কুয়েটে রাজনীতি বন্ধই থাকবে একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত
এদিকে, বুধবার দিনভর ক্যাম্পাসে থমথমে অবস্থা বিরাজ করলেও নতুন করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগকে দায়ী করে সংবাদ সম্মেলন করেছে ছাত্রদল। এর আগে দুপুর দেড়টার দিকে উপাচার্যের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবিতে কুয়েটের প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ৩টার পর অবশ্য শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সরে যায়।
সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় পাঁচ সিদ্ধান্ত: খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) গতকাল সিন্ডিকেটের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার ও প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান ভূঞা স্বাক্ষরিত সিন্ডিকেট সভার কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
কুয়েটের প্রো-ভিসি ড. শেখ শরীফুল আলম জানান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. এম এ হাসেমকে সভাপতি ও সহকারী পরিচালক (ছাত্র ও কল্যাণ) শাহ মুহম্মদ আজমত উল্লাহকে সদস্য সচিব এবং প্রফেসর ড. মোহাম্মাদ আবু ইউসুফ ও প্রফেসর ড. আবু জাকির মোর্শেদকে সদস্য করে চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। এ ছাড়া অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে- একা?ডে?মিক কার্যক্রম ২৮শে ফেব্রুয়া?রি পর্যন্ত স্থ?গিত, আহতদের সকল চিকিৎসা খরচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মচারীদের সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধাদেশ বহাল রাখা। যদি কেউ এ আদেশ অমান্য করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। এ ছাড়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বহিরাগতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের সাময়িক বহিষ্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সকাল থেকেই অনেক শিক্ষার্থী হল ত্যাগ করেন। ক্যাম্পাসের বাইরে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে যারা ভাড়া রয়েছেন, তাদের ভেতর ভয় এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা রয়েছেন উদ্বিগ্ন।
কুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি ঘিরে মঙ্গলবার ছাত্রদল ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। তাদের অধিকাংশের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। আহতদের কুয়েটের মেডিকেল সেন্টারসহ আশপাশের বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় আটক করা হয়েছে পাঁচজনকে।
এ ব্যাপারে খানজাহান আলী থানার ওসি মো. কবির হোসেন বলেন, ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তবে থানায় মামলা হয়নি।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (নর্থ) মো. নাজমুল হাসান রাজীব বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় গতরাতে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের গেটে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনে তালা: এদিকে মঙ্গলবার রাতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের শাস্তি এবং উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ছাত্র কল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগসহ ছয় দফা দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বুধবার দুপুর ১টা পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। এরপর দুপর দেড়টার দিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কুয়েট মেডিকেল সেন্টারের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা কুয়েটের প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। মঙ্গলবার রাত থেকে ভিসি প্রফেসর ড. মাছুদ মেডিকেল সেন্টারে অবস্থান করছিলেন। অসুস্থ থাকার কারণে তিনি সেখানে অবস্থান করার কথা জানালেও ছাত্ররা সারা রাত তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল বলে জানান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে বুধবার বেলা সাড়ে ৩টার পর শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সরে যান।
ছাত্রদল দায়ী করলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শিবিরকে: খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের গুপ্ত কর্মী এবং ক্যাম্পাসে রয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদী নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ কর্মীদের দায়ী করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ। সেইসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে শুধুমাত্র ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ রাজনীতি করতে পারবে, আর অন্য কোনো সংগঠন করতে পারবে না- এটা তো হতে পারে না’। কুয়েটে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার দুপুরে ছাত্রদল খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন নেতৃবৃন্দ। সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আফসান মো. ইয়াহিয়া।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে নতুন একটি বাংলাদেশে আমরা পদার্পন করেছি। সেই বাংলাদেশে যদি আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলি ছাত্র রাজনীতি থাকবে না। বিগত জুলাই-আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না আনলে রাজনীতি করাটা কঠিন হবে। ছাত্রদল শুরু থেকেই ইতিবাচক রাজনীতি করে আসছে। সংকটটা তখনই প্রকট হবে, যদি আপনি জুলাই-আগস্টের স্পিরিটের সঙ্গে না যান। ছাত্রদল সবসময় জুলাই-আগস্টের স্পিরিটকে ধারণ করে প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি করতে চায়। আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চাই। যেখানে সব দলের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে। ছাত্রলীগের মতো একটি দলই রাজনীতি করবে বাকিদের যদি রাজনীতি করতে না দেন তাহলে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন, সেই শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম বলেন, কুয়েটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি রয়েছে। এটি সম্পূর্ণ একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন। তারা রাজনৈতিক দল গঠন করে আগামীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা কুয়েটে নিজেদের কার্যক্রম চালু রেখে কোন মুখে দাবি করে যে তারা এখানে ছাত্র রাজনীতি চালু করতে দেবে না। কুয়েটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্যাডে হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং আরিফ সোহেল স্বাক্ষরিত ৭৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি প্রকাশিত হয়েছে। সেই কমিটি স্পষ্ট প্রকাশ পায় যে সেখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু আছে।
তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবারের ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে- ছাত্রদলের ছেলেরা হেঁটে যাচ্ছে, অপরদিকে ওরা মিছিল নিয়ে আসছে। সেখানে প্রতিষ্ঠানের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ওমর ফারুক দেখিয়ে দিচ্ছে ছাত্রদলের ছেলেরা যাচ্ছে এবং তার উস্কানিতে ছাত্রদলের ছেলেদের তারা ধরেছে এবং পরবর্তী প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, ছাত্রলীগের মতো যারা আচরণ করবে, তাদের পরিণতিও ছাত্রলীগের মতো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আফসান মো. ইয়াহিয়া বলেন, মঙ্গলবার বিকালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)- এ একটি চরম অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। পাল্টাপাল্টি হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দা। আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে এখানে সরজমিন তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এসেছি। আমরা আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করার সঙ্গে সঙ্গে উক্ত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং এসব ন্যক্কারজনক হামলাতে ও এসবের উস্কানিতে জড়িত যেই হোক না কেন, সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক তাদের সকলকে বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অনলাইনে ও অফলাইনে নিরন্তর অপপ্রচারের মাধ্যমে সত্য ঘটনাকে চাপা দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নামে যে মিথ্যা অপবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, তার জবাবে বাস্তব প্রেক্ষাপটে আমাদের সংগঠনের নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করা অতি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও আমরা এখানে তদন্তের দায়ভার নিয়ে এসেছি এবং মোটাদাগে একটি প্রতিবেদন আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় সংসদের কাছে জমা দেবো, কিন্তু তারপরেও প্রশাসন কর্তৃক আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পর বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত এসব ঘটনার পুরো সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (ওঈঈচজ)-এর ধারা নং ১৯, ২১ ও ২২ অনুসারে রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য হয়ে বাকস্বাধীনতার চর্চা ও সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করা সকল শিক্ষার্থীর স্বীকৃত অধিকার। তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে বর্তমানে ফ্যাসিবাদ ও দখলদারিত্বের চর্চা যখন অসম্ভব, তখন সেই ফ্যাসিবাদ ও দখলদারিত্বের সংস্কৃতির ধারক-বাহক গুপ্ত ও নিষিদ্ধ সংগঠন শিবির ও ছাত্রলীগ সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত ও অবৈধ উপায়ে ক্যাম্পাসসমূহে সাধারণ শিক্ষার্থীর বেশ ধরে গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি করে ক্যাম্পাসসমূহে নিজেদের অঘোষিত দখলদারিত্ব জারি রাখার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- ছাত্রদলের সহ-সভাপতি হাবিবুল বাশার, সাফি ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাহেদ হাসান, হাসানুর রহমান, শাহাদাত হোসেন, সোহেল রানা, নুরুজ্জামান চন্দন, কুয়েট শিক্ষার্থী রাহুল জাবেদ, ইফান ফয়সাল, শেখ জিলানী ও মাসুম।
No comments