চলে গেলেন নাসিরউদ্দীন আহমেদ মুসা। আমাদের সবার নাসির ভাই। আমরা নানা পরিচয়ে চিনি নাসির মুসাকে। একজন মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, শিক্ষানুরাগী। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা তথা শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটি আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। কবিতা লিখতেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন একবুক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্ত সে আশা পূরণ না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন হতাশ, বেদনাহত। তারই প্রকাশ ১৯৮৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর লেখা ‘স্বাধীনতার সংলাপ’ নামের কবিতায়। ‘এই ষোলই ডিসেম্বরে-/ এক বুক আশা নিয়ে ফিরেছিলাম ঘরে।/ আজ সেই ষোলই ডিসেম্বর/ দীর্ঘ ১৬ বছর পর,/ এক বুক শূন্যতায়-/ ভরা আমার ঘর।’
ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন। কবিতা লেখা নিয়ে তাঁর জীবনে ঘটেছে অনেক অম্ল-মধুর ঘটনা। ভর্তি পরীক্ষার খাতায় স্বরচিত কবিতা লেখার অপরাধে ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীর বাছাই পরীক্ষায় অঙ্ক খাতায় কবিতা লিখে বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। সে যাত্রায় তাাঁক উদ্ধার করেছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নলিনীরঞ্জন চক্রবর্তী। ১৯৬৯ সালে ‘স্বাধীন দেশের নগরিক তবু পরাধীন হয়ে বাঁচি’ কবিতাটি লেখার অপরাধে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। এ ঘটনার পর তাঁর মা হাজেরা বেগম ও বাবা মুন্সী কবিরউদ্দীনের পরামর্শে বড় ভাই চিত্রশিল্পী এম মহিউদ্দীন বাড়ির পাশের পুকুরে বস্তায় ভরে তাঁর লেখা কবিতা ও গানের পাণ্ডুলিপি ফেলে দেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ইঙ্গিত নামের একটি সংকলন সম্পাদনার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
১৯৪৯ সালের ১ জুলাই ভাঙ্গার সদরদী গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম হয় তাঁর। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৮ সালে রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮১ সালে এলএলবি পাস করেন।
১৯৬৯ সালে তিনি সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি ফরিদপুর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। গণ-অভ্যুথানের সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন এবং কারারুদ্ধ হন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
বাংলা একাডেমীর চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে আসেন ফরিদপুরে। ফরিদপুর ইয়াসিন কলেজ এবং পরে ভাঙ্গা কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর মধুখালী আয়েনউদ্দিন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯২ সালে তিনি ফরিদপুর শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ফরিদপুর সিটি কলেজ। কলেজের নিবন্ধন করা, জায়গা জোগাড় করাসহ প্রতিটি কাজ তিনি করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু কলেজটি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার পর একটি মহল নাসির মুসার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। ২০০৬ সালে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। তাঁকে অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনটি মামলাই প্রমাণিত না হওয়ায় খারিজ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের আগস্টে তাঁকে আবার সিটি কলেজের অধ্যক্ষের পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। জীবনের এই সংকটময় সময়ে গভীর দুশ্চিন্তায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অনেক ভালোবাসা, শ্রম আর নিষ্ঠা দিয়ে তিনি সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এ কলেজই তাঁর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এ জন্য তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ সিটি কলেজ চত্বরে নেওয়া হয়নি। এ প্রতিবাদের মাধ্যমেই পদে পদে ঘা খাওয়া লাঞ্ছিত-বঞ্চিত এ মানুষটি নিজের শেষ অভিমানের জানান দিয়ে যান।
পান্না বালা: সাংবাদিক।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন একবুক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্ত সে আশা পূরণ না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন হতাশ, বেদনাহত। তারই প্রকাশ ১৯৮৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর লেখা ‘স্বাধীনতার সংলাপ’ নামের কবিতায়। ‘এই ষোলই ডিসেম্বরে-/ এক বুক আশা নিয়ে ফিরেছিলাম ঘরে।/ আজ সেই ষোলই ডিসেম্বর/ দীর্ঘ ১৬ বছর পর,/ এক বুক শূন্যতায়-/ ভরা আমার ঘর।’
ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন। কবিতা লেখা নিয়ে তাঁর জীবনে ঘটেছে অনেক অম্ল-মধুর ঘটনা। ভর্তি পরীক্ষার খাতায় স্বরচিত কবিতা লেখার অপরাধে ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীর বাছাই পরীক্ষায় অঙ্ক খাতায় কবিতা লিখে বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। সে যাত্রায় তাাঁক উদ্ধার করেছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নলিনীরঞ্জন চক্রবর্তী। ১৯৬৯ সালে ‘স্বাধীন দেশের নগরিক তবু পরাধীন হয়ে বাঁচি’ কবিতাটি লেখার অপরাধে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। এ ঘটনার পর তাঁর মা হাজেরা বেগম ও বাবা মুন্সী কবিরউদ্দীনের পরামর্শে বড় ভাই চিত্রশিল্পী এম মহিউদ্দীন বাড়ির পাশের পুকুরে বস্তায় ভরে তাঁর লেখা কবিতা ও গানের পাণ্ডুলিপি ফেলে দেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ইঙ্গিত নামের একটি সংকলন সম্পাদনার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
১৯৪৯ সালের ১ জুলাই ভাঙ্গার সদরদী গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম হয় তাঁর। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৮ সালে রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮১ সালে এলএলবি পাস করেন।
১৯৬৯ সালে তিনি সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি ফরিদপুর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। গণ-অভ্যুথানের সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন এবং কারারুদ্ধ হন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
বাংলা একাডেমীর চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে আসেন ফরিদপুরে। ফরিদপুর ইয়াসিন কলেজ এবং পরে ভাঙ্গা কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর মধুখালী আয়েনউদ্দিন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯২ সালে তিনি ফরিদপুর শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ফরিদপুর সিটি কলেজ। কলেজের নিবন্ধন করা, জায়গা জোগাড় করাসহ প্রতিটি কাজ তিনি করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু কলেজটি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার পর একটি মহল নাসির মুসার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। ২০০৬ সালে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। তাঁকে অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনটি মামলাই প্রমাণিত না হওয়ায় খারিজ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের আগস্টে তাঁকে আবার সিটি কলেজের অধ্যক্ষের পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। জীবনের এই সংকটময় সময়ে গভীর দুশ্চিন্তায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। অনেক ভালোবাসা, শ্রম আর নিষ্ঠা দিয়ে তিনি সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এ কলেজই তাঁর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এ জন্য তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ সিটি কলেজ চত্বরে নেওয়া হয়নি। এ প্রতিবাদের মাধ্যমেই পদে পদে ঘা খাওয়া লাঞ্ছিত-বঞ্চিত এ মানুষটি নিজের শেষ অভিমানের জানান দিয়ে যান।
পান্না বালা: সাংবাদিক।
No comments